Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কথাগুলো নানাস্তরে নানা জায়গায় নিরন্তর বলে যেতে হবে

আশীষ লাহিড়ী

 





লেখক বিজ্ঞানের দর্শন ও ইতিহাসের গবেষক, বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ও অনুবাদক।

 

 

মধ্যরাতে অন্তর্জলী

কয়েকমাস আগে বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের ঠিক পরেই আমি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম পত্রিকায় একটি লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখায় মূলত এই কথা বলেছিলাম যে, শত অরাজকতা সত্ত্বেও ভারতবর্ষের অনেক মানুষের মনে এই বিশ্বাস ছিল যে, সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা ন্যায়পরায়ণ, রীতিমতো বিদ্বান বিচক্ষণ মানুষ, তাঁরা আর যাই হোক সাধারণ মানুষের প্রতি কোনও অনাচার হতে দেবেন না; কিন্তু অযোধ্যা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই বিশ্বাসকে ধূলিসাৎ করে দিল।

লেখাটি পড়ে একজন পাঠক তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, এই যে আপনারা জুডিশিয়ারিকে এইভাবে হেয় করছেন, এর দ্বারা আপনারা গণতন্ত্রের বিরাট ক্ষতি করছেন৷ সেই ভদ্রলোকের কথা আজ আবার মনে পড়ছে। দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি শাসক দলের অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে বলার ঠিক পরেই, মধ্যরাতে, অবিলম্বে, তাঁর বদলির নোটিশে সই করেন রাষ্ট্রপতি। শোনা যায়, তিনিও নাকি লেখাপড়া-জানা লোক। পরদিনই দিল্লি হাইকোর্টের নতুন বিচারপতি এসে স্থগিতাদেশ দিলেন এবং মামলাটির শুনানি এপ্রিল মাস অবধি পিছিয়ে দেওয়া হল৷ ইনিও নিশ্চয়ই লেখাপড়া-জানা লোক। একের পর এক ঘটনা দেখে দেখে তা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের ভরসা তৈরি হয়। গণতন্ত্রের নাম করে তারই এক স্তম্ভ বিচারব্যবস্থার ওপর যেধরনের অলৌকিক ভরসার কথা বলা হচ্ছে, সেই ভরসা কি আর বজায় রাখা সম্ভব?

 

শাহিনবাগ: পাঁচিলহীন জালিয়ানওয়ালাবাগ

পাশাপাশি, দিল্লিতে হিংসার ঘটনা আমাকে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তফাত এই, জালিয়ানওয়ালাবাগে একটা ঘেরা জায়গার মধ্যে গুলি চালিয়ে কয়েকশো মানুষকে খুন করা হয়েছিল, আর এখানে খোলা শহরের বুকে চলল মুসলিম-নিধন। সবচেয়ে নির্লজ্জ ও অনুশোচনাহীন সাম্রাজ্যবাদী উইনস্টন চার্চিল ওই ঘটনার পর বলেছিলেন, এ ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে কলঙ্কজনক। আত্মপক্ষ সমর্থনে ওডায়ার বলার চেষ্টা করেছিলেন, কী করব, ওরা যে ভয়ঙ্কর বিপ্লবী এক সেনাদল। ওদের না মারলে আরেকটা সিপাহি বিদ্রোহ হতে পারত। চার্চিল তখন বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, ওরা তো একটা ঢিলও ছোড়েনি। আজ এতদিন পর দিল্লির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে ইচ্ছে করছে, এই ক্ষেত্রে যাদের মারা হল, তাদের তরফ থেকে প্রাথমিক স্তরে হিংসার প্ররোচনাগুলি কী ছিল? কিছুই না।

চার্চিলের আরেকটা সাম্রাজ্যবাদী সত্যদর্শনের কথা না বললেই নয়; ‘ব্রাহ্মণদের হাতে ভারতের শাসন ছেড়ে দিয়ে চলে আসাটা নিষ্ঠুর নির্লজ্জ অবহেলার কাজ হবে।… এইসব ব্রাহ্মণরা মুখে পাশ্চাত্য উদারনীতিবাদের বুলি আওড়ায়, ভান করে যেন এরা দর্শনঋদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ, কিন্তু এরাই তো বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত করে রেখেছে প্রায় ষাট কোটি সহ-দেশবাসীকে, যাদের এরা বলে “অচ্ছ্যুৎ”। হাজার বছরের নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তাদের এরা শিখিয়েছে এই দুঃসহ দশাটা মেনে নিতে।…’ আজ ২০২০ সালের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে তাঁর ১৯৩১ সালের এই উক্তির যাথার্থ্য অস্বীকার করার মতো  যোগারূঢ় ৫৬+ ইঞ্চি বুকের পাটা কার আছে?

