Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তিনটি অণুগল্প

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

 

হিল-ভিউ

বেশ কয়েকবার, একটা হিল-টপ দেখেছি। ট্যুরিস্ট স্পট। সানরাইজ পয়েন্ট এবং সানসেট পয়েন্ট— দুটোই বলা যায়। লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে… অনেকটা ওপরে ঘুরে ঘুরে উঠতে হয় গাড়ি করে। অন্যান্য পর্যটকদের মোটামুটি ভিড়ও হয়। কিন্তু কোনওবারই সেখান থেকে সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয় দেখা হয়নি।

একবার দেখলাম মেঘলা।

একবার যেতে যেতেই সন্ধে হয়ে গেল, পৌঁছে দেখি আকাশ অন্ধকার।

আর একবার খুব বৃষ্টি। একটা রাস্তার ধারের দোকানে কফি খেলাম।

একবার গাড়ি দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া গেল না। যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম, সেখান থেকে হেঁটে ওপরে ওঠার আগেই সূর্য পাটে বসে গেল।

যে বার সব ঠিকঠাক হল… সেবার গিয়ে দেখলাম পশ্চিম দিকে একটা পাঁচতলা হোটেল। তারপর পূর্ব দিকেও দেখলাম একটা তিন-চারতলা হোটেল। আর তাদের মাঝে এদিক ওদিক এক-দোতলা আরও সব হোটেল আর লজ। ফাঁক-ফোকরে রেস্তোরাঁ, ক্যাফে। সূর্য উঠুক বা ডুবুক… দেখবটা কোন ফাঁক দিয়ে?

একজন পর্যটক বললেন “এই লজগুলো বেশি ভাল, ছাত থেকে হিলভিউ, গাছপালা, অর্কিড দিয়ে সাজানো… রাতে এখানে স্টে করে, কাল সকালে ফেরা যাবে।”

আমি বললুম, “সকালে কি তুড়ি মেরে এই সব আগাছা ভ্যানিশ করে দেওয়া হবে?”

লোকটা জিজ্ঞেস করল, “মানে?”

দেখলাম, সেই লোকটার মত আরও অনেকেই বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে এক একটা হোটেল আর লজের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সপরিবার, সবান্ধব, সস্ত্রীক।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সব গাড়িগুলো জায়গা মত পার্ক করে যে যার মত এদিক ওদিক কেটে পড়ল। দেখলাম একটা সাদা রঙের তিন-তলা হোটেলের সামনে খুব সুন্দর করে সাজানো বাগান। কিছু বাহারি গাছ ছেঁটে মাপ দিয়ে ব্যাঙের ছাতার মত ঢিবি ঢিবি করে রেখেছে। গাছগুলোর পাতা রঙিন। কোনওটা সিঁদুরে লাল, কালচে লাল, কোনওটা মেরুন, কোনওটা বেগুনি, কোনওটা বাদামি, কোনওটা হলদে-সবুজ ছিটছিট, কোনওটা নীলচে সবুজ। যে বাসে গেছিলাম, সে বাসের কেউই ফিরল না। আগে বুঝিনি, যে ওরা ওখানেই থাকতে গেছে।

নিজেকেই ব্যবস্থা করে একটা চলন্ত জিপ থামিয়ে ফিরতে হল।

ফেরার পথে মেঘ করল। বৃষ্টি হল। সন্ধে নেমে এল। পথের ধারে একটা চা-সিগারেটের দোকানে দাঁড়িয়ে কফি চাইলাম… চা দিল।

জিজ্ঞেস করলাম টাউনে পৌঁছতে এখান থেকে আর কতক্ষণ লাগবে। চায়ের দোকানের বউটা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। অন্য এক খদ্দের বলল “টাউন থেকেই তো আসছেন… টাউন পাহাড়ের ওপরে। নিচে কেউ থাকে না।”

কথাটা শুনে বোকার মত একবার ফেলে আসা পথের দিকে তাকালাম, যেটা পাহাড় থেকে নেমে এসেছে… আর একবার সামনের পথের দিকে তাকালাম যার দু’ধার আগাছা ঘেরা, ঝাপসা… জঙ্গলের দিকে গেছে। দু’দিকেই রাতের অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই।

 

***

–এর পর, এখনও অবধি ওই হিল-টপ পয়েন্টে বেড়াতে যাওয়ার কোনও স্বপ্ন আর দেখিনি। ওই শেষবার।
–এরকম আরও কোনও জায়গা আছে… যা একাধিক বার স্বপ্নে দেখেন?
–হ্যাঁ…
–যেমন?
–একটা রাস্তা… বাই-পাসের মত। বড় রাস্তার ভিড় কাটিয়ে একটা গলি দিয়ে বাই-পাসে এলেই রাস্তা ফাঁকা।
–আর?
–আর সেই রাস্তায় ছুটতে ছুটতে পা ভেসে ওঠে… টেক অফ করার মত। মাটি থেকে ছ’ ইঞ্চি ওপরে ভেসে চলে যাওয়া যায়। সেখানে সাইকেল চালানো কী সোজা! প্যাডেলই করতে হয় না! বৃষ্টির জলে কর্পূরের গন্ধ ভেসে আসে…
–না… মানে, ওই রাস্তা ছাড়া আর কী বার বার দেখেন?
–…
–কী হল?
–সেই সব কিছুই যা আপনি বাড়ি থেকে এখানে আসা আর যাওয়ার পথে প্রতিদিন দু’বার দেখেন… কিন্তু কোনওদিনই বুঝতে পারেন না, যে আপনি গতকাল যা দেখেছিলেন, আজ সেগুলো তেমন নেই। যাওয়ার পথে যেমন দেখেছেন, ফেরার পথে আর তেমন নেই।
–…
–নোট করে রাখবেন?… সেই না-দেখাগুলো? যেভাবে আমার দেখাগুলো নোট করে রাখেন?

 

চুমকি

ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল।

বুলডোজার দিয়ে আগাছা সরাচ্ছে। যেখানে অনেকটা জমি শিল্পবিপ্লবীকে যৌতুক দেওয়া হয়, সেখানে বড় নিমগাছের পরিবারও আগাছা। গোটা দশেক ময়ূর ছিল, মানে… এখনও আছে। বনবিভাগকে দিতে পারে, পালক ছাড়িয়ে খেয়েও নিতে পারে।

চারদিক থেকে ভেসে আসা কনস্ট্রাকশনের ধাতব শব্দ, আর গাড়ির আওয়াজ। এরই মাঝে আবার একটা সন্ধে পেরিয়ে গেল। কিছুদিন আগে এমনই এক সন্ধেবেলায় একটা চল্লিশ বছরের নতুন হনুমান মন্দির থেকে তুকারামের ভজন ভেসে আসছিল। সঙ্গে খঞ্জনীর সঙ্গত। সেই জায়গাটাই অন্যরকম। শুধু চল্লিশ বছরকে পুরনো বলে মেনে নিইনি বলে একজন ভুরু কুঁচকেছিল। এর বেশি কিছু না।

সেখান থেকে মাইল খানেক দূরে এক সম্রাটের সমাধি। সমাধির স্মারক এক গোলাপ পাপড়ি আমার দিকে উড়ে এসেছিল, ফিরিয়ে দিইনি। সেই সমাধিও প্রাচীন নয়… হয়ত তিনশো বছরের কিছু বেশি।

অতি বৃদ্ধ এক ম্যামথের খুলি মাটিতে মিশে গেছে, এক মিসিং লিঙ্ক-এর অস্থি হয়ে গেছে পাথর। তাদের ওপর আঁচড় কাটা অক্ষরমালা ধুলো হয়ে যাবে। ধূপ অথবা আগরবাতির ধোঁয়ায় তুঁহু তুঁহু করতে করতে কার্বন-ডেটিং তাচ্ছিল্য করে যাবে তাকে… যে ভুরু কুঁচকেছিল।

তার ঘাড়-বাঁকা ভক্তিকে বলবে ‘ফোট সালা’!

