Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঋত্বিক ঘটকের ছবি অস্বীকৃত ইতিহাসের গল্প বলে

ঋত্বিক ঘটকের ছবি অস্বীকৃত ইতিহাসের গল্প বলে -- সেঁজুতি দত্ত

সেঁজুতি দত্ত

 

কিছুদিন আগে খবর পেলাম বিজেপি যুব মোর্চা এনআরসি-র পক্ষে এবং হিন্দু শরণার্থীদের দুঃখ-দুদর্শার কথা মাথায় রেখে, নিজেদের ‘উদ্বাস্তু-দরদি’ মনোভাব তুলে ধরতে, ঋত্বিক ঘটকের ছবি থেকে কিছু বিশেষ বিশেষ দৃশ্য এবং সংলাপ নিয়ে একটি ছয় মিনিটের কোলাজ ভিডিও বানাতে চলেছে। খবরটা শুনে বুঝে উঠতে পারিনি কীভাবে রিঅ্যাক্ট করব। প্রথমে খুব হাসি পেল, কিন্তু তারপরই দেখলাম সোশাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠছে যে ঋত্বিক তার ছবিতে ১৯৪৭-এর পরে মুসলমানদের গল্প ঠিকঠাক রিপ্রেজেন্ট করেননি। এই প্রশ্নে এবং এই প্রশ্ন থেকে উদ্ভূত সম্ভাব্য আলোচনার কথা ভেবে একটু ঘেঁটে গেলাম।

কিন্তু সমস্যা হল, আমি ঋত্বিক নিয়ে যতটা না চিন্তিত, তার থেকেও বেশি ভাবছি বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে শিল্পী এবং শিল্পকর্মের ধরন কী হবে তাই নিয়ে। তারা কী করবেন এবং কী করা উচিৎ সেগুলিও মাথায় আসছে বৈকি। অতীতের কাজের নতুন পাঠ কীরকম হবে এই প্রশ্নও ঘুরেফিরে আসছে। থেকে থেকেই যখন রাজনৈতিক শিল্পকর্ম, অথবা নারীবাদী শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা হয়, তখন বলে থাকি যে প্রয়োজনে শিল্পীকে ডিরেক্ট এবং গোদা হতে হবে। শৈল্পিক সূক্ষ্মতা হয়ত এরকম সময় কাজে দেবে না। কিন্তু আবার এও মনে হয়, এই প্রশ্নগুলো আমাদের এমন কোনও দিকে ঠেলে দিচ্ছে না তো যেখানে মনে হতে পারে যে ‘প্রকৃত’ রাজনৈতিক শিল্পী তাহলে কখনওই নুয়ান্সড হবেন না? এবং হলেই এভাবে হাইজ্যাকড হবেন?

ওদিকে অ্যাবস্ট্রাকশনের একটা মজা আছে। যে কোন অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট (সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, চিত্রকলা ইত্যাদি) অনেক রকম পাঠের দরজা খুলে দেয়। কিন্তু অ্যাবস্ট্রাক্ট অর্থে আমরা কী বুঝি? সাধারণ জ্ঞানে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর সংজ্ঞা হিসেবে যদি নন-ন্যারেটিভ কাজগুলোকে ধরে নিই, তাহলে কাহিনিচিত্রে ফর্মাল এক্সপেরিমেন্টগুলোকে কি এর দোসর হিসেবে ভাবা যেতে পারে? অর্থাৎ, সিনেমার ক্ষেত্রে সেই সব ছবি যেখানে গল্প নেই এবং সাধারণ ভাষায় ‘ভীষণ কঠিন’। কিন্তু গল্প থেকেও কীভাবে অ্যাবস্ট্রাকশনে যাওয়া সম্ভব? অথবা আদৌ যাওয়া সম্ভব কি? এখানেই ঋত্বিক ঘটকের কাজের গুরুত্ব।

