ছায়াপাখি — নীল হ্রদের তীরে, পর্ব ২ (প্রথমাংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

The Duck and the Kangaroo

বিমল আর নীলিমা এবার হীরকদের কাছে অনেকদিন বাদে। আগেরবার যখন এসেছিল তখনও হীরকরা অ্যাপার্টমেন্টে। সেটা ছিল দুই বেডরুমের, আমেরিকার নিরিখে ছোট। প্রথম কদিনের চমক কেটে যাওয়ার পর ওরা ফিরে যাওয়ার জন্য একদম অস্থির। বিশেষত বিমল। নীলিমার কথায় দুর্গাপুরে থাকতে চরকির মত ঘুরে বেড়ায়, এখানে পায়ে বেড়ি পড়েছে। তাই তোর বাবার মন বসছে না। নীলিমারও তার পাড়াতুতো সঙ্গীদের জন্য মন কেমন করত না তা নয়। কিন্তু ছেলের বৌয়ের সঙ্গে এদেশের দোকানে ঘুরতেও বেশ মজা পেয়েছিল। একসঙ্গে এত জিনিস একই দোকানে কোনওদিন দেখেনি নীলিমা। জিনি আবার জোর করে শাশুড়িকে জিন্স পড়িয়েছিল। প্রথমে লজ্জা পেলেও নীলিমা দুদিনেই স্বচ্ছন্দ। শুধু হীরকের কেমন কেমন লাগছিল। সামনে বলেনি, তাহলে মা আর ওসব পরবে না। শুধু জিনিকে বলেছিল, মা মা ভাবটা কেমন নাকি হারিয়ে যায়। শুনে জিনির রাগ, গাঁইয়া তুমি একটা।

বর্ডারের চাকরিতে হীরকের তখনও এক বছর হয়নি। বর্ডার বুক স্টোর। অ্যান আরবারেই ওদের হেড অফিস, হীরক ছিল তার সিস্টেম ডিভিশনে। কাজের চাপ। ওদিকে তিস্তা হবে হবে। সেইজন্যেই ওদের আরও আসা। এখানে হাতে হাতে এগিয়ে দেওয়ার কেউ তো নেই। পাশে পাশে থেকে জিনিকে যতদূর সম্ভব বিশ্রাম দেওয়া যায়। নীলিমা ওই নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু বিমলের সময় কাটত না। একে তো প্ল্যান্ট থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিল তিন মাসের। এমনটা বিমল কক্ষনও করেনি। অথচ নীলিমাকে একা পাঠানো যায় না। আবার ছেলে এত খরচ করে আনছে, এসেই ফেরত যেতে পারে না। কুল রাখি না শ্যাম রাখি অবস্থা। শেষে এই থেকে যাওয়া। বসে বসে কাজের জন্য হাত নিশপিশ করত। তার অনুপস্থিতিতে মিলিং মেশিনটার কী দশা হচ্ছে সেটা ভেবে অস্থির। হীরক মজা করে বলেছিল, বাবা তুমি হয়তো আমার জন্যও এত চিন্তা করোনি কক্ষনও।

বিমল শুকনো মুখে বলত, ওই চিন্তাটাই তো শুধু আছে। সারাদিন কী আর করব বাড়ির মধ্যে বসে বসে? কোথাও নিজে নিজে যাওয়ার উপায় নেই। না আছে বাস, না ট্রেন। এত চওড়া চওড়া রাস্তা, কিন্তু সে রাস্তার সুখ শুধু গাড়িওয়ালাদের। যাদের নিজের গাড়ি নেই তারা কী করে মনি?

মঞ্জিনিকে ওরা মনি বলে, জিনি নামটায় কেমন বিদেশি গন্ধ। জিনি হাত উল্টে বলেছে, যারা এখানে থাকে সবার গাড়ি আছে বাবা। কেন দেখলে না সেদিন? জলের লাইন সারাতে এল, নিজের গাড়িতে চড়েই তো।

দেখেছে বিমল। এর মানে তার মত মেশিনপত্র নিয়ে যারা কাজ করে তারাও এখানে গাড়ি চালিয়ে ঘোরে। গরীব বড়লোকের পার্থক্যটা তাহলে হয় কীভাবে? এইসব প্রশ্ন কাকে করবে? তার ইংরাজি জ্ঞান নেহাত কাজচালানো গোছের, বলার অভ্যাস তো নেই। তাছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলতে হলে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে। সকাল বিকেল দুবার হেঁটে চক্কর দিয়ে আসত, আশপাশ সব চষে ফেলেছিল। কিন্তু তার মানে শুধু মাঠ, চওড়া রাস্তা, কেয়ারি করা সবুজের ছয়লাপ। রাস্তায় ধরাচুড়ো পরে দৌড়াতে দেখেছে লোককে। পার্ক আছে। সেখানেও অনেকে আসে। দেখলেই হাসি মুখে হাউডি বলেছে। কিন্তু বিমল তার মাথায় কোনও কথা ইংরাজিতে সাজিয়ে ওঠার আগেই তারা এগিয়ে গেছে অনেকদূর। কেউ কেউ সাইকেল করে যায়। কাজের যাওয়া নয়। ঘুরতে, এক্সারসাইজ করতে, কখনও সপরিবারে।

নীলিমার অসুবিধা ছিল কম। দুর্গাপুরে থাকতেই বা বাড়ির থেকে কতটা বেরোত! তাছাড়া জিনির শরীর ভারী হয়ে গেছে। অত কাজ করতে পারছে না, তাই তার কাজের অন্ত নেই। নীলিমা রান্নাঘরে হাতের কাছে এতরকমের সাজসরঞ্জাম দেখে বিগলিত ছিল। রান্না করার এত আরাম এখানে। দিনভর হীরকের কী ভালো লাগে তার লিস্ট বানিয়ে বানিয়ে রান্না করছে। সবরকমের মাছ পাওয়া যায়— রুই, কাতলা, বোয়াল, ইলিশ এমনকি কই। কতরকমের যে করে খাওয়াতে ইচ্ছে হত। যখন ছেলেমেয়েরা কাছে ছিল, অত সম্বল ছিল না যে অমন চাকা চাকা মাছ খাওয়াবে। এমনও দিন গেছে দুপুরের খাওয়ার পর রাত্রে দু পিস মাছ পড়ে আছে। বিমলকে একটা দিল, এবার কোন বাচ্চাকে দেয়? ছেলেমেয়েগুলোও এমন ছিল— মাছের থালার দিকে তাকিয়েই রূপার কেমন গা গুলোতে থাকবে, হীরু বলবে সকালের মাছ রাতে খেতে কেমন পান পান গন্ধ লাগে মা। নীলিমা কি জানে না কেন এইসব? দেখে চোখে জল এসে যেত। তারপর যখন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল, দুই ছেলে চাকরি করে, সংসারে আর কোনও টানাটানি নেই তখন ছেলেমেয়েরা কোথায়? তাই সেই যাত্রায় এসে মনের সুখে হীরককে কতরকমের মাছ করে যে খাইয়েছে! এতেই নীলিমার সুখ। বিমলের ওপর বিরক্ত হয়ে বলত, এত সুন্দর জায়গা। মনে হয় যেন হিল স্টেশনে বেড়াতে এসেছি। আহা চোখ জুড়িয়ে যায়। তোমার কেন ভালো লাগে না বলো দেখি? বিমলের ছটফটে ভাবটা নীলিমার কাছে হীরকের জায়গার অসম্মান। তার মানে তার ছেলের অপমান। প্রাণপণে সেটাকে আড়াল করতে চাইত। কিন্তু দু কামরার ফ্ল্যাট, কত আর চেপে রাখা যায়। জিনির কানে যেতই। রাত্রে বিছানায় সেই নিয়ে গজগজ। এত টাকাপয়সা খরচ করে আনা হল, কারও মুখে একটু হাসি নেই। এই দুদিকের চাপে হীরক একদম স্যান্ডউইচ।