 

হিন্দুরাষ্ট্র: সিঙ্গল পয়েন্ট অ্যাজেন্ডা

শত ত্রুটি সত্ত্বেও আমাদের সংবিধানে কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্রের কথা বলা হয়নি, সেই কারণে এই সংবিধানকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক সমস্ত দিক থেকে ধ্বংস করে, একটা সিঙ্গল-পয়েন্ট অ্যাজেন্ডা নিয়ে চলছেন এঁরা: লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তাতে কে মরল, কে বাঁচল, সুনাম হল কি বদনাম হল, সেসব দেখার দরকার নেই। একজন বিদেশি প্রেসিডেন্ট যখন সফর করছেন, তাঁর নাকের ডগায় ঘটনাগুলি ঘটানো হল, এটা কি নিতান্ত কাকতালীয়? এমনটাও হতে পারে, যে-আমেরিকা থেকে ইসলামোফোবিয়া সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই আমেরিকার ইসলামোফোবিক প্রেসিডেন্টকে পাশে নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বার্তা দিলেন, দেখিয়ে দিলেন, তিনি ও তাঁর দল মুসলমানদের সাবাড় করার জন্য কতদূর যেতে পারেন।

২০০২-এর গুজরাট থেকে আমরা একই প্যাটার্ন লক্ষ করে আসছি। রাষ্ট্র নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে এবং সংখ্যালঘু নিধনে হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডা ও পুলিশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। বিখ্যাত লেখক ইউ আর অনন্তমূর্তি ঠিক এই প্রসঙ্গ নিয়েই আলোচনা করেছিলেন। ২০০২-এ নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, তিনি কিন্তু গুজরাট গণহত্যার পর একবারের জন্যেও বলেননি যে তিনি এই হত্যালীলা ঠেকাতে চেষ্টা করেছিলেন, করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কারণ ও কথা বললে সেটা তাঁর দুর্বলতা হিসেবে গ্রাহ্য হত। বরং তিনি সেই ঘটনা থেকে উত্তরোত্তর ফায়দা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী হলেন। অর্থাৎ দেশে একটার পর একটা মুসলিম গণনিধনযজ্ঞ (‘রায়ট’ নয়) ঘটানো হচ্ছে, আর হিন্দুত্ববাদীরা একটা একটা করে ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে তাদের চূড়ান্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে।

আরও একবার জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রসঙ্গ মনে পড়ে যাচ্ছে। জালিয়ানওয়ালাবাগে সেদিন নিরস্ত্র মানুষেরা জড়ো হয়েছিলেন দানবিক রাওলাট আইনের প্রতিবাদে। আর আজকের দিল্লিতে, শাহিনবাগে একইরকমভাবে নিরস্ত্র মানুষেরা বিশেষ করে মুসলিম মহিলারা গত সত্তর দিন ধরে অবস্থান করছেন বৈষম্যমূলক সিএএ আইন ও এনআরসি-এনপিআর-এর প্রতিবাদে। শাহিনবাগে যা হচ্ছে তা কিন্তু দেশের সংবিধান মেনে একেবারে সুচারু শান্তিপূর্ণ গান্ধিবাদী প্রতিবাদ। এখানে ভারতের কিছু নাগরিক প্রতিপদে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে তাঁরা কোনওভাবেই সংবিধানের গণ্ডির বাইরে যাচ্ছেন না। উল্টোদিকে, দেশের শাসকগোষ্ঠী স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে দেশের সংবিধানকে তাঁরা মানেন না, এ দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার পথে যদি সংবিধানকে জলাঞ্জলি দিতে হয়, তা করতে তারা পিছপা নন। ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি নাথুরাম গডসে যে প্রক্রিয়ার সূত্রপাত করেছিলেন, আজ আমরা তারই সম্প্রসারণ দেখছি।

 

ওরা যে শিখহন্তা, তার বেলা?

