Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চারটি অণুগল্প

সাধন দাস  

 

আয়না

নতুন রাজনৈতিক দল ক্ষমতা দখল নেওয়ার পর শহরে প্রেম করার জন্যে অগুন্তি স্বামীহীন সধবা ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্ডারি খুন কিংবা ছদ্মবেশে ভিক্ষে করা ছাড়া কোনও কাজ নেই। পুলিশ এবং দুর্ভিক্ষ বেড়েই চলেছে। পালাবার সঙ্গী খুঁজছিলাম।

সেলুনে ঢুকেছি। ভিখিরির খোলস ছেড়ে স্মার্ট যুবক হয়ে বেরিয়ে আসব। সাদা কাপড়ে মুড়ে উঁচু চেয়ারে বসে আছি। নায়কোচিত চুল ছাঁটানোর পর সাবানের ফেনায় মুখ ঢাকা। আয়নার মধ্যে দেখা হল রাস্তার এক সুন্দরীর সঙ্গে। বিধবার চিহ্ন নেই। চোখ মেরে ইঙ্গিত করতেই দাঁড়িয়ে গেল। সুন্দরীর গায়ে ধাক্কা মেরে দুজন পুলিশ সেলুনে ঢুকে পড়ল। আয়নাগুলোতে নজরদারি চালাচ্ছে। মাথা এগিয়ে সুন্দরীকে ঢেকে দিলাম। মুখখানা সুঁচলো করে গালের মধ্যে জিভ ঠেলে ব্রণ দেখার ভান করছি। অর্ধেক সাদা শেয়াল আর অর্ধেক মুখফোলা ব্যাঙের মতো দেখাচ্ছিল আমাকে। হত্যাকারী খুঁজে না পেয়ে পুলিশ চলে গেল।

শহর যেদিক দিয়ে ছাড়ব, সুন্দরী উল্টো দিকে হাঁটছে। নিজেকে প্রেমের কলম্বাস ভেবে পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করলাম।

গাছে ঝোলানো পোস্টার নায়িকায় চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম— কত দূর চললেন?

–কাজের জায়গায়।
–আপনার ওখানে কাজ পাওয়া যায়?

মহিলা মুচকি হেসে জানালেন, তিনি একটা মেল বিউটি পারলারে কাজ করেন। সেখানে ম্যানেজার কাম সিকিউরিটির পোস্ট খালি।

–আপনাকে পছন্দ হয়েছে। চাকরিটা পাইয়ে দেব। করবেন?

রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব পাওয়ার গল্প মিথ্যে নয়। বললাম— আপনি সত্যিই সুন্দরী।

নারীরা নাকি পুরুষের মনের কথা বুঝতে পারে! হাসি চোখে তুলে বললে— একটা খবর আপনার জানা দরকার, এই নিয়ে আমি চতুর্থবার বিধবা হলাম। একজন করে বিয়ে করছি আর খুন হচ্ছে। গতকাল চতুর্থ জন খুন হল।

বুকের ভিতর কেঁপে উঠল। নখের ফাঁকে দেখলাম রক্ত লেগে আছে। খুন করা আর খুন হওয়ার জোড়ে শুধু মাত্র প্রেম। ট্রয়, লঙ্কা কত কাণ্ড তো ঘটে গেছে! আপাতত পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্যে জানিয়ে দিলাম, রাজি।

চুল দাড়ি গোঁফ ছাঁটা লোমের পাহাড় পেরিয়ে বিউটি পারলারে ঢুকলাম। আমাকে ধরতে আসা পুলিশটি এখানে পোশাক খুলে ছদ্মবেশ নিচ্ছে। পা দুটো কুকুরের মত সরু। লোম ভর্তি। টুপিতে লাগানো শান্তিরক্ষার প্রতীক, পায়ে ঝুলছে। এক সধবা আদর করে সারা শরীরে ক্ষুর বুলিয়ে দিচ্ছে। পুলিশটা মানুষ সাজার চেষ্টা চালাচ্ছে। পেছনের আয়নায় ওর শকুন চোখদুটো দেখতে পেলাম। তড়িঘড়ি পিছন ফিরে মুখ ঢাকতে গিয়ে দেখলাম আমার সামনেও আয়না।

