Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নপুংসক

সাধন দাস

 

একজোড়া চটির শব্দ আসছে। ঝাঁপের দরজায় ঝুঁকে আছে একদলা অন্ধকার। আর একটুকরো আঁধার, অন্ধকার থেকে বেরুচ্ছে, আবার অন্ধকারে ঢুকে পড়ছে। গড়িয়ে গড়িয়ে বেড়াচ্ছে ঝুপড়িময়।

চটির শব্দ, ওই আসছে..

না, এ অন্য জোড়া।

–ফটফট… ফটফট…

মিলিয়ে গেল। এ শব্দ দূরে যাবে। এবার চেনা শব্দ আসছে। দরমার ঝাঁপ খোলা। আঁধার, অন্ধকারজোড়া রাত্রি পথ চেয়ে আছে।

একজোড়া চটির দশদশ বিশ ইঞ্চি মাটি লাগে দাঁড়াতে। হাঁটুক, দৌড়াক, থেমে থাক, বিশ ইঞ্চির বেশি তারা চায় না। এর বেশি মাপে তাদের স্পর্ধা নেই।

ওরা ফুটপাথে অপেক্ষা করে। একখানা পুরুষের সোল, পুরুষালি ফিতে। একখানা মেয়েলি। ছাপাছুপো, রঙিন ছবি আঁকা। দুই কিসিমের হাওয়াই মিলে একজোড়া চটি অপেক্ষা করে, ফুটপাথে।

দুপুরের দিকে ফাঁকাই থাকে। বেলা যত গড়িয়ে আসে চটিজোড়া সন্ত্রস্ত হয়। পুরুষের একজোড়া ফর্সা পা ঢুকে পড়ে চটিজোড়ার ভিতরে। একজোড়া বুট ততক্ষণ নেচে নেচে পালিশ হয়, আড়ষ্ট হয়ে চটিজোড়া, ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করে। যেন একজোড়া নরনারী একজোড়া পা বুকে নিয়ে চুপচাপ দেখে, কতক্ষণে শেষ হবে পালিশের কাজ। তারপরই নরনারীর বুকে ঢুকে পড়ে, একজোড়া ঢ্যাঙা পা। এবার চামড়া জুড়ে ফিতে সেলাই। ঘিনঘিনে পা ফিনফিনে হয়ে ঢুকলেও ওরা বুঝতে পারে দিদিমণি হস্তিনী।

শঙ্খিনী, পদ্মিনী, খড়মপেয়ে, গম্ভীর, গাবদা, ছ্যাতড়ানো কামাই নেই ঢুকেই যাচ্ছে।

যে সমস্ত পায়ে ভর দিয়ে শহর চলতে থাকে, যে সমস্ত পা শহরে ভর করে চলে ওরা দুজন কমবেশি সবাইকে চেনে। কেউ পুরুষের বুকে ভর রেখে, মেয়েটিকে আলতো আদরে রাখে। কেউ বুড়ো আঙুলে মেয়েটির বুকে খোঁচা দেয়। কেউ পায়ের পাতায় খেলে। কেউ গোড়ালি চেপে রাগ দেখায়। যাঁরা চুপচাপ থাকেন তাঁদের খানিক আপন মনে হয়।
এত আপন কেউই নন যে বিশ ইঞ্চি জমিকে আপন করে অধিকার ছেড়ে দেয়।

জমজমাট রাতে সুচের ছিদ্রে আলোর এক ফেরতা সুতোর পথে চটিজোড়া খুপরিতে ফেরে। ফিরতে থাকে। সুচ ঘোরাবার হাতে সেলাইয়ের শব্দ হয়, পায়ে পালিশের, কানে কয়েনের শব্দ মনে হয়– ফ…ট…র– ফ…ট…র…

আলোর সুতো বেয়ে অনুভূত হয় একখানা পা বেয়ে হেঁটে আসছে পুরুষালি পদমূর্তি, আর একখানা রমণীর। এগিয়ে আসছে। পুরুষরমণী মিলেমিশে দূরে আঁধার ও অন্ধকারজোড়া রাত্রির দিকে তাকিয়ে নিজেকে মনে হয় নপুংসক, হিজড়ে, দুনিয়া জাম করা অন্ধকারে আমি একা, এ ভয়ংকর রাত্রির মিছিল আমার একার। মরে যেতে ইচ্ছে করে।