Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা: সবকিছুকেই কবিতা নেয়

গীতা চট্টোপাধ্যায় | কবি

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, আগেও, অল্প দু চারটি যা পড়েছি, তাতে, এবং এখন, একটু খুঁটিয়ে পড়তে গিয়েও, মনে হয়েছে, কী বিশাল ও গভীর তাঁর পড়াশুনো, কত প্রচুর তাঁর লেখালেখি, কত অসামান্য তাঁর ছন্দপ্রকরণ, বিষয় নির্বাচন, ঐতিহ্যশীলতা, আর কী অদ্ভুত তাঁর নীরবে ও সম্পূর্ণ আড়ালে থেকে এই কবিতাচর্চা, আর কী অল্প অধিকাংশ পাঠকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, কী অল্প অধিকাংশ পাঠকের হৃদয়ের মাপ।

তবে এই কথাটি বার বার বলে বলেও কোনও লাভ সে অর্থে নেই। কেননা, এই কথাগুলোও প্রায় রোজকার কৃতকর্ম হয়ে উঠেছে। এসবের পরিবর্তে বরঞ্চ কিছু কবিতা পড়ে নেওয়া প্রয়োজন এখন। পড়িয়ে নেওয়া দরকার মানুষজনকে কিছু কিছু লেখা। অপ্রাপণীয় যে বইগুলির রচয়িত্রী তিনি, সে বইগুলি পুনর্মুদ্রণ করাও দরকার। এসব জরুরি কাজ না করে যদি হা হুতাশে কাটে দিন, তা হবে গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার প্রতিই অশ্রদ্ধা।

গীতা চট্টোপাধ্যায়ের তিনটি বই, বাংলা সন ১৩৭৯, ১৩৮০-র ভেতরে প্রকাশিত, তিনটিরই প্রকাশক কবি ও কবিতা প্রকাশনা সংস্থা, ১০ রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিট, কলকাতা-৬। ‘গৌরী চাঁপা নদী, চন্দরা’, মীনাঙ্কসোপান’ (এটা কাব্যনাট্য সঙ্কলন), ‘সুপ্ত দিবানিশি কলকাতা’। ‘বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে বঙ্গ ইতিহাস’ পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ, সম্ভবত ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত।

বইগুলি সামান্য উপরি উপরি পাঠের উপযোগী নয়, আমরা যাকে বলি স্যাম্পলিং, একেবারেই সেরকম সস্তাদরের উপভোগ্যতা নেই এই সব বইয়ের, রচনার। অথচ একই সঙ্গে, সঙ্গে নিয়ে থাকার, নীরবে নির্জনে বসবাসের উপযোগী এই বই কয়টিকে সেভাবে, একেবারে নির্দিষ্ট এক পাঠকগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরার অবকাশই বা হল কোথায়, যাকে বলে টার্গেট গ্রুপ? ফলত, দু মলাটের ভেতরে বন্দি বইগুলি থাকে, থেকে যায় তাদের নিজস্ব বলয়ে, নিজের পৃথিবীতে, অনাবিষ্কৃত ভূখণ্ডের মত। অন্তত আমাদের মেনস্ট্রিম লেখালেখির বলয়ে, অত্যন্ত গোবরগণেশ পড়াশুনোর বলয়ে তো বটেই।

 

ছন্দ-প্রকরণ, ভাষাবলয়

উল্লেখ্যভাবে গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা একটা ছন্দের শৃঙখলায় বাঁধা লেখ্যভাষার কবিতা। এই ডিসিপ্লিন এতটাই সর্বাতিশায়ী যে অন্যকিছুর আগে এটাই চোখে পড়ে। আদিগন্ত যা কবিতা তিনি লিখেছেন, পয়ার, মহাপয়ার ও মাত্রাবৃত্তের ঘনসন্নিবদ্ধ, আঁটোসাটো এক মহার্ঘতায় ঘিরে দেন তিনি। সুদূর, অতীতবাহিত এক সময়কে মিউজিয়াম পিসের মত নিটোল কাচের বলয়ে বেঁধে রাখার মত এই সজ্জাময়তা। যা তাঁর কবিতাকে যথাযথ, সিরিয়াস, এবং তুলনাহীন করে তোলে বহুঘৃষ্ট হীরকখণ্ডের মত। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য বোধহয় ভাষার শুদ্ধি, অত্যধিক সংস্কৃত উল্লেখ, রেফারেন্সক্রমে অথবা বাংলা কথা অনুষঙ্গে, প্রাচীন পারস্যগালিচার মত এক গভীর দুষ্প্রাপ্যতা দেয় যা তাঁর লেখাকে। এই কবিতার সঙ্গে আপনিও কিছুক্ষণ থাকুন, পাঠক, আপনার কলমেও অবলীলায় আসতে শুরু করবে, আমারই মত, ঘৃষ্ট বা মহার্ঘ-এর মত শব্দ, তৎসম-কেন্দ্রিক হয়ে উঠবে আপনার চিন্তাভাবনা৷ তবে শুধু তৎসম নয়, তদ্ভব, দেশজ ও বিদেশি শব্দের, বিশেষত চেতনার সচেতন বাঙালিয়ানার সঙ্গে সঙ্গে সচেতন ইংরিজি ব্যবহার। এইসব কথাই উদাহরণ-নির্ভর। একটু একটু দেখা যাক।

