তারান্তিনো, সিজন দুই — তেরো

প্রিয়ক মিত্র

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

মহেশ সেনের নাড়ি ধরে বসে আছে ফাদার। সকলেই তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে।

লতা তার জায়গা ছেড়ে একচুলও নড়েনি। সে এই নাট্যের কলাকুশলীদের অভিব্যক্তি দেখতে চাইছে একটু দূরে থেকে। এই নাট্যের কেন্দ্রে যে সে, তা দিব্য বুঝতে পারছে সে। তাকে উদ্ধার ক‍রতেই সূর্যবাবু, ফাদার— এরা জড়ো হয়েছে এখানে। এই নিয়ে কোনও সংশয় নেই যে জয়চাঁদও ওদেরই লোক।

তাহলে কি মহেশ সেনকে বিষ খাওয়ানো দিয়েই নাটকের যবনিকা পতন শুরু হয়ে গিয়েছে?

এসব ভাবতে ভাবতেই লতা দেখছিল, ফাদারের পাশে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সনাতন হাজরা। সূর্যবাবুর ছদ্মবেশ যদিও তার মুখ আড়াল করে রেখেছে, কিন্তু সূর্যবাবু অভিনয়ে যে কিঞ্চিৎ কাঁচা, তা আগে লক্ষ করেছে লতা। জয়চাঁদ দিব্য মুখেচোখে একটা দুশ্চিন্তার হাবভাব রেখেছে। জনার্দন সান্যাল অন্যদিকে মুখেচোখে একটা আশ্চর্য হিংস্র ভাব যেন সবসময় ধরে রেখেছে। মহেশ সেনের সঙ্গে তার দুবার বাগযুদ্ধ হয়েছে, একবার ফাদারকে নিয়ে, আরেকবার সনাতন হাজরাকে নিয়ে। মহেশ সেনের প্রতি আদৌ কোনও সহানুভূতি তার আছে বলেই মনে হচ্ছে না।

ফাদার মুখ তুললেন। ‘নাড়ি একটু ধীর বটে। তবে সুস্থই আছেন বোধহয়।’

উত্তরে সনাতন হাজরা শুধু একটা ‘হুম’ বললেন। গোল বাঁধাল সেই জনার্দন সান্যাল‌।

–অসুস্থ হলেন কী করে?

সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল জনার্দন।

–বোধহয় খাবার থেকে, প্রায় বিড়বিড় করে বলল সনাতন হাজরা।

একটু সচকিত হল সকলেই। ফাদারের ভুরু কুঁচকে আবার সোজা হয়ে গেল। সূর্যবাবু শ্মশ্রুগুম্ফ নিয়ে একইরকম স্থানুবৎ। জয়চাঁদের চোখ সরু হয়ে গেছে।

–পয়জনিং! আঁতকে উঠেছে জনার্দন। মাই গড, তার মানে আমরাও…
–না, দৃঢ়ভাবে বলল সনাতন। গোলমাল যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে ওর খাবারেই ছিল।

কথাটা বলেই লৌহকঠিন ঠান্ডা চোখে সনাতন সোজা তাকাল জয়চাঁদের দিকে।

জয়চাঁদ মুখটা একটু সহজ করে সেই গা রি রি করা হেঁ হেঁ-টা করে বলল,

–কী যে বলেন বাবু! রান্না তো সব একসঙ্গেই হয়েছে।
–বাটিতে খাবার সাজিয়ে দিয়েছ তুমি, গলায় সেই এক শীতলতা আর কাঠিন্য নিয়ে বলল সনাতন।
–তাতে কী হয়েছে, আমি কি ওর বাটিতে আলাদা মাংস দিয়েছি?

জয়চাঁদের মুখচোখের ভাবভঙ্গি ক্রমশ পালটাচ্ছে। একটু একটু করে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে তার।

একটু গলা চড়িয়ে পরের কথাটা বলল জয়চাঁদ।

–আমি কি সাহেবের খাবারে বিষ মিশিয়েছি?

সনাতন মুচকি হাসল।

–বিষের কথা কে বলেছে জয়চাঁদ?

লতা পুরো ব্যাপারটা রুদ্ধশ্বাসে নিরীক্ষণ ক‍রছিল। হঠাৎ একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল।

হঠাৎ জেগে উঠল মহেশ সেন।

সকলের কথা থেমে গেল তৎক্ষণাৎ!

দু চোখ বিস্ফারিত। ঠোঁটের কোণে হালকা গ্যাঁজলা উঠছে। কেদারা থেকে নামতে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ল মহেশ সেন। সনাতন ধরতে গিয়েও পারল না। হাঁটুতে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে মহেশ সেন ক্রমে এগিয়ে এল লতার দিকে।

লতা স্তব্ধ। কী চায় মহেশ সেন?

