Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

হাল ছাড়েনি জেএনইউ

কল্পক গুহ

 

গত কয়েকবছরে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে আক্রমণ অত্যন্ত নিয়মিত হয়ে পড়েছে। কখনও বিজেপি-আরএসএসের দ্বারা, আবার কখনও কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের বেসরকারিকরণের নীতির দ্বারা। এরকম একাধিক উদাহরণ আমরা দেখেছি। একদিকে সিবিসিএস-এর (Choice Based Credit System) মাধ্যমে বকলমে চেষ্টা চলছে কলেজগুলিতে বেসরকারিকরণের নীতি বাস্তবায়িত করার। আগের বছর ভারতের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকর হয়েছে সিবিসিএস সিস্টেম। প্রসঙ্গত, সিবিসিএস সিস্টেম কি?

  1. বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম নির্দেশিত হবে ইউজিসি দ্বারা পাঠক্রম গঠনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার থাকবে না।
  2. পার্সেন্টেজের বদলে CGPA/SGPA ব্যবহার করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে।
  3. বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম হবে সেমিস্টার সিস্টেম অনুসারে।
  4. ছাত্রছাত্রীরা যেকোনও ডিসিপ্লিন থেকে তাদের ইলেক্টিভ বেছে নিতে পারবে। এছাড়াও থাকছে সফট স্কিলের একটি করে কোর্স।

আপাতভাবে এই ব্যবস্থাকে অত্যন্ত ছাত্রদরদি মনে হলেও এটি আদতে তা নয়। কয়েকটি কলেজ বাদ দিলে এই ব্যবস্থা কার্যকর করে তোলা অত্যন্ত সমস্যাজনক।

অন্যদিকে অনুদান কমিয়ে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ছাত্রছাত্রীদের গবেষণাবিমুখ করে তোলারও চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ কলেজেই এই তথাকথিত অত্যাধুনিক ব্যবস্থা কার্যকর করে তোলার পরিকাঠামো এখনও নেই। এর প্রমাণ হিসেবে দেখা যায় যে কীভাবে পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ কলেজেই পরিকাঠামোর অভাবে সিবিসিএস সিস্টেম নিয়ে নাজেহাল অবস্থা। পরিকাঠামো তৈরি করা গেল, পরিকাঠামো উন্নত করবার নামে এরপরে ঘটবে ফি বৃদ্ধি। অর্থাৎ এই ধরনের তথাকথিত আধুনিক, উন্নত সিস্টেমকে ব্যবহার করা হচ্ছে বেসরকারিকরণের একটি হাতিয়ার হিসেবে। অন্যদিকে শাসকদল ক্রমাগত গবেষণা, শিক্ষা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে বিদ্বেষ তৈরি করছে। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্রছাত্রীদের নখদাঁত ভেঙে দেওয়া এবং তাদের গোপাল বালক তৈরি করা, এমন এক ছাত্রদল যাদের প্রতিবাদ করার সাহস থাকবে না, শাসকের সামান্য চোখরাঙানিতেই যারা ভয় পেয়ে যাবে। তবে আশার কথা, এখনও দেশের বিভিন্ন উৎকৃষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা এধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে, আজও বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখাচ্ছে। এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির একটি উদাহরণ অবশ্যই দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় বা জেএনইউ।

কিছুদিন আগে জেএনইউ-তে হোস্টেল-সংক্রান্ত নতুন নির্দেশিকা ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়। সেই নির্দেশিকাতে হোস্টেলে ঢোকার সময়ে জারি করা হয় কারফিউ, হোস্টেলে ছাত্রছাত্রীদের পোশাক ঠিক করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া হোস্টেলের ফি-ও বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়। কোথাও হোস্টেল ফি মাসে ২০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০০ টাকা হয়েছে, আবার কোথাও ১০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা। ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রভাবে ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ নানা কলেজের নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে একটা মনে রাখা প্রয়োজন, ছাত্রছাত্রীদের জীবনে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে একাধিকবার বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে উঠেছে, যেমন ১৯৬৮  সালে ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলন প্রাথমিকভাবে ছাত্ৰছাত্রীদের দাবি নিয়ে শুরু হয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত সরকারবিরোধী এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল।