শেষে হীরক বাবাকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছিল। তোমার হাম্বারের থেকে ভালো, হাসতে হাসতে বলেছিল হীরক। সেই সাইকেল হল বিমলের ডানা। কোনও দোকান থেকে কিছু কিনতে গেলে হেঁটে যাওয়া যেত না। অনেকটা দূর। যাওয়া যদি বা যায়, মালপত্র হাতে ফেরত আসা বিমলের সাধ্য নয়। সাইকেল পেতেই কাছাকাছি দোকানের কাজগুলো করতে শুরু করে মুখে আলো ফিরে এসেছিল। তাছাড়া এখানকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর মাইহারে জিনিস কিনতে গিয়ে দেখে ওখানে অনেক বাঙালি। বাংলাদেশের, বেশিরভাগ রাত্রের শিফটে কাজ করত। সেইখানে একদিন কুমিল্লার একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে বিমলের কী আনন্দ। বাড়িতে এসে সগর্বে বলছিল নীলিমাকে। জিনি অবশ্য সাবধান করে দিল। বেশি বন্ধুত্ব করে ফেলো না বাবা। ওরা অন্য ক্লাস। বাড়িতে না এলেই ভালো। এটা শুনে খুব অবাক হয়েছিল বিমল। এখানে যারা মাল তোলার কাজ করে তারাও গাড়ি চালায়। জলের পাইপ সারাতে যে লোকটা এসেছিল তার সঙ্গে মনি কেমন হেসে হেসে বন্ধুর মত কথা বলছিল। পোশাক দেখেও তো বিমল কোনও ফারাক করতে পারে না। অন্তত তার জামাকাপড়ের চাইতে ওদের কোন অংশে খারাপ? তাহলে বিমল কি অন্য ক্লাস? সেই কথা গড়াতে গড়াতে শ্বশুর আর বউতে একদিন তুমুল।

জটিলতা এড়াতে গত কয়েক বছরে বাবা মাকে আনার ব্যাপারে সাবধানতা দেখিয়েছে হীরক। মাঝখানে জিনির বাবা মা দুবার ঘুরে গেছে। হীরক তবুও উচ্চবাচ্য করেনি। যদি আনার ব্যবস্থা করতে হয় জিনিই কথা তুলুক। এবার তাই হয়েছিল। জিনিই বলল। তোমার বাবা তো এখন রিটায়ার করেছেন। আমাদের এখন অনেক ছড়ানো বাড়ি। বাগান আছে। বাবা বাগান করতে ভালোবাসে, এবার একবার নিয়ে এসো। বেশিদিন মন টিঁকবে।

পাশাপাশি থেকেও মানুষ অচেনা থেকে যায়। এই বিস্ময় বুকে লালন করতে করতে হীরক বলল, বাবা বাগান করবে, তো বব কী করবে?

বাড়ি হওয়ার প্রথম থেকে বব ওদের লন সামলায়, ঘাস কাটে। গাছের পাতা ছেঁটে দেয়। মরশুমি ফুলগুলোরও ওই ব্যবস্থা করে। মাসে শ দেড়েক যায়, কিন্তু নিয়মমত কাজ করে। বব কস্টেলো ওদের প্রতিবেশী। নিজের এত বড় বাড়ি, সে কেন পাশের বাড়ির লনের ঘাস কাটার কাজ নেবে প্রথমে হীরক বুঝে উঠতে পারেনি।  সেই কারণে ভয় ছিল, নিজে চেয়ে কাজ নিচ্ছে। যদি মন দিয়ে কাজ না করে ছাড়াবে কেমন করে? কী করে বলবে, আপনার কাজ ভালো নয়, কাল থেকে আর করবেন না। বাড়ির কাজের লোক হিসাবে যাদের মেনে নেওয়া যায়, তাদের এমনভাবে বলা যায়। প্রতিবেশীকে নয়।

বাবা এলে কি ওকে না করে দিতে হবে?

–আহা তা কেন? ও ওর মত করবে। জায়গার তো অভাব নেই। ব্যাকইয়ার্ডটা তো এমনি পড়ে আছে। ওখানে বাবা সবজিবাগান করতে পারে। তাছাড়া এখন চিনুও এই দেশে। নিউ জার্সি এমন কি দূর। বাবা মা ওদের কাছে গিয়ে থাকবে কিছুদিন। জায়গা বদল হলে ওদের ভালো লাগবে।

তিস্তা বড় হচ্ছে। মঞ্জিনি চায় ও নিজের পরিবারকে একটু জানুক। ওই ফাঁকে বাংলাটাও শিখে নেবে। সেটা দরকার। হীরক আর জিনি, নিজেরা এত ব্যস্ত। জিনির নিজের বিউটি পার্লার রম রম করে চলছে। মেয়ের জন্য যথেষ্ট সময় দিতে পারে না। বাংলা নিয়ে যে বসবে তার সময় কোথায়?

অথবা সময় আছে, কিন্তু ভাগাভাগি হয়ে গেছে। দুটো সমান্তরাল রাস্তার মত। ডুবে যাচ্ছে নিজের নিজের জগতে। হীরক যে কী ভাবে এত সাতপাঁচ, বুঝতে পারে না জিনি। ওর গুমরানোটা দেখতে পায়, কিন্তু উৎসমুখ খুঁজে পায় না। দুঃখবিলাস তোমার, বলেছে মাঝে মাঝে রাগ করে। হীরকের চোখে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখেনি। ছবি আঁকার নেশাটা যেন ওকে আরও দূরে নিয়ে চলে গেছে জিনির থেকে। নিজের দোকান ঘিরে জিনিরও একটা নিজস্ব জীবন এখন। দুজনের জগৎ ছোঁয়াছুয়ির দূরত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। বুকের মধ্যের ফাঁকা জমিটা দিন দিন বাড়ছে। হয়তো বাড়ির লোক থাকলে একটু বদলাবে। সবাই একসঙ্গে কথা, বসা, খাওয়া— তাদেরকে আবার কাছাকাছি এনে দেবে। ভাবনাগুলো মনের মধ্যে সাজিয়েছে, হীরককে এতসব ভেঙে বলেনি জিনি। কী বুঝতে কী বুঝবে!

জিনির এই উৎসাহ হীরকের ভালোই লেগেছিল। সেইমত ব্যবস্থা করেছে। চিনু প্যাসেজ মানির কিছুটা দিতে চেয়েছিল। হীরক নেয়নি। মোটে দুবছর এসেছে এই দেশে, সেটল করতে সময় লাগে। ভাইয়ের কাছ থেকে এখন নেওয়ার কোনও মানে হয় না। পরেরবার যখন ওরা আসবে, তুই দিস— বলে এই কথাটা আর এগোতে দেয়নি।

বিমল আর নীলিমা এবার এসে ভালোই আছে। তিস্তা বেশ বড় হয়ে গেছে, দাদু দিদার সঙ্গে টকটক করে কথা বলে বেশ। ওরা আসার আগে জিনি নিয়ম করে দিয়েছিল তিস্তা বাড়িতে ইংরাজিতে কোনও কথা বলবে না।

হীরক হেসেছে। কী লাভ? হাজার হাজার মাইল দূরে বড় হয়ে, দুটো বাংলা শব্দ শিখলেই কি বাঙালি হয়ে যাবে? তার জন্য মানুষের মধ্যে থাকতে হয়, একসঙ্গে বাঁচতে হয়। শুধু শুধু টর্চার মেয়েটার উপর।

জিনি ধাঁ করে রেগে গেল। কী বলতে চাইছ বলো তো? নিজের তো কোনও চেষ্টা নেই মেয়েকে বাংলা শেখানোর। ভাবটা এমন যেন বাঙালি সাজতে গেলে মেয়েকে একেবারে দুর্গাপুরে নিয়ে গিয়েই ফেলতে হবে। কেন বাঙালির কম বেশি হয় না? বাইরে বড় হলে বাঙালি হওয়া যায় না?

