Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জাতের নয় ভাতের লড়াইয়ে রুখে দাঁড়াল অপরাজিত বাংলার যৌবন

সৌতিক

 

 

বেকারদের কাজের দাবিতে, কম খরচে পড়াশোনার দাবিতে, কারখানা গড়ার দাবিতে এসএফআই, ডিওয়াইএফআই সহ ১২টি বাম সংগঠনের নবান্ন অভিযানের ডাক ছিল গত শুক্রবার। সেইমতো কয়েক হাজার ছাত্র-যুব’র মিছিল দীপ্ত কণ্ঠে এগিয়ে চলছিল নবান্নের দিকে, জাতের নয় ভাতের লড়াইয়ের হিসেব বুঝে নিতে। বঙ্কিম সেতু ভাসিয়ে বঙ্গবাসী মোড় হয়ে মিছিল সবেমাত্র জিটি রোডের পুলিশের প্রথম ব্যারিকেডের সামনে এসেছে, তখনই শান্তিপূর্ণ ওই মিছিলে উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল বিশাল পুলিশবাহিনী। টিয়ার গ্যাস, জলকামান  সাথে ‘উপরমহলে’র নির্দেশে স্কুল-কলেজে পড়া ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের উপর চলল নির্বিচারে লাঠি চালানো।

মীনাক্ষী মুখার্জি, ডিওয়াইএফআই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভানেত্রী। পুলিশের কাছে হাত জোড় করে উনি  অনুরোধ করছিলেন, “আমরা এখানে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে এসেছি, প্লিজ আপনারা কোনওরকম লাঠিচার্জ করবেন না।”

কিন্তু পুলিশবাহিনী মীনাক্ষীকে মেরে ফেলে দিয়েছিল রাস্তাতে। তাও কোনও মহিলা পুলিশ নয়, পুরুষ পুলিশ। রাস্তাতে পড়ে যাওয়ার পরও ছাড়েনি, রাস্তাতে ফেলে মীনাক্ষীকে আবার মারতে লাগে।

পুলিশের এই নারকীয় অত্যাচারে প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী আহত। অনেকের অবস্থা খুব সঙ্কটজনক, ২২ জনকে জেল হেফাজতেও নেওয়া হয়েছে। শনিবার দিন জামিন না মেলায় সোমবার দিন পর্যন্ত এখন অপেক্ষা করতে হবে জামিনের জন্য।

আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক মেয়ের বাবা শুক্রবার সন্ধেতেই ইন্টারনেট থেকে জানতে পারেন মেয়ের রেজাল্ট বেরিয়েছে। কিন্তু মেয়ে জানতে পারেনি সে স্নাতক হয়ে গেছে কারণ মেয়ে পিউসা বিশ্বাস তখন হাওড়া মহিলা থানার পুলিশ হেফাজতে।

মেয়ের সাথে কথা হয়েছে বিকেলে একবার, তখন ওকে রেজাল্টের খবর দিতে পারিনি। পরে জেনেছি ও বিএসসি পাশ করেছে। ও জানতে পারেনি, এটুকুই যা আক্ষেপ। বাকি আমার আর কোনও উদ্বেগ নেই। আন্দোলনে গেলে গ্রেপ্তার হতেই পারে।

ফোনে যোগাযোগ করা হলে মেয়ের জন্য গর্বিত বাবার এটাই প্রতিক্রিয়া ছিল।

এসএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য এর মাথাতে পুলিশ যখন লাঠি দিয়ে সজোরে মারছে পিউসা তখন সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে এই ঘটনার জোরালো প্রতিবাদ করে। পুরুষ পুলিশরা তখন রক্তাক্ত সৃজন ভট্টাচার্যকে ছেড়ে পিউসাকে টানতে টানতে রামেশ্বর লেনের মুখে দাঁড় করানো প্রিজন ভ্যানে তুলে দেয়।

মাথায় মারছেন কেন, তখন পুলিশকে এটাই বলেছিলাম। ওরা আমাকে ঘিরে ধরে, আমি ভয় পাইনি। সংগ্রাম চলবে, লড়াইও চলবে।

পরে মহিলা থানার হেফাজতে থাকা পিউসার থেকে এই বিবৃতি পাওয়া যায়।

তাঁত শ্রমিকের পেশাতে যুক্ত কৃষ্ণনগরের বিশ্বজিৎ বিশ্বাস আট মাসের শিশুকন্যাকে বাড়িতে রেখে এই নবান্ন অভিযানে এসেছিলেন। সব পেটে ভাত আর সব হাতে কাজ এই দাবিতে মিছিলে হাঁটার অপরাধে ওনার রাতে ঠিকানা হয় হাওড়ার চ্যাটার্জিহাট থানা। ওনার জেল হেফাজতে থাকার খবর শুনে ওনার স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া, “চিন্তা কোরো না, আমি এখানে আছি। লড়াই করেই বাড়ি ফিরবে।”

ছাত্র-যুবদের উপর পুলিশের এদিনের তান্ডব দেখলে কে বলবে এই পুলিশ প্রশাসনই কিছুদিন আগে শাসক দলের ভয়ে টেবিলের তলাতে মুখ লুকোয় কিংবা বা তৃণমূলের দাদাদের ভয়ে পুলিশ স্টেশন ছেড়ে পালিয়ে যায়।

অবশ্য শুধু পুলিশ নয়, পুলিশের এই তান্ডবের সঙ্গী ছিল তৃণমূলও। জিটি রোডের উপর একটি পাঁচতলা বাড়ির ছাদ ও উল্টোদিকে নির্মীয়মাণ একটি দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে ছাত্র-যুবদের এই মিছিলকে লক্ষ করে বড় বড়  ইট ছোড়া হয়। এই ইটের আঘাতে অনেকে আহত হয়ে পড়েন, পরে ওই দুটি বাড়ির ছাদে উঠে ছাত্র-যুবরা ওদের হাতেনাতে ধরে ফেলেন। তৃণমূলের নির্দেশেই যে ওরা ওই কাজ করছিল তা স্বীকার করে। ওই দুটি বাড়ির ছাদ থেকে কয়েক বস্তা ইটও উদ্ধার করে মিছিলে হাঁটা ছাত্র-যুবদের একাংশ।

নবান্ন অভিযানে পুলিশের এই নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে শনিবার ১২টি বামপন্থী ছাত্র যুব সংগঠনের ধিক্কার মিছিল শুরু হয় এসএফআই, ডিওয়াইএফআই রাজ্য দপ্তর থেকে। এই মিছিল যায় শিয়ালদা চত্বর পর্যন্ত। নবান্ন অভিযানে ছাত্র-যুবদের যৌবনের স্পর্ধা যেমন দেখেছে রাজ্যবাসী তেমনি শনিবারও রাজপথ দেখল সেই কিছুতেই হার না মানা দিনবদলের স্বপ্ন দেখানো যৌবনের স্পর্ধা। এদিনের মিছিলের একদম সামনের সারিতে ছিলেন এসএফআই-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস, রাজ্য সভাপতি প্রতীক উর রহমান, ডিওয়াইএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জী, রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র সহ ১২টি বাম সংগঠনের ছাত্র-যুবরা যেমন ছিলেন তেমনি নাগরিক সমাজের এক বিরাট অংশের সচেতন মানুষের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো।

রাজপথ ছাড়াও পুরো রাজ্য জুড়ে এদিন ছাত্র-যুবরা পুলিশের এই নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে কালো ব্যাচ পরে কালা দিবস পালন করে। বাম সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে জানা গেছে সব পেটে ভাত, সব হাতে কাজ যোগাবার এই আন্দোলন এখানেই থামার নয়, বেকারদের পেটে যতদিন ক্ষিদে থাকবে এই আন্দোলন ততদিন চলবে।

আসলে ওরা শাসকের চোখে চোখ রেখে বুঝিয়ে দিতে চায়— পৃথিবীর সব যুদ্ধ হয়তো সাথে সাথেই জেতা যায় না, কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে থাকতে হয় এটা বোঝানোর জন্য কেউ তো একজন ছিল, কেউ তো একজন শুরু করেছিল, কেউ তো একজন শাসকের চোখে চোখ রেখে বলতে পেরেছিল, “রাজা তোর কাপড় কোথায়?”

সেদিনের নবান্ন অভিযানে একদম সামনের সারিতে উপস্থিত থাকা ও কালকের প্রতিবাদ মিছিলে হাঁটা এক ছাত্র তার ব্লগে লিখেছে….

কাল ঘুমের মধ্যে বার বার কেঁপে উঠছিলাম। স্বপ্নের মধ্যে শুধু দেখছিলাম ওরা আমার সাথীদের মারছে, খুব মারছে, মেরে ফাটিয়ে দিচ্ছে। তারপরও আমার সাথীরা মাথা উঁচু করে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে আর ওরা এক পা এক পা করে পিছোচ্ছে। হ্যাঁ এসব দেখতে দেখতে ঘুমের মধ্যে শুধু কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম।

ঘুমের মধ্যে বার বার মীনাক্ষীর মুখটা ভেসে উঠছিল। মীনাক্ষী মুখার্জি, আমাদের ডিওয়াইএফআই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভানেত্রী। পুলিশ এর কাছে হাত জোড় করে ও অনুরোধ করছিল, “আমরা এখানে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে এসেছি, প্লিজ আপনারা কোনওরকম লাঠিচার্জ করবেন না।”

কিন্তু না, ওরা মীনাক্ষীকে মেরে ফেলে দিল রাস্তাতে। তাও কোনও মহিলা পুলিশ নয়, পুরুষ পুলিশ। রাস্তাতে পড়ে যাওয়ার পরও ছাড়ল না, রাস্তাতে ফেলে ওরা মীনাক্ষীকে আবার মারতে লাগল।

ঘুমের মধ্যে আমি আবার কেঁপে উঠলাম। এখনো কেঁপে উঠছি মাঝে মাঝে… না ভয়ে নয়, উত্তেজনায় কেঁপে উঠছি বার বার।

মীনাক্ষী, সৃজনদা, শতরূপদা, পিউসা, সাবিরা, তনুশ্রীদের হাত ধরে লাল ঝান্ডাটা বয়ে বেড়ানোর উত্তরসূরি আমরা পেয়ে গেছি।

আমি এখনও কাঁপছি, আমি আরও কাঁপতে চাই, হয়তো কাল থেকে আমার মতো আপনারাও কাঁপছেন।

মীনাক্ষীদের যৌবনের স্পর্ধা দেখে সদা সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা পাম এভিনিউয়ের দু কামরা ভাড়াবাড়িতে থাকা ওই মানুষটাও হয়তো কাল থেকে বার বার কেঁপে উঠছেন নিজের উত্তরসূরিদের খুঁজে পাওয়ার আনন্দে।

 

সৌতিক এসএফআই-এর সমর্থক। শুক্রবারের মিছিলে ছিলেন।