সে কেন জলের মতো… অথবা সরলপদ্যপাঠ সহায়িকা

শিবাংশু দে

 

“মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর

পোড়ো বাড়িটার

ঐ ভাঙা দরজাটা।

মেলাবেন।

পাগল ঝাপটে দেবে না গায়েতে কাঁটা।

আকালে আগুনে তৃষ্ণায় মাঠ ফাটা

মারী-কুকুরের জিভ দিয়ে খেত চাটা,–

বন্যার জল, তবু ঝরে জল,

প্রলয়-কাঁদনে ভাসে ধরাতল–

মেলাবেন।”

(সংগতি — অমিয় চক্রবর্তী)

তিনি হয়তো মেলান, কিন্তু কবিতা মেলায় কি? আর কবিতা যদি নাই মেলায়, তবে কবিতার কাজটা কী? কেন লোকে কবিতার কাছে যায়। বিচ্ছিন্ন হতে, না সম্মিলিত হতে? কবিতায় অবসাদের স্বাদকে অতীন্দ্রিয়ের প্রসাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার একটা চলন আছে। আছে দুঃখবোধের থোড়ে নেশাগ্রস্ততার কলাবৌ। তারা কখনও নেহাৎ একা, কখনও একতার স্বর। সব মিলিয়ে কবিতা হয়ে ওঠার আকুলতাটি কিন্তু প্রচ্ছন্ন থাকে না। কবি অমিয় চক্রবর্তী এই আকুলতাটিকেই মনে করেন কবিতার মূলধন। আকুলতা না থাকলে মিলবে কী করে? ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়ির ভাঙা দরজা?

আমাদের শাস্ত্রে বলে, “কবিতা বনিতা চৈব সুখদা স্বয়মাগতা।” অর্থাৎ কবিতা ও বনিতা তখনই সুখদা হতে পারে, যখন তারা স্বয়ম এসে সমর্পিতা হয়। তাই এ অধম কবিতা নিয়ে কখনও তর্ক করে না। করে না প্রিয় নারীসঙ্গের যৌক্তিকতা নিয়ে। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া অনুভূতিনির্ভর, তর্কনির্ভর নয়। কবিতাবোধের সার রয়েছে ‘বোধে’র ভিতর, ‘সমারূঢ়’ নির্ভর কবিতাচর্চার সঙ্গে নেই। “আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার মনের কাছে…..”

***

সব ভাষাতেই কবিতা পড়ার পাঠপদ্ধতি সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায়। এই শিল্পে কবি ও পাঠকের ভূমিকা মুদ্রার দুই পিঠ। কবি পাঠকদের তৈরি করেন, না পাঠকরাই কবিতার প্রধান স্রষ্টা এটা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কাব্যভাবনার ক্ষেত্রে বদলটা আসে ধীরে। কিন্তু কাব্যভাষা দ্রুত পালটায়। হাল আমলে তো প্রতি দশকের হিসেবে কবিতাকে বর্গীকরণ করা হচ্ছে। জানি না, যেসব লেখা ‘কবিতা’ হয়ে ওঠে তাদের ক্ষেত্রে এ জাতীয় দশকওয়ারি গণনা কতটা সমীচীন।

বিশের দশকে বাংলাকবিতায় পড়ার অভ্যেসটি বদলে দেবার কৃত্যটি যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। তাঁর সেরিব্রাল আধেয় ছিল নিঃসন্দেহে গভীর। নিজে কবিতা লিখতেন দাপটের সঙ্গে। তাঁর প্রধান শক্তিটি ছিল বিশ্বকবিতার অধুনাতন গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসা আর পঠন আগ্রহ। বিদেশি শৈলি ও কৌশল এদেশের কবিতায় প্রয়োগ করা বিষয়ে তাঁর উৎসাহ বহু সমকালীন ও ভাবী কবিদের অনুপ্রেরিত করেছিল। তাঁর থেকে উৎকৃষ্ট কবি সেকালে আরও ছিলেন। কিন্তু পাণ্ডিত্য ও সংগঠক হিসেবে বাংলা কবিতায় বিশের দশকে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে কবিতা ও কবি বিষয়ে তাঁর মতামত কখনও কখনও বেশ বিতর্কিত বা একমুখী হয়েও পড়ত। আধুনিক বাংলা কবিতার পরিভাষা যে কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে তাঁর মতটি এরকম,