–আমি কি অতসব কিছু বলেছি? আমার যা মনে হয়, বলেছি। অসহায় বোধ করেছে হীরক। জিনি কেন সব কিছুর সঙ্গে দেশে ফেরাটা জুড়ে দেয়!
–একবারে বলোনি, তবে সারাদিন এই ধরনের কথাই তো তোমার মুখ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেরোয়। খারাপ কি বলেছি আমি? বাবা মা আসছে এই ফাঁকে ওর বাংলা শেখাটা হয়ে যাবে। আবার যদি মেয়েকে দাদু দিদার সঙ্গে কথা বলতে না দিতাম, তখন ঠিক উল্টো কথা বলতে।
–আমি কী বলতাম এবার সেটাও মুখে বসিয়ে নিয়ে মুণ্ডুপাত করো। হীরক দপদপ করে বেসমেন্টে নেবে গেছে। জিনি নিষ্ফল আক্রোশে তার চলে যাওয়া দেখেছে। একটা মন চেষ্টা করেও আরেকটা মনকে ছুঁতে না পারার একটা কষ্ট আছে। সেটা জিনির থেকে কেঊ বেশি জানে না।

জিনি আর হীরকের এইসব চাপান উতোর বিমল আর নীলিমার কানেও যে একেবারে পৌঁছায় না, তা নয়। কিন্তু দুদিনের জন্যে এসে এর মধ্যে পড়ার কোনও মানে হয় না। বিমল তো পারতপক্ষে মাথা গলাতে চায় না।

নাতনির সঙ্গে কথা বলতে বরং ভালো লাগে। তাছাড়াও বিমলের ভালো কাজ হয়েছে বাগানে। ববের সঙ্গে ভালো আলাপ করে নিয়েছিল। বিমল প্রথমে অবাক হয়েছিল। যার নিজের এত বড় বাড়ি, একসময় ভালো চাকরি করত, সে কেন পাশের বাড়িতে ঘাস কাটতে আসবে?

বব কথা বলতে ভালোবাসে। সারাক্ষণ বকবক। বিমলকে পেয়ে ওর খুব জমেছে। বিমল ইংরাজিতে মোটামুটি কথা চালিয়ে নিচ্ছে। না হলে এত গল্প হয় কী করে। ববের দুই ছেলে এক মেয়ে। বিমলেরও তাই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কথা বলতে বলতেই জেনেছে ওর মেয়ে কিম থাকে এই শহরেই, কিন্তু একা। সপ্তাহে বার দুয়েক মা-বাবার কাছে ঘুরে যায়। সেটা শুনে বিমল অবাক। বিমল এসে জিনিকে বলেছিল। তোমাদের দেশের কাণ্ডকারখানা বুঝি না কিছু। এক ছেলে শিকাগো থাকে, আরেক ছেলে ডালাস। সেটা নয় বুঝি। কিন্তু ওর মেয়ে কিম থাকে এই অ্যান আরবারেই। তাহলে বাপ-মায়ের সঙ্গে থাকতে কী আপত্তি?

শুনে নীলিমাও তাজ্জব। অমন সোমত্ত মেয়েটাকে আলাদা রেখেছে। বাবা মায়ের মনে কি ভয়ডর নেই?

জিনি বুঝিয়েছে, এখানে এমনই বাবা। স্বাবলম্বী হওয়াটাই বড় হওয়ার মূল মন্ত্র। আঠেরো বছর হলেই ছেলেমেয়ে আলাদা হবে, না হলে ওদেরই সম্মান থাকবে না।

নীলিমার বিস্ময় আর ধরে না। তার মানে আমাদের তিস্তাসোনাও আঠেরো বছর হলে বাড়ি থেকে চলে যাবে?

এই প্রশ্নে জিনি একটু ফাঁপরে পড়ে গেল। তার একটা মন স্বাধীন জীবনযাপনকে কদর করে। মুক্ত বিহঙ্গের মত জীবন কাটানো এলিসার কথা মনে পড়ে যায়। আবার অসময়ে এলিসার চলে যাওয়াটাও ভুলতে পারে না। নিজের মেয়েকে কি অমনিভাবে দেখতে চায় জিনি? চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সি মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড হয়, সেক্সুয়ালি অ্যাক্টিভ। মেয়েকে কি সেই পথে যেতে দিতে পারবে? নিজের মেয়ের জন্যে এমন ভবিষ্যতের কথা ভেবে জিনি শিউরে ওঠে। হীরককে বলে লাভ নেই। কথা তুললেই বলবে, বারবার বলেছি এদেশে থাকার দরকার কী, দেশে কিছু কম সুবিধা? সেটা কি শুনলে?

বিমল জিনিকে আশ্বস্ত করেছে, যস্মিন দেশে যদাচার। এদেশে যখন পাকাপাকি থাকবে ঠিক করেছে তখন আর এসব ভেবে লাভ কী?

লিভিং রুমে বসে হীরককে সেই কথাটাই বলছিল বিমল, ওদের বড় হওয়ায় আমাদের দেশের ছাপ মোটে থাকবে না। সেইটাই সত্যি। বুঝি সেটা। তোরা তো আর ভারতের নাগরিক না যে আমাদের নিয়মে বাঁচতে হবে।

–এর সঙ্গে নাগরিক হওয়ার কোনও সম্বন্ধ নেই বাবা। যেমনভাবে বড় হচ্ছে, তেমনটাই তো করবে। বাবা যে তাদের আমেরিকান নাগরিক হওয়াটা ভালোভাবে নেয়নি সেটা হীরক জানে। এই নিয়ে এবারেও একটা অশান্তি হোক, চায় না।

হীরকের কথা মেনে নিল বিমল। সেটা হয়তো ঠিক বলেছিস হীরু। কিন্তু তিস্তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটা কথা কী মনে হয় জানিস?

ওকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে শুনে তিস্তাও সেখানে হাজির। হীরক একটু চিন্তিত হল। বাবা কী বলতে কী বলবে, এখানকার বাচ্চারা আবার একটু বেশি সেন্সিটিভ। তারা কম বয়সে বড়দের চড়থাপ্পড় খেয়েছে। কোনও কথা হলে গায়ে মাখেনি। যে কথা বাবা তাদের ছোটবেলায় বলেছে কিংবা যেভাবে ধমকেছে, সেরকম কথা এখানের বাচ্চাদের বলা যায় না। লিভিং রুমে কথা হচ্ছে। জানে রান্নাঘরে মায়ের সঙ্গে কাজ করতে করতে জিনিরও কান এদিকেই।

