বাংলার রায়: স্বস্তি ও অস্বস্তি — পঞ্চম বর্ষ, প্রথম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

ভারতীয় জনতা পার্টি ও সংযুক্ত মোর্চাকে প্রত্যাখ্যান করিয়া, অবশেষে বাংলার মানুষ আগামী পাঁচ বৎসরের জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের হস্তেই রাজ্যশাসনের ভার ন্যস্ত করিলেন। নির্বাচকমণ্ডলীর এই রায় একদিকে যেমন সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন, অন্যদিকে তেমনই সুদূরপ্রসারী— রাজ্যের সীমা অতিক্রম করিয়া এই জনাদেশের তাৎপর্য যে আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতিকেও বহুলাংশে প্রভাবিত করিবে, তাহা অনুমান করিয়া লইতে বিন্দুমাত্রও অসুবিধা হয় না। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই সংখ্যাটি যখন আপনাদিগের হস্তে পঁহুছিবে, ততক্ষণে উপর্যুপরি তৃতীয়বারের জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণ সুসম্পন্ন হইয়াছে। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পক্ষ হইতে— রাজ্যের সকল অধিবাসীর পক্ষ হইতেও— তাঁহাকে আমাদিগের সানন্দ অভিবাদন ও শুভেচ্ছা। নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে পরাজিত হইবার কারণে, নিয়মানুসারে, তাঁহাকে আসন্ন ছয় মাসের মধ্যে অপর কোনও আসন হইতে নির্বাচিত হইয়া আসিতে হইবে— আমাদিগের বিশ্বাস, সেই প্রক্রিয়া যথাকালে, নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হইবে।

এবারের বিধানসভা নির্বাচনের রায়ের মতোই প্রাক্‌-নির্বাচনী সময়কালটিও ছিল নানা কারণেই অভিনব, এবং নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিও যে তদপেক্ষা কম অভিনব হইবে না তাহা ভাবিবার সঙ্গত কারণ রহিয়াছে। বস্তুত, তেমন ইঙ্গিত ইতোমধ্যেই মিলিতে শুরু করিয়াছে। কিন্তু সে-প্রসঙ্গে খানিক পরে আসা যাইবে। পাঠকের স্মরণে থাকিবে, রাজ্যে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার পূর্ব হইতেই নির্বাচনী উত্তাপ ক্রমশ ঘনাইয়া উঠিতেছিল, এবং নির্ঘণ্ট প্রকাশের অব্যবহিত পর হইতেই তাহা ক্রমে চূড়ান্ত সংঘর্ষের দিকে যাইতে শুরু করে।

পশ্চিমবঙ্গ দখল করিবার জন্য বিজেপি এইবার দৃশ্যতই সর্বস্ব পণ করিয়াছিল— ভোটের প্রচারে সর্বশক্তি নিয়োগ করিবার পূর্ব হইতেই শাসকদলের নেতৃবর্গকে একের পর এক মামলায় জড়াইয়া এবং অতীতের হিমায়িত মামলাগুলিকে জিয়াইয়া তুলিয়া তাঁহাদিগের ঘুম কাড়িয়া লওয়ার বন্দোবস্ত পাকা হইয়াছিল। এই কার্যে সিবিআই ও ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সি-কে যেমন তাহারা নির্লজ্জ ব্যবহার করিয়াছে, তেমনই ভোটঘোষণার পর হইতে গণনা ও ফলপ্রকাশের কাল পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে কার্যত নিজেদের আজ্ঞাবহ তল্পিবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করাইয়া নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মৌলিক নিরপেক্ষতাকেই নস্যাৎ করিয়া দিয়াছে। বস্তুত, রাজ্যে আটদফায় নির্বাচনের অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত হইতে শুরু করিয়া প্রতিটি পর্যায়েই নির্বাচন কমিশনের একের পর এক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এমনকী সাধারণ মানুষের কাছেও এই বার্তা স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে যে, স্বাধীন এই প্রতিষ্ঠানটি নামেই স্বাধীন— কার্যক্ষেত্রে বিজেপি-র আত্মার সম্প্রসারণমাত্র। গত দু মাস ধরিয়া শান্তিরক্ষার কার্যে নিযুক্ত কেন্দ্রীয় বাহিনির ভূমিকা লইয়াও জলঘোলা কম হয় নাই— কোচবিহারের শীতলখুচির ঘটনা সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে আসিয়াছে, এবং কেন্দ্রীয় বাহিনির বিনা প্ররোচনায় প্রাণঘাতী গুলিচালনার ঘটনা দেশব্যাপী নিন্দা কুড়াইয়াছে।