“….অর্থাৎ, এই আধুনিক কবিতা এমন কোনও পদার্থ নয় যাকে কোনও একটা চিহ্ন দিয়ে অবিকলভাবে শনাক্ত করা যায়। একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য। অন্তর্মুখিতা ও বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম। আধ্যাত্মিক জীবনের তৃষ্ণা, এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে, শুধু ভিন্ন ভিন্ন কবিতে নয়, কখনও হয়তো বিভিন্ন সময়ে একই কবির রচনায়।”

নিজের পছন্দের লক্ষণের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বাংলা কবিতার প্রতিনিধিত্বমূলক একটি সংকলন গ্রন্থিত করার চিন্তা তাঁর মনে বছর পনেরো ধরে জাগরুক ছিল। সেই ক্রমে  বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদনায় ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত দশ বছরের মধ্যে চারটি সংস্করণ মুদ্রিত হয়। এই সংস্করণটির প্রথম কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১) এবং সূচিপত্রে শেষ নাম অলোক রঞ্জন দাশগুপ্ত (১৯৩৩)। বাহাত্তর বছর জন্মসনের মধ্যে যেসব কবি বাংলাভাষায় লিখেছেন তাঁদের রচনা থেকে নির্বাচিত সংকলন ছিল এই বইটিতে। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় বুদ্ধদেব লিখেছিলেন, “….বাংলা কবিতা রূপে-রসে উজ্জ্বল ও বিচিত্র, পরিমাণেও প্রচুর, অথচ সেই তুলনায় সংকলনগ্রন্থ যথেষ্ট নেই। গত কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যে যে-ক’টি বেরিয়েছে, বিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকা বা বৈবাহিক উপহার লক্ষ্য করার জন্য তারা সাহিত্যিকের পক্ষে তৃপ্তিকর হতে পারেনি। বাংলা বইয়ের কাটতির এই সুপারিশ দুটি এড়িয়ে গিয়ে শুধু আনন্দের জন্যই কাব্যচয়নে প্রবৃত্ত হবার প্রয়োজন আছে। ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সেই ধরনের প্রথম প্রচেষ্টা, বলা যায়।”

“….শুধু আনন্দের জন্যই কাব্যচয়নে প্রবৃত্ত হবার প্রয়োজন ” ঘোষণাটি বাংলাকবিতায় প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য বুদ্ধদেব ‘প্রথম প্রচেষ্টা’ হিসেবে এই সংকলন গ্রন্থটির আয়োজন করেছিলেন। এই বইটি নিয়ে অসংখ্য লোক আলোচনা করেছেন। এমন কি শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষও আছেন তাঁদের মধ্যে। ‘আধুনিক’ বাঙালির কবিতা পড়তে শেখার যাত্রাটিতে এই সংকলনটির নিজস্ব স্থান রয়েছে। সংকলিত কবিতার সংখ্যা দিয়ে সম্পাদক ও অন্যান্য পাঠকের ‘রুচির বৈষম্য’ কিছুটা বোঝা যেতে পারে। দশের বেশি কবিতা রয়েছে পাঁচজনের। সমর সেনের ১৩টি, বুদ্ধদেবের নিজের লেখা ১৫টি, রবীন্দ্রনাথ ও অমিয় চক্রবর্তীর ১৬টি করে এবং বুদ্ধদেবের পরিচিত কাব্যরুচিপ্রবণতার কথা ভাবলে হয়তো একটু বিস্ময় লাগে, জীবনানন্দের সর্বাধিক ১৯টি কবিতা রয়েছে। ১৯৩১ সালের পরবর্তী জাতকদের মধ্যে একা অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের দু’টি কবিতা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যম’ কবিতাটি তিনি ১৯৫৬ সালে ‘কবিতা’ পত্রিকার জন্য মনোনীত করেছিলেন। তার পর ‘জরাসন্ধ’। শক্তির মতে তাঁর প্রথম হয়ে ওঠা ‘কবিতা’। ১৯৬০ সালে ‘হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ্য’ও প্রকাশিত হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর কোনও নির্বাচনযোগ্য কবিতা বুদ্ধদেব খুঁজে পাননি। ১৯৫৩ সাল থেকে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা ও কাব্যচর্চা চালিয়ে এসেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৫৮ সালে ‘একা এবং কয়েকজন’, কিছুদিন পরেই ‘বন্দী জেগে আছ’ প্রকাশিত হয়েছিল। তবু তাঁর কবিতা স্থান পায়নি এই সংকলনে।

আলোচ্য সংকলনটির কয়েকটি কবিতা আলাদা করে পড়তে বসে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হল তা নিয়েই আপাতত ভাবছি।

***

“কী ভালো লাগলো আমার এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;

চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,

মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।

 

তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তার পর গেলে ওদিকে,

ইস্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, তাই দেখতে।

গড়ি চলে গেলো।– কী ভালো তোমাকে বাসি,

কেমন করে বলি।

 

আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায় না।

গোরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত!

তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে এসে আমরা পাবো

যা এতদিন পাইনি।”

(চিল্কায় সকাল — বুদ্ধদেব বসু)

মুগ্ধতা ছাড়া শিল্প হয় না। দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত বা গহন চিন্তাশীল মানুষেরা সচরাচর মুগ্ধ হতে ভুলে যা’ন। তাঁদের বোধের জগৎ ঝুঁকি নিতে চায় না। মুগ্ধতা প্রবল ঝুঁকির সন্দর্ভ। পাণ্ডিত্য আর শিল্পীর ক্রিয়াশীলতা সমান্তরাল চলে। তাদের শুরু বা শেষ, কোথাও হাতধরাধরি নেই। এই যেমন উল্লিখিত বিখ্যাত কবিতার লাইনগুলি লিখেছেন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু। যাঁর পাণ্ডিত্য, সাহিত্যবোধের চোখ ধাঁধানো প্রখরতা আর সমুজ্জ্বল অভিভাবকত্ব বাংলা শব্দশিল্পকে ছায়া দিয়েছে বহুকাল। কিন্তু কবিতা লিখতে বসে তাঁর মুগ্ধতাবোধের সীমা পৌঁছে যাচ্ছে বিপরীত মেরুতে। তিনি আকুলতাবোধ করছেন পাঠকের সঙ্গে একাত্ম হতে। কবিতার যা কাজ। সেখানে তাঁর বোদলেয়ার, রিলকে বা মালার্মের শোভিত অক্ষরজগতের প্রতি কথিত আনুগত্য ছাপিয়ে রূপ নিচ্ছে একটি হ্রদ, একটু হরিৎ আর কোনও হ্লাদিনীর পরস্পর মিশতে থাকা দৃশ্যের ক্যালাইডোস্কোপ। পাঠক এই নির্ভেজাল রূপকল্পকে স্পর্শ করতে পারে। তাই কবির এই অবস্থানটি কী তাঁকে নির্ভেজাল পাণ্ডিত্যের জমাট বিশ্ব থেকে সরিয়ে এনে স্বস্তি  দিচ্ছে? বসন্তের বাতাসটুকুর মতো?

কবিতানির্ভর চর্চায় ‘কোয়ান্টিটি’র ভার ক্লিষ্ট করে। সাড়ে চার পাতার ‘কবিতার কথা’ এখনও একটা বাতিঘর। আর ‘কোয়ান্টিটি’র কথা যদি ধরা হয়, তবে কৃত্তিবাস, চৈতন্যপ্রসঙ্গ বা মঙ্গলকাব্য নিয়ে সব চেয়ে বেশি কথা বলা হয়েছে।

***

নামলো সন্ধ্যা,

সূর্যদেব, নামলো এখানে সন্ধ্যা,

কবিতার সন্ধ্যা

পিলু বারোঁয়ার সন্ধ্যা।

একাকার এই ম্লান মায়ায়

জাগরহৃদয়ের গোধূলিলগ্নে

শুধু নীলাভ একটু আলো এলো

তোমার পোস্টকার্ড,

আর এলো তোমার ট্রেনের অস্পষ্ট দূরাগত ডাক।

 

সূর্যদেব, এর পূরবী ওর বিভাসকে আশীর্বাদ করে চলে যাক।

(টপ্পা-ঠুংরি — বিষ্ণু দে)