বিমলের চোখ একটু উদাস। ছোটবেলায় আমরা দাদু দিদার কাছে গল্প শুনতাম। ওঁদের ছোটবেলার গল্প, জীবনের কত অভিজ্ঞতা। মজার কথা, কাজের কথা। ওঁদের চোখ দিয়ে কত কিছু চিনতে শিখেছি। ওই শুনতে শুনতে শিখতাম। কিন্তু তিস্তার কাছে আমি কী গল্প করব বল? আমাদের জীবন এতটাই আলাদা যে ওকে বললেও কিছু বুঝতে পারবে না। আমাদের কাছ থেকে ওর শেখার কিছু নেই। বরং আমরা ওর কাছ থেকে কত কিছু শিখছি। তোদের তো সময় হয় না। ও আমাদের গাছ চেনায়। বাইরের লম্বা গাছটা যে মেপল গাছ, শরৎকালে তার কেমন রং বদলায় সব বলেছে আমাকে। তারপর উত্তর-পশ্চিম কোণের গাছটা, ওটা নাকি আপেল গাছ। ওর কাছেই তো জানলাম। আপেল খেয়েছি, কিন্তু গাছ তো দেখিইনি আগে কক্ষনও। আমার মনে পড়ছিল দেশের বাড়িতে দাদু খড়ম পায়ে হাঁটছে আর আমি হাত ধরে সঙ্গে। দাদু আমায় গাছ চেনাচ্ছে।

তিস্তা টরটর করে উঠল। দাদু মোট্টে ট্রি চিনছে না ড্যাডি। অলোয়েজ আমাকে শো করতে বলে।

জিনি হাঁ হাঁ করে উঠল। তিস্তা, তোমাকে ইংলিশ ওয়ার্ড ইউজ করতে বারণ করেছি না? তাছাড়া বড়দের কথার মাঝখানে কেন কথা বলছ?

হীরক বাবার দুঃখটা বোঝে না তা নয়। কিন্তু সান্ত্বনা দেয়। তাতে কী বাবা। এখানে তোমার নাতনি তোমার সঙ্গে হাত ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তোমাকে গাছ চেনাচ্ছে। ও যখন দুর্গাপুরে যাবে, তুমি আম জাম গাছ চিনিও।

–এ শুধু গাছের কথা না রে হীরু। সব কিছুই। মনে কর আমি যদি ওকে এখন চড়কের মেলার কথা বলি ও বুঝতে পারবে?
–এখানেও তো অনেকরকম মেলা হয় বাবা। জিনি বিমলকে উৎসাহ দিল। আসলে দুটোর মধ্যে কানেক্ট করে দিতে পারলে, ঠিক পারবে।

বিমল চুপ করে গেছিল। আসলে এগুলো ঠিক বলে বোঝাবার মত দুঃখ নয়। বুকের মধ্যে থাকলে এর ভার বোঝা যায়। কিন্তু মুখ থেকে বেরোলেই কেমন পলকা। নীলিমা আবার ফস করে বলে ফেলল, তোমার না সবতাতেই বাড়াবাড়ি। যে দেশের যেমন। সারা জীবন মাছ কুটছি, রাঁধছি, বাড়ছি। হেন মাছ নেই দেশে রাঁধিনি। এদেশে এসে দেখি কত নতুন মাছ। সলোমন, কড এইসব নাম। তারপর ওই যে ক্যাটফিশ না কী সব, কী নামের বাহার। জিনি আর তিস্তার কাছে শিখছি আমি। তাতে কী?

এইসব নানা কথার মধ্যে থেকে একসময় শানুর কথা উঠে এল। উঠল বলা ভুল। হীরক নিজেই কথাটা তুলল। নীলিমা নিজে থেকে বলেনি।

শনিবার দুপুরবেলায় ডেকে বসেছিল। নীলিমা কমলালেবু ছাড়িয়ে কোয়া বাড়িয়ে ধরছিল। ঠিক যেন ছোটবেলার মত। ফারাক বারান্দায় বসে শীতকালের শেষ দুপুরে কমলালেবু খেত ওরা, এখানে এখন গরম। কোয়া থেকে সাদা দাঁড়িগুলো টানতে টানতে হীরক অস্ফূটে বলল, মা শানুর কী খবর?

–শানু? আমাদের দেশে কী আর হবে? আজকাল আইন আদালতের ওপরেও কি কোনও ভরসা আছে?
–কেন?
–বাপটাকে পিটিয়ে মারল বলেছিলাম তো। গলাটা খাটো করে বলল নীলিমা, শুনেছি কোন একটা মেয়েকে নিয়ে কাণ্ড। ছেলে বিয়ে করবে, বাপ দেবে না। ব্যস। কী লজ্জার কথা বল? আর একটা কোয়া হাত বাড়িয়ে দিল নীলিমা।
–তারপর?
–এত বড় একটা অন্যায্য কাজ, তবু নাকি পুলিশ ছেড়ে দিল! ভাবতে পারিস? সব টাকার খাঁই, ন্যায়-অন্যায় মানছে না কোনও! ধামা চাপা দিয়ে দিল। পরমেশবাবুর আত্মার শান্তি হবে?
–শানুকে ছেড়ে দিয়েছে? ঠিক জানো?
–ঠিক-বেঠিক জানি না বাপু। তখন একটা শোরগোল হয়েছিল খুব। শানুকে জেলে নিয়ে গেল। তারপর যে কী হল! হঠাৎ একদিন শুনলাম, শানুকে ছেড়ে দিয়েছে। দুর্গাপুর ছেড়ে চলে গেছে। কেন ছাড়ল, কী বৃত্তান্ত কিছুই জানি না। হ্যাঁ গো, তুমি কিছু শুনেছ?

বিমল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অ্যান আরবার নিউজ পড়ছিল। চোখ তুলে বলল, নাহ। আগে তো পরমেশবাবুর সঙ্গে দেখা হত। বিশেষ কথা বলতেন না ভদ্রলোক শেষ দিকে। তাছাড়া কী হবে আর খোঁজ নিয়ে?

–হ্যাঁ রে তোদের আরেক বন্ধু মণীশ নাকি নিজের বউকে ছেড়ে দিয়েছে? কী কাণ্ড, এত বড় একটা মেয়ে আছে ওর। নিজের পরিবার ছেড়ে মেম বিয়ে করেছে?

হীরকের কিছু কানে ঢুকছিল না। ভাবছিল শানুর কথা। সমাজের কাছে কত অপ্রয়োজনীয়। ওর অস্তিত্ব হিসাবের খাতার বাইরে। ও জেলে থাকুক কি বাইরে, কারও কিচ্ছু এসে যায় না। খোঁজই রাখে না কেউ আর। যেন জীবনটা চলে গেছে, শুধু ছায়াটা পড়ে আছে। তাও তো শানুর খবর কিছুটা হলেও পায়। রেখার তো কোনও খবরই পেল না আর। কোথায় নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছে, ছায়াও পড়ে না।

ছোটবেলায় জেঠুরা এসেছিল দুর্গাপুরে বেড়াতে। সবাই মিলে মাইথন যাওয়া হয়েছিল। ব্যারেজের উপর দাঁড়িয়ে ড্যামের জল দেখছিল। চারপাশে অনেক লোক আরও, সবাই পিকনিক করতে এসেছিল। দিনের শেষে সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। হঠাৎ দূর থেকে এক গগনভেদী চিৎকার। আপনজনের জন্য ডাক। আর্তনাদ।

–মীনা! মীনা!

অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সেই বুকফাটা চিৎকারে সন্ধ্যার বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠছিল। দশদিক দাপিয়ে কে তার মীনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল সেই সন্ধ্যায়। পেয়েছিল কি? কেউ কি জলে ডুবে গেল? না কি শুধুই ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে অন্য কারও সঙ্গে? জানা হয়নি। কিন্তু হীরকের মনে হল ওই ডাকের মধ্যে দিয়েই হয়তো লোকটার ভালোবাসার জনকে হারানোর কষ্ট বেরিয়ে যাচ্ছিল। কমেও থাকতে পারে কিছুটা। সে যদি এইভাবে বুক ফাটানো আওয়াজে খুঁজে বেড়াতে পারত ‘রেখা! রেখা!’ বলে। পারেনি কোনওদিন। নিজের বুকের এই কষ্টটা কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেনি। পারেনি গলা ছেড়ে কাঁদতেও। সেটা পারলেও অন্তত হালকা হতে পারত।

 

২.