 

সুগার বেল্ট

আখের মতো রোগা কালো যুবক দু’তিনটে আখ হাতের মুঠোয় চেপে হেঁসোর এক এক টানে পেড়ে ফেলছিল। মড়মড় শব্দ হচ্ছে। দিনে তিন টন কাটতেই হবে। হাতের মুঠোয় নরম ঠেকল। চলন্ত হেঁসো থামিয়ে দেখল, আখ নয় খেংড়িকাঠি মেয়েমানুষের কোমর।

আখের মত রোগা কেলটে যুবতি দু’তিনটে আখ হাতের মুঠোয় চেপে হেঁসোর এক এক টানে পেড়ে ফেলছিল। তিন টন কাটতেই হবে। হাতের মুঠোয় নরম ঠেকল। আখ নয়, কাঠির মাথায় আলুরদম মার্কা মদ্দামানুষের কোমর।

দু’জনেই ফিক করে হাসল।
দম বলল— আয় প্রেম করি।
খেংড়ি বলল— না। তুই পেট করে দিবি। কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। খাব কী?

খেংড়ি আগের দিন বলেছিল— আয় প্রেম করি।
দম বলেছিল— না তোর পেট হয়ে যাবে। কাজ বন্ধ হবে। খাবি কী?

মুকাদম (আখের জমির ঠিকাদার) মেয়েমানুষের কোমর হাতের মুঠোয় চেপে ধরল। পেড়ে ফেলল ডাক্তারের টেবিলে। জরায়ু থাকা চলবে না। ডাক্তার মুঠো মুঠো জরায়ু ধরছে। এক একটানে পেড়ে ফেলছে। বলছে— যা, সুগার বেল্টে ঢুকে পড়।

মুকাদম বলছে— দিনে চার টন কাটতেই হবে।

আখের খেতে আলুর দম বলল— আয় প্রেম করি।

খেংড়িকাঠি আর কিছু বলছে না। হাতের মুঠোয় তিন চারটে আখ। এক এক টানে পেড়ে ফেলছে। মড়মড় শব্দ হচ্ছে।

 

বাটি বাজছে

পরের ট্রেন ভর্তি হয়ে অনার কিলার্সের দল আসছে। চুমকির হাত বগলে চেপে হুড়মুড় করে নেমে পড়লাম। হাতে বাটি প্ল্যাটফর্মে বুড়িভিখিরি সন্দেহজনকভাবে দেখছে। বন্দি হাতে ব্যাগ খুলে চুমকি কয়েন দিতেই বুড়িভিখিরির দল ঘিরে ধরল। সবাই শ্যেন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আমরা হুলিয়া হয়ে গেলাম।

একটা পার্কের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়লাম। এখানকার বুড়িগুলো মিটমিটে শয়তান। বাটি বাজাচ্ছে আর ঘাড়ের উপর ঝুঁকে পড়ছে।

–দে বাবা, কুছ তো দে। আল্লা তেরা ভালা করেগা।

কিছুতেই চুমকির গায়ে ঘেঁষতে দিচ্ছে না।

বামুনকে শিখণ্ডি করে মন্দিরে ঢুকছি। বিয়ের ভড়ংটা সেরে ফেলতে পারলে আইবুড়ো প্রেমের ফ্যাচাং ঘোচে। পথের দু’ধার জুড়ে সেই বুড়িভিখিরি! মাজা দোমড়ানো, কুঁজো। নোংরা ছেঁড়া থান। গা ভর্তি মাকড়শার জাল। একইরকম বাড়িয়ে দেওয়া হাত, সর্বত্র একই বাটি। বামুন বললে— ওদের কিছু দিন।