তাঁর কবিতার নামকরণেই পাই, থরে-বিথরে, গভীর বেদ-উপনিষদ-বৌদ্ধশাস্ত্র ঘাঁটা বৈদূর্য। ‘ভূর্ভূ বঃ স্বঃ’ অথবা ‘শ্যামাস্তমালদ্রুমৈঃ’ যখন গৌরীচাঁপানদী, চন্দরা-র এক একটি বিভাগনাম, কবিতাশীর্ষক তখন তত্র কা পরিবেদনা, অথবা তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি, ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকৎ, প্রণতোহস্মি দিবাকরম, মহতী বিনষ্টি বা ওঁ মণিপদ্মে হুম…।

আমাদের দিন গেছে প্রদোষাহ্নে মালতী বসাক!
যকৃৎ অক্ষম হলে পালটাবেই জীবনের মানে,
হৃদয় বিক্ষত হলে অন্য কোথা অন্য কোনওখানে
আপ্তবাক্যে শান্ত হত যথারীতি বাধ্য ক্যাডিলাক।

উপরের কবিতাংশটি ‘তত্র কা পরিবেদনা’ কবিতা থেকে তোলা। আশ্চর্যভাবে, এখানে কোনও রাবীন্দ্রিক শুচিবায়ুগ্রস্ততা দেখছি না, আমরা, যদিও দেখছি অনায়াসে আত্তীকৃত পঙক্তি ‘অন্য কোথা অন্য কোনওখানে’। দেখছি না বেদ-উপনিষদবাহিত জীবনদর্শনের কোনও ছাপ, বরঞ্চ, উপযুক্তভাবে ৭০ দশকের কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কলমে উঠে আসছে শ্লেষ ও জীবনানন্দীয় অ্যাংস্ট, বিষাদ-উদ্বেগময় অন্ধকার।

রৌপ্যচক্রে কেনা যায় স্বচ্ছলতা, সুখ বহুদূর

এ বিশ্বের সবচেয়ে পরিণত কোন সে মানুষ?
দুর্ধর্ষ নাস্তিক কিংবা অতিনম্র ভাবালু প্রেমিক—
যে পোড়ে বুদ্ধির ঝাঁঝে, যে-বা ডোবে আতুর বন্যায়?
বাহুবল ক্ষাত্রবীর্য, বীরভোগ্য বিধি মাৎসন্যায়?

….

বেদের মহিমা ঠেকে সপ্তরথী ব্যূহে অপৌরুষ
স্বৈরাচারী পুষ্পধনু, প্রজাপতি বিবাহ-বণিক।
তথাপি জীবনবৃন্তে কেউ খোঁজে দুর্বোধ্যের সায়
রৌপ্যচক্রে স্বর্ণসূত্রে স্বচ্ছলতা কেউ খুঁজে পায়।

…..