অনেকে বলার চেষ্টা করছেন, আমরা আজ বিজেপির নিন্দা করছি, কিন্তু ১৯৮৪তে যারা দিল্লিতে নির্বিচারে শিখ হত্যা করেছিলেন, তারাই বা কম কীসে!

অবশ্যই তাই। কেউ কম নয়। বস্তুত, কে বিজেপি, কে কংগ্রেস সেটা আমাদের মাথা থেকে বের করে দিতে হবে। এগুলো তো নিছক একেকটা রাজনৈতিক এনটিটি, যাদের নামে ভোটের সময় ভোট চাওয়া হয়। কিন্তু শুধু বিজেপি নয়, আমাদের দেশে সমস্ত দক্ষিণপন্থী দলের মধ্যেই হিন্দুত্ববাদের এলিমেন্ট রয়ে গেছে। নেহেরু অবশ্যই সেকুলার ছিলেন, সে সময়ের অনেক নেতাই হয়তো ছিলেন। পাশাপাশি হিন্দুত্বের প্রতি নরম মনোভাবাপন্ন বহু নেতাও কংগ্রেসে ছিলেন, যেমন মদনমোহন মালব্য, যেমন সর্দার প্যাটেল। পরবর্তীকালে ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে বাবরি মসজিদে রামলালার জন্য দরজা খুলে দিয়েছিলেন রাজীব গান্ধি, তিনি তো কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী। বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেসের একটা বড় অংশের মধ্যে হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতি দুর্বলতা বরাবর ছিল। শুধুমাত্র মাত্রার তফাত। বিজেপি-আরএসএস-এর মতকে হিন্দুত্ববাদের হার্ড প্রপোজিশন বলতে পারি। অপরটি সফ্‌ট প্রপোজিশন: যেমন আপ দলটি। কেজরিওয়াল ভোটের আগে বিজেপির “বিরোধিতা” করে বলেছিলেন, তাঁর হাতে ক্ষমতা থাকলে তিনি দু ঘণ্টায় শাহিনবাগকে সাফ করে দিতে পারেন। ভোটে বিজেপিকে হারিয়েই তিনি গেলেন হনুমানজির মন্দিরে! আপ বিজেপি নয়, কিন্তু বকলমে বিজেপির কর্মসূচিরই প্রয়োগ ঘটাচ্ছে৷

এই রাজ্যেও অনেকে ঘটা করে রামনবমী পালন করেন, পাড়ায় পাড়ায় হনুমানজয়ন্তী উদযাপন করেন, এগুলো কি বিজেপিরই অ্যাজেন্ডাগুলিকে বাস্তবায়িত করা নয়? এই কথাটা এখন খুব সোজাসুজি, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা দরকার যে এদেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা কোমর বেঁধে হিন্দুরাষ্ট্রের দিকেই এগোচ্ছে এবং এই কাজে বিজেপি একা নয়। দোসরদের মনের কথা হল, মুসলমানদের আমরা দয়া করে থাকতে দিয়েছি। ওদের তাড়াব না, পায়ের তলায় থাকুক চাকরবাকরের মতো, কিন্তু বেশি ট্যাঁ ফোঁ করলে, সমানাধিকার-টাধিকার চাইলে মার খেয়ে মরে যাবে। এই মতাদর্শের সবচেয়ে কড়া মুখ অবশ্যই বিজেপি, কিন্তু বাকিরা, যাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রমুখী ভাবনা নেই, তারাও বিজেপির কাছাকাছি রয়েছে। রাজনীতির ময়দানে তাঁরা যতই বিজেপি-বিরোধী অবস্থান নিন না কেন, তা শুধু ক্ষমতা লাভের লড়াই, অন্তরে এরা বিজেপি-আরএসএসের মতাদর্শের থেকে খুব একটা দূরে নন।

 

খুব নতুন কি?

আমার জন্ম আটচল্লিশ সালে। আমাদের ছোটবেলাতেও আশেপাশে মানুষের মধ্যে হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতি ঝুঁকে থাকা মনোভাব দেখেছি৷ তবে তখন মানুষ এত উচ্চকিতভাবে কথাগুলো বলতেন না। বলা হত চুপিচুপি, নিজস্ব গণ্ডিতে। ক্রমে যত দিন গেছে, এই কথাগুলো প্রকাশ্য আলোচনায় চলে এসেছে। এটা যদি একটা রাষ্ট্রের অন্তরের কথা হয়, তাহলে ভারতবর্ষকে সভ্য দেশ বলার কোনও যুক্তি নেই। এরপরেও আমাদের মধ্যে অনেক তথাকথিত ভদ্রলোক দোনামোনা করছেন, বলার চেষ্টা করছেন, আরেকটু ধৈর্য ধরুন, এদের মধ্যেও নিশ্চয়ই কিছু ভালো আছে। এঁরা কি চাইছেন যে আমরা ইতিহাসে একটি গোঁয়ারগোবিন্দর দেশ বলে পরিচিত হই? ভারতের হিন্দুরা এক চরম অসভ্য অমানবিক জাত, এটা প্রমাণিত হলেই কি তাঁরা খুশি হবেন? হিন্দুদের কোনও  আইনবোধ নেই, কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই, বিজ্ঞানবোধ নেই, মানবিকতার চেতনা নেই, কোনও পারস্পরিকতার বোধ নেই– এইটা প্রমাণিত হয়ে গেলে হিন্দুদের গৌরব কি বাড়বে?

 

রাষ্ট্র-খুল্লতাতদের দোলাচল

এর মানে কি তাহলে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে ১৯৫০ সালে আমাদের যে সংবিধান গৃহীত হল, যেখানে ভারতকে ধর্মভিত্তিক দেশ না করে জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের সমানাধিকার সুনিশ্চিত করা হল, সেই নীতিটা আসলে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটা আরোপিত নীতি? ভারতবর্ষের প্রকৃত চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ ও লালন করার উপযুক্ত নয়? সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে এই নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হয়েছিল। সেসবের সঙ্কলন ইন্টারনেটে বা ছাপা অবস্থাতেও পাওয়া যায়। সেগুলোর খানিকটা পড়লেই বোঝা যাবে যে সেই পরিষদের একটা বিরাট অংশ চাননি সব ধর্মের মানুষের সমানাধিকারের কথাটা এত পরিষ্কার করে বলা হোক। যেমন ধরা যাক, রাজেন্দ্রপ্রসাদ। তিনি সজ্জন মানুষ ছিলেন, পড়াশুনো জানা বিদ্বান মানুষ, কিন্তু চিন্তাভাবনার দিক থেকে পুরোপুরি হিন্দুপন্থী। তিনি হিন্দুত্ববাদী অবশ্যই ছিলেন না, কিন্তু হিন্দু-পন্থী ছিলেন। কিন্তু সেদিন তিনি যা বলেছিলেন তা থেকে ধীরে ধীরে আজকের এই হিন্দুত্ববাদে পৌঁছে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু না। তাঁর সঙ্গে এই নিয়ে নেহেরুর প্রচুর মতবিরোধ হয়েছিল। সোমনাথ মন্দির নিয়েও নেহেরুর সঙ্গে রাজেন্দ্রপ্রসাদের মতভেদ হয়েছিল। নেহেরুর বক্তব্য ছিল, ভারত যদি সেকুলার রাষ্ট্র হয় তবে সরকার কেন মন্দির নির্মাণ করবে? ধর্মপালনের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের স্বীকৃত অধিকার, যে যার ধর্ম পালন করুক, কিন্তু রাষ্ট্র কেন তাতে সরাসরি অংশগ্রহণ করবে? রাজেন্দ্রপ্রসাদ এটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। জাতিধর্মনির্বিশেষে মানুষের সমানাধিকার বর্ণাশ্রম-সমর্থক হিন্দুপন্থীদের মনের কথা নয়, কতকটা বাধ্য হয়েই তাঁরা এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলেন৷ ফলে পরে যখন নরেন্দ্র মোদির মতো ডাকাবুকো নেতারা ক্ষমতায় এসে ভদ্রতা সভ্যতার তোয়াক্কা না করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আক্ষরিক খড়্গহস্ত হন, তখন সেই উগ্র হিন্দুত্বকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আর এই নরমপন্থী হিন্দুবাদীদের থাকে না!

