Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গার্গী কলেজ থেকে ভুজের হস্টেল: যে কথাগুলো বারবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার

স্রোতা দত্ত আচার্য

 




লেখক জেন্ডার অ্যাকটিভিস্ট, সাংবাদিক ও প্রবন্ধকার।

 

 

মহারাষ্ট্রের গণেশ পুজো। মহা ধুমধাম। তাঁর বিসর্জনে ঢোল পেটাতে পেটাতে চলেছেন এক মহিলা। আপাতদৃষ্টিতে যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। বাদ্যযন্ত্রের নারীপুরুষ হয় না। উচিতও নয়। কিন্তু খটকা লাগে ভালো করে মন দিয়ে দেখলে। সেই মহিলার দৃপ্ত ভঙ্গি, তাঁর চলনও পুরুষালি। এমনকি ঢোল বাজানোর ঢংটাও।

প্রায় সেরকমই আরেকটি দৃশ্যপট ভাসে চোখে। সম্ভবত দশেরা উদযাপনে। ছোট ছোট ট্যাবলোতে সুসজ্জিত মহিলা। ‘সুসজ্জিত’ বললাম, কারণ পোশাক, উষ্ণীষ, তাতে গোঁজা নকল পালক, হাতে খাপ খোলা বাঁকা তলোয়ার। সমস্তটা নিয়ে যে ছবিটা তৈরি হয়, তা একদিক থেকে দেখলে বেশিরভাগ বলবে, “এই তো! মহিলাদের সফল সশক্তিকরণ’। কিন্তু সশক্তিকরণ মানে কি পুরুষালি ভঙ্গিমা বা যাপনের অনুকরণ? এই দুটো ভিডিও-র কথা মনে পড়লেই কেন জানি, মনের মধ্যে এই প্রশ্ন জাগে।

অবশ্য মহিলাদের সশক্তিকরণ/ শক্তিশালী করার ঘটনা যে এই রাজনৈতিক আবহে ঘটছে বা ভারতে একটা নতুনতর ঘটনা, তা কিন্তু নয়। অসুরের সঙ্গে লড়ে যখন দেবতাদের ল্যাজেগোবরে অবস্থা, তখনই নারীশক্তির জয়জয়াকার করে মহিলার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল একাধিক আয়ুধ। তাকে কি প্রকারান্তরে নারীদের উপর পুরুষতান্ত্রিকতার আরোপ বলা যায় না? তা কি নারীসত্তার উপর পুরুষতান্ত্রিকতার ক্ষমতায়নেরই এক রূপ নয়?

এ যদি পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা দিক হয় অন্যদিকটা তবে নিশ্চিতভাবে নারীকে অবলা চিহ্নিত করে আর এক ধরনের পৌরুষত্বের আস্ফালন। রাস্তাঘাটে মেয়েদের প্রতি টিটিকিরি, অশালীন মন্তব্য, গার্হস্থ হিংসা, অ্যাসিড হানা এখন এতটাই আকছার যে কেমন যেন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। সেসবের খবর আর আমাদের নাড়া দেয় না তেমনভাবে। কিন্তু বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরও একটা জিনিস অলক্ষ্যে ক্রমে ক্রমে জনমানসে জাঁকিয়ে বসেছে, যা আর এখন তেমন উপেক্ষণীয় নয়।

বেশ কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা গেছিল, এক বিকৃতকাম আধবুড়ো বাসে দুই তরুণী সহযাত্রীকে উদ্দেশ্য করে হস্তমৈথুন করছে। এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন এবং এক মানসিক বিকারগ্রস্ত পুরুষের আচরণ বলে উপেক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু বিষয়টা আর অবহেলার যোগ্য থাকে না, যখন দিল্লির গার্গী কলেজের ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি ও তাদের অমর্যাদার খবর ছড়িয়ে পড়ে।