সেভাবে ভেবে দেখলে বিজেপির ঋত্বিক ব্যবহার করবার হুমকি (হ্যাঁ হুমকিই বটে) নিয়ে আমি অতটা চিন্তিত নই। ঋত্বিকের মত চলচ্চিত্রকারের বিশ্ববীক্ষা পাঠ করে থাকলে ওরা এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতেন না। আর তাছাড়া সিনেমার যে কোনও ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রই ফর্ম এবং কন্টেন্টের যুক্তি দিয়ে ওদের কাত করে দিতে পারবে। এখানে বলে রাখা ভালো, ঋত্বিকের পরিবার ইতিমধ্যেই ওর ছবিগুলো নিয়ে হিন্দুত্ববাদী ভিডিও বানাবার বিরোধিতা করে লিখিত বিবৃতি দিয়েছে। চলচ্চিত্রের ভক্ত, ছাত্র, গবেষক, এবং সমালোচকদের অনেকেই বিরোধিতায় কলম ধরেছেন। কিন্তু তাহলে কি এই দাঁড়াচ্ছে যে, ঋত্বিক কঠিন এবং অ্যাবস্ট্রাক্ট আর তাই শুধু সিনেমাবোদ্ধারাই ওকে ভালো বুঝতে পারেন এবং পড়তে পারেন? অথবা, শুধুমাত্র ওর পরিবার এবং বিশিষ্ট সিনেমা দরদিদেরই একমাত্র কনসার্ন এই ঘটনা? একদমই না।

একটা গল্প বলি। দেশভাগের পর এক পরিবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু দেশে রয়ে গেল। একই মায়ের পেটের ভাইবোন, কিছু থাকল এদেশে, কিছু থাকল ওদেশে। ওদেশ যখন স্বাধীন হল তখনও ওদেশের ছেলেমেয়েগুলো এদেশে এল না। ভাবল, নতুন দেশ, নিজের দেশ, তাই ছেড়ে যাবে না। ওদের ভিটেমাটি কিছু ছিল না। ভাড়াবাড়িতেই আজীবন বাস। তবুও রয়ে গেল। ওদেশ যখন রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ইসলামকে বেছে নিল, তখনও। ওদেশ থেকে যখন পাড়াপড়শি সব এদেশে চলে গেল, তখনও। কিন্তু একটা সময়ে আর পারল না। যখন এদেশে মুসলমানের মসজিদ পুড়ল, দাঙ্গা বাঁধল, তখন ওদেশেও দাঙ্গা হল, মন্দির ভাঙল, মানুষ মরল। সেই পরিবারের যে অর্ধেক ওপারে ছিল, তারা এবারে ঠিক করল এপারে আসবে। আজ্ঞে, ধর্মের নামেই তারা এপারে এল। ধর্মযুদ্ধের বলি হয়ে তারা তাদের সাধের ঘর সংসার হারাল— চলে এল।

কলকাতার আনাচেকানাচে কান পাতলেই এই গল্প শুনতে পাওয়া যায়। অনেকটা যুদ্ধ-পরবির্তী ইতালীয় নিও-রিয়ালিজমের কুড়িয়ে পাওয়া গল্পগুলির মতন। কিন্তু ঋত্বিক সেই সময় নিয়ে ছবি বানাননি। উনি ১৯৭৬এ মারা গেছেন, আর এই গল্প ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর না পেরোলে তৈরি হতে পারে না। ঐতিহাসিক সময় শুধুই আর্কাইভাল নিউজ তৈরি করে না। গল্পেরও জন্ম দেয়। এইসব গল্পে ‘আসল’ মানুষ খুঁজলে পাওয়া যাবে না একটাও। এইসব গল্প পরিবারের ভেতরকার লুকোনো গল্প। নতুন দেশের নাগরিক হতে গেলে ‘আসল’ ঘটনাগুলো এভাবে ‘গল্প’ হয়ে যায়। উৎপাটন অস্বীকার করতেই হয়, নাহলে নতুন দেশের ‘স্বাভাবিক’ নাগরিক হওয়া যায় না।

