জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের ‘হাইওয়ে…’ : লেখকের নিজস্ব ‘অতিপ্রাকৃত রিফিউজ’

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

‘Pointed Roofs’। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত ডরোথি রিচার্ডসনের উপন্যাস। যার সমালোচনায় আরেক ঔপন্যাসিক মে সিনক্লেয়ার সাহিত্যের নিরিখে প্রথম ব্যবহার করলেন শব্দটি। অবশ্য তারও আগে শব্দটির প্রথম দুটি ব্যবহার করেছিলেন ১৮৫৫ সালে ‘The Senses and the Intellect’ গ্রন্থে লেখক আলেকজান্ডার বেইন এবং ১৮৯০ সালে ‘The Principles of Psychology’ প্রবন্ধে লেখক উইলিয়াম জোনস। হ্যাঁ, স্ট্রিম অফ কনশাসনেস-এর কথা বলছি। এই স্ট্রিম অফ কনশাসনেস এবং ইন্টেরিয়র মনোলগ এক এক করে ব্যবহার করে থাকলেন প্রুস্ত, জয়েস, উলফ, চেকভ, লরেন্স স্টার্নের মতো দিকপালরা।

ছোট্ট করে এই স্ট্রিম অফ কনশাসনেসের উল্লেখ করলাম ‘হাওয়াকল’ থেকে প্রকাশিত জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ ‘হাইওয়ে ও অন্যান্য গল্প’ প্রসঙ্গে। অণুগল্প, ছোটগল্প এবং গদ্যে জয়দীপের সাবলীলতা এবং প্লট তৈরির কুশলী কলম ইতিমধ্যেই সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব নিশে তৈরি করে নিয়েছে। শুধুমাত্র প্লট বা গল্প বলার নিছক ফর্মুলা রাস্তায় জার্নির জন্য জয়দীপ আসেননি। গল্প থেকে আরেক গল্প, ব্যক্তিগত থেকে সামাজিক সমস্যা এবং সর্বোপরি শব্দ নিয়ে, স্টাইল নিয়ে, স্ট্রিম অফ কনশাসনেস নিয়ে, এক অমোঘ খেলা – খেলতে খেলতে কখন যে গল্পটা বলা হয়ে গেল, খেয়াল থাকে না। শেষ করে অস্ফুটে মনে হয়, বাঃ রে …

‘হাইওয়ে ও অন্যান্য গল্প’-গ্রন্থে এই মুগ্ধতা আকাশ ছুঁয়েছে। আটটি গল্প, আকারে ছোট হলেও বিষয়ে এবং প্লট নির্বাচনে গভীর মনঃসংযোগের দাবি করে প্রত্যেকটিই। লেখায় জয়দীপ কিছু লেইট মোটিফ এনে ফেলেন। কিছু শব্দ, বিষয় তাঁর লেখায় বারবার আসে। ভেঙে যাওয়া যৌথতা বা বনেদিয়ানা নিয়ে হাহুতাশ ঠিক নয়, বরং এক পেলব কষ্টের জন্ম নেয় প্রত্যেকটি প্লটে। ছোট পরিবারে সচ্ছলতা জন্ম নিলেও আসলে চরিত্রগুলো ভেতরে ভেতরে আলাদা হয়ে যায় ছাদ আলাদা হয়ে যাওয়ার দিনেই। জয়দীপ দেখিয়েছেন এটাই বাস্তব। তবুও, চোনার মতো লেগে থাকে যৌথতার টান – ‘রেডিও জড়িয়ে যদি আমি এখনও শুয়ে থাকি – তাহলেই কি আমি প্রাচীন – সেপিয়া বা সাদা কালো?’ যে ইন্টিরিয়র মনোলগের কথা শুরুতেই বলেছিলাম জয়দীপের চরিত্ররা সেই মনোলগেরই একেকজন কথক। এবং এই মনোলগের সঙ্গে মিশে যায় নারী চরিত্র তুলে ধরার পেছনে লেখকের অদ্ভুত এক মুনশিয়ানা। মনে পড়ে, প্রয়াত লেখক দিব্যেন্দু পালিতের প্রসঙ্গ। ‘অনুভব’, ‘বৃষ্টির পরে’, ‘ঢেউ’, ‘আড়াল’ – মনে রাখার মতো বহু উপন্যাসের স্রষ্টা আত্মপ্রচারবিহীন এই প্রজ্ঞা সম্পর্কে লেখিকা বাণী বসু বলেছিলেন, মেয়েদের সম্পর্কে, মেয়েদের চরিত্রায়নে মহিলা সাহিত্যিকদের সঙ্গে একাসনে বসতে পারেন দিব্যেন্দু। লেখক জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় বয়সে নবীন, এই ধারাবাহিকতা এবং ফর্ম রেখে দিলে দিব্যেন্দুর যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারেন তিনি। তাঁর বর্ণা, শাঁওলি, কৌশানী, রত্না, সর্বাণী, মল্লিকা বা রূপাঞ্জনা এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক প্রক্ষেপ, ঘটনার টানাপড়েন, পারিবারিক জটিলতা, ডিভান, সোফাসেট, ক্রিস্টাল বোল – নিখুঁত চরিত্রায়ন প্রত্যেকটি পরিসরে। পাঠককে জোর করে গল্পে ঢুকিয়ে আনেন, যেন খোদ এক ভয়ার অভিনীত হয়। জয়দীপের ‘হাইওয়ে’ তখন রিয়ার উইন্ডো, আর আমরা বিস্ময়াবিষ্ট এক একজন জেমস স্টুয়ার্ট। খোদ স্যার হিচককের মতোই এ বইয়ের আট আটটি গল্প, আট আটটি ফ্ল্যাটের, পরিবারের জানলা।