বুড়িটা আমাদের টার্গেট করেছে, চুমকি ওকেই একটা আধুলি দিল। বাটি আমার সামনেই পেতেছে। আমি দেব না। বুড়ি বাটি নাচিয়েই চলেছে। চুমকি ওকেই আবার সিকি দিল। স্থিরপ্রতিজ্ঞ বুড়ি, ঠান্ডা বিষণ্ণ দৃষ্টি, আমার চোখে তাকিয়েই আছে। যেন আমাকেই দিতে হবে। কে টিকটিকি! কে দালাল! ঘুলিয়ে যাচ্ছে। সবাই বাটি বাজাচ্ছে। চুমকিকে দালালের হাতে তুলে দিতে পারলেই বিশ হাজার। টিকটিকি, দালাল, অনারকিলার… ফেঁসে গেলে একই ফাঁদ। মালটা ফের বুড়িকেই সিকি দিল। বাটিতেই ফুটো চিহ্ন থাকার কথা। চোয়াল শক্ত করে বুড়িকে বললাম— ষোলো আনা তো হয়ে গেছে, বাটি নামাও।

মন্ত্র পড়াচ্ছে বামুন। কানে ঢুকছে বাটির বাজনা। চুমকির মাথায় সিঁদুর তুলে দিচ্ছি। বিষণ্ণ দৃষ্টি ওর। চোখ নামানো। যজ্ঞাগ্নির সামনে শূন্য অঞ্জলি পেতেছে। আমি দেখছি, টিনের বাটি। বামুন বললে— সিঁদুর মাখিয়ে একটা কয়েন ওর হাতে দিন।

কদিনের যে ঘর বাঁধা? সংসার সংসার খেলা? বাটি বেজেই চলেছে।

 

পাঁচ তালাক

চার ভাই। ব্রহ্মতালু পর্যন্ত মদ টেনেছে। টইটম্বুর মাতাল। রাস্তা জুড়ে টলতে টলতে ফিরছে।

বড়ভাই বলল— মাল খাওয়া খুব অন্যায়।
মেজ বললে— কিন্তু বেআইনি নয়।
সেজ বললে— তাহলে ঘরের মাগিটা গাল পাড়ে কেন?
ছোট বললে— আয় ভাই, তালাক দিই।
চার ভাই এক সঙ্গে বলে উঠল— তালাক তালাক তালাক।

বড়ভাই বলল— বিবিরা তো শুনতে পেল না।
মেজ বললে— পেল আর না পেল।
সেজ বললে— আমরা তো পাচ্ছি।
ছোট বললে— আয় ভাই, চেঁচিয়ে বলি।
চার ভাই চেঁচিয়ে উঠল— তালাক তালাক তালাক।

বেওয়া বিবি খাতুনরা বাড়ির বেড়া, জানলা ফাঁক করে তালাক দেখছে।

বড়ভাই বলল— ওরা কারা? ভয় পাচ্ছে কেন?
মেজ বললে— আমাদের কেউ না। এ পাড়ার মাল।
সেজ বললে— বুঝিয়ে বল, মাল মানে মেয়েমানুষ।
ছোট বললে— তাহলে এদেরও তালাক দে।
চার ভাই আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল— তালাক তালাক তালাক।

বাড়ির কাছে আসতেই আম্মু ছুটে এল ব্যাটাদের সামলাতে। আম্মুকে চ্যাংদোলা করে মাথায় তুলে চারভাই পাড়ার চৌহদ্দি ঘুরতে লাগল। চার ব্যাটার আটখানা হাতের মধ্যে বুড়ি কচ্ছপের মতো হাঁচড়াচ্ছে পাঁচড়াচ্ছে।

বড়ভাই বলল— আমাদের তো আর বিবি নেই!
মেজ বললে— নেই। লিকে করব।
সেজ বললে— আম্মু তো আছে।
ছোট বললে— আম্মুকেই তালাক দে।
আম্মু বললে— ছেড়ে দে বাপ। চারবার হয়ে গেছে।
চার ভাই আম্মুকে শূন্যে ছেড়ে দিল— তালাক, তালাক, ফের তালাক।