এইখানেই শেষ নহে— দেশের প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দলের সর্বভারতীয় প্রধান, একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, উত্তরপ্রদেশ ও অন্যান্য বিজেপি-পরিচালিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের প্রচারের নামে কার্যত এ-রাজ্যে ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করাইয়া ও দলের আইটি সেল-এর প্রধানকে তিনমাসের জন্য এই রাজ্যে পাকাপাকি মোতায়েন করিয়া দিয়া বিজেপি প্রমাণ করিয়াছে— পশ্চিমবঙ্গ নামক অঙ্গরাজ্যটি তাহাদের যে কোনও মূল্যে না-জিতিলেই চলিতেছে না— তাহার জন্য দেশের অন্যান্য সমস্যা আপাতত চুলায় যাইলে যাউক— করোনা-মহামারিতে দেশ ফৌত হইয়া যায়, সে-ও ভি আচ্ছা, কিন্তু ‘সুনার বঙ্গাল’ তাহাদিগের চাই-ই চাই! সুশাসনের পথে প্রধানতম অন্তরায়ের তালিকা আলোচনা করিতে বসিয়া অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা প্রায়শই ‘মিসপ্লেস্‌ড প্রায়োরিটি’-র কথা বলিয়া থাকেন— বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গে প্রচারের অছিলায় অতিমারিগ্রস্ত দেশের স্বার্থ দেশনায়কগণ যেই প্রকারে সমূলে বিসর্জন দিয়াছেন, তাহা এই-সংক্রান্ত আলোচনায় প্রশাসনিক অপদার্থতার একটি কেস স্টাডি হিসাবে অচিরাৎ পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূত হইতে পারে।

এত কাণ্ডের পরে রাজ্যবাসীর একাংশের, এমনকী দেশবাসীরও, প্রতীতি জন্মিয়াছিল— বিজেপি-র এমন সর্বগ্রাসী আয়োজন নিতান্তই বিফলে যাইবে না। সে ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও ঘৃণানির্ভর সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের নগ্ন, ন্যক্কারজনক চেহারাটি অনতিদূর ভবিষ্যতে রাজ্যকে গ্রাস করিবে— তাহা কল্পনা করিয়া রাজ্যবাসীর আতঙ্কের অন্ত ছিল না। ভোটের ফলে এ-কথা নিঃসংশয় রূপে প্রমাণিত যে, সেই আশঙ্কা হইতেই রাজ্যবাসীর বৃহদাংশের ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটবাক্সে একত্রিত হইয়াছে— কংগ্রেস বা বামেরা বিজেপি-কে আটকাইতে সমর্থ না-ও হইতে পারেন, এমত ভাবনা হইতে সেইসব দলের সমর্থকদের একটা বড় অংশও ‘সময়ের দাবি মানিয়া’ তৃণমূল কংগ্রেসকেই সমর্থন দিয়াছেন। ভোটের ফলের যে চিত্র গত দোসরা মে তারিখে সামনে আসিয়াছে, তাহা হইতে পরিষ্কার— এই জনাদেশ যত না তৃণমূলের কৃতকর্মের প্রতি প্রশ্নাতীত সমর্থনের পরিচায়ক, তদপেক্ষা অনেক বেশি করিয়া বিজেপি-র উত্থানকে আটকাইবার সর্বাত্মক চেষ্টার প্রতিফলন। এবং এই সর্বাত্মক প্রয়াসে কেবল যে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই তৃণমূলের পাশে দাঁড়াইয়াছে তাহা নহে, বস্তুত হিন্দু ভোটের এক উল্লেখযোগ্য অংশও তাহাদের পক্ষে গিয়াছে। এমনকী, প্রধানমন্ত্রীর ওড়াকান্দি-নাট্যেও বহ্বারম্ভেও লঘুক্রিয়া হইয়াছে— তাঁহার হাজার কুম্ভীরাশ্রু ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অমিত মিথ্যাশ্বাস সত্ত্বেও মতুয়া ভোটের একটি বড় অংশ তৃণমূলকে বিমুখ করে নাই।