হীরক নীলিমাকেও একটা সাইকেল কিনে দিল।

বিয়ের পর পর যখন বিমল চিত্তরঞ্জনে থাকত নীলিমা সাইকেল চালিয়েছে। চিত্তরঞ্জন শহরটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। বিমল কোচ ফ্যাক্টরিতে সারাদিন, কিছু দরকার হলে পাওয়ার উপায় নেই। এইসব কথা ভেবে বিমল নীলিমাকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিল। তখন তাদের কিইবা বয়েস। নীলিমার সবে আঠেরো পেরিয়ে উনিশ। এখন ছেলেমেয়েদের কাছে হানিমুনের কথা শোনে। নীলিমার জন্য ওই সাইকেল শেখাটাই ছিল হানিমুন। সকালে নদীর ধারে সাইকেল শিখতে গিয়ে কত মজাই যে হত। সে বয়সটাই ওমনি ছিল। ঝগড়াও কম হয়নি। সাইকেলে প্যাডেল করতে শিখেছে মোটে, ভরসায় ছিল বিমল পিছন থেকে ধরে আছে। ওমা, সে লোক কখন ছেড়ে দিয়েছে! বেশ চালাচ্ছিল, কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে যেই দেখল অনেক দূর থেকে বিমল দাঁত বের করে হাসছে, ব্যস হাত পা ছেতরিয়ে মাটিতে আছাড়। হাঁটুতে কতটা ছড়ে গেছিল। খুব চোটপাট করেছিল সেদিন বিমলের উপর। তুমি কোন আক্কেলে সাইকেল ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লে? বিমল যত বলে, এমনিভাবেই তো শেখে লোকে। তুমি কেন পিছন দিকে ফিরে তাকালে, সেইজন্যেই তো পড়ে গেছ। কে শোনে কার কথা। দুদিন রাগ করে কথা বলেনি নীলিমা।

বেশ কিছুদিন সাইকেল চালিয়েছিল তখন। দোকান বাজার নিজেই করেছে সাইকেল চেপে। এরপর রূপা পেটে এল। বিমল চাকরি ছেড়ে সংসার গুটিয়ে দুর্গাপুরে যাওয়ার সময় ওই সাইকেল বেচে দিল। তারপর থেকে আর কোনওদিন সাইকেল চালায়নি নীলিমা। দুর্গাপুরে অত দরকারও ছিল না।

হীরক যখন বলল, মা তুমিও কেন সাইকেল করে বাবার সঙ্গে বেরোও না, তুমি তো নাকি আগে চালিয়েছ— নীলিমা সলজ্জ মুখে কিন্তু কিন্তু করেছিল। তবে এবার তার কাজও কম। সারাদিন বাড়িতে কেউ থাকে না, তিস্তা নিজের স্কুলে। এর মধ্যে বিমল সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলে নীলিমা একা। এইসব ভেবেই হীরকের বলা।

–কবে কোনদিন চালিয়েছিলাম, আমার কি ছাই সেসব আর মনে আছে? নিজের উপর ভরসা ছিল না নীলিমার।
–আরে বাবা, সাইকেল আর সাঁতার একবার শিখলে কেউ ভোলে নাকি? বিমল উৎসাহে টগবগ। তুমি তো প্যান্ট পরছ, একবার আমার সাইকেলেই ট্রাই করে দেখো না হয়।
–হ্যাঁ, আমি সাইকেলে চাপি আর তুমি পিছন থেকে ছেড়ে দাও সেবারের মতন। এবার পড়লে যখন হাড় ভাঙবে, আর তো জুড়বে না।

বিমল ভাবল বছর বছর কেটে যায়, মেয়েরা ঠেস দেওয়া কথা একদম ভোলে না। তবে নীলিমার গালের রক্তিমতা দেখেই বুঝে গেল যে ইচ্ছা আছে ষোল আনা। তাই পুরনো কথার ঝাল টেনে রাগ করল না।

–তাহলে চলো, এখনই একবার চেক করে নাও তোমার মনে আছে কি নেই।
–চুপ করো তো! তোমার তো উঠল বাই তো কটক যাই। বলেছ, ভেবে দেখি। তাছাড়া তোমার উপর ভরসা নেই, কখন ছেড়ে দেবে। আমি যখন সাইকেলে উঠব হীরুকেও থাকতে হবে। নীলিমার গলায় কিশোরী মেয়ের জেদ।

এই কথায় বিমল অবশ্য দুঃখ পেল। ছেলের উপর যে ভরসা আছে, স্বামীর উপরে নেই। কিন্তু নীলিমাকে টলানো গেল না।

শনিবার বাড়ির সামনের রাস্তায় সাইকেল নিয়ে যাওয়া হল। নীলিমার মোটার ধাত নয়। কিন্তু শত হলেও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর একটু ভারী হয়েছে। কমেছে নিজের ওপর ভরসাও। আস্তে আস্তে নীলিমা না-এর দিকে ঝুঁকছিল। নেহাত ছেলে খুব জোর করল বলে ভাবল একবার চেষ্টা করে দেখবে। নতুন করে শিখতে হলে এই বয়সে আর পারবে না।

এইরকম সাতসতেরো ভাবনা নিয়ে সাইকেলে উঠে বসল। এখানে আবার হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক, সেটাও পরা হল। একদিকে বিমল, অন্যদিকে হীরক। দুজন আছে যখন, পড়বে না নিশ্চয়— এই ভরসায় প্যাডেলে পা দিল। প্রথম প্রথম সাইকেলটা কেঁপে কেঁপে এগোল। কিন্তু সত্যিই দুপাকের পর বিমল আর হীরককে ছেড়ে একাই এগিয়ে গেল নীলিমা। ওদের সাবডিভিশানটা পুরো এক চক্কর দিয়ে মুখে হাসি ফুটল নীলিমার। সে পেরেছে। একটা বাচ্চা মেয়ের মতই খুশিতে টগবগ করে ফুটছিল।

সেইদিনই সাইকেল কেনা হল মাইহার থেকে। তিস্তার পছন্দে গোলাপি রঙের সাইকেল। তিস্তার সাইকেলেরও ওই রং। ঠিক হল, নীলিমা আর একটু সড়গড় হলে নাতনির সঙ্গে পার্কে সাইকেল চালাতে যাবে।

রবিবার আর একটু প্র্যাকটিসের পর নীলিমা বেশ স্বচ্ছন্দ। মনেই হয় না চল্লিশ বছর আগে শেষ সাইকেল চালিয়েছে। সোমবার সকালে জিনি একটা ছোট পিকনিক বাস্কেটে ফলের রস, স্যান্ডউইচ, চিকেন ফ্রাই, চিপস সব ভরে হাতে ধরিয়ে দিল। যাও গিয়ে গ্যালাপ পার্কে পিকনিক করে এসো তোমরা দুজনে। বাবা তুমি সাইকেল নিয়ে গ্যালাপ পার্কে গিয়েছ তো? রাস্তা চেনো?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ মনি। আমি আর না হলেও সাইকেল নিয়ে তিনবার গেছি। এখান থেকে মাইল তিনেক হবে। রাস্তা মুখস্থ হয়ে গেছে।
–ব্যস তাহলে আর কী চিন্তা। তোমরা তাহলে আজ চুটিয়ে গ্যালাপ পার্কে রোমান্স করো গিয়ে। মুখ টিপে হাসতে হাসতে তিস্তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল জিনি। তিস্তার মুখ একটু গোমড়া ছিল। ওদের পিকনিক বাস্কেট দেখেছে। ঠাম্মা ওকে ছাড়া পিকনিক করতে যাচ্ছে, সেটা মোটেই ভালো লাগেনি।