কবিতায় ‘হয়ে ওঠা’ থাকে, ‘করে তোলা’ নয়। “সূর্যদেব, এর পূরবী ওর বিভাসকে আশীর্বাদ করে চলে যাক।” একটা কবিতা হয়ে উঠছে। কোনও হট্টগোল ছাড়াই। যখন প্রথম কৈশোরে বোধের জগৎটিকে লাল মলাট পরাতে শুরু করেছিলুম, তখন একটা থিওরি ছিল “সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা : শিল্পীর আয়ুধ।’ প্রভাবিত হইনি বলা অতিশয়োক্তি হবে। কিন্তু খুব শিগগিরিই বুঝতে পেরেছিলুম যদি শোলোকভ ভালো লাগে, তবে লেখার জোরেই লাগবে। পাস্তেরনাককে যদি অবজ্ঞা করতে হয়, তবে লেখার কমজোরিই প্রধান বিবেচ্য হবে। মায়াকোভস্কিকে ভালো লাগার জন্য কারও সুপারিশ লাগে না।

***

সমর সেন যখন  In defence of decadence লিখে একঘরে হ’ন, আমি তাঁকে ছাড়ি না। ছাড়তে পারি না, দাগানো লালঝাণ্ডা হওয়া সত্ত্বেও। ট্র্যান্সকবিতার অঘোরপন্থীরা, শক্তি বা বিনয়, আমার প্রিয় কবি। সাড়ে তিনদশক আগে প্রমত্ত শক্তির সঙ্গে ‘এত কবি কেন’ প্রশ্নে মুখোমুখি রীতিমতো ‘লড়ে’ যাওয়া। সবই তো আছে এই জীবনেই। কবিতা জ্ঞানের বাহন নয়। লুকিয়ে সটকে শেখানোর কোনও ম্যাজিক তার মধ্যে নেই। আমাদের ভাষায় কবিতা বিষয়ে সফল গদ্যের প্রথম  প্রণেতা আবার সেই রবিবাবু। তবে এই বিষয়টি লেখার সময় তিনি কবি এবং শুধুমাত্র কবি। সেই ঘরানায় বুদ্ধদেব, বিষ্ণু, জীবনানন্দ, সমর, আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং পরবর্তীকালে অনেক কবি বিশেষত নীরেন্দ্র, শঙ্খ, সুনীল এবং জয় কদাচ কবিতা বিষয়ে গদ্য লেখার সময় নিজেদের ‘কবিত্ব’ থেকে বিচ্যুত হননি। (আমি উত্তর আধুনিক পণ্ডিতদের এর মধ্যে আনছি না।) কবিরা মাস্টার নন, তা হলে ‘সমারূঢ়’ লেখার প্রয়োজন  হত না। কোটেশন কণ্টকিত কবিতার ব্যাখ্যা লেখার প্রয়োজন  ক্লাস নাইনের পর আর নেই। কবিতা ‘বুঝতে’ পাণ্ডা লাগে না। কারণ সমস্ত কবিই সামগ্রিকভাবে বা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কবিতা নিয়ে যা বলেন তার ব্যাকরণ তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত। তাও বহুসময় একধরনের কবিতা হয়ে ওঠে। কোনও স্বতঃসিদ্ধ ফর্মুলা নেই। যেটা পাওয়া যেতে পারে সেটা তাঁদের হাত ধরে ভালো লাগা বা ভালো না লাগাটুকু ভাগ করে নেওয়ার সুখ। তার অসীম মূল্য আছে আমি তা স্বীকার করি, কিন্তু কখনও তো নিজের পায়ে (নিজের অনুভূতিতে) দাঁড়াতে হবে। তখন নীরবতাই শেষ উত্তর।

***

“……রাত্রিকে কোনোদিন মনে হতো সমুদ্রের মতো।

আজ সেই রাত্রি নেই।

হয়তো এখনও কারো হৃদয়ের কাছে আছে সে-রাত্রির মনে।

আমার সে-মন নেই

যে-মন সমুদ্র হ’তে জানে।

একবার ঝ’রে গেলে মন

সেই ঝরা ফুল আর কুড়োবার নাই অবসর;

তখন প্রখর সূর্য জীবনের মুখের উপর

তখন রাত্রির ছায়া জীবনের আয়ুর উপর

জীবন তখন শুধু পৃথিবীর আহ্নিক জীবন।”

(রাত্রিকে — সঞ্জয় ভট্টাচার্য)

কবিতার ব্যাখ্যায় অনন্ত সম্ভাবনা। কোনও একজন পারঙ্গম কাব্যশিল্পী যা আমাদের হাত ধরে শিখিয়ে দেবেন, সেটাই শুধু ধ্রুব, সেটাই প্রশ্নাতীত, সেই ধারণা কেটে গেছে বহুদিন। যেমন,