মনে রাখতে হবে, ঘটনাটা ঘটেছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক দুদিন আগে। উত্তপ্ত রাজধানীতে একদিকে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী অবস্থান। অন্যদিকে ধর্মীয় মেরুকরণের তাসে নির্ভর করে নির্বাচনে মুখরক্ষার মরিয়া চেষ্টা। শাসক দল দুদিকেই তাল ঠুকছে। একদিকে সিএএ-র সমর্থনে পথে নামিয়েছে হাজার হাজার কর্মী -সমর্থকদের, অন্যদিকে শাহিনবাগ, সীলমপুরের মতো এলাকায় ধর্নাকারী মহিলাদের উদ্দেশ্যে ন্যক্কারজনক ভাষা ও ইঙ্গিত। সরকারিভাবে নির্বাচনী প্রচারের সময়সীমা শেষ হওয়ার পরেই ঘটে গার্গী কলেজের ঘটনা।

কলেজের ছাত্রীরা বন্ধ দরজার অন্দরে নিজেদের মধ্যে উৎসব করছিল। সেখানে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে একদল পুরুষ। উৎসব বন্ধ করে, মেয়েদের শৌচালয়ে বন্ধ করে, তাদের সম্পর্কে অশালীন কথা বলে, যৌন হেনস্থা করেই ক্ষান্ত দেয়নি তারা। অতজন ছাত্রীর সামনে, সামাজিকতার মুখে ছুতু ছিটিয়ে হস্তমৈথুনও করেছে। বেসরকারিভাবে শোনা যাচ্ছে, যারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে তারা শাসকদলের সমর্থক।

কাহানিমে টুইস্ট এখানেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসেই স্লোগান তুলেছিলেন ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’, নারীর ক্ষমতায়নের কথা উঠলেই কুমীরছানা দেখানোর মতো উঠে আসে ভারতের প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রীর নাম। এটা তো মুখোশ! কিন্তু আসলে এর আড়ালে রয়েছে মহিলাদের ভয় দেখিয়ে, অপমান করে দমিয়ে রাখার নতুনতর পন্থা। বর্তমান রাজনৈতিক সামাজিক দর্শন আসলে এই কথাটাই জনপরিসরে গেঁথে দিতে চায়। মেয়েরা আসলে ভোগ্য পণ্য, ব্যবহার্য বস্তু। অনেকটা গুপি গাইন বাঘা বাইন ছবিতে হাল্লারাজার সেই পুতুলের মতো। যখন ইচ্ছে তার পেট ফুঁড়ে দেওয়া যায়, যখন খুশি চোখ খুঁচিয়ে দেওয়া যায়। কারণ মহিলারা অবলা। তারা সতী। তারা সাবিত্রী, দময়ন্তীর আধুনিক সংস্করণ।

আধুনিকতার জোয়ারে না ভাসলে মন জয় করা সহজ নয়। কিন্তু সেই আধুনিকতা দু’নৌকোয় পা দিয়ে চলার মতো। ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ বা উজ্জ্বলা যোজনার উজ্জ্বল প্রচার মনে বিশ্বাস আনে, মনে হয় পুরুষতন্ত্র ও বর্তমান  রাজনৈতিক দর্শন মহিলাদের নিয়ে যথেষ্ট ভাবিত। কিন্তু উলটো চোরাস্রোতও তার বিরুদ্ধমতে ধোঁয়া দেয়। যেখানে মেয়েদের বোঝানো হয় তোমরা অপবিত্র।

এর সাম্প্রতিক উদাহরণ ভুজের একটি হস্টেলের ঘটনা। কোন মেয়ে ঋতুমতী তা পরীক্ষা করতে ৬৮ জন ছাত্রীর অন্তর্বাস খুলে পরীক্ষা করে দেখা হয়। এমনটা করেছেন সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষা। জানা গিয়েছে, সেই ছাত্রীনিবাসের ঋতুমতীদের জন্য রয়েছে আলাদা থাকার ব্যবস্থা। খাবার ঘরে, মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ।

ঘটনা হল, মহিলাদের হেয় করা বা তাদের কেন্দ্র করে ধর্ষকাম বা বিকৃতকাম মানসিকতার উদযাপনের ‘সাফল্যে’র ধারণা কিন্তু এই আধুনিক ভারতে একদিনে গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান লাগাতার বুঝিয়ে গেছেন, মহিলাদের মর্যাদা তার গিন্নিপনায়। বুঝিয়েছেন বর্তমানে মহিলারা ঘরে বাইরে সামলালেও আসলে পুরুষদের স্থান ঘরের বাইরে। সেইসঙ্গে তিনি এটাও মনে করেন, মহিলাদের নিরাপত্তার ভার শুধু মহিলাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া যায় না।