বিমল আর নীলিমা যখন বেরোল তখন রাস্তা বেশ ফাঁকা। তবুও নীলিমার ভয় ভয় করছিল। কে আগে যাবে সেই নিয়ে একটা ছোটখাটো গৃহযুদ্ধ হয়ে গেল। বিমলের মতে নীলিমা আগে যাক, তাহলে বিমল খেয়াল রাখতে পারবে। নীলিমার কথা তুমি রাস্তা চেনো, আমি তোমার পিছনে থাকব আর দেখব কোথায় কীভাবে বাঁক নিচ্ছ। তাই হল। বিমল চলতে চলতে পিছন ফিরে খেয়াল রাখছিল। তার সাইকেলেই আবার পিকনিক বাস্কেট। এইসবের জন্য নীলিমার থেকে বিমলের অবস্থা বেশি টালমাটাল। সুবিধার মধ্যে এইখানে সাইকেলের জন্য আলাদা লেন করে দেওয়া আছে আর গাড়িগুলোও দেশের মত ঘাড়ের উপর উঠে আসে না। তবু দুবার রাস্তা পার হওয়ার ব্যাপার ছিল, সিগন্যাল দেখে তবে যেতে হবে। বিমল দুবারই থেমে নীলিমাকে পার করাল। ঘটনাবিহীন পৌঁছে গেল গ্যালাপ পার্ক।

পার্কে ঢুকেই নীলিমাকে খুশিতে মুখরিত হতে দেখে বিমল অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। বয়স যেন একলাফে কমে গেছে তোমার? কে বলবে রাত্রে বিছানায় গাঁটের ব্যাথা নিয়ে ছটফট করো!

–আর তুমি? ছেলের মত হাফপ্যান্ট পরে লাগছে তো একটা বাচ্চা খোকা! একটা ক্যামেরা থাকলে তোমার একটা ছবি তুলে রাখতাম আজ। নীলিমার কথায় খুশির আমেজ। ঝাঁঝহীন, খোঁচা বাঁচানো যেমন কথাকে অনেকদিন আগে পিছনে ফেলে এসেছিল সব যেন ফিরে আসছে আজ। উৎসাহ পেয়ে বিমল বলল, এখান দিয়ে একটা নদীও গেছে। এর পর দিন তুমিও হাফপ্যান্ট পরে এসো, নদীতে নামতে পারবে।

ওমা, এটা নদী? হুরন নদী কলকল করে বয়ে যাচ্ছে। স্রোত আছে, কিন্তু চওড়া নয় মোটেই। ছিপ ফেলে মাছ ধরছে কেউ কেউ। কায়াকে করে নদীর বুকে নেমে পড়েছে অনেকেই। দেখো, একদম আমাদের দেশের পানসির মত। তুমি চালাতে পারলে বেশ হত, আমরা পানসি চড়ে ঘুরে বেড়াতাম।

বিমলের মনে হল পারবে। খুব ছোটবেলায় সে ভেলা চালিয়েছে বর্ষায় স্কুলে যাওয়ার সময়। আটাত্তরে যখন বন্যা হল, তার সাধের মিলিং মেশিনে জল ঢুকেছে কিনা দেখতে ত্রাণের জন্য আসা একটা ভেলায় চড়ে গেছিল সে-ও। কিন্তু কীভাবে ওই পানসিগুলো পাওয়া যাবে জানে না। ফ্রি তো হবে না। হীরক কিছু ডলার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে, দেখবে যদি পাওয়া যায়। ববের সঙ্গে কথা বলে নিজের ইংরাজিতে একটু ভরসা হয়েছে, যদিও এদের অনেক কথাই সে বুঝতে পারে না। নীলিমাকে বলল, আগে সাইকেল চালিয়ে পার্কটা ঘুরে দেখো, তারপর পানসির কথা ভাবা যাবে।

এরকম সবুজে ঢাকা জায়গা নীলিমা কোনওদিন দেখেনি। এতটা জায়গা জুড়ে। পার্ক মানে এত্ত বড়! এগিয়ে যাওয়া বিমলকে চেঁচিয়ে বলল, পার্কটা কত বড় গো? তুমি এর শেষ অব্দি গেছ আগে?

নীলিমাকে এখন কিশোরীর মত লাগছে বিমলের। না হলে এত জোরে চেঁচায় রাস্তার মাঝখানে? বিমলের কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছিল। দুর্গাপুরে কয়েকটা পার্ক আছে, কিন্তু তার এমাথা থেকে ওমাথা দেখা যায়। এত ছোট। এখানে সেরকম নয়। আগের দু-তিনবার এসে পুরোপুরি যায়নি বিমল, একা একা অত ভালো লাগে নাকি! সাইকেলের গতি কমিয়ে নীলিমার কাছাকাছি এসে বলল, না আগে যাইনি। চলো আজ ঘুরে আসব নাহয় পুরোটা।

এগুলোকে ওরা পার্ক বলে? দেশের পার্কে কিছু বেঞ্চি আর বাচ্চাদের জন্য ঢেঁকি আর দোলনা ছাড়া কটাই বা গাছ থাকে। এখানে গাছ-ই গাছ। মাঝে মাঝে খোলা জমি পড়ে আছে, ঘন সবুজ তার বিস্তার। সেখানে অনেকে ব্যায়াম করছে আবার। কতরকমের পাখি যে চারদিকে! একটা শালিকের মত পাখি দেখল যেন। অন্য পাখিগুলোকে চিনতেই পারছিল না নীলিমা। জলে হাঁস সাঁতার কাটছে। সারস মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আছে জলের ধারে। এই সারসগুলো আলিপুরের চিড়িয়াখানায় দেখেছিল অনেক বছর আগে। জলের ধারে ধারে বেঞ্চ। তার কাছে কাছে লোহার চৌকো চৌকো শিক দেওয়া উনুন করা। এক জায়গায় দেখল উনুন জ্বলছে আর মাংস পুড়াচ্ছে একটা লোক। নীলিমাকে দেখে আবার হাত নাড়ল। ভয় পেয়ে নীলিমা তাড়াতাড়ি প্যাডেল করে বিমলের কাছাকাছি চলে এল। এবার না চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ গো আমায় দেখে হাত নাড়ল কেন ওই লালমুখোটা?

মজা পেয়ে হাসল বিমল। এখানে সবাই এমন হেসে তাকায়। তুমিও হাত নাড়িয়ে বলে দেবে হাই!

হ্যান্ডেল থেকে হাত উঠাই আর উল্টে পড়ি আর কী। কিরকম লজ্জা লাগছিল নীলিমার। দুর্গাপুরের রাস্তায় দেখেছে উঠতি বয়সের ছেলেরা সাইকেল করে কমবয়সি মেয়েদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাত নেড়ে চলে যায়। কোনও কোনও মেয়ে হেসে ওঠে, পালটা সাড়া দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ মেয়েই বিরক্তিসূচক শব্দ করে মাথা নামিয়ে চলে যায়। এটা খারাপ বলেই ধরা হয়। আর এখানে বুড়ো বুড়ো লোকগুলো এমন করে? নীলিমা মোটেই উল্টে হাত নাড়বে না।

মোটের উপর সাইকেল ভ্রমণ বেশ মজায় এগোচ্ছিল। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে সাইকেল চালাচ্ছিল বিমল আর নীলিমা। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথাও বলছিল দুজনে। নিজেদের বয়সটা ভুলতে বসেছিল। এমন সময়ে হুড়মুড়িয়ে দুটো হরিণ এক্কেবারে নীলিমার সামনে এসে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় নীলিমা ভয়ের চোটে হ্যান্ডেল থেকে হাত সরিয়ে ফেলতেই টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে আছাড়।

ব্যথার চেয়েও লজ্জা পেয়েছিল বেশি। এক ভদ্রলোক জগিং করছিল। দৌড়ে এসে হাত ধরে টেনে তুলে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, আর ইউ অলরাইট ইয়ং লেডি?

