সোলি সোরাবজি ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করে গেছেন

অশোক কুমার গাঙ্গুলী

 



সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান

 

 

 

সোলি সোরাবজি আইনজ্ঞ হিসেবে খুবই উঁচু মানের ছিলেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি দু-বার ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছিলেন, যা অত্যন্ত সম্মানের বিষয়। সাংবিধানিক আইনে সোলি সোরাবজি প্রথম সারির বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি আজীবন নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, সেই সংক্রান্ত নানা মামলায় বহুবার সওয়াল করেছেন। এই বিষয়ে তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছিল। তাঁর সময়ের বেশিরভাগ যুগান্তকারী মামলায় সোলি সোরাবজি অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিখ্যাত কেশবানন্দ ভারতী মামলায় তাঁর অবদান ছিল। মানেকা গান্ধি মামলায় তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিহোটো হলোহান নামে একটা মামলা হয়েছিল, সেখানে স্পিকারের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সংবিধানের দশম অনুচ্ছেদে দলবিরোধী কার্যকলাপ ঠেকানোর জন্য স্পিকারকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে তা নিয়ে সোলি সোরাবজি গুরুত্বপূর্ণ সওয়াল করেছিলেন। এরপরে এস আর বোম্মাই মামলায় সোলি সোরাবজির মস্তিষ্কপ্রসূত সওয়াল পরবর্তীকালে আইন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই মামলার আগে বিভিন্ন রাজ্যে যেভাবে খেয়ালখুশিমতো রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হত, এখন আর সেভাবে করা যায় না। বোম্মাই মামলার পর অনেকগুলি রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন কার্যকর হওয়ার পরিস্থিতি সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট জানায় যে একটা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে যখন ইচ্ছে ফেলে দেয় যায় না। আদালতে এই রায়ের সূত্রপাত এই এস আর বোম্মাই মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই। এই রায়ের ক্ষেত্রে সোলি সোরাবজির মুখ্য ভূমিকা ছিল। তিনি ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করে গেছেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা হয়েছিল কার্গিল যুদ্ধের সময়। একটি পাকিস্তানি বিমান ভারতের সীমানায় ঢুকে পড়ার কারণে ভারতীয় সেনা সেটাকে গুলি করে নামায়। তা নিয়ে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছিল। সেই মামলায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন সোলি সোরাবজি। তিনি ভারতের তরফে সওয়াল করে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে সেই মামলা খারিজ করে দিয়েছিলেন।

সোলি সোরাবজির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা হল অরোভিল মামলা। পণ্ডিচেরিতে অরবিন্দ আশ্রম সংক্রান্ত  মামলায় নাগরিকের ধর্মীয় অধিকারের ওপর সরকারি আইন কীভাবে ও কতটা হস্তক্ষেপ করতে পারে তার অত্যন্ত সুন্দর ও যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখা দিয়েছিলেন। এছাড়া দিল্লিতে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার গড়ে তোলার পেছনে ওঁর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা ছিল। সোলি সোরাবজি ওঁর তত্ত্বাবধানে খুব দক্ষ কিছু জুনিয়র তৈরি করছিলেন যাঁদের মধ্যে গোপাল সুব্রমনিয়াম, বিচারপতি সালভে অন্যতম।

মানবাধিকার রক্ষায় সোলি সোরাবজির ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য৷ তিনি জাতিসংঘের প্রতিনিধি হয়ে আফ্রিকায় গিয়েছিলেন ও সেখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কলকাতার আইনজীবী সমাজের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। কলকাতা হাইকোর্টের দেড়শো বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে তিনি এখানে এসেছিলেন। আমাদের সকলের সঙ্গে অনুষ্ঠানে অংশও নিয়েছিলেন।

ব্যক্তি হিসেবেও সোলি সোরাবজি খুব উদার মনের মানুষ ছিলেন৷ অত্যন্ত সজ্জন ও সুভদ্র। আমি যখন সুপ্রিম কোর্টে যাই, আমি তাঁকে পেয়েছি, যদিও তখন তাঁর আশি বছরের কাছাকাছি বয়স। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল অবধি আমি সুপ্রিম কোর্টে ছিলাম। সেই সময়কালে আমার সামনে উনি গোটা তিন-চারেক মামলায় সওয়াল করেছেন। অন্যান্য বড় বড় বিচারপতিদের এজলাসেও মামলা লড়েছেন। ২০১০ সালে ওঁর ৮০ বছরের জন্মদিনে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল, আমিও সেখানে আমন্ত্রিত ছিলাম। সকলে মিলে খুব আনন্দে কেটেছিল সেই সন্ধেটা যার মধ্যমণি ছিলেন সোলি সোরাবজি। উনি খুবই আমুদে ও দিলখোলা গোছের মানুষ ছিলেন। তিনি জ্যাজ সঙ্গীতের সমঝদার ও ভক্ত ছিলেন। সোলি সোরাবজির কাছে জ্যাজ রেকর্ডের অসাধারণ সংগ্রহ ছিল। আমি অনেকবার ওঁর বাড়িতে গিয়েছি। ওঁর বাড়িতে গেলে উনি তাঁকে নিজের ল লাইব্রেরিটা দেখানোর আগেই জ্যাজ সঙ্গীতের সংগ্রহটা দেখাতেন। দেখা হলেই উনি আমাকে ওঁর বাড়ি যেতে বলতেন, আমিও অবসর নেওয়ার পরে ঘন ঘন যেতাম। হোস্ট হিসেবেও উনি অসাধারণ ছিলেন। সন্ধেবেলা সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ আমি যেতাম, ওঁর জ্যাজ লাইব্রেরিতেই আমরা বসতাম। ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় অনেক মজার গল্প, ঘটনার কথা জানতে পেরেছি। অটলবিহারী বাজপেয়ির সঙ্গে ওঁর খুবই সখ্যতা ছিল। অটলবিহারী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সেই সময়কার অনেক অ্যানেকডোটস ওঁর কাছে শুনেছি যা অবশ্য প্রকাশ্যে বলাটা ঠিক হবে না। সোলি সোরাবজির মাপের একজন মানুষের সঙ্গে কাটানো সেইসব মুহূর্তে আমার কাছে মধুর স্মৃতি হয়ে থাকবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...