 

নরম হিন্দুপন্থা ওরফে সংখ্যাগুরুবাদ

এই নরম হিন্দুপন্থা আমাদের দেশের বৃহত্তর সমাজেরই চরিত্র। আমরা ছোটবেলা থেকেই এই সংখ্যাগুরুবাদী চর্চাটি দেখতে অভ্যস্ত। পশ্চিমবঙ্গে স্কুলে স্কুলে সরস্বতী পূজা হয়; আমরা ভেবে দেখি না আমরা অজান্তেই স্কুলের অহিন্দু ছাত্রছাত্রীদের ওপর ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছি কিনা। আমাদের ছেলেমেয়েরা নির্দ্বিধায় বাংলা রচনা লেখে, দুর্গাপূজা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। দুর্গাপূজা কীভাবে মুসলিম বা আদিবাসী বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হতে পারে? এইভাবে আমাদের চেতনে-অবচেতনে হিন্দু আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির চাষআবাদ চলতে থাকে, ফলে পরে যখন কেউ বলেন যে এই দেশ প্রাথমিকভাবে হিন্দুর, তখন এই চূড়ান্ত অশ্লীল কথাটাও আমাদের শ্রুতিকটু লাগে না। আমরা ফাঁদে পড়ে যাই।

 

ইতিহাসের ইতিবাচক শিক্ষা

১৯৩৭ সালে সুভাষচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের কাছে পরামর্শ চাইলেন, ‘বন্দে মাতরম’ গানটি কংগ্রেসের অধিবেশনের শুরুতে গাওয়ার পক্ষে উপযুক্ত কি? রবীন্দ্রনাথ খুব স্পষ্টভাষায় বললেন, এই গানের যেখানে দেশকে দুর্গার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই দেশটিকে হিন্দু দেশ বলে মনে করা হচ্ছে। একজন বৌদ্ধ, একজন মুসলিম বা একজন খ্রিস্টান কী করে এটা মানবেন? এই যুক্তি সুভাষচন্দ্র মেনে নিয়েছিলেন। তারপর থেকে কংগ্রেসের সভাগুলিতে ‘বন্দে মাতরম’ গানটির প্রথম দুটো স্তবকই গাওয়া হত, বা এখনও গাওয়া হয়। খেয়াল করবেন, আজকের হিন্দুত্ববাদীদের একটা বড় দাবি, বন্দে মাতরমকেই জাতীয় সঙ্গীত করতে হবে। অঙ্ক মিলে যাচ্ছে। বিবেকানন্দ-উপাসক সুভাষচন্দ্র বসু একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু। অথচ তাঁর গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজে তিনি যেভাবে সেকুলারিজম-এর চর্চা করেছেন, তা তো ইতিহাস। ফৌজে একজন হিন্দু উপাসনা করছেন, পাশের খাটিয়ায় পাশে বসে একজন শিখ উপাসনা করছেন, একজন মুসলিম নামাজ পড়ছেন, একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বাইবেল পড়ছেন, অথচ ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই তাঁরা প্রত্যেকে আজাদ হিন্দের একেকজন যোদ্ধা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছেন। যুদ্ধের ময়দানে জয় হিন্দ ছাড়া তাঁদের আর কোনও স্লোগান নেই। পরবর্তীকালে দিল্লির লালকেল্লায় যখন তাঁরা বন্দি, মহাত্মা গান্ধি এসেছিলেন দেখা করতে। বন্দিরা জানালেন, এমনিতে তাঁরা ভালোই আছেন, শুধু একটাই অভিযোগ: জেলে হিন্দু চা আর মুসলিম চা আলাদা আলাদা কেটলিতে দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা হেসে বলেন, এর প্রতিবাদে তাঁরা ঐ দুটো কেটলি থেকে চা নিয়ে একটা তিন নম্বর কেটলিতে ঢেলে সবাই মিলে খান!

 

হিন্দুত্ববাদী পাকিস্তান

আজ আমরা এই শিক্ষার দিক থেকে পিঠ ফিরিয়ে ঠিক উল্টোদিকে দৌড়চ্ছি। তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নেওয়া গেল যে হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি হল। কিন্তু সে রাষ্ট্র তো তৎক্ষণাৎ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। পাকিস্তান সাক্ষী। আপন ভঙ্গুর অস্তিত্ব বজায় রাখবার জন্য ইসলামি চরমবাদকে মদত দিয়ে চলতে হচ্ছে তাকে, সারা বিশ্বের সামনে ভিখারি হয়ে মানসম্মান খুইয়ে প্রতিনিয়ত হিন্দু ভারতকে শত্রু হিসেবে– ‘অপর’ হিসেবে- খাড়া করতে হচ্ছে। হিন্দুদের অবস্থা তো আরও কাহিল। তাদের নিজেদের মধ্যেই এত সম্প্রদায় এত গোষ্ঠী, এই বিভিন্নতা ও বৈপরীত্যগুলি হিন্দুরাষ্ট্র সামলাবে কীভাবে? রাষ্ট্র তো জন্মমুহূর্ত থেকেই দুর্বল হবে।

 

আরও কত দূরে সে অনন্তধাম?

নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় টার্ম-এর কার্যকলাপ দেখে, বিশেষত দিল্লির ঘটনার পরে অনেকে বলছেন, ভারতবর্ষ হিন্দুরাষ্ট্র হতে কি কিছু বাকি আছে? আছে বইকি। প্রথমত, এখনও দেশের সংবিধান অপরিবর্তিত। দ্বিতীয়ত, এখনও আমরা এইসব বিরোধী কথাবার্তা বলতে পারছি, পত্র-পত্রিকায় সেসব ছাপাও হচ্ছে। হিন্দুরাষ্ট্র একবার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে যে স্তরের নজরদারি থাকবে, তখন এই কথাগুলো আমরা আর বলতে পারব না। হিটলারের জমানায় কী ঘটেছিল? তারা ইহুদিদের শুধু খুন করেছে তা নয়, ঠিক আমাদের আজকের এই এনআরসি-সিএএ-র আদলে ইহুদিদের অফিসে গিয়ে ফর্ম ভরতে হত। ফর্মে ঘোষণা করতে হত তার চোদ্দো পুরুষের নামধাম, পেশা ইত্যাদি সমস্ত তথ্য। এই ফর্ম পূরণ করার সময় ইহুদিটি যদি পুরুষ হয়, তাহলে যে চেয়ারে সে তখন বসে আছে সেই চেয়ার থেকে একধরনের এক্স-রে এমিশনের ব্যবস্থা থাকত, যা অগোচরে ইহুদি পুরুষটির অণ্ডকোষে প্রবিষ্ট হয়ে তার প্রজনন-ক্ষমতা হরণ করত। ভারতবর্ষে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে এই জিনিসগুলো শুরু হবে। প্রথমে মুসলিমদের নিকেশ করা হবে৷ তারপর আমাদের মতো লোক যারা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কোনও পংক্তিতেই নেই, যারা সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকেই দূরত্ব বজায় রাখি, তাদেরও বেঁচে থাকবার কোনও অধিকার থাকবে না।

 

আশার রুপোলি আলো

কিন্তু আমাদের মতো এত বড় দেশে এই হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করাটা কঠিন হবে। এটা তো জার্মানি বা ইতালির মতো অত ছোট দেশ নয়। তাছাড়া প্রতিবাদ ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ পথে নেমেছে। গায়ের জোরে তাদের হয়তো হঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ দিয়ে, গুন্ডা দিয়ে পেটানো হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদের রাজনৈতিক মূল্যও তো কম নয়। সবকিছু একবারে চরমে না পৌঁছলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও তো সেইভাবে দানা বাঁধতে পারে না৷ আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠী ক্রমশ সেই চরম বিন্দুর দিকে ছুটে চলেছে। এখনও এই পরিস্থিতিটা চূড়ান্ত নয়। এখনও আরও কিছু দেখার বাকি আছে৷ এবং সেটা হলে তার বিরুদ্ধে  প্রতিবাদটাও তীব্র হবে। মাও সে তুং-এর একটা কথা আছে, যেখানে অত্যাচার, সেখানেই প্রতিরোধ৷ অনেকটা যেন নিউটনের তৃতীয় সূত্রের সমাজ-বৈজ্ঞানিক রূপ। সেটাই ক্রমে আমরা চারপাশে দেখতে পাচ্ছি৷ শাহিনবাগে, পার্ক সার্কাসে অথবা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মহিলারা যে প্রতিবাদ করছেন, তা কি আমরা আগে কখনও দেখেছি? অসভ্য শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলার এই সুসভ্য সাহস তো কুর্নিশ করার মতো। মানুষ একজোট হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের মতো মানুষেরা যা করতে পারি তা হল, এই কথাগুলো নানাস্তরে নানা জায়গায় নিরন্তর বলে যাওয়া। বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে তো বটেই, বিজেপি