চায়ের কাপের মত ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া আরও কিছু শীতলতা। অন্ধকার। ফেলে দেওয়া কাপের আর খোঁজ থাকে না। কেউ না কেউ ঠিক তুলে নিয়ে যায়। অনেক কাপের সঙ্গে, শুকিয়ে যাওয়া চিনি দুধ… মিশে যাওয়া আলাদা আলাদা ঠোঁটের গন্ধ।

কাগজের কাপগুলো একইরকম, কালকেরটা ছুঁড়ে ফেলার আগে দু’বার ভাবিনি, আগামীতেও ভাবব না।

শুধু আজকেরটা একটু বেশি সময় পেল, ঠিক যেমন চুমকি… কোনও কোনও দিন, কোনও কোনও বাবুকে হঠাৎই বেশি খুশি করে ফেলে।

প্রাচীনতম উটের মেরুদণ্ডের দিব্যি… আমি চুমকিকে দেখতে পাই— মরুভূমির চন্দ্রস্নাত নিতম্বের ঢালে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে… উদগ্রীব, ঠোঁট ফাঁক করে। আর এক ঝাঁক রাতপোকার মত তরল আকাশগঙ্গার মৃদু স্রোত ঢুকে যাচ্ছে তার উরুর মাঝে… নিগূঢ় জরায়ুর আশ্রয়ে।

 

কিউট

প্রশান্তি… কাঁধে হাত রাখে। ধান্দাবাজ কিংবা নিখাদ শুয়োরের বাচ্চাকে দেখেও ভাবতে শেখায়— দ্যাখ, সপরিবার সুখছবিতে একেও কেমন মিষ্টি লাগে!

হাত ধোয়ার বেসিন এর কাছে দুটো মাকড়শা, জালে থিতু হয়ে একটা দিন শেষ করল। তাদের একজন, দু হাতে আঁকড়ে একটা মশার মৃতদেহ ধরে আছে, ঠিক যেমন একটা মিষ্টি কাঠবেড়ালি মুখের কাছে বাদাম ধরে থাকে।

কাঠবিড়ালি তোমার কিউট লাগে। ওই জায়গায় মাকড়শাকে রাখা অসম্ভব। কিন্তু বিশ্বাস করো, মাকড়শাটাও খুব মিষ্টি লাগছিল… দু হাতে মশার লাশ, আর ছ হাতে জালটা আঁকড়ে। নিশ্চিন্ত।

দেখো—

একাধিক প্রজাতির প্রাণী একটা লম্বা শৃঙ্খল করে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। কচর কচর, গপ গপ, সুলুপ সুলুপ শব্দ হচ্ছে। একজন তার সামনের জনকে খেয়ে নিচ্ছে। যে ফুরিয়ে যাচ্ছে, তার জায়গা নিচ্ছে আর একজন। এই দীর্ঘ শৃঙ্খলে খাওয়ার শব্দ থামে না, ওটা চলতেই থাকে— কচর কচর, গপ গপ, সুলুপ সুলুপ।

থাক, তার থেকে বরং দেখো—

একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে দুটো প্রাপ্তবয়স্ক মাকড়শা, আর দুটো ফুটফুটে বাচ্চা মাকড়শা। একটা কিউট পারিবারিক ছবি।

কোনও প্রজাতির মাকড়শার পিঠে আবার চোখের মত দুটো ছোট বিন্দু আর একটা হাসি মুখ থাকে… ঠিক হাসি হাসি ইমোজির মত!

সন্ধেবেলা আমিও কটা ডাঁশ মশা মারলাম। হাতে কালচে লাল রক্ত লাগল। একজন শহিদ হওয়ার আগে বলল— লালকেল্লার রাগ আমাদের ওপর দেখিয়ে কী হবে?

আচ্ছা দু’হাতে খাবার ধরে মিষ্টি হাসলে আমাকে কি কিউট দেখাবে?

কী ধরনের খাবার ভাবতে হবে না… শুধু মিষ্টি হাসি… অ্যাঁ?