এক এক জানলায় নিজের গল্প, নিজেদের গল্প। কমলকুমার মজুমদারের ‘মল্লিকাবাহার’ বা জগদীশ গুপ্তের ‘অরূপের রাস’ – বাংলা সাহিত্যে সমকামিতার প্রয়োগের নিরিখে খুব সামান্যের মধ্যে অন্যতম। সেসবেরই এক জ্বলন্ত লেগ্যাসি হয়ে থাকবে জয়দীপের ‘ছুঁয়েছিলে বলেই…’ গল্পটি। in media res বা গল্পের মাঝখান থেকে শুরু করে পাঠককে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছুটা মেঘের ভেতর রেখে হঠাৎই এক তীব্র সম্পর্ক, তীব্র সত্য উন্মোচনের মধ্যে ফেলে দেন লেখক। শক বলতে পারেন তাকে, বলতে পারেন আয়না। ‘সারাদিন পর’ গল্পে সেই শুরুর স্ট্রিম অফ কনশাসনেস – নিরাপত্তা নাকি নিরাপত্তাহীনতা, দ্যোতক হিসেবে একপাল ভেড়ার কথা। আর ভেড়া থেকে তাদের গায়ের লোম – সবুজ, ঘন, নরম – ঘাস – আকাশ – সস্তা লাল ঘুড়ি। অদ্ভুত এক মায়ায় গল্প এগোয় – ‘ডাকনামহীন একটা ভেড়া যদি জেগে ওঠে, যদি একটা ধারে দাঁড়িয়ে ভাবে ফেলে আসা আস্ত দিনটার কথা, তাহলে বোঝা খুব মুশকিল’। তারপরেই সেই মোক্ষম কথা – ‘ডাকনাম নেই – ইচ্ছেও নেই – সোজা হিসেব।’ গল্পের পর গল্পে একটা ক্লান্ত দাম্পত্য ঘুরেফিরে আসে। ‘দেওয়াল হওয়াই ভালো – ছাদ হওয়া সকলের সাধ্যে কুলোয় না।’ অথবা ‘চার দেওয়ালের মাঝে ভদ্রতা রক্ষা – সে বড়ো অদ্ভুত জিনিস … বিশেস করে রাতে – একসঙ্গে শুতে যাওয়ার আগে।’ অবশ্য ব্যতিক্রমও থাকে। ‘আবিরমাখা কদমগাছ’-এর টাইম অ্যান্ড স্পেসের ব্যবধানে সম্পর্কের বুনন, ফাঁকা স্টেশন চত্বর – যাকে ছেড়ে চলে আসার সময়ে ‘স্টেশন আর প্ল্যাটফর্ম আবার আসতে বলল। বেড়ালগুলো আবার আসতে বলল।‘ পাঠককে সমব্যথী হতে বাধ্য করে এ গল্প। দোলের সময়ে প্রতিবছর ফিরে ফিরে আসে একটি কদমগাছ। দাম্পত্য এখানে ভরসা, চিরকালীন এক বন্ধুত্বের প্রতিশব্দ। যেন এমনই তো হওয়ার কথা, অথচ হয় না কেন? যদিও তা কি শুধুই দু প্রজন্ম আগের বলেই সম্ভব হল, লেখক এ প্রশ্নকে পাঠকের কাছেই ছেড়ে দিয়েছেন, আর নিয়ে গেছেন গৌতম-বর্ণা, পার্থ-সর্বাণী বা সুকল্প-শাঁওলিদের দূরত্বের ভেতর। ‘হাইওয়ে’ গল্পে একটা অন্ধকার সাতারার রাস্তায় কাপ্সে পরিবারের ফেটাল কারক্র্যাশ – সিনেমাটিক আনপ্রেডিক্টেবল একটা টুইস্ট এন্ডিং-এ ভিনরাজ্যের দুই মানুষের কথা – ‘বাচ্চা খুশ, মাডাম খুশ, আমিও খুশ’। আর যে সম্পর্কগুলো হল না? তারাও কি পরিণতি পেলে এমনই অ্যান্টিক্লাইম্যাক্সে এসে মিশত? হাইওয়ের পাতায় পাতায় সেইসব সম্পর্কের ভেতর একটা ফ্ল্যাট গজানো ডিপ্রেশিং বনেদি বাড়ি, সিঁড়ির পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে অন্ধকারে ঠোঁট ঘষে দেওয়া শুভ বিজয়ার প্রীতি, নাম না জানা ফুল, মেট্রো স্টেশন, বৃষ্টি, সময় – ‘মাত্র দশ মিনিট একটা ছাতার রাজত্বকাল’। এবং এইসমস্ত প্লটের ভেতর পাঠক যখনই একটা লিঙ্ক খোঁজার চেষ্টা করবে, ভাববে বসন্ত দ্বীপের কুন্তল-মল্লিকার হাত ধরে শুরু করে সম্পর্কের ভিত দুহাজার একুশে এসে ঠেকে যাচ্ছে নীল সোফাসেটে স্রেফ শারীরিক অভ্যেসের অধীনে থাকা দুটো মানুষ মানুষীর গল্পে – তখনই স্বাদ বদলাতে চলে আসবে ‘কোপা ডি লা ভিডা’। মনে পড়ে যায় দিব্যেন্দুর কিংবদন্তী হয়ে যাওয়া ‘ইয়াসিন ইয়াসিন’-এর মতো উপন্যাস বা ‘ব্রাজিল’-এর মতো ছোটগল্প। জয়দীপের ‘কাপ অফ দ্য লাইফ’ আধো জাগা আধো স্বপ্নের সলিলকির ভেতর দিয়ে বলে চলে সেই দোকানি ছেলেটার গল্প – অন্য কোনও দেশের জার্সি পরে নামতে যার ভালো লাগে না।