বিমল ততক্ষণে এসে গেছে। একরাশ লজ্জায় নীলিমার মুখ আরক্ত। ইংরাজিতে কী জবাব দেবে! কোনওমতে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।

লোকটা চলে যেতেই ঝাঁঝিয়ে উঠল বিমলের উপর। আমাকে বলতে পারলে না রাস্তায় হরিণ আছে?

–আরে বাবা, আমি কী করে জানব? এর আগে আমিও তো দেখিনি। তোমার কি খুব লেগেছে?
–এখন তো লাগছে না। তবে রাত্রে ব্যথাটা চাগাবে। নীলিমা একটু ধাতস্থ বোধ করছিল।
–সাইকেল চালাতে পারবে?
–একটু বরং বসে নিই, তারপরে আবার যাব না হয়? চলো আমরাও ওই বেঞ্চে বসে দেখি কিছুক্ষণ। মনি আমাদের জন্য খোসাছাড়ানো বাদাম দিয়েছে, বসে বসে বাদামভাজা খাই।

দুজনে বসে বসে বাদাম খাচ্ছিল। গরম বেশ।। দুর্গাপুরে বছরের এই সময়ে লু বয়। সেরকমটা নয়। তবু সাইকেল চালিয়ে একটু ঘেমে গেছিল নীলিমা। রোদে মুখ লাল হয়ে গেছে একদম। এখন নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়োচ্ছে। চুল উড়ছে পতপতিয়ে। বিমল খুব অবাক হয়ে নীলিমার দিকে তাকিয়েছিল।

–কী দেখছ এমন হাঁ করে? পরের বউকে দেখছ নাকি?
–সেইরকমই লাগছে নীলু। তোমাকে একদম অন্যরকম লাগছে। বয়স এক ঝটকায় কমে গেছে আজ।

আদর করে নীলু বলে অনেক আগে ডাকত বিমল। সেসব কবেই চুকেবুকে গেছে। আজ কেমন ফিরে এসেছে কিছু হারানো দিন।

–এখানে লোকের যেন বয়েস বাড়ে না, তাই না? দেখেছ পার্কে কত লোক, আমাদের থেকে বড়ই হবে বয়সে। কিন্তু দেখে কে বলবে!
–হ্যাঁ, দুজনকে দেখলাম আবার চুমুও খাচ্ছে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে। কে কোথায় দেখছে কোনও পরোয়া নেই। যারা পাশ দিয়ে যাচ্ছে তারাও এমনভাবে যাচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। বলতে বলতে বিমল হেঁচড়ে নীলিমার দিকে একটু এগিয়ে এল।

নীলিমা শশব্যস্ত। অ্যাই! তুমি কেন এগিয়ে আসছ। কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে কিন্তু বলে দিলাম।

–আহা, ওরা চুমু খেতে পারে আর আমরা কি একটু হাত ধরে বসতে পারি না? সন্তর্পণে নীলিমার বাঁ হাতের পাতার উপর নিজের ডান হাতখানা রাখল বিমল। ভুলে যাওয়া উষ্ণতা প্রবাহিত হচ্ছিল দুজনের মধ্যে। নীলিমা হাত সরিয়ে নিল না। অনেকক্ষণ কোনও কথাও বলল না। তারপর ধীরে ধীরে অস্ফুটে বলল, এদেশে লোকেরা অনেক সুখী হয় আমাদের চাইতে, না গো? বুড়িয়ে যায় না আমাদের মত।

সাহস পেয়ে বিমল বলল, এই নীলু একটা গান করো না! ওই যে তুমি গাইতে, আমার বেলা যে যায় গানটা।

কিন্তু নীলিমা অন্য কিছু ভাবছিল। সবাই এখানে এত সুখী। হীরু মনি ওদের সব আছে। মেয়েটা এত মিষ্টি হয়েছে। তাহলে আমার ছেলেটা কেন সুখী নয়?

বিমল ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। কেন, হীরুর আবার কী হয়েছে? বেশ ভালোই তো দেখি। মনিও তো বেশ ভালো মেয়ে। কেমন গুছিয়ে সংসার করছে। নিজের ওরকম একটা দোকান বসিয়েছে!

–তুমি কিচ্ছু বোঝো না। মায়ের চোখকে অত সহজে ফাঁকি দেওয়া যায় না গো। উপর উপর সব ঠিক আছে, কিন্তু ছেলেটা আমার ভালো করে হাসেও না একটু। হাতের চেটোয় চোখ মুছল নীলিমা। ভিতরে ভিতরে গুমড়ায়। আমি বুঝি।

এ তো শরতের আকাশ একেবারে। এখুনি এত হাসি মজা হচ্ছিল, কোথাও কিছু নেই কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল একেবারে। বিমল অস্থির ভঙ্গিতে বলল, কিসের গুমড়ানো যে দ্যাখো বুঝি না। ভালোই তো আছে, ভালো চাকরি করছে। বেশ হাসিখুশি সংসার।

–কবে ভালো করে হাসতে দেখলে ওকে? ঝাঁঝিয়ে ওঠে নীলিমা। নিজের ছেলেকে ভুলে গেছ? ভালো করে মন খুলে কথা বলে না। কেউ তাকিয়ে না থাকলে উদাস মুখে হাঁ করে চেয়ে থাকে।
–কী বলবে বিমল? মায়ের কল্পনা ছাড়া আর কিছু না। আসলে সেই চিরকালীন শাশুড়ি বউয়ের ব্যাপার। বউয়ের খুঁত বের করবে বলে পাথর খুঁড়ে জল বের করছে। একটু আগের সুন্দর সকালটা কেমন তেতো হয়ে গেল শুধু শুধু। কথা ঘোরানোর জন্য বিমল বলল, এতগুলো খাবার সঙ্গে দিয়েছে মনি, খেয়ে নেবে নাকি?

নীলিমা এখনও ভাবছে। ধীরে ধীরে বলল, তুমি হীরুর আঁকা ছবিগুলো দেখেছ? ওদের বেসমেন্টের এক কোণায় রাখা আছে।