ঋত্বিক ঘটক নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের এই নব্য মুগ্ধতা আসলে তাদের এতদিন তৈরি করা, গল্পের মাধ্যমে ‘সত্য’ নির্মাণ প্রয়াসেরই আরেক ম্যানিফেস্টেশন। ঠিক যেমন তারা মহাকাব্য-নির্ভর হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ করতে চলেছেন, সেইরকম। এরা চাইছে গল্পের কাল্পনিক মানুষের মাধ্যমে ‘আসল’ মানুষের কাছে পৌঁছতে। এরা চাইছে কাল্পনিক মানুষদের দেশ থেকে তাড়াতে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। ১৯৯২ সালের দাঙ্গার পর যেসকল বাংলাদেশি এদেশে এসেছেন তাদের প্রকৃত উদ্বাস্তু বলা যায় না হয়ত। তারা প্রত্যেকেই এখনকার ভাষায় ‘অনুপ্রবেশকারী’। রাষ্ট্রপ্রদত্ত কোনও কাগজ এদের কাছে নেই কারণ বাবরি মসজিদ ধ্বংস আর তার কারণে দাঙ্গা, এই দিন এবং তারিখকে কেন্দ্র করে দেশের নাগরিকত্বের আইন পালটানো যায় না। বলা যায় না— ‘আমরা মেরেছি, তাই ওরা মেরেছে, তাই এবারে আমরা নাগরিকত্ব দেব।’ যদিও হিন্দু বীরেরা গর্বের সঙ্গে বলেন যে তারা মসজিদ ভেঙেছেন, তারা বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে ওদেশে দাঙ্গা হয়েছে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দাঙ্গার দায় তারা নেবেন না, নেন না। ধর্মের নামে দাঙ্গা যে আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির ফসল সেটা এরা স্বীকার করবেন না। আর এইখানেই আমার ধারণা ওদের এই প্রয়াস ব্যাকফায়ার করবে। এদেশের (অন্তত বাংলায়) রেজিস্টার্ড শরণার্থীর তুলনায় ওরা যাকে বলছে অনুপ্রবেশকারী, সেরকম হিন্দুর সংখ্যা পশ্চিমবাংলায় অনেক বেশি। শহর অথবা মফঃস্বলের উচ্চবিত্ত অথবা উঠতি বড়লোক মুসলমানদের যে কাগজপত্র আছে তা ‘ওপার’ থেকে আসা অনেক বড়লোক হিন্দুদেরও নেই। এদের আছে শুধু গল্প। ওই গল্পকে ভিত্তি করে একবার ভোটে জেতা যায়, কিন্তু ওই গল্পকে স্বীকার করতে বললে দেশের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা তুলে দিয়ে শুধুই ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করতে হবে। এই নব্য উদ্বাস্তু, যারা আসলে ঘোষিত শরণার্থী নন, তাদের অবস্থান ৭১-এর রিফিউজিদের থেকে এসেনশিয়ালি আলাদা। দেশভাগের সময়ে প্রিয়জনের থেকে আলাদা হয়ে যাবার স্মৃতি তাদের আছে। এবং পরবর্তীকালে নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এমন এক নতুন দেশে তাঁরা এসে পড়েছেন যে দেশের সংখ্যাগুরু মানুষই তাদের উৎপাটনের কারণ।

