Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নাম নেই

আহমেদ-খান হীরক

 

ওই মাঠটার এপাশে, এখানে, এটা, গত বছরেও, একটা চায়ের দোকান ছিল। ছিল, তবে, এখন নেই। নেই, তবে, মাথার ওপর যে চালা সেটা আছে। আর টুটাফুটা চালার ভেতরে আছে ছাইতোলা চুলা। আর ডিসেম্বরের মফস্বলি শীত আছে। চুলাটা ঘিরে একটা মাদি কুকুর ও মরদ মুক্তিযোদ্ধা আছে। মরদ কি? সন্দেহ হয়।

মাদি কুকুরটা আছে প্রজননের স্বার্থে। তার পেটভরা বাচ্চা। যে কোনও সময় সেগুলো বেরিয়ে আসবে, ছটফট করবে। কিন্তু ওই মুক্তিযোদ্ধাটা, যে মাটির মেঝেতে পড়ে ছিল ‘ও’ হয়ে, এখানে ঠিক কেন, বোঝা যাচ্ছে না। কুকুর ও সে, প্রায় পাশপাশি, শুয়ে আছে।

কুকুরটা জন্ম দিচ্ছে, আর মুক্তিযোদ্ধাটা কি মারা যাচ্ছে?

লোকটার শরীরে ছাই। মুখে ছাই। চোখে ছাই। চেহারা তাই ভালো চেনা যায় না। অবশ্য চেহারায় তেমন ভিন্ন কিছু নাই যা তাকে আলাদা করে। তবে, একটা লম্বা কাটা দাগ, তার বুকের কাছে আছে। সে থাকা আর না থাকা এমন কী! একটা মাছি ওড়ে কিছুক্ষণ ভনভন। একটা ডিসেম্বর শুয়ে থাকে। একটা লম্বা শীত বসে বসে ঝিমায়। একটা প্রজন্ম আসতে চায়… ছাই আর ছাই চারিদিকে ছাই।

একটা মিছিলের মতো জনস্রোত, মাঠ ছেড়ে, প্যারেডের গতি ছেড়ে, রোদের কিনারা ছেড়ে, সরু পথ ধরে এগিয়ে আসে। এগিয়ে আসতে আসতে হুল্লোড় করে। একে অন্যকে ধাক্কা দেয়। পেছনে শীতমাখা ধুলো ওড়ে। ধুলো ছড়িয়ে যায়। একটা জনস্রোত ধুলো নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। আর তারা কিছু না ভেবেই ঢোকে চায়ের ওই সাবেকি দোকানে। একটা লম্বা শরীর ছাই দেখে তারা চমকায় না। লাশ দেখে চমকায় না। শুরুতে এবং শেষে এখানে অনেক লাশ। স্তূপ স্তূপ লাশ। ওই সব গণ্ডগোলের দিনেও লাশ ভেসেছে নদীতে-নালায়-ডোবায়। এখনও অনেক লাশ ডোবে আর ভেসে যায়। সে তুলনায় এ তেমন অধিক কিছু তো নয়। একটা ছাইয়ের ভেতর আরেকটা শরীর গুমরায়। মিছিলে কণ্ঠ ওঠে, ক্যাটায় এই শুভ দিনটায় মরল আবার?

: শুভই বা কী?

: শুভ না ষোলই ডিসেম্বার…!

: হুহ মরণের জইন্যি আবার দিনক্ষণ চাই!

: তাও, মানুষের একটা লাগে না লাগসই… বাঁইচা আর মইরা যাবার কারণ… তারপর তারও লাগে কিছু কিছু দিন!

তারা খুব উৎসুক হয়ে ছাইয়ের ও দেহের আশেপাশে দাঁড়ায়। একটা ঠাণ্ডা বাতাস চারিদিকে হলকায়। একজন বলে, এ তো এই গেরামের নয়।

আরেকজন বলে, তাইলে কী আর কাম নাই? একটা মরণ পইড়ে আছে সাপের মতন তাকেই তো কব্বর দেওয়া চায়…!

একমাথাচুল বলে, আর কেউ যদি থাকে দাবিদার! কেউ যদি কয় কই রাখছো আমার বেরাদর…?