অত্যন্ত বিচক্ষণতার সহিত রাজ্যের মানুষ তাঁহাদিগের রায় জানাইয়াছেন, এবং সেই রায়ে যাহাতে কোনওরূপ ধোঁয়াশা না-থাকে তাহাও সুনিশ্চিত করিয়াছেন। গত দুই মাসে তৃণমূল কংগ্রেসের একশ্রেণির সুবিধাবাদী নেতারা যেভাবে একের পর এক দল পালটাইয়া বিজেপি-র পক্ষে ভিড়িয়াছেন, তাহাতে আশঙ্কা ছিল, ফলপ্রকাশের পরে আরও নির্লজ্জ ঘোড়া-কেনাবেচা চলিবে— বিজেপি যদি কোনওক্রমে ম্যাজিক সংখ্যার কাছাকাছিও যাইতে পারে, তাহা হইলে অর্থবল কাজে লাগাইয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পঁহুছিবার পক্ষে প্রয়োজনীয় অবশিষ্ট মাথাগুলি তাহারা সহজেই ক্রয় করিয়া লইবে। কার্যক্ষেত্রে বিজেপি-কে তিন অঙ্কে পঁহুছিতে না-দিয়া সেই সম্ভাবনায় সমূহ জল ঢালিয়া দিয়া বঙ্গবাসী প্রমাণ করিয়াছেন, সম্ভাব্যতার অঙ্ক তাঁহারাও কিছু কম বুঝেন না— বস্তুত বিজেপি-র চাণক্য বলিয়া কথিত অমিত শাহজি-র তুলনায় অনেক বেশিই বুঝেন। অন্য সব কিছু ছাড়িয়া দিলেও, কেবল এই উপলব্ধিটুকুর জন্যই তাঁহারা ধন্যবাদার্হ হইতে পারেন। দেশবাসীর চক্ষে বাঙালিদের এই পরিণতিবোধ ও বিচক্ষণতা ইতোমধ্যেই বহুল প্রশংসা ও শ্রদ্ধার উদ্রেক করিয়াছে— সারাদেশ বাংলার মানুষকে একবাক্যে ধন্য-ধন্য করিতেছে।

অপিচ, আবেগের আতিশয্যে, এই নির্ণয়ে হয়তো বা কিছু অতিসরলীকরণজনিত ভ্রান্তি রহিয়া গেল। ভুলিলে চলিবে না, রাজ্যের তখ্‌তে বিজেপি-র আসনগ্রহণ এ-যাত্রা আটকাইয়া দেওয়া গেলেও, ভোটারদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি— প্রায় ৩৮ শতাংশ— বিজেপি-কেই ভোট দিয়াছেন। এই সংখ্যাটির তাৎপর্য অতীব গভীর— ইহার অর্থ, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপি-আরএসএস তাহার শিকড় অনেকদূর গাড়িতে সক্ষম হইয়াছে। বস্তুত, এটি নিছক কোনও সংখ্যামাত্র নহে— আরএসএস-লালিত হিন্দুত্বের ভাবাদর্শ যে রাজ্যের কোণায়-কোণায় অপ্রতিহত গতিতে অগ্রসরমান, তাহার এক সুনিশ্চিত দ্যোতকও বটে। আশা, যে বিচক্ষণতার সহিত রাজ্যের মানুষ বিজেপি-র রথের চাকা মাটিতে বসাইয়া দিয়াছেন, সেই একই পরিণতমনস্কতা হইতে তাঁহারা এই বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটনে ব্রতী হইবেন।

অস্বস্তির আরও, বস্তুত অনেকই, কারণ রহিয়াছে। খানিক আগেই বলিতেছিলাম, এই রায় যত না তৃণমূলের প্রতি সমর্থনজনিত, তাহার তুলনায় অনেক বেশি করিয়া বিজেপি-কে আটকাইবার প্রয়াসের প্রতিফলন। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, গত ১০ বৎসরে তৃণমুল কংগ্রেস রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে কোনও গৌরবজনক উদাহরণ পেশ করিতে পারে নাই। প্রশাসনে ও দলের বিভিন্ন স্তরে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতিতে লাগাম পরানো সম্ভব হয় নাই, উলটাইয়া শাসক দলের সর্বোচ্চ হইতে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত দুর্নীতি ও দাদাগিরির অভিযোগ সরকারের মাথাব্যথার কারণ হইয়াছে। দুর্নীতির পাশাপাশি, সংখ্যালঘু-তোষণের পুরাতন অভিযোগ আরও জোরালো হইয়াছে। দলনেত্রী ইহাকে হিন্দু-আগ্রাসনবাদের বিপরীতে মুসলিম-ভোটব্যাঙ্ককে সংগঠিত রাখিবার মোক্ষম এক উপায় ভাবিয়া হৃষ্ট হইতে পারেন, কিন্তু রাজ্যবাসীর একটি বড় অংশের মতে, ইহাতে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে কার্যত দূরে ঠেলিয়া দিবার বন্দোবস্ত হইয়াছে এবং বিজেপি ইহার সুযোগ লইয়া হিন্দুদের মধ্যে সমর্থন বাড়াইয়াছে। সরকারের জনহিতকর প্রকল্পগুলি আপাত-অর্থে লোকপ্রিয়তা অর্জন করিলেও, সেগুলিকে সাধারণের সক্ষমতাবর্ধন ও সশক্তকরণের লক্ষ্যে ইতিবাচক পদক্ষেপ অপেক্ষা দীর্ঘমেয়াদে সরকারের মুখাপেক্ষী করিয়া রাখার প্রয়াস হিসাবে কেহ-কেহ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। সর্বোপরি, যথেচ্ছ দান-খয়রাতি করিতে গিয়া এই সরকারও তাহার আসল কৃত্যগুলি হইতে নজর সরাইয়া আরও এক ‘মিসপ্লেস্‌ড প্রায়োরিটি’-রই দৃষ্টান্ত পেশ করিয়াছেন। অর্থাৎ, বিজেপি-বিরোধিতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিকতা লইয়া প্রশ্ন না-উঠিলেও, তাঁহার রাজ্যশাসনদক্ষতা আদৌ প্রশ্নাতীত সাফল্যের দাবি করিতে পারে নাই। তথাপি মানুষ যে তাঁহাকে ঢালিয়া ভোট দিয়েছেন, তাহা কার্যত তাঁহারা জ্বলন্ত চুলা অপেক্ষা তপ্ত কটাহকে তুলনায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করিয়াছেন বলিয়াই— অন্য কোনও ইতিবাচক কারণে নহে। ফলত, অনতি-ভবিষ্যতে অ-বিজেপি কোনও শক্তি যদি সুশাসনের বিশ্বাসযোগ্য অ্যাজেন্ডা লইয়া মানুষের নিকট হাজির হয়, তখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আসল পরীক্ষার ক্ষণ উপস্থিত হইতে পারে। বাম-কংগ্রেস জোটের দুর্ভাগ্য, তাঁহারা সেই বিশ্বাসযোগ্যতার পরীক্ষায় ব্ল্যাঙ্ক পেপার জমা দিয়া মমতার কাজ সহজ করিয়া দিয়াছেন।

কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, রাজ্যের মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর হস্তে যে গুরুদায়িত্ব অর্পণ করিয়াছেন, তাহা কদাপি নিঃশর্ত নহে। সে দায়িত্ব তিনি কীভাবে পালন করিতেছেন, মানুষ তাহা অবশ্যই পুঙ্খানুপুঙ্খ নজরে রাখিবেন। শুরুতেই যে নির্বাচনোত্তর অশান্তির কথা বলিয়াছিলাম, শপথগ্রহণের পর সেই অশান্তি তিনি কত দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনিতে পারেন সেদিকে মানুষের লক্ষ থাকিবে। যেভাবে এই মুহূর্তে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হিংসার ঘটনা ঘটিয়া চলিয়াছে, যেভাবে কেবল রাজনৈতিক বিরুদ্ধতার কারণে একের পর এক প্রাণ যাইতেছে, তদ্বিষয়ে আশা করা যায় মুখ্যমন্ত্রী অবগত আছেন। তাঁহার নিকটে আমাদিগের প্রত্যাশা, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠিয়া প্রকৃত অর্থে এক জননেত্রীর ন্যায় তিনি আচরণ করিবেন, ও দলমতনির্বিশেষে অপরাধীদের চিহ্নিত করিয়া তাহাদিগের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। আগুন দিয়া আগুন নিভানো যায় না, এ-কথা তাঁহার অপেক্ষা অধিক আর কে জানেন? দলীয় স্বার্থকে অতিক্রম করিয়া প্রকৃত রাজধর্ম পালনের এক মস্ত সুযোগ তিনি পাইয়াছেন; আশা, তিনি তাহার যথোচিত মর্যাদা দিবেন।

একইসঙ্গে, রাজ্যে এই মুহূর্তে বাড়িয়া চলা অতিমারির দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে তাঁহার সরকার কত দ্রুত ব্যবস্থা লয়, তাহারও হিসাব লওয়া জারি থাকিবে। এই মুহূর্তে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় হাসপাতালের বেড, অক্সিজেন ও ঔষধ অপ্রতুল। একদিকে যেমন অসংখ্য ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ ও তরুণ ছেলেমেয়ে অসুস্থ সহ-নাগরিকগণের হস্তে সেই অপ্রতুল সুবিধা পঁহুছিয়া দিতে উদয়াস্ত প্রাণপাত করিতেছেন, ঠিক তখনই খবর আসিতেছে, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুতদার সেই মহামূল্য সামগ্রী লইয়া কালোবাজারি শুরু করিয়াছেন। রাজ্যবাসী নজরে রাখিবেন, নূতন সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করিয়া এ-বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতেছে কি না। বলা বাহুল্য, দেশ এখন এক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্য দিয়া চলিয়াছে। এমতাবস্থায়, নূতন সরকারের সামনে যে কোনও হনিমুন পিরিয়ড থাকিবে না— বস্তুত প্রথম দিন হইতেই অতি কঠিন এক প্রশ্নপত্র যে অপেক্ষা করিয়া থাকিবে— তাহা আর আলাদা করিয়া বলিবার অপেক্ষা রাখে না। আপন মন্ত্রিমণ্ডলী ও আমলাবৃন্দ সমভিব্যাহারে মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে সেই প্রশ্নপত্রের মোকাবিলা করেন, তাহা অবশ্যই দেখিবার বিষয়।