মহেশ সেন লতার কাছে এসে শক্ত মুঠিতে আঁকড়ে ধরল তার চুল। গলা দিয়ে প্রায় আওয়াজ বেরচ্ছে না মহেশ সেনের। লতার চুল খামচে ধরে গোঙানির স্বরে মহেশ সেন কী বলল কিছু বোঝা গেল না। চুলটা চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারল না লতা। এক হাতে লতার চুলটা খামচে ধরে রেখেই, ভয় ধরানো বিস্ফোরক চাহনিতে ফাদারের দিকে, জয়চাঁদের দিকে আঙুল তুলে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল সে।

চুলটা খামচে ধরে থাকায় লতার লাগছিল। আর তাতেই যেন লতার মাথায় রক্ত চড়ে গেল আচমকা।

হাতের কড়াটাই তার কাছে একমাত্র অস্ত্র বলে মনে হল।

সেই ভারী লোহার কড়া দিয়ে সজোরে মহেশ সেনের মাথায় ঠিক গুনে গুনে চারবার আঘাত করল লতা।

মহেশ সেনের মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এল গ্যাঁজলা। এক মুহূর্ত সময় নিয়ে মহেশ সেন লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। মাথার কোণ দিয়ে ঝরনার মতো ঝরে পড়ল রক্ত। মাটির একটা অংশ হয়ে উঠল জবার মতো লাল।

ঘরে উপস্থিত সকলেই ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে ছিল কিছুক্ষণ। লতা হাঁপাচ্ছিল চেয়ারে বসে।

জনার্দন আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে কোমর থেকে বের করে ফেলেছে পিস্তল। সনাতনও তার ধুতির গেঁজ থেকে একটি পিস্তল বের করল।

–এই ঘর থেকে কেউ কোথাও বেরোবে না।

চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সনাতন।

জনার্দন হুঙ্কার দিয়ে উঠল।

–আমি জানতাম, এই ঘরের লোকজন গোলমেলে। এই ফাদার যে এদের লোক সেটা আগেই বুঝেছিলাম আমি, বলেছিলাম সে কথা। ইশ, তখনই যদি হাতকড়া পরিয়ে দিতাম…

ফাদার এবার মুখ খুলল।

শান্ত, থমথমে গলায় বলল ফাদার,

–আমি এই গোটা ঘটনায় কী করেছি বলতে পারেন?
–শাট আপ! গর্জে উঠল জনার্দন। আর একটাও কথা নয়। এই গোটাটা যে আপনারই পরিকল্পনা, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
–হাত তুলুন। হাড়হিম করে দেওয়া কণ্ঠস্বরে বলল সনাতন।

লতা বসেছিল ওই একই জায়গায়। জীবনে প্রথম মানুষ খুন করল সে। এতদিনের জমানো আগুন হঠাৎ জ্বলে উঠেছে।

তাকে কিছু ভাবার অবকাশ দিল না জনার্দন। প্রায় চুলের মুঠি ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল ফাদারের পাশে।

এবার সনাতন আর জনার্দন— দুজনেরই চোখ পড়ল সূর্যবাবুর ওপর।

–আসা থেকে আপনার মুখ থেকে একটাও কথা বেরোয়নি। খাওয়ার সময়েও খুব সাবধানে খাচ্ছিলেন। বেশি মুখ নাড়ালে বুঝি নকল দাড়িগোঁফ থাকবে না?

ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে গটগট করে তার দিকে এগিয়ে গেল সনাতন।

সূর্যবাবু আচমকা তার লাঠিটা ছুড়ে ফেলে দিল ঘরের আরেক কোণে। পাঞ্জাবি তুলে কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে ফেলল সূর্য মিত্র। সেই পিস্তল সোজা সনাতনের দিকে তাক করা। চোখের পলকে সনাতনের বন্দুক থেকে আচমকা গুলি ছুটে গেল। সেই গুলি সোজা গিয়ে লাগল সূর্যের হাতে। পিস্তল ছিটকে পড়ল।

–শুধু শুধু চালাকি করার চেষ্টা করছেন আপনি।

সূর্য সনাতনকে এক ধাক্কা মেরে পালানোর চেষ্টা করতে গেল। সনাতনের ওই চেহারাতেও আসুরিক শক্তি। সূর্যর গলা চেপে ধরে দেওয়ালে ঠেসে দিল তাকে সনাতন। এবং একটানে দাড়িগোঁফ খুলে ফেলল তার।

–মাই গড! সূর্য মিত্র! আর্তনাদ করে উঠল জনার্দন।

এর ফাঁকেই দরজার কাছে একটা আওয়াজ।

জয়চাঁদ পালিয়েছে।

–পালাতে দেবেন না ওকে। ধরুন!

চিৎকার করে উঠল সনাতন।

জনার্দন দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে নামতে গিয়ে হোঁচট খেল জনার্দন দুবার। কিন্তু সামলে নিয়ে নামতে থাকল।

কোনও মতে দালানে পৌঁছে জয়চাঁদকে দেখতে পেল জনার্দন।

জয়চাঁদ মাথার ওপর দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে।

তার সামনে দাঁড়িয়ে একটা লোক। লোকটার মুখ চেনা চেনা লাগল জনার্দনের। সে জয়চাঁদের পিছন থেকে পিস্তল বাগিয়ে এগোতে চেষ্টা করল। কিন্তু আচমকা একটা আকাশ কাঁপানো শব্দ।

তার কানের একদম পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে একটা গুলি। কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল জনার্দনের।

–নামিয়ে রাখুন পিস্তলটা!

গর্জে উঠল জয়চাঁদের সামনে দাঁড়ানো লোকটা।

এত কাছ দিয়ে গুলি বেরনোয় মাথা পরিষ্কার হয়ে গেল জনার্দনের। জেল থেকে পালানো আসামীদের প্রত্যেকের স্কেচ টাঙানো ছিল লালবাজারে, উডপেক সাহেবের ঘরে।

এই লোকটা পালিয়েছিল স্বদেশিদের সঙ্গেই। ভয়ঙ্কর খুনে এই লোকটা।

লোকটার নাম প্রমথরঞ্জন।

 

আবার আগামী সংখ্যায়

___

তারান্তিনো-র সব কটি পর্বের জন্য ক্লিক করুন: তারান্তিনো — প্রিয়ক মিত্র

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...