ফুল সোয়েটার বলে, এই পাগলার আর কে রাখে খবর? গত রাইতেই হয়ত নামছে লাস্ট ট্রেইন থেইকা… তারপর ল্যাঙচাতে ল্যাঙচাতে আইসে এখানে… এখানে হয়ত ছিল আটকায়ে মৃত্যু তার। হয়ত ছিল তার এই মফস্বলেই কোনও স্মৃতি… হয়ত তার কিছু ছিল এই মাটিতেই… হয়ত মায়া ছিল হয়ত প্রেমপিরিতি ছিল… হয়ত ছিল কিছু…

কিন্তু এসব কথা হয় না বেশিক্ষণ। এই ছাইমাখা দেহটার পরিচয় নিয়ে খানিকক্ষণ ভার হয়। জনস্রোত কিছুক্ষণ আচানক উচাটনে, কিছুক্ষণ হুদাই দ্বিধায়। বিধায় অনেকক্ষণ হয়ে যায়। বিধায় আসে আরও কেউ কেউ, কেউ কেউ চলে যায়। একজন বুকের ও ছাপটাকে দেখে জ্ঞান বিছড়ায়। বলে, ডাকাত আছিল নিশ্চয়… এইখানে দেখি হাঁইসার ফোঁড়!

: চোরও হইতে পারে। এদের দিয়া তো কোনও ভরসাই নাই!

নীল মাফলার স্মৃতি হাতড়ায়। কিছুটা কাতরায়। বলে, হাঁইসা না হইয়া অন্যকিছুও তো হইতে পারে। এমন এক দাগ দেখা গিয়াছিল মতিউরের জাঙে… জঙ্গে গিয়াছিল সে…

এই মতিউর কে চেনে না যেন কেউ। মতিউরের নাম তাই স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ। একজন বলে, মরতে হইল তারে ওই কুত্তিটার কাছেই… এমন নাপাক মরণ… এই মরণের কোনও গতি নাই…!

কে জানি বলে, এইবার ধর… ধড়টাকে টান… সাবধান! সাবধানে টানতে হয় মুর্দাকে…

সবাই টানার জন্য হাত বাড়ালেও গুটিয়ে নেয় ফের। মুর্দার কী পরিচয়? কী তার ধর্ম কী তার জাত? একটা দেহের পরিচয় কী করে হয় নিশ্চিত? বিধায় জনস্রোত টান দেয় মলিন লুঙ্গিটায়! আর তেতাল্লিশ বছর পর ওই ছাইমাখা শরীরটা আবার নেংটা হয়। আবার। আসলে দুইবার। নেংটা হয়। লুঙ্গিটা টান দিয়ে খুলে নেয় জনস্রোত। আর তারা উদগ্রীব হয়ে দেখতে চায় পরিচয়। শরীরের পরিচয়। দেখে, ছাইমাখা দেহটার, প্রায় নাই হয়ে যাওয়া দেহটার, দুই পায়ের ফাঁকে কোনও পরিচয় তো নাই। পরিচয়ের স্থানে একটা গভীর ক্ষত, তেতাল্লিশটি বছরের শুকনো ক্ষত, ভাঁজ হয়ে থাকা শীতের মৃত পাতার মতন একটা ক্ষত যেন শরীর দুলিয়ে ঘরটা কাঁপিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠতে চায়।

জনস্রোত খুব চমকায়। চমকে তারা পেছায়। এমন দেখায় তাদের মনে হয় দেখা শেষ হয় নাই। যেন আরও দেখা বাকি থেকে যায়। তারা দেখে আরও ঝুঁকে। দেখে সেই ক্ষতের ভেতর গোপন একটা ঝর্ণামুখ— যেন একটা প্লাবন বিশাল— আর তার থেকে একটা চিকন ধারা, মানুষের ভেতরের রুপালি তরল ধারা, বেরিয়ে এসেছে কোনও অভিপ্রায়ে, পুং-প্ররোচনায়। এসে, সাপের মতন এঁকেবেঁকে, একটা পিঁপড়ে-নদী হয়ে, চলে গেছে ধুলো আর ছাই… ছাই আর ধুলোর দিকে। যেতে যেতে, ঘুরে যেতে যেতে, ওই ধারাটা যেন বাংলাদেশের এক নিখুঁত ম্যাপ এঁকে গেছে।

দুই পায়ের ফাঁকে, শুকনো ক্ষতর নিচে, বাংলাদেশের ম্যাপ, থির হয়ে গাঢ় হয়ে জমে থাকে। বাতাসে তখন কেবল জন্ম নেয়া কুকুরের বাচ্চার ডাক।