“……রাত্রিকে কোনোদিন মনে হতো সমুদ্রের মতো।

আজ সেই রাত্রি নেই।

হয়তো এখনও কারো হৃদয়ের কাছে আছে সে-রাত্রির মনে।”

সমসাময়িক জীবনানন্দ সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছেন। অজান্তেই হয়তো। সঞ্জয় সজ্ঞানে ফাঁদে পড়ার মানুষ ন’ন। কবিতা ভারতীয় দণ্ডসংহিতা নয়, যে তার ইন্টারপ্রিটেশন সব সময় একমুখী হবে। কোন ইন্টারপ্রিটেশন তাঁর অন্বিষ্ট ছিল, তিনিই জানেন। আমরা নিজেদের মতো করে ভাবতে চেষ্টা করছি। কবিতার ক্র্যাফট, অর্থাৎ তার শব্দচয়ন, অলংকারশাস্ত্রের প্রয়োগ, নাটকীয়তা, সংলাপের পরিসর এবং এ সব কিছুর থেকে একটা ‘মানে’ বার করার আকুল প্রয়াস এখন আর টানে না। ফুল নিজেই ফোটে। তর্ক ছাড়াই।

***

লোকপ্রিয় মানুষের সঙ্গে সংখ্যাগুরু মানুষেরা থাকেন। তাই সংখ্যালঘুদের একটা বিপদ তো থাকেই গণতান্ত্রিক নিয়মে। তবে একটা পর্যায়ের পর সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ যখন থেকে “জলের মতো একা ঘুরে ঘুরে কথা কওয়াকেই” ‘কবিতা’ বলে জেনেছি, তখন হাটের ধূলাকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়ে গেছে।

***

“এবার ‘আমার ভালো লাগে না’ বললে আলোচনা শেষ।” ব্যক্তি আমার ‘ভালো লাগেনা’ সন্দর্ভটি অহমবোধ থেকে আসে। আর কবিতার কাছে আসাটা ‘অহমশূন্য’ হতে চাওয়ার প্রথম স্তর। যখন শুধু অনুভূতির কথা হয়, তখন ‘আলোচনা’র কোনও অবকাশ নেই। তর্ক, আলোচনা, বাদানুবাদ করার জন্য অন্য অনেক মাঠ রয়েছে। চার দশকের অধিক পেরিয়ে আসার পর প্রিয় কবিতা আর প্রিয় বনিতাকে আমি তার বাইরে রাখি। তর্ক করে তাদের ‘ভালো লাগানো’ যায় না। যেমন,

“… আজকে আমার মনের মাঝে

ধাঁই ধপাধপ তবলা বাজে

রাম খটাখট ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ

কথায় কাটে কথার প্যাঁচ।

আলোয় ঢাকা অন্ধকার

ঘন্টা বাজে গন্ধে তার।

গোপন প্রাণে স্বপনদূত,

মঞ্চে নাচেন পঞ্চভূত।

হ্যাংলা হাতী চ্যাং দোলা,

শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা।

মক্ষিরানী পক্ষিরাজ

দস্যি ছেলে শান্ত আজ….”

(আবোলতাবোল)

যে পারে সে অমনি পারে, পারেন সুকুমার রায়চৌধুরী নামে এক কবি। হ্যাঁ, বুদ্ধদেব এমনভাবেই নামটি লিখেছেন তাঁর এই সংকলনে। খেয়ালরস, অনুপ্রাস আর ধ্বন্যাত্মক শব্দ নিয়ে গড়ে তোলা কবিতার মোজাইক। বছর পাঁচেক পরেই একশো বছর হয়ে যাবে এই কবিতার। ‘আধুনিকতা’র সংজ্ঞা বোঝাবার জন্য এরকম উদাহরণ খুব বেশি পাওয়া যায় না। শেষের চার লাইন তো উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। উল্লেখ করিওনি। ‘দস্যি’ ছেলের কবিতা বাঙালির কাছে একদিন মন্ত্র হয়ে গেছে। আলাদা করে কিছু করতে হয়নি। ছবি, আওয়াজ, আলো, প্রতীক, উপমা, গতি অক্ষরবদ্ধ শব্দের ভিতর দিয়ে এঁকে ফেলার কবিতা ‘স্বয়মাগতা’ না হলে কবি ধরতেই পারবেন না তাকে। অনার্য শব্দসমুচ্চয় থেকে গড়ে ওঠা ধ্বনির গভীরগামিতা বালককে উল্লাস দেয়, প্রবীণকে জীবনের মিছুটান।

“… তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে

দিগন্তে দুরন্ত ঝড়ের মতো!

কিংবা আমাদের ম্লান জীবনে তুমি কি আসবে,

হে ক্লান্ত উর্বশী

চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে যেমন বিষণ্ণমুখে,

উর্বর মেয়েরা আসে:

কত অতৃপ্ত রাত্রির ক্ষুধিত ক্লান্তি,

কত দীর্ঘশ্বাস,

কত সবুজ সকাল তিক্ত রাত্রির মতো,

আর কত দিন!”

(উর্বশী — সমর সেন)

বাংলা কবিতায় মিথ হবার জন্যই যাঁর কিছুদিনের জন্য বেড়াতে আসা, সেই কবি বেশ বিপদে ফেলেছিলেন পাঠকদের, বিশেষ করে কাব্যসমালোচকদের। কীভাবে তাঁর কবিতা পড়তে হবে? পরিচিত ছাঁদ কিছু নেই। নেই মধ্যবিত্ত সুশীল সঙ্গতি। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য আবেদন প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি নির্মাণের। কবিতাকে অকস্মাৎ তিনি ত্যাগ দিয়েছিলেন। তুলনীয় কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো। বেশ কিছু কবিতাপাঠক বিশ্বাস করতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাব্যশরীরে সমর সেনের প্রকট ছাপ রয়েছে। যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা বিনয় মজুমদার গ্রস্ত ছিলেন জীবনানন্দে। হতে পারে। সুনীল নিজে বার বার বুদ্ধদেব বসুর প্রতি আনুগত্য জানিয়েছেন। ‘বন্দীর বন্দনা’র উত্তরে ‘বন্দী, জেগে আছো?’ সেসময় কবিতা আলোচনায় কয়েকটি ‘রেডিমেড কয়েনেজ’ ব্যবহার করা হত। ‘যুগযন্ত্রণা’, ‘নাগরিক অবক্ষয়’, ‘অতৃপ্ত ক্ষুধা’ বা ‘বিমূর্ত অবসাদ ‘, সবই সমর সেনের কবিতার প্রতি অনলস বর্ষিত হয়েছে। বাংলাভাগের উত্তরকালে নাগরিক জীবনের আন্ডারবেলি যেভাবে এসেছে জীবনানন্দে বা প্রেমেন্দ্রে, সমর সেনে তার নিরাবেগ তীক্ষ্ণতা চমকে দিয়েছিল পাঠকদের। এই সংকলনে বুদ্ধদেব একটু অপ্রত্যাশিতভাবেই বিষ্ণু দে’র থেকে অনেকগুলি অধিক কবিতা সমর সেনের রচনা থেকে নিয়েছেন। “… অতৃপ্ত রাত্রির ক্ষুধিত ক্লান্তি” জাতীয় ইমেজারি বহু কবিই সেসময় ব্যবহার করতেন। অনেকেই খ্যাতনামা, প্রতিষ্ঠিত নিজগুণে। কিন্তু সমর সেন যেন অনায়াস নায়ক ছিলেন বাংলাকবিতার এই জঁরটির, মোটামুটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ‘সকালের কলতলা’, ‘ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক’, ‘ক্লান্ত গণিকার কোলাহল’, ‘মদির মধ্যরাত্রে’, ‘ মৃত্যুহীন প্রেম’ থেকে মুক্তি চাওয়া কাব্যভাষা এতটা অমোঘভাবে তখনও পর্যন্ত আর কেউ ব্যবহার করেননি।

“…. মেয়েদের চোখ আজ চকচকে ধারালো;

নেচে-নেচে ঢেউ তোলা, নাচের নেশায় দোলা

মিশকালো অঙ্গে কী চেকনাই!

মৃত্যুর মৌতাতে বুঁদ হয়ে গেছি সব

রমণী ও মরণেতে ভেদ নাই!

হে-ইডি, হাইডি, হা-ই!”