ঋত্বিক ঘটক দেশভাগের গল্প বলেন না। ঋত্বিক দেশভাগ পরবর্তী ভারতের (ভবিষ্যত) নাগরিকের গল্প বলেন। সেই নাগরিকও আসল নাগরিক নয়। গল্পের নাগরিক। যদিও প্রশ্ন থেকেই যায়, যে এই গল্পের নাগরিক তো দেশের ঐতিহাসিক নাগরিকও বটে। কিন্তু ঋত্বিকের কাজ অত সরল নয়। উনি নিজে কী ভাবতেন সেই প্রসঙ্গে না গেলেও, ওনার শিল্পী সত্তা অন্তত জানত যে এই দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এক পর্যায়ে আর রিয়েল পলিটিক্স নিয়ে চিন্তিত থাকবে না। এদেশের রাম-রহিম দু বেলা খেতে না পেলেও ‘মন্দির ওহি বনেগা অউর মসজিদ টুটেগা’ করবে। তাই ঘটকের জগদ্ধাত্রী, আমাদের নীতা, গলায় রক্ত উঠে মরে। কাল্পনিক রামরাজ্যে শরৎচন্দ্রের দুলে বউ মরার সময় চিতার কাঠ পায় না, আর ঋত্বিকের বাগদি বউয়ের মৃতদেহ এক লহমায় ছারখার করে দেয় ঈশ্বরের সাজানো বাগান, সীতার নতুন বাড়ি।

ঋত্বিক শুধুই গল্প বলেন। রামরাজ্যের গল্প। সেই গল্পের ছ্যাঁকা হিন্দুত্ববাদীরা সহ্য করতে পারবে তো? ঘটকের সিনেমায় মুসলমানের গল্প নেই। হিন্দুদেশে মুসলমানের গল্প থাকে না। কিন্তু ওর গল্পে ভবিষ্যতের ভূত আছে। সেই ভূত অতি ভয়ঙ্কর। দাঁত-নখ বার করে কামড়াতে আসে। ঋত্বিক আমাদের ইতিহাস দেখা এবং পড়ার একটা স্ট্রাকচার তৈরি করে দেন। ওর সিনেমায় উদ্বাস্তু মেয়েরা হিন্দুদেশ নির্মাণের এক একটি বলি। নতুন দেশে নতুন পরিবার এবং নতুন বাড়ি তৈরি করতে গেলে এই মেয়েদের আহুতি হিসেবে দান করে দিতে হয়। আজ যখন নতুন (এবং পুরাতন) প্রজন্মকে তাদের আগের প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্কের ‘লিঙ্ক’ তৈরি করতে বলা হচ্ছে, তখন প্রত্যেকটি পরিবারের সেই ভুলে যাওয়া এবং হারিয়ে যাওয়া মেয়েগুলিকে এরা কীভাবে সনাক্ত করবে? ঋত্বিক বলেন ওদের খুঁজে পাওয়া যায় না। নাগরিকত্ব প্রমাণে প্রথম বলি হয় প্রান্তিকেরা। খেতে না পাওয়া, সর্বহারা মানুষ হয় যক্ষায় মরে যায়, নাহলে ডাউউটফুল ভোটার হয়ে দিন কাটায়। কোনও হিন্দুরাষ্ট্র এদের বাঁচাতে পারে না, কারণ এদের ধর্ম নেই, আছে শুধু না পাওয়ার গল্প। শুধুমাত্র “দোহাই আলি”র গগনভেদী সুর মনে করিয়ে দেয় যে ওদের সঙ্গে জুড়ে থাকার শেষ নৌকাটাও জলে ডুবে গেছে। হিন্দুরাষ্ট্র সব মানুষের একসঙ্গে বেঁচে থাকার সহায়ক নয়।

এনআরসি, সিএএ, এনপিআর, এইসব নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, আর এগুলোর প্রতি (হিন্দু) মানুষের আস্থা বাড়াতেই যখন ঋত্বিককে টেনে আনছেন হিন্দুত্ববাদীরা তখন ১৯৯২ এর ৬ই ডিসেম্বরের ফলে ওপারে কী হয়েছিল একবারও উল্লিখিত হচ্ছে না। উল্লেখ করা সম্ভবও নয়। সেটা করতে গেলে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা, দাঙ্গা লাগানো এবং তারই প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যে ওদেশেও দাঙ্গা হয়েছে সেটা স্বীকার করতে হবে। প্রত্যেকটি মৃতদেহের, প্রত্যেকটি ঠিকানাহীন মানুষের দায় নিতে হবে। ঋত্বিকের ছবিতে দেশভাগের যে ক্রিটিক আছে সেরকমই বিরানব্বইয়ের ক্রিটিক রাখতে পারবেন তো আজকের হিন্দুত্ববাদীরা? ৭১-এর নীতা, সীতা, অনসূয়াদের কাছে তো কাগজ চাওয়া যায় (কেউ কেউ হয়ত দিয়েও দেবেন), কিন্তু ৯২-এর সুতপা, অস্মিতা, মুনমুনদের কাছে কী চাইবেন? ওরা তো সত্যিই দেশভাগ দেখেনি, মন্বন্তর দেখেনি, দেখেছে শুধু দাঙ্গার ভয় আর শিখেছে ভুলে থাকতে। ওদের কাছে গল্প আছে। আজ সেই গল্পকে সত্যি বলে মেনে নিতে বললে তার মাশুল গুনতে হবে অনেক।

১৯৯২-এর পরে যারা এপারে এসেছে, তারা সবাই একদিন হঠাৎ করে চলে আসেনি। কেউ কেউ রাতারাতি বাড়িঘর বেচে চলে এসেছে তো কেউ সময় নিয়ে টাকাপয়সা গুছিয়ে এসেছে। এদের অনেকের বা প্রত্যেকেরই পরিবার পরিজন এদেশে ছিল এবং আছে। হয়ত এদের অনেকেই এদেশ-ওদেশের ধাক্কা সামলে আবার নতুন করে সংসার পেতেছে। তারা যা ভুলে গেছে, ঋত্বিক ঘটকের ছবি সেগুলোকেই গল্পের ছলে মনে করিয়ে দিতে থাকে। ঐতিহাসিক গল্পগুলিকে হিন্দুত্ববাদী গল্পে পরিণত করার যে চেষ্টা ওরা করবে বলে ভাবছে, সেই গুড়ে বালি পড়বে আমি নিশ্চিত। ঋত্বিকের ছবি আমাদের না-বলা ইতিহাসকে মনে রাখতে শেখায়। নতুন দেশের এই রূপ দেখে একবার অন্তত আহা বলতে বাধ্য করে। আর এই এনআরসি, সিএএ, এনপিআর আমাদের আবার করে মনে করাচ্ছে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া মা, মাসি, পিসির কথা, ফেলে আসা বান্ধবীদের কথা। নতুন দেশের নতুন ফ্যামিলি-ট্রি হিন্দুদেশের মানচিত্রে এখনও না শুকোনো দগদগে ঘা। ঋত্বিক ঘটক ওই ঘা লুকিয়ে রাখার কাজ করেননি কখনও।

লেখার শুরুতেই অ্যাবস্ট্রাকশনের প্রসঙ্গ এনেছিলাম। আবার সেখানেই ফেরত যাচ্ছি। ঋত্বিক বলেছিলেন সিনেমার চেয়ে প্রভাবশালী আর কোনও মিডিয়াম পেলে তিনি সিনেমাকে ‘লাথি’ মেরে চলে যেতেন। কথাটি শুনতে যতটা অহংপূর্ণ মনে হয়, ভাবনার দিক থেকে হয়ত ততটাই বিনীত। ঋত্বিকের ছবির আখ্যান বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যাবে, তা আসলে দেশ, ইতিহাস, এবং নাগরিক মানুষকে বোঝার একধরনের বৌদ্ধিক পদ্ধতি। চলচ্চিত্র দিয়ে সেই বোধ জাগ্রত রাখার ক্ষেত্রে ‘ঋত্বিক’ একটি অন্যতম চিন্তার সিস্টেম। অন্যান্য সব ভাবনার পরিকল্পের মতই ঋত্বিকেও পক্ষের এবং বিপক্ষের অবস্থান থাকবে। কিন্তু সেই গঠনতন্ত্রকে ফেলে রেখে ঋত্বিককে আত্মীকরণ করা একপ্রকার অসম্ভব। এই লেখায় আমি সজ্ঞানে ঋত্বিকের ছবির আখ্যান পাঠের প্রলোভন থেকে বিরত থেকে বর্তমান সময়কে তার প্রস্তাবিত সিস্টেম দ্বারা বোঝার চেষ্টা করছি মাত্র। 