বুদ্ধবন্দনা করতে করতেও তাই গীতার কলম বলে উঠেছে এক বিষণ্ণ অবিশ্বাসের কাহিনি, আর্তি উঠেছে অসম্পূর্ণতার। “সঙ্ঘারামে আমার সংশয়”।

 

পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম

গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় যেমন রবীন্দ্রনাথ, তেমনি জীবনানন্দ, ঔপনিষদিক আস্তিক্যবোধের পাশাপাশিই রয়ে যান। ‘হেমন্তের মাঠে পিতা’ কবিতায়, আমি বোধ করি, রয়ে গেছে সেই অঙ্গীকার। পিতৃত্ব-স্বীকরণের মাধ্যমে সেই গভীর ঋণপালন। কবিতাটি প্রায় পুরোটাই উল্লেখ্য, তবু দীর্ঘ কবিতাটির গমনপথ লক্ষ্য করলেই আমরা বুঝতে পারব গতিপ্রকৃতি।

হেমন্তের মাঠে যেতে বড় ভয় হয়।
হেমন্তের মাঠ ভরে মৃত্যুগুলি জেগে আছে।
অপরাহ্ন-বিষণ্ণ আলোয়।

এভাবে শুরু কবিতাটির। এর পর পাই অমেয় ও অমোঘভাবে জীবনানন্দীয় অনুষঙ্গভার: শিশির, ডুমুরপাতা, ঠান্ডায় জমাট ডিম, ঘাসের পোকা, আধহাঁটু পাটক্ষেত…।

তারপর আসে ‘মৃত্যুর নিজস্ব এক গন্ধ আছে— শ্বাসরুদ্ধ নীল…’।

তারপর বলা হয় হেমন্তের মাঠ পার হয়ে যায় জ্যোতির্ময় শব/ আল ধরে নেবে যায় রাজার হরকরা…

অবধারিতভাবে আমাদের মনে পড়ে যায় জ্যোতির্ময় রবীন্দ্রনাথ। ‘হেমন্তের মাঠে যেতে পায়ে পায়ে অপ্রমেয় শোক’। তারপর নতুন শ্লোকে,

‘কিছুই শোকের মত শুদ্ধ নয়’।
‘কিছুই শোকের মত দ্রষ্টা নয়’;

আমরা অন্যতর এক শোকের সন্ধান পেয়ে যাই।

শোক কি নির্লিপ্ত করে সন্ধ্যার মতন?— হেমন্তের মাঠে বড় বিচ্ছেদবেদনা।

এর পরেই আমাদের প্রার্থিত সেই যোগাযোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে:

হেমন্তের মাঠে পিতা রয়েছেন শুয়ে—
তাঁর রক্ত পদ্মমুঠি ধানের তুষের ধারে ক্ষত
শিথিলচরণ দুই কুয়াশায় ডুবে আছে ঘুমে

চোখ তবু জ্বলে উঠে খোঁজে তাঁর উত্তরপুরুষ
চারপাশে মৃত্যুগুলি মেঠো ইঁদুরের দাঁতে
স্মৃতিকে কেবলি করে ভোঁতা…

হেমন্তের মাঠে এই একবুক অন্ধকারে
কি আশায় দাঁড়িয়েছি শূন্য হাত মেলে?
তবে কি আমিই তাঁর মনোনীত উত্তরপুরুষ?

আসলে, কবিতায় নিজেরই অজান্তে নিজের নিয়তি-অক্ষর রচনা করেন কবি। হয়ত গীতাও চেয়েছেন নিজের জন্মরহস্যকে এভাবেই বিবৃত করতে।

 

আত্মদীপো ভব

তথাপি গীতা চট্টোপাধ্যায় এক নারী। এবং নারীর বাচননির্মাণে তাঁর কিছু কথা থেকেই যায়। তাঁকে আমরা এখনও মনে রাখি বিখ্যাত সেই কবিতা ‘উঠোনে ধানের রাশি খেয়ে যায় মহিমায় ঘোড়া/ কর্তার ঘোড়ার সামনে কী করে বা যেতে পারে নারী’ নির্মাণে স্বয়ংসিদ্ধা গীতার শ্লেষাত্মক জবানিতে নারী-অস্তিত্ব উঠে আসে অব্যর্থ ছন্দকুশলতায়। এক আলোছায়াময় কৌম ও প্রাচীন পৃথিবী ফুটে ওঠে তাঁর লেখায়। ‘’আর তুই পুতুল খেলবি?’/ কপালে দিলেন লাল দাগা।/ ‘আর তুই চৌকাঠ ছাড়াবি?’/ হাতে দেন রাঙারুলি শাঁখা।/ ‘ঘাটে গিয়ে দেরি হবে তোর?’/ দু’পায়ে আলতার শক্ত ডোর।/ বেদনা আরম্ভ তারপরে/ অন্ধকার শিল্পের ভেতর।’