ব্যক্তিগত সম্পর্কের পরিসর থেকে বেরিয়ে কখনও বৃহত্তর আলোয় পাঠককে ফেলে দিয়েছেন লেখক। আর সেখানেও চোখ ঝলসে গেছে পড়তে পড়তে। যৌথ থেকে ছোট হয়ে আসা চারপাশ একটা ক্লান্ত, মৃত স্পর্শের কথা বলে, যে ছোঁয়া ‘কোনও মানুষের শরীর পেলে, ঠিক কালশিটে পড়ে যেত।’ পাঠক আয়না ফেলে নিজের অহং-এর দিকে – ‘ যে যতটা উপরে যেতে পারে, সে নিজের ওপরে থাকার কথা জানায় অন্যদের।’ অথবা কোথাও মধ্যবিত্ত রাজনীতি-বোধের উপর বড়সড় প্রশ্ন – ‘কোথাও একটা বড় শূন্যতা থাকলে মধ্যবিত্তকে এমনভাবে রাজনীতি পেয়ে বসে।’ তাহলে শেষটুকু? আলো কি নেই? ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে কোথাও ভালোবাসার, সম্পর্কের পুনরুত্থানের কথা থাকলেও, জিতে যাওয়া থাকলেও সামাজিক প্রেক্ষাপটে, বড় পর্দায় সে আশা বড়ই ক্ষীণ। আর তাই – ‘পায়ের ওপর দিয়ে মোটর বাইক চলে গেলে সরি কাকু ছাড়া সভ্যতার আর কিছুই বলার নেই।’

এই সমস্ত নিয়েই জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের ‘হাইওয়ে ও অন্যান্য গল্প’ লেখকের নিজস্ব ‘অতিপ্রাকৃত রিফিউজ’, যা জয়দীপকে ক্রমশ স্বতন্ত্র করে দিচ্ছে সমসাময়িক ছকে বাঁধা বাংলা বাজারের থেকে। প্রচ্ছদে বিতান চক্রবর্তীর কালার টোনে, ভাবনায় গ্রন্থের থিমের হুবহু প্রতিস্থাপনা। হাজার রঙের ভেতরে ঝলসে যাওয়া আসলে রংহীন সবকিছু। ‘হাওয়াকল’ প্রকাশনার সুন্দর ঝকঝকে পাতার ভেতর যদিও কখনও কখনও মুদ্রণ সমস্যায় কিছু শব্দ অসম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে শুরু হয় আবার পরের বাক্যে। এইটুকু না হলেই হয়তো ভালো হত।

অবশ্য এহ বাহ্য। যতই ‘মালিকানাহীন ছড়ানো ছেটানো’ মানুষ মানুষীর ভেঙে পড়া সম্পর্কের সামনে আয়না ধরার স্পর্ধা দেখান লেখক, পাঠক জানেন বড় মমতায়, স্নেহে জয়দীপ একসময় ঠিকই তাঁর গল্পগুলোকে তুলে দেবেন ‘মাঝারি উচ্চতার রঙ্গন ফুলের গাছ, কালবৈশাখী সহ্য করে টিকে থাকা একটি পাখির বাসা আর মাটির কাছে জন্ম নেওয়া বুলবুলি পাখির বাচ্চাগুলোকে’।

কারণ, শেষমেশ, ‘আমাদের তো বেঁচে থাকতে হবে, বলো? থাকতেই হবে …’

হাইওয়ে ও অন্যান্য গল্প

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

হাওয়াকল প্রকাশনা

মূল্য ২৫০ টাকা

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4655 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...