![bikash@soli](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/05/bikash@soli.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য
আইনজীবী, বামপন্থী রাজনীতিক
সোলি সোরাবজি ছিলেন বম্বের পার্সি গ্রুপের অন্যতম বিখ্যাত একজন আইনজীবী। বম্বে হাইকোর্টের এক অত্যন্ত নামকরা আইনজীবী, জামশেদজি কাঙ্গা-র চেম্বারে জুনিয়র হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন। তিনি আরেক বিখ্যাত আইনজ্ঞ পালকিওয়ালার সঙ্গেও কাজ করেছিলেন। পরবর্তীকালে সোলি সোরাবজি দিল্লিতে চলে আসেন। মোরারজি দেশাই যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, সোলি সোরাবজি অ্যাডিশনাল সলিসিটর জেনারেল হন। বিখ্যাত কেশবানন্দ ভারতী মামলাতে তিনি আইনজীবী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য এই মামলায় মূল আর্গুমেন্ট করেছিলেন আইনজীবী এল কে পালকিওয়ালা। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট যে তত্ত্বটি গ্রহণ করলেন, তা হল সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামোর তত্ত্ব৷ এই মামলায় রায় হয়েছিল যে সংবিধানের যে মূলগত পরিকাঠামো তাকে পরিবর্তন করার জন্য সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। এটা এক যুগান্তকারী রায়। এর পর সোলি সোরাবজি সলিসিটর জেনারেল হিসেবে এস আর বোম্মাই মামলায় হাজির হয়েছিলেন। সেখানেও তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ সওয়াল করেছেন। মূলত তিনি মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য পরিচিত আইনজীবী ছিলেন। বাজপেয়ি সরকারের সময় সোলি সোরাবজি ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছিলেন। সর্বসময় ও সর্বক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান ছিল মানুষের মৌলিক অধিকারের পক্ষেই। ভারতের অ্যাটর্নি জেলারেল হিসেবে তিনি জাতিসঙ্ঘের তরফে ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চেও মানবাধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছেন।
প্রয়াত স্নেহাংশুকান্ত আচার্য্যের কাছে একটা মজার ঘটনা শুনেছিলাম। কলকাতা হাইকোর্টে ইন্দিরাকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে একটা মামলা করা হয়। মামলাটা করেছিলেন কলকাতার একজন স্বনামধন্য আইনজীবী, সুব্রত রায়চৌধুরী। তখন সোলি সোরাবজি কলকাতায় এসেছিলেন সরকারের হয়ে সওয়াল করতে। মামলায় বিচারপতি ছিলেন টি কে বাসু। সোলি সোরাবজি মামলার আগে সুব্রত রায়চৌধুরীকে বলেছিলেন— “আমাকে জজ সম্পর্কে কিছু টিপস দাও।” সুব্রত রায়চৌধুরী মজা করে বলেছিলেন— “জজসাহেব একটু কানে কম শোনেন। তুমি চেঁচিয়ে কথা বোলো।” সোলি সোরাবজি বন্ধুর কথা শুনে সত্যিই চেঁচিয়ে চেঁচিয়েই তাঁর সওয়াল শুরু করলেন, যা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তাতে জজ বেশ খানিকটা বিরক্ত হন। তখন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সোলি সোরাবজি সুব্রত রায়চৌধুরীকে বললেন, “এটা কী হল? তুমি আমার লেগ পুল করলে কেন?” অর্থাৎ এঁরা যেমন কোর্টে দাঁড়িয়ে সওয়াল করতেন, তখনও তাঁদের সেন্স অফ হিউমরও ছিল প্রবল। এঁরা মূলত তাত্ত্বিক লড়াই করতেন, কোর্টে একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন, কিন্তু তার ছায়া কখনও ব্যক্তিগত সম্পর্কে পড়তে দেননি। সওয়াল চলাকালীন এই হিউমারের প্রকাশও ছিল সোলি সোরাবজির একটা বড় গুণ।
যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনওদিন সুযোগ হয়নি ওঁর সঙ্গে বা ওঁর বিরুদ্ধে আদালতে দাঁড়ানোর, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট করিডরে অনেকবার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। উনি মামলা লড়তেন, সেই মামলা আমরা মন দিয়ে শুনতাম। তাঁর সম্বন্ধে একটা কথাই বলা যায়— ব্রিলিয়ান্ট লইয়ার। ভারতবর্ষে যে কজন প্রথম সারির আইনজীবী এসেছেন, সোলি সোরাবজি নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম ছিলেন। মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষার প্রসঙ্গে তিনি আজীবন খুব সজাগ ছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে উনি শেষ যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাতে উনি দুঃখপ্রকাশ করেছেন যে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তিনি মন্তব্য করছেন আজকের আদালত সেই আগেকার দিনের মতো মানুষের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট তৎপর নয়। পাশাপাশি, আমাদের এক্সিকিউটিভরাও মানবাধিকার রক্ষায় যোগ্য ভূমিকা পালন করছেন না। ওঁর মূল বক্তব্যই ছিল বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা যেকোনও মূল্যে রক্ষা করতেই হবে। এটা দেশের বিচারপতিদের দায়িত্ব যে ভারতের সংবিধানকে রক্ষা করার জন্য তাঁদের যে স্বাধীন অধিকার দেওয়া আছে, তা তাঁরা কার্যকর করেন। সেটা যে ইদানিং সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে না তা তাঁর দুঃখের কারণ ছিল। পাশাপাশি, তিনি এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে আইনজীবীদের পক্ষে থেকে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে নানা প্রসঙ্গে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গত নয়। এর ফলে বিচারপতিদের প্রতি অযথা একটা অনাস্থার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এটাও উচিত নয়। অর্থাৎ বিচারব্যবস্থার দুটো দিকের চ্যুতি নিয়েই তিনি খুব ওয়াকিবহাল ও যথেষ্ট ক্রিটিকাল ছিলেন। কিছুদিন আগে আরেক প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল অশোক দেশাই চলে গেলেন। এখন শুধু ওঁদের সমসাময়িক ফলি নরিম্যান বেঁচে আছেন। সোলি সোরাবজির প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় আইনব্যবস্থার একটা গৌরবময় যুগ শেষ হয়ে এল।
*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত