Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

যে ভোটার সেই নাগরিক– এই রণধ্বনি উঠুক

ধীমান বসাক

 

নতুন নাগরিকত্ব বিলে কী থাকছে, তা পুরোপুরি এখনই না জানা গেলেও আঁচ করা যেতে পারে। এটা নিয়ে আলোচনা করার আগে দুটো সরকারি আদেশনামা নিয়ে বলে নেওয়া দরকার। ২০১৫ সালে দুটি নোটিফিকেশন বেরোয়, একটি পাসপোর্ট আইনের অধীনস্থ পাসপোর্ট অর্ডারে, অন্যটি ফরেনার্স অ্যাক্টের অধীনস্থ ফরেনার্স অর্ডারে। তাতে বলা হয় যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা, যেমন হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিশ্চান, পার্শি ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে ভারতে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া এসেছেন বা তাদের বৈধ কাগজের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, তাদেরকে অবৈধ অভিবাসী বলে ধরা হবে না। দুটো অর্ডারেই একই কথা বলা হয়।

বিজেপি নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনীর জন্য যে বিল এনেছিল, তাতে নাগরিকত্ব আইনে বলা হচ্ছে যে নাগরিকত্ব আইনের জন্যও এরা অবৈধ অভিবাসী বলে বিবেচিত হবেন না।

এই বিলের আরেকটি সংশোধনী হল, যে যাঁরা নাগরিকত্ব অর্জন বসবাসের মাধ্যমে করতে চান, তাঁদের মধ্যে ঐ ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে বসবাসের মেয়াদ আগের এগারো বছরের বদলে ছয় বছর করা হল।

বিজেপি এই বিলকেই দেশজোড়া এনআরসি বা এনআরআইসি-র দোসর করে বলতে চাইছে, আমি তো কাউকে বাদ দিতে চাইছি না, আমি এনআরআইসিতে যারা বাদ পড়তে পারেন, তাদেরও নাগরিকত্ব দেওয়ার রাস্তা করছি।

লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই যে মুসলমানকে এর আওতা থেকে বাদ রাখা হয়েছে। আর দেশগুলোও লক্ষ করুন। শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, নেপাল, ভুটান নেই। এ দেশগুলোতে নিপীড়ন নেই? শ্রীলঙ্কায় সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সিংহলী, সেখানে তামিলরা দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়িত হননি? মায়ানমারেও বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু, সেখানে রোহিঙ্গারা অত্যাচারিত হননি? এবারে বিশেষ কয়েকটি দেশ এবং বিশেষ কয়েকটি সম্প্রদায়কে বেছে নেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য মুসলমানকে বাদ দেওয়া, মুসলমানত্বকে আঘাত দেওয়া।

সংবিধানের ১৪ এবং ২১ নম্বর ধারা, যা মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে, এগুলোর সঙ্গে অন্য মৌলিক অধিকারের ধারাগুলোর একটা বড় তফাত হল, অন্যগুলোতেও সিটিজেন বা নাগরিক শব্দটার ব্যবহার হয়েছে, কিন্তু এই দুটো ধারায় কিন্তু ভারতের সীমার মধ্যে বসবাসকারী যে কোনও ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। ১৪ ধারায় বলা হচ্ছে— ভারতের সীমার মধ্যে রাষ্ট্র কোনও ব্যক্তিকেই আইনের কাছে সমতা দিতে বা আইনের সমান সুরক্ষা দিতে অস্বীকার করতে পারবে না। ২১ ধারায় বলা হয়েছে আইনে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ছাড়া কোনও ব্যক্তিরই জীবন বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে তাকে বঞ্চিত করা যাবে না। এই দুটো অধিকার শুধু নাগরিক নয়, ভারতের সীমার মধ্যে যে কোনও ব্যক্তি পাবেন। সংবিধানের প্রস্তাবনা বা ভূমিকায় একেবারে শুরুতে ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।

নিঃসন্দেহে নাগরিকত্ব আইনের বিজেপির আনা সংশোধনী সংবিধানের এই কথাগুলির বিপরীত। এভাবে নাম করে কয়েকটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বেছে নিয়ে সেখান থেকে আসা মুসলমানকে ছাঁটাই করে ফেলার কোনও আইন এর আগে হয়নি। মনে রাখবেন ২০১৫-র যে দুটো আদেশ বেরিয়েছিল, তা সরাসরি আইনে বদল নয়, যদিও নিঃসন্দেহে তা সংবিধান ও আইনবিরোধী।