এই মন্তব্যের বহুমুখী এবং ব্যপকার্থে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। মহিলাদের নিরাপত্তার ভার মহিলাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। কারণ তারা অবলা। আত্মরক্ষায় অক্ষম। তাই তাদের নিরাপত্তা দিতে পারে একমাত্র পুরুষেরা। আর যে পুরুষ নারীর রক্ষা করে সেই পুরুষ তো দরকারমতো ভক্ষক হওয়ার স্বপ্ন, ক্ষমতা, স্বাধীনতা সবই বয়ে বেড়াতে পারে। কেন জঙ্গলের রাজা সিংহ কি প্রয়োজনে শিকার করে না?

অবশ্য মোহন ভাগবত এও বলেছেন, মহিলাদের সম্মানের শিক্ষার পাঠ শুরু করা উচিত বাড়িতেই। কিন্তু তিনি তো এটাও বলেছেন, মহিলারা গৃহবধূরূপেই আদর্শ। ফলে সনাতনধর্ম, সংস্কারের দোহাই পেড়ে মেয়েরা বুঝতে শেখে তারা আদর্শ দময়ন্তী, সীতা, সাবিত্রী। সেই সঙ্গে বোঝানো হয়, পুরুষদের ক্ষমতা বেশি। তাদের পায়ের তলাতেই মহিলাদের আসল স্থান। সনাতন ধর্ম প্রচারকারীরা যদি দশকের পর দশক ধরে এভাবে মগজধোলাই করে, আর তার প্রতিফলন যদি গার্গী কলেজ বা ভুজ হস্টেলের মতো ঘটনায় ঘটে, তবে বোধহয় অবাক হওয়ার কিছু নেই। মহিলা সশক্তিকরণ, বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও, উজ্জ্বলা যোজনা তো আসলে পর্দা। তার আড়ালে চলছে দমননীতি। সেখানে বিরোধীপক্ষ, জনজাতি, মহিলা— সব এক গোত্রের। তাদের ভয় দেখিয়ে, ত্রাস সৃষ্টি করে সমঝে রাখার পন্থা বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রের করায়ত্ত।

এছাড়াও এখানে আর একটি কথা না উল্লেখ করলেই নয়। তা হল, এ ধরনের খবর কোথাও একটা ধর্ষকামকে তোল্লাই দেয়। একদল পুরুষ রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতাবলে মহিলাদের হেনস্থা করে। সে খবরে মহিলারা ত্রস্ত ও দিশেহারা হলেও, পুরুষদের একাংশকে তা কোথাও সন্তুষ্ট করে। ক্ষমতায় বলীয়ান পুরুষ পরিতৃপ্ত হয়। আরও একবার মহিলাদের হাতের মুঠোয় পিষে ফেলে কব্জা করার উদাহরণ। তার মানে এই নয় যে, এ খবর প্রকাশ না করাই ভাল। এর লাভ ও ক্ষতির দুটো দিকই আছে। যেসব নারী অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইতে সামিল তারা আরও সঙ্ঘবদ্ধ হয়। অন্যদিকে আপামর সাধারণ মহিলা, নারী আন্দোলন থেকে যোজন দূরে, তারা শঙ্কিত হয়ে মনে করে, বদ্ধ আগলই মহিলাদের সব থেকে নিরাপদ আশ্রয়।

মুশকিলটা হল, এভাবেই পুরুষতন্ত্রের শিকলে বাঁধা পড়ে মহিলারাই। তাই আজও ঘটে ভুজ হস্টেলের ঘটনা। খবরে প্রকাশিত হয়, পুরুষরা মেনে নেবে না তাই মহিলাদের সেনানায়ক করা যাবে না। পুরুষরাই মহিলাদের ক্ষমতায়নের নামে তার হাতে যুদ্ধাস্ত্র তুলে দিতে কসুর করে না। আবার সেই পুরুষেরাই ক্ষমতা চলে যাওয়ার ভয়ে মেয়েদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে ভয় পায়। সেই ভয় থেকেই ঘটে এই ধরনের নানা ঘটনা। যেখানে সুযোগ রয়েছে সেখানেই মেয়েদের অত্যাচার করে, ভয় দেখিয়ে, গলা টিপে প্রমাণের চেষ্টা করে যে পুরুষই শ্রেষ্ঠ।