–ছবি?
–এই তো বাবার অবস্থা। চোখ খুলে দেখোও না কিছু। হীরু ছোটবেলায় কত ভালো ছবি আঁকত ভুলে গেছ? এখন আবার ছবি আঁকা ধরেছে।
–বেশ, সেটা তো আনন্দের খবর। এখানে বাসে ট্রামে কাউকে মারপিট করে জীবন কাটাতে হয় না তো। তাই হাতে অনেক সময়। অমন সবাই কিছু না কিছু করে। কেন ববকে দেখোনি গ্যারেজভর্তি যন্ত্রপাতি বোঝাই। হেন কাঠের কাজ নেই যা করতে পারে না। আঁকছে মানে ভালো আছে, খুশি মন না থাকলে কেউ ওইসব কাজ করতে পারে?
–ছবিগুলো দেখলে বুঝতে কেন বলছি। ছোটবেলায় ছবি আঁকত, সেসব আমার কাছে সব তোলা আছে। তাতে কত রং, আনন্দ ভরা। আর এখানে কটা ছবি দেখলাম। কেমন কেমন লাগছিল ওসব দেখে। একটা ছবি এঁকেছে আমাদের দুর্গাপুরের, বেনাচিতির মোড়। রাস্তায় লোক না হেঁটে ছায়া হেঁটে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এমন কেন রে হীরু। ভূত না কি? ছেলে বলল, ভুতের তো ছায়া থাকে না মা। আমরাই ভূত, আমাদের ছায়াগুলো ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হা হা করে হাসল বিমল। বাহ, খুব ভালো বলেছে কথাটা। দেখতে হবে ছবিটা। বিমল নীলিমার ভাবনার কারণটা ধরতে পারছে না। বড় হয়েছে, কতরকম ভাবনা চিন্তা করে আঁকে। আমি দেখেছি আমাদের মেন অফিস বিল্ডিঙে, ওরকম ছবি থাকে। দেখলে কিছু বোঝা যায় না, লোককে বুঝিয়ে দিতে হয়। তুমি খামোখা মাথা গরম করছ।

–না গো। শুধু একটা ছবিতে এমন দেখলে বলতাম না। আরেকটা ছবিতে দেখলাম রাস্তায় চাপ চাপ রক্ত পড়ে আছে, আর একটা ছায়া পালাচ্ছে। এই ছায়াটারও কোনও মানুষ নেই। দেখেই কেমন একটা গা শিরশির করে উঠল।
–জিজ্ঞেস করলে পারতে।
–তুমি তো বাবা। বাবার কিছু কর্তব্য তো করো। ছেলেকে আলাদা করে ডেকে জিজ্ঞেস করো একবার।

নীলিমা বলেই খালাস। ছেলে বড় হয়ে যাওয়ার পর মায়ের সঙ্গে যাও কথা বলে, বাবার সঙ্গে উপর উপর। বিমল জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দেবে কে জানে! তবু সন্ধ্যাবেলায় হীরক বাড়ি ফিরতে দেখতে চাইল ছবিগুলো। ছবিতে বাবার উৎসাহ দেখে হীরক অবাক। তুমি ছবি দেখতে চাও?

–কেন, আমি দেখতে পারি না?
–না, না সেটা বলছি না। কখনও দেখতে চাওনি আগে, তাই। আমার তো দেখাতে ভালোই লাগবে। নিচে নিয়ে গেল বিমলকে।

হীরকের বেসমেন্টটা বেশ বড়। এখানেও টিভি, সোফা সব আছে। সঙ্গে একটা ঘর। সেটাই হীরকের স্টুডিও হয়েছে। বেশ অনেকগুলো ছবি। বড় বড়। দুই তিন ফুট লম্বা একেকখানা। নীলিমা ঠিকই বলেছে। বেশিরভাগ ছবিতেই যতরকম ছায়ানৃত্য। একটা মেয়ের ছবি এঁকেছে, তার মুখেও কোনও একটা মানুষের ছায়া পড়ে ঢেকে গিয়েছে। অথচ মানুষটা নেই। তারপর ওই যে চাপ চাপ রক্ত পড়ে আছে রাস্তায়, দেখলেই গা ছমছম করে না? কোনও লোক নেই শুধু একটা ছায়া দৌড়ে পালাচ্ছে। কী এসবের মানে? কিছুই বুঝতে পারল না বিমল। এগুলো কী রে হীরু? ভালো ভালো রং দিতে পারিস না? এত কালো কালো কেন? এরকম ছায়াই বা কেন ওতে। সব কটাতেই অমনিধারা।

–এসব মডার্ন আর্ট বাবা, তোমরা অত বুঝবে না। আমি একটা এক্সিবিশান করব। মেন থিম হবে শ্যাডো। থিমটাই ওমনি, তাহলে ছবিগুলো সেই বিষয়েই হতে হবে, তাই না?
–ছায়া ছাড়া অন্য কোনও ছবি আঁকিস না নাকি?

হীরক অবাক হল। কেন আঁকব না? এটা এবারের থিম। দাঁড়াও তোমাকে আমার আগের এক্সিবিশানের ছবিগুলো দেখাই।

একটা বড় দেরাজের থেকে র‍্যাপ করা অনেক ছবি বের করে আনে হীরক। এইটা বছর দুয়েক আগে করেছিলাম। ওটাই ছিল আমার প্রথম শো। সোলো নয়, আমার অফিসের এক কলিগ পাবলোর সঙ্গে। তাই অত বেশি ছবি নয়।

–কেউ কেনে?
–হ্যাঁ, দুটো বিক্রি হয়েছিল। তবে চেনাপরিচিতদের মধ্যে। আস্তে আস্তে কাগজের খোলস ছাড়িয়ে ছবিগুলো বেরোতে থাকে। এই ছবিতে আবার অনেক রং।
–আরে এটা তো দুর্গাপূজার ছবি।
–হ্যাঁ, সেবার থিম ছিল ইন্ডিয়ান ফেস্টিভ্যাল। দেখো দোলের ছবি আছে একটা, মনে হবে আমাদের বাড়ির সামনেটা যেন…

নীলিমা শুধু শুধু মাথা গরম করছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বিমল। তোর মাকে এই ছবিগুলো দেখাস তো। তোর ওই ছায়ানৃত্য দেখে কেমন ভেবড়ে গেছেন মহিলা। বাবা আর ছেলেতে মিলে প্রাণ খুলে হাসল অনেকদিন বাদে।

ওপরে এসে সাড়ম্বরে সেটাই বলল। দেখে এলাম নীলিমা। হীরু তো এক্সিবিশান করবে ছায়া নিয়ে, তাই এত ছায়ার ছবি। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছিলে। হীরুর আগের এক্সিবিশানের ছবিগুলো দেখো, ওতে পুজোর ছবিটবি আছে। তোমার ভালো লাগবে।

মঞ্জিনি কাছেই ছিল। শুনে অবাক। কীসের এত চিন্তা করছ মা? আমাকে বলোনি তো।

–তোমাকে আর কী বলব মনি। দেখি ছেলেটা কেমন মনমরা থাকে। নিচে বেসমেন্টে দেখলাম কীসব দুঃখের ছবি এঁকে রেখেছে। মায়ের মন, কষ্ট পায় এসব দেখলে।

কথাটা নীলিমা এইভাবে না বললেও পারত। মনিকে দোষারোপ করা হয়ে গেল। বলে অবধি মনে মনে জিভ কাটছে। কী দরকার ছেলের বাড়ি বেড়াতে এসে এসব বলা। কিন্তু হাতের তীর আর মুখের কথা, একবার বেরিয়ে গেলে তো আর ফেরানো যায় না।

মঞ্জিনি অদ্ভুত চোখে তাকাল নীলিমার দিকে। সেই তাকানোয় বিষাদ। বাড়ির বউ তো আমি, মেয়ে নই। তাহলে তোমার মায়ের মন আমার কষ্টটাও হয়তো বোঝার চেষ্টা করত।

ধীর পায়ে দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেল মঞ্জিনি। হীরক এখনও বেসমেন্টে। বিমল নীলিমার উপর বিরক্ত হয়ে বাগানে চলে গেল। সোফার এক কোণে বসে চোখে আঁচল চাপা দিল নীলিমা।

সকালটা এমন সুন্দর শুরু হয়েছিল আজ। দিনটা যে এইভাবে শেষ হবে কেউ বুঝতে পারেনি।

 

(ক্রমশ)


‘ছায়াপাখি’-র সব কটি পর্বের জন্য ক্লিক করুন: ছায়াপাখি — বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...