গীতা এইভাবেই যুগান্তপ্রেরিত বাংলাভাষা-ঐতিহ্যের প্রান্তসীমায় নিজেকে বসিয়ে রাখেন, আর বোঝেন তাঁর নিজ স্থানটিকে, যে দর্শন, যে চোখদুটি একেবারে তাঁর নিজস্ব:

‘তরাসে কাঁপিস কেন মেয়ে, কোনও পরপুরুষকে দেখে?’
‘-না মা, মেঘ বিজুলছে।’
‘আকখুটে, কোথায় রাখিস বেলাশেষ ভরন্ত কলস?’
‘-পিছল পৈঠায় পড়ে ঘট ভেঙে গেছে।’
‘খুব কি লেগেছে বাছা, ওষ্ঠাধর রক্তাক্ত এমন!’
‘-কই কিছু জানি না তো, ঘরে ফেরা পথ অন্ধকার!’
‘ও মেয়ে, ফেরা তো চোখ, দৃষ্টিহীন কেন তোর তারা?’
‘-এখনো দিই নি সন্ধ্যা, চোখ খোঁজে চোখের আলোক।’
‘একী, কালশিরা-চিহ্ন গোপন রাখিস দেখি নীলশাড়ি বুকের আঁচলে?’
‘-এ আমার আজন্মের অহঙ্কার প্রিয়তম দাগ।’
‘থির হয়ে এইখানে দু-দণ্ড বসে নে, শ্বাস উথাল-পাথাল।’
‘-এবার নিঃশ্বাসগুলি দীর্ঘ হয়ে যাবে, এই ভয়!’
‘অন্ধকারে সেই ভয়ে আবার পিছল ঘাটে চলে যাবে নদীর উদ্দেশ
পুরনো বাঙলার মেয়ে, ছিল যার একদিন ঘর হৈতে আঙিনা বিদেশ!’

(ঘর হৈতে আঙিনা বিদেশ)

কবিতাটি পুরোটা উদ্ধৃত করার একটাই কারণ, টুকরো টুকরো করে কোনও কবিকে বোঝা যায় না। বিশেষত এমন একটি পূর্ণায়ত গানের মত গমক-ঠমক, ব্যঞ্জনা-ইঙ্গিতসম্পন্ন কবিতার ব্যাপারে কোনও কথা বলা প্রায় অসম্ভব, যদি না কবিতাটি থাকে একবারে সামনে। প্রতিটি শব্দের ভেতরে একাধিক অর্থ পুরে দিয়ে, প্রায় প্রাচীন মা-দিদিমাদের মত রহস্যালাপ করে, রস-পূর্ণ এই কবিতার নারীত্ব এতই বহুবিস্তারী ও অভিভবময়, যে এটি প্রায় অনন্য উদাহরণের মতো বলে দেয়, গীতা চট্টোপাধ্যায়ের হাতে কীই না সম্ভব।

‘কবিতার গেরস্তালী’ কবিতায় আশাপূর্ণা দেবীকে নিয়ে তাঁর শ্রদ্ধানিবেদনে তিনি জানান, আশাপূর্ণা যেমন লেখেন তেমনটি ঠিক লিখতে পারলে গেরস্তালি কবিতা হয়। এবং সেখানে, একটি একটি কড়িবরগা কবিতারও, মাছের আঁশ, ফুলদানি, চটের জমির সুতোর ফোঁড় ইত্যাদির সঙ্গে। এই কবিতায় আছে ভিজে হাতে মস্ত একটা খোঁপা বাঁধার অনুভূতি… এই কবিতায় আছে এই খবর যে ভেলভেটে মোড়া আলমারিতে কাচের পুতুল, ফরাসিনী মন-মোহিনী ও গলার নিচে একটুখানি প্যারিস-আঠা, এই

‘সবকিছুকেই কবিতা নেয়।’
‘সমস্ত কবিতা লেখো, কবিতা সমস্ত কারণ।’

সবকিছুকেই কবিতা নেয়। সবকিছুকেই কবিতা নেয়। গীতা চট্টোপাধ্যায় জানান, তাঁর নারী অস্তিত্ব, সাংসারিক অস্তিত্ব, তাঁর অসূর্যম্পশ্যা অস্তিত্ব, আসলে কবি-অস্তিত্বের সঙ্গে কোথাও বেজোড় নয়, বেমানান নয়।

গীতা চট্টোপাধ্যায়ের চলে যাওয়া বাংলাভাষার কবিতাভুবনকে, নিভৃতে, আরও বেশি রিক্ত করে দিয়ে গেল।