(নীলকণ্ঠ — প্রেমেন্দ্র মিত্র)

‘আমি কবি যত ইতরের….’ ঘোষণা নিয়ে এসেছিলেন  তিনি। ‘ফেরারি ফৌজে’র মতো একটি অপ্রতিরোধ্য রূপক ছিল তাঁর আস্তিনের ভিতর। সর্ব-অর্থে একজন ‘আধুনিক’ কবি। চার প্রজন্ম পেরিয়েও তাঁর কাব্যশরীর, অলংকারের ভাষ্য পাঠককে ফিরে পড়ায়। মন দিয়ে পড়তে বাধ্য করে। বাংলাকবিতার শিরদাঁড়ায় রসসঞ্চার করে অনিবার্য লিরিকমন্যতা। সঙ্গীতধর্মের পুনরাবৃত্তি লক্ষণটিই লিরিক-আশ্রিত। এই প্রবণতাটির নির্ভর করেই অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ বাংলাকবিতাগুলি রচিত হয়েছে গত দুশো বছর ধরে। সংস্কৃত মন্ত্রের জোরের জায়গা তার পুনরাবৃত্ত শব্দের ঝংকার। উপযুক্ত উচ্চারণে দৈবী অভিঘাত সৃষ্টি হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে পুরাতন রীতি। কিন্তু লিরিকছাঁদকে আত্মস্থ করেও প্রেমেন্দ্র মিত্রের আধুনিকতা ছিল তাঁর চিন্তার সার্বভৌম চলনে। কবিতাকে স্থান-কাল-পাত্রের সীমার মধ্যে বেঁধে রাখতেন না। হরিণ-চিতা-চিল, সব স্তরগুলিতেই সমান স্বচ্ছন্দ তাঁর ভাবনার যাওয়া-আসা। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে কবিতায় দৃশ্যের জন্ম নিয়ে তাঁর সহজ অধিকার, মনস্ক পাঠকের চোখে পড়বেই। তথাকথিত ‘কল্লোল-যুগে’ যেসব অগ্রণী বাংলাকবিরা যাত্রা শুরু করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতার মুকুট কে পেতে পারেন তা নিয়ে নানা মুনির বিতণ্ডা মনে না রেখেই বলা যায় প্রেমেন্দ্রকে সিংহাসনচ্যুত করা সহজ নয়।

***

শব্দ তো ব্রহ্ম, পবিত্রতম নির্মাণ। প্রতিটি শব্দের নিজস্ব আত্মা আছে। তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার মধ্যেই সিদ্ধি। অবশ্য  শব্দের মায়ায় ভুলে অনেকেই ‘আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে…’। একজন সচেতন কবি এই প্ররোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারবেন এটা প্রত্যাশিত। যেমন নির্জন স্বাক্ষরে প্রথম স্তবকের পরেই ‘রয়েছি সবুজ মাঠে, ঘাসে…’ যেই শুরু হল কবিতা এগিয়ে যেতে লাগল ‘আমি সেই পুরোহিত’-এর দিকে। মনেই পড়বে না এই কবিতা কোনও দিন ‘তুমি তা জানো না ….’ বলে শুরু হয়েছিল। যদিও এভাবে জীবিত বা মৃত কবিদের মাংসকৃমি খোঁটার কোনও প্রয়োজন নেই। সত্যি কথা বলতে কী, চার-পাঁচ দশক ধরে কবিতা পড়ার পুরাতন অভ্যাসের দাস হিসেবে এখনও মনে হয় কোনও রণকৌশলই ঠিকঠাক স্থির করা যায়নি। কীভাবে কবিতার মোকাবিলা করব সে বিষয়ে স্ট্রাকচার্ড কোনও প্রস্তুতি নেই। অন্য কোনও রকম শিল্পমাধ্যম নিয়ে এমত সংকটের সম্মুখীন হই না। কীভাবে কবিতা পড়ার চেষ্টা করলে সে স্বয়মাগতা, সুখদা হবে, জানা নেই এখনও।

***

বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত এই ‘প্রাচীন’ সংকলনটি ইশারা জানাচ্ছে সরলপদ্যপাঠসহায়িকা সম্পন্ন পাঠককে বিশেষ সাহায্য করে না। এ তো শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উপভোগ করার মতো ব্যাপার। স্বরলিপি, সুরসংস্থান কাগজে লিখে বোঝাবার চেষ্টায় সুরের নন্দনলোক আরও দূরে চলে যায়। কোন কবিতা কখন কীভাবে পাঠককে ট্রিগার করবে তার বোধহয় কোনও সহজ সমীকরণ নেই। জলের মতো একা ঘুরে ঘুরে কথা বলাই কবিতার অন্বিষ্ট।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...