Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

“সংবিধানের প্রহরী হিসেবে বিচারব্যবস্থার গুরুত্ব কমে গেল”

বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য

 

রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলায় ভারতের শীর্ষ আদালতের রায়দানের পর চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর তরফ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল বাম রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য-এর সঙ্গে। পত্রিকার তরফ থেকে নানা প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানালেন।

সবচেয়ে প্রথমে আপনার কাছ থেকে জানতে চাইছি, সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটা কী?

আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এই রায় ভারতবর্ষের সংবিধানের যে মূল নীতি, অর্থাৎ  ধর্মনিরপেক্ষতা, তার বিরোধী। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, তিনি সরকারকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে তুমি একটা মন্দির তৈরি করো, এটা তিনি করতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, এটা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে ওই স্থানে একটি মসজিদ ছিল। এখন জায়গাটি কার মালিকানা বা কার মালিকানা নয়, পাঁচশো বছর পরে তা ঠিক করতে বসা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের কারওই উচিত হয়নি, প্রয়োজনও ছিল না। ২০১৯-এ পৌঁছে সেটা করতে গেলেই ভুল হওয়ারই কথা এবং এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তৃতীয়ত, এই রায়ের ফলে দেশের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা অনেক বেশি প্রশ্রয় পেয়ে গেল। তারা এখন উৎসাহিত হয়ে দেশের নানা জায়গায় মসজিদ বা গির্জাকে ভেঙে ফেলে সেটা কোনও প্রাচীন মন্দির হিসেবে দাবি করে বসবে। সেখানে তারা অনেকদিন ধরেই পূজার্চনা করত এই যুক্তিতে হয়তো আরেকটা মামলা লাগিয়ে দেবে। সেই মামলা দীর্ঘায়িত হবে এবং অশান্তি বাড়বে। মোটের ওপর, এই রায় নতুন করে সমস্যা সৃষ্টির একটা উপাদান হয়ে রইল।

বেশ। এই প্রসঙ্গে একটা বিষয় সম্বন্ধে জানতে একটু কৌতূহল হচ্ছে৷ এই মামলায় স্বয়ং রামলালা একটা পক্ষ ছিলেন৷ এটা কীভাবে সম্ভব হল? দেবতা, যিনি একটি কাল্পনিক বা পৌরাণিক চরিত্র, তিনি নিজেই নিজের মামলা লড়ছেন, আইনে কি এইরকম কোনও ব্যবস্থার কথা বলা আছে?

আপনি দেখবেন, পূর্বে অনেকেই নিজের সম্পত্তি দেবোত্তর হিসেবে মন্দিরে দান করতেন, যেমন ধরুন কোনও বৈষ্ণব তাঁর স্থাবর সম্পত্তি, জমি-জমা ইত্যাদি রাধামাধব জিউ-এর মন্দিরকে দান করলেন। সেখানে ওই মন্দিরটাই সম্পত্তির মালিক। সেক্ষেত্রে মন্দির বা অধিষ্ঠিত দেবতাকেই একটা আইনি সত্তা ধরা হয়, যেহেতু তাদের উদ্দেশ্যেই সম্পত্তির মালিকানা দেওয়া হয়। সেই সম্পত্তির লালনপালন করেন সেবায়েতরা, কিন্তু সেই সম্পত্তি বিক্রি করার অধিকার তাদের থাকে না। অর্থাৎ মন্দিরের ‘deity’ বা বিগ্রহ বা মূর্তি, সম্পত্তির ওপর তাঁর একটা অধিকার থাকে, যদি সেই সম্পত্তি তাঁর নামে দান করা হয়ে থাকে। ঠিক তেমনিভাবেই এই মামলার ক্ষেত্রে রামলালা একটি ‘entity’ হিসেবে থাকতেই পারেন, কিন্তু রামলালাকে যে কেউ ওই সম্পত্তি দান করেছিল তার তো কোনও প্রমাণপত্র নেই, ফলে এক্ষেত্রে তাঁর অধিকারও প্রমাণ করা যায় না।

আচ্ছা, মামলার রায়ে এক বিচারকের বয়ানে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে৷ অযোধ্যার ওই বিতর্কিত স্থানে শ্রীরামচন্দ্র জন্মেছিলেন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু নাকি এই বিশ্বাস পোষণ করেন। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে৷ আদালত কি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত কোনও বিশ্বাসের ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন?