দেশ ভাগ হয়েছিল মূলত বাংলা এবং পাঞ্জাবের বুকের ওপর দিয়ে। কোটি কোটি উদ্বাস্তু মানুষ নিজের ভূমি, স্বজনের লাশ ফেলে রেখে এপার থেকে ওপার, ওপার থেকে এপারে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দান, আরেকবার দেশকে, বিশেষত বাংলাকে সেই বিভীষিকার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। ভারত কখনওই বলেনি যে সে হিন্দুর জন্য, মুসলমানের জন্য নয়। এ আইন পাশ হলে তা সরাসরি হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে একটা পদক্ষেপ হবে, সংবিধানের মূল কাঠামো বা বেসিক স্ট্রাকচারের বিরোধী হবে তা। ইতিমধ্যেই পাসপোর্ট আর ফরেনার্স অর্ডারে ২০১৫-র সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে বেশ কয়েকটি দরখাস্ত জমা পড়েছে। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীও এরকম বহু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

এখন এই সংশোধনী যদি লোকসভায় পাশ হয়, রাজ্যসভায় সরকারের গরিষ্ঠতা নেই, সেখানে বাকি দলগুলোর নীরব বা সরব সমর্থন লাগবে, দেখার কে কী করেন।

যদি সব পেরিয়ে এই আইন চালুও হয়ে যায়, তাহলেও যাদের জন্য এই আইন করা হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে, তাদের কাছে এই আইন এক ফাঁদ হিসাবেও দেখা দিতে পারে।

এই সংশোধনীর সুযোগ যারা নিতে চাইবেন, তাদেরকে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদন করার অর্থ হল তিনি স্বীকার করে নিলেন যে তিনি বৈধ কাগজ ছাড়াই ভারতে আছেন, তিনি বিদেশ থেকে এসেছেন। এটা করবেন কিনা, সেটা ভেবে দেখার মতো বিষয়। দ্বিতীয়ত, কীভাবে প্রমাণ হবে যে তিনি ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে এদেশে এসেছেন?

এই বিল সংসদীয় কমিটিতে আলোচনার জন্য গেছিল। সেই কমিটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরের কাছে জানতে চায় প্রমাণ নিয়ে। রিপোর্টের[1] ২.১৪ অনুচ্ছেদে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে—

2.14 As regards authentic verification of the claims of the applicants for Indian citizenship that they have been victims of religious persecution in their respective countries, the Intelligence Bureau (IB) submitted as under:

“The individuals claiming religious persecution and seeking Indian citizenship had entered India decades ago, mostly in the aftermath of partition of the country when a large scale migration between India and Pakistan took place. It is not possible to verify their claim now. However, for recent cases, if any, due verification would be made before their claim for Indian Citizenship is entertained.

As per the Standard Operating Procedure (SOP) under preparation by MHA, for an applicant who applies with an affidavit mentioning that he/she was compelled to migrate to India due to religious persecution or fear of religious persecution, alongwith other supporting documents, a detailed enquiry will be conducted by Foreigners Regional Registration Office (FRRO)/Foreigners Registration Office (FRO) concerned to verify his/her claim. If the affidavit is not supported by documents, the case will be referred to Foreigners Tribunals to be constituted for this purpose under the Foreigners (Tribunals) Order, 1964 for verification of the claim regarding religious persecution.”

অর্থাৎ আইবি দপ্তর বলছে— এইধরনের দাবীদাওয়ার বেশিরভাগটাই হচ্ছে দেশভাগের সময়কার, যখন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিপুল অভিবাসন ঘটেছিল। এখন তাদের দাবী যাচাই করা আর সম্ভব নয়। তবে, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে, তাদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়ার আগে যথাযথ যাচাই করা হবে। স্বরাষ্ট্র দপ্তরে তৈরি করা হচ্ছে একটা বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়া (এসওপি), যাতে এই ধারায় কেউ হলফনামা এবং ডকুমেন্ট সহ আবেদন করে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণ উল্লেখ করলে তা ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস তদন্ত করে দেখবে। যদি হলফনামার কোনও সাপোর্টিং ডকুমেন্ট না থাকে, তবে সেই আবেদন এই উদ্দেশ্যে গঠিত ফরেনার্স ট্রাইবুনালে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, ধর্মীয় নিপীড়নের বক্তব্য যাচাইয়ের জন্য।

পরিষ্কার যে আবেদন করলেই নাগরিকত্ব মিলবে এমনটা নয়, ততদিন আপনি যে দেশকে নিজের করে নিয়েছেন, তাতে পরবাসী হয়ে ঝুলতে থাকবেন।

এরপর ঐ রিপোর্টের ২.১৭, ২.১৮, ২.১৯, ২.২০ অনুচ্ছেদ তুলে দিচ্ছি—

2.17 The Committee then queried about the number of persons belonging to minority communities who would benefit from the proposed Amendment on the basis of religious persecution. In response, the Intelligence Bureau (IB) informed as follows:

“As per our records, there are 31,313 persons belonging to minority communities (Hindus – 25447, Sikhs – 5807, Christians – 55, Buddhists – 2 and Parsis -2) who have been given Long Term Visa on the basis of their claim of religious persecution in their respective countries and want Indian Citizenship. Hence, these persons will be immediate beneficiaries.”