১৯৬৮ সালে ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রী আন্দ্রে মারল-র সিনেমাথেক ফ্রঁসে থেকে প্রবাদপ্রতিম আর্কাইভিস্ট অঁরি লাংলোয়াকে বহিস্কার করার প্রতিবাদ মে ৬৮র ফরাসি গণ আন্দোলনের অন্যতম সূত্রপাত হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সেই বছরের কান চলচ্চিত্র উৎসবও এই আন্দোলনের ফলে বন্ধ হয়ে যায়। সমসাময়িক যে কোনও যুবকেন্দ্রিক আন্দোলনকেই ফরাসি আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে আবেগঘন হয়ে ওঠা ঠিক নয় জানি; প্রতিটি আন্দোলন তার নিজের সময় এবং সেই সময়ের সূক্ষ্মতায় নির্মিত হয়। কিন্তু মে ৬৮ আমাদের মনে করায় যে সিনেমার ইতিহাস প্রতিরোধেরও ইতিহাস। 

সিনেমার ইতিহাস মনে করায় যে ১৯৩৩ সালে জোসেফ গোয়েবলস নাৎসি জার্মানির তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী হন। আবার এই ইতিহাসই আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কীভাবে একটি গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি ‘রাম কে নাম’-কে সোশাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও ব্যান করে দেওয়া হয়। আজ যে লক্ষ লক্ষ মানুষ একে অপরের নাগরিকত্বের দাবিতে পথে নেমেছেন সেটা দেখে আমরা আশাবাদী। অতএব আজ যে ঋত্বিক ঘটককে হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের করে নিতে চাইছে সেটাও হয়ত ঐতিহাসিকভাবে হওয়ারই ছিল। 

এবছরের ২৩শে মে-র ভোটগণনার দিন একটা টিভি চ্যানেলে দেখছিলাম একজন বলছেন, যে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী ভোট কমে যাওয়া এবং সারা দেশে দক্ষিণপন্থী ভোট বেড়ে যাওয়ায় এখন নাকি দক্ষিণপন্থীদেরই উচিৎ বামপন্থার মতো বিরুদ্ধতাকে ধারণ করে রাখা, কারণ আদর্শ গণতন্ত্র বিরোধিতার মাধ্যমেই টিকে থাকে। তা বেশ। তবে ওই বিশ্লেষক হয়ত বামপন্থা বলতে শুধুই ভোটের রাজনীতি ভেবেছিলেন। হয়ত ভেবেছিলেন একটি নির্দিষ্ট দলের হারিয়ে যাওয়া মানে একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শও হারিয়ে যাচ্ছে হয়ত। কিন্তু বিভেদের রাজনীতি, সংখ্যাগুরুর রাজনীতিকে বেশি ঠেললে যে মানুষ পথে নেমে বামপন্থী হয়ে যায় তা ওরা ভুলে গেছেন। যে লাল পতাকাকে ওরা তেরঙা দিয়ে যুঝবে বলে ভেবেছিলেন, সেই তেরঙা যে আজ সাধারণ প্রান্তিক নাগরিকেরা ক্লেম করে বসবেন ততটা ভেবেছিলেন কিনা সন্দেহ হয়। ঋত্বিককে নিয়েও এরা এরকমই কিছু একটা করছেন হবে। কারণ গোটা লেখায় একটা আবশ্যিক কথা উল্লেখ করা হয়নি– ঋত্বিক ঘটক একজন ঘোর বামপন্থী চলচ্চিত্র নির্মাতা। ওনাকে স্পর্শ করলে ছ্যাঁকা তো খেতে হবেই।