পারেন, যদি সেই বিশ্বাসের কোনও বস্তুগত ভিত্তি থাকে। যেমন ধরুন, সূর্য পূর্বদিকে ওঠে এটা একটা বিশ্বাস। কিন্তু এই বিশ্বাসের বস্তুগত ভিত্তি আছে। এটা বোঝা যায়। কিন্তু যে বিশ্বাসের কোনওরকম বস্তুগত ভিত্তি নেই, তার উপর নির্ভর করে এই ধরনের রায়দান এক সাঙ্ঘাতিক বিপজ্জনক ঝোঁক।

তাহলে খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই রায়ের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

সুপ্রিম কোর্ট এই রায়দানের মাধ্যমে দুটি অপরাধ করেছে। এক, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে আঘাত করেছে। এবং দুই, মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছে।

আরেকটু নির্দিষ্টভাবে জিজ্ঞেস করছি, আমাদের গণতন্ত্রে সুপ্রিম কোর্ট বা সাধারণভাবে বিচারব্যবস্থাকে আমরা সংবিধানের প্রহরী বলে মনে করতাম, এই রায় কি সেটাকে ব্যর্থ করে দিল না?

সেটাই আমাদের বক্তব্য। বিচারব্যবস্থাই ছিল মানুষের শেষ আশ্রয় যেখানে সাধারণ মানুষ সরকারের সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে খানিকটা রেহাই পেতে পারত। কালকের রায়ের পর দেখা যাচ্ছে বিচারব্যবস্থা তাদের সেই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।

একজন আইনজীবী হিসেবে আপনার কাছে কী মনে হয়, মন্দির বা মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কি এমন কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারত, যাতে ধর্মনিরপেক্ষতাও বজায় থাকে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তির বাতাবরণও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়? যেমন ধরুন অনেকেই ওই জায়গায় হাসপাতাল বা স্কুল তৈরি করার কথা বলছেন…

অবশ্যই করা যেত। আমি তো বলব মন্দির-মসজিদ বাদ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ওখানে একটা জয়েন্ট মেমোরিয়াল তৈরির কথাও বলতে পারতেন, সেটাও মেনে নেওয়া যেত। সুপ্রিম কোর্ট তার বদলে যা করলেন, সরকারকে মন্দির তৈরি করার ব্যবস্থা করে দিতে বললেন, সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

এবং এই রায় কি কোনওভাবে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আরও বেশি সন্ত্রস্ত, কোণঠাসা করে ফেলল না? তাদের মনে একটা আশঙ্কা আসতেই পারে, এই দেশে সংখ্যালঘুদের সম্ভবত আর সুবিচার পাওয়ার আশা নেই…

শুধু তাই নয়, আপনি মোটেই আশ্চর্য হবেন না যদি আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই দেখেন দেশের কোথাও কোনও মসজিদ বা গির্জা ভেঙে ফেলা হল..। বরং আরও বেশি বেশি করে এসব করা হবে। যেহেতু সামাজিকভাবে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ, বেকারত্ব ও অশিক্ষা এখনও আমাদের মূল সমস্যা, এসব থেকে মানুষকে বিপথে পরিচালিত করার জন্য এইসব সমস্যাগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা।

আপনার কাছে আমাদের শেষ প্রশ্ন। আইনি দিক থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তো তাঁদের রায় শুনিয়ে দিয়েছেন। এরপর কি অন্য কোনও উপায় আছে এটাকে নিয়ে এগোনোর, রিভিউয়ের আবেদন করে বা অন্য কোনওভাবে সুবিচার পাওয়ার কি কোনও আশা আছে এই মামলায়?

আমার এ বিষয়ে রীতিমতো সন্দেহ আছে। বর্তমান বিচারপতিদের বোধের যা মান, রিভিউ করে এই মামলায় আর কোনও লাভ আছে বলে আমি মনে করি না। বলা যেতে পারে, চূড়ান্ত অবিচারেই এই মামলাটির নিষ্পত্তি হল।