2.18 Asked to state the fate of other people belonging to minority communities who have come to India from the three countries under reference due to religious persecution but have not declared so at the time of their arrival in India, the Intelligence Bureau submitted as under:

“For other to apply for Indian Citizenship under this category, they will have to prove that they came to India due to religious persecution. If they had not declared so at that time of their arrival in India, it would be difficult for them to make such a claim now. Any future claim will be enquired into, including through R&AW before a decision is taken.”

2.19 In evidence, the Committee asked whether only 31,313 persons would be benefitted. In reply, the Director, IB deposed:

“Yes, because they have claimed; they have applied. There will be many others who might have come and they might have already taken citizenship by various means. They might have obtained passport, ration card. All other documents they might have obtained and they might have already registered themselves in the voters list. So, for all practical purposes, they are already citizens of this country. Tribunals are already there to identify if any of them has obtained it by fraudulent means. That is a different issue altogether. The Bill is for those who have applied and who have claimed that they have been persecuted in their respective country.”

2.20 The Director, IB further stated:

“So, from the available data, I think, it will be a small number. I feel that it is from human angle also because they have left their original countries decades back. They are here; they have become citizen-less. They do not get many benefits which are available to the citizens or persons of this country and they cannot go back home. Considering all these facts, the Government took a decision and the Bill has been brought.”

যা বলা হল তার মোদ্দা কথা হল, এর সরাসরি সুবিধে পাবেন ৩১,৩১৩ জন, যারা ইতিমধ্যেই এই আবেদন করেছেন এবং তাদেরকে দীর্ঘস্থায়ী ভিসা দেওয়া হয়েছে। বাকিদের কী হবে, যারা এদেশে এসে ঘোষণা করেননি যে তারা ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে এসেছেন, একথার উত্তরে আইবি বলছে, তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে সেটা, যারা আসার পরপরই নিপীড়নের কথা জানাননি তাদের দাবী বিচার করা খুবই কঠিন হবে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে র(RAW)-র কাছেও রিপোর্ট চাওয়া হবে।

বুঝলেন? আম তো যাবেই, ছালাও যেতে পারে।

আর তারপরই আসবে দেশজোড়া এনপিআর আর এনআরসি/এনআরআইসি। তাতে শুরু হবে আরেকদফা বিদেশি বনাম নাগরিক বাছাই। এই বাংলার কয়েক কোটি মানুষের জীবন, গোটা বাংলার সমাজ তছনছ করার এই আইন এক বিভীষিকা, বাঙালিবিরোধী প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।

শোনা যাচ্ছে উত্তরপূর্ব ভারতের ট্রাইবাল এলাকা এই ক্যাবের আওতা থেকে বাদ যাবে। তাই যদি হয় অসমে বড়ো ট্রাইবাল কাউন্সিল বা বিটিসি-র এলাকার মধ্যে (উদালগুড়ি, কাঁকরাঝোড়, বরপেটা এবং আরও কয়েকটি জেলার অংশ) থাকা কোচ-রাজবংশী এবং বাঙালিরাও আবেদনের উপযোগী বলেই বিবেচিত হবেন না।

আর এর সবকিছুর মধ্যে সরকারের হাতিয়ার হবে আধার, যা দিয়ে আপনাকে খুঁজে বের করা, চিহ্নিত করা, বাদ দেওয়ার কাজ চলতে থাকবে।

এর বিপরীতে গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার দাবী হতে পারে, যে ভোটার সেই নাগরিক। আমাদের ভোটে সরকার, এমএলএ, এমপি, মন্ত্রী, কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত সদস্য হয়েছ— আমরা সবাই নাগরিক।

এই রণধ্বনি ওঠানোর সময় এসেছে!


[1] https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=https://www.prsindia.org/sites/default/files/bill_files/Joint%2520committee%2520report%2520on%2520citizenship%2520%2528A%2529%2520bill.pdf&ved=2ahUKEwj1-eqguaPmAhWMzDgGHborBEIQFjAAegQIBxAB&usg=AOvVaw32yDGMpYlrPRXA9Z7OBw1d