আরও একটি গুরুদায়িত্বের কথা মাথায় আসিতেছে। সদ্যোসমাপ্ত ভোটের ফল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি দেশের বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলির নিকট অপরিসীম শ্রদ্ধার উদ্রেক যেমন করিয়াছে, তেমনই জাতীয় স্তরে এক নয়া ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তি-অক্ষের সম্ভাবনার পথও প্রস্তুত করিয়াছে। সেই পথটি উচ্চাশাব্যঞ্জক ও গৌরবজনক তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু একইসঙ্গে, সেই পথে যাত্রা করিতে হইলে জাতীয় রাজনীতিতে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হইয়া উঠিবার দায়ও তাঁহার থাকিবে। সে দায় কেবল কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভায় আপনার গুটিকতক প্রতিনিধি গুঁজিয়া দিয়াই সমাপ্ত হইতে পারে না। ইতোপূর্বে ত্রিপুরা, অসম ও মেঘালয়ে তাঁহার সেই নিরীক্ষা বিপুলভাবে ব্যর্থ হইয়াছে। একইসঙ্গে, আগামী দিনে শিবসেনা, ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, বহুজন সমাজ পার্টি প্রমুখ আঞ্চলিক ও আপনাপন স্বার্থবাহী শক্তিগুলির সঙ্গে সমন্বয় করিয়া একটি ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচির ভিত্তিতে সেই বহুবর্ণ জোটকে আগাইয়া লইয়া যাওয়া সহজ কাজ নহে। কিন্তু, ভারতবর্ষ নামক দেশটি এখন যে অবস্থার মধ্য দিয়া চলিয়াছে, তাহাতে সম্ভাব্য দেশনেত্রীর জন্য সহজ পথ বলিয়া কিছু থাকিবে না— ইহাই স্বাভাবিক। সেই যাত্রায় তিনি কতদূর বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে নিজেকে পেশ করিতে পারেন, সেদিকে দেশবাসীর লক্ষ থাকিবে বই কী!

সুদীর্ঘ এই সম্পাদকীয় নিবন্ধের উদ্দেশ্য ছিল, আমরা চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পক্ষ হইতে কীভাবে সদ্যোসমাপ্ত ভোটপর্বটিকে মূল্যায়ন করিতেছি, সম্মুখবর্তী পথটিকেই বা কীরূপে দেখিতেছি, তাহার একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা। কিন্তু এই নিবন্ধে তাহার সবকটি দিক ও স্তর এবং তাহাদের সম্ভাব্য তাৎপর্যনিচয়কে আমরা স্পর্শ করিতে পারি নাই। বস্তুত, বিষয়টি এতই জটিল ও বহুবিস্তৃত যে, কোনও একটি নিবন্ধে তাহা সম্ভবও নয়। সেই বিধায়, আমাদিগের এই সংখ্যাটির কেন্দ্রীয় বিষয়-অভিমুখ হিসাবে আমরা এই একই বিষয়কে বাছিয়া লইয়াছি। এই ভোটপর্ব আমাদের কী দিল, কী কী শিখাইল, বস্তুত আদৌ কিছু শিখাইল কি না, এবং সর্বোপরি, সেই শিক্ষায় ভর করিয়া আগামী দিনে আমাদের রাজ্যটি কোন পথে চলিতে পারে— একাধিক নিবন্ধে তাহারই তথ্যনিষ্ঠ অনুসন্ধান জারি থাকিল। অনুরোধ— আপনারা আপনাদের সুচিন্তিত মতামত দিয়া এই আলোচনাকে প্রাণবান ও রসবতী করিয়া তুলিবেন।

পরিশেষে জানাই, গত পহেলা মে তারিখে এই ওয়েবপত্র পাঁচ বৎসরে পদার্পণ করিল। আপনাদিগের সহৃদয় সমর্থন, সহযোগিতা, সমালোচনা ও অক্লান্ত অংশগ্রহণ ব্যতীত এই যাত্রা কদাচ সম্ভব ছিল না। রাজ্যের নবগঠিত সরকারটি যে রূপ চেষ্টা করিবে বাংলাকে আগামী দিনে সর্বাঙ্গীন উন্নতি ও সুশাসনের উৎকর্ষবিন্দুতে পঁহুছিয়া দিতে, তেমনই আমাদিগেরও দায়িত্ব থাকিবে আগামী বছরগুলিতে এই কাগজটিকে আরও আগাইয়া লইয়া যাওয়ার। সে কাজ আমরা সম্যক পারিতেছি কি না, আপনারা নজরে রাখিবেন এবং সুপরামর্শ দিয়া আমাদের সাহায্য করিবেন— এ-ই প্রার্থনা।

প্রণাম ও শুভেচ্ছা জানিবেন।

ইতি।

 

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
অভীক ভট্টাচার্য,
চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4649 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...