ফি বৃদ্ধির ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি বৃদ্ধি হয়েছে। কিছুদিন আগে আইআইটিগুলিতে প্রায় ৯০০ শতাংশ ফি বৃদ্ধি ঘটেছিল। যত দিন যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ফি বৃদ্ধির ঘটনা অত্যন্ত সাধারণ হয়ে পড়েছে, পাশাপাশি কমে যাচ্ছে গবেষণাখাতে সরকারের বাজেট। সরকারের মদতে ক্রমাগত চলছে বেসরকারিকরণের তীব্র ষড়যন্ত্র, কর্পোরেটদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই পাশ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক শিক্ষাবিল। এই ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে দিকে দিকে একত্রিত হয়ে, ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে ছাত্রছাত্রীরা। কখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিবিসিএস বিরোধী আন্দোলন, আবার কখনও জেএনইউ-তে হোস্টেল ফি বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন। আর এইসব আন্দোলন আজ এই ফ্যাসিস্ট সময়েও আমাদের স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছে।

হোস্টেল ফি বৃদ্ধির ঘটনা এবং হোস্টেলে ছাত্রছাত্রীদের ওপর অগণতান্ত্রিক ফরমান জারি করার বিরুদ্ধে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্র ইউনিয়নের ডাকে ছাত্রছাত্রীরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। এই অগণতান্ত্রিক ফরমান জারি করা হয় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া। আসলে ভারতবর্ষের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়তেই ছাত্রছাত্রীদের মতামতের গুরুত্ব খর্ব করার চেষ্টা চলছে, যার উদাহরণ হিসেবে আমরা দেখব পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলিতে দীর্ঘ দুবছর ধরে কোনও ইউনিয়ন নেই, বারবার লাগু করার চেষ্টা হয়েছে দালাল কাউন্সিল মডেল। (দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিয়ন ইলেকশনের নোটিস বেরিয়েছে)।

জেএনইউ-র আন্দোলন ছিল অগণতান্ত্রিক ফরমানের বিরুদ্ধে, ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, বেসরকারিকরণের নীতির বিরুদ্ধে, শিক্ষার অধিকারের দাবিতে। প্রায় দশদিন ধরে ছাত্রছাত্রীদের তীব্র আন্দোলন চলে। এরকম অবস্থায় গত ১১ই নভেম্বর ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদের ওপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণ নেমে এল। প্রতিবাদ দমনের জন্য ব্যবহৃত হল জলকামান, চলল লাঠিচার্জ, নামল আধা-সামরিক বাহিনী। সাধারণ মানুষ, পড়ুয়াদের আন্দোলনে এভাবেই বারবার নেমে এসেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি কোনও সরকারের ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে আন্দোলনকারীদের লড়াকু মনোভাবের সামনে শাসকের জলকামান অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যায়, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দমিয়ে দিতে পারে না ছাত্রছাত্রীদের স্পৃহা। এক্ষেত্রেও সেকারণেই কর্তৃপক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হয়। অর্থনৈতিকভাবে দুঃস্থ পড়ুয়াদের জন্য কমানো হয় হোস্টেল ফি। তবে এটা আংশিক জয়। শিক্ষা কোনও কর্তৃপক্ষ বা সরকারের দয়া নয়, সেটা সকল ছাত্রছাত্রীদের অধিকার। তাই যতদিন না সকল দাবিগুলো আদায় হচ্ছে অধিকার ছিনিয়ে আনার লড়াই চলবে। শুধু জেএনইউ নয় যেখানে যেখানে সরকার সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ নামাবে, সেখানে শোষিত মানুষ নিজেদের অধিকারের দাবিতেই পথে নামবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।

জেএনইউ-র আন্দোলনে বিবেকানন্দের স্ট্যাচু বিকৃতির ঘটনা অন্যতম বিতর্কিত বিষয় হয়ে থেকেছে। গত ১৪ই নভেম্বর বিবেকানন্দের মূর্তি বিকৃত করা হয়। বিবেকানন্দের স্ট্যাচু বিকৃতির দায় ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে আন্দোলনের নামে কুৎসা চালাচ্ছে দাঙ্গাবাজরা। এইখানে এই ফ্যাসিস্টদের কার্যকলাপ বারবার মনে করিয়ে দেয় তিরিশের দশকের জার্মানির স্মৃতি। রাইখস্ট‍্যাগ আজও ঘটে।

এই প্রসঙ্গে বলা যায় গত কয়েকদিন আগে বিজেপি সরকার বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে সিআইএসএফ জওয়ান মোতায়েন করে, যা থেকে স্পষ্ট সামান্য গণতান্ত্রিক পরিসরের জায়গাও রাষ্ট্র পড়ুয়াদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। তবে বিশ্বভারতীর পড়ুয়ারা এবং সমগ্র দেশের মানুষ এই বিজেপি সরকারকে তাদের সকল অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের জবাব দেবে, দিকে দিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, এ নিয়ে যেন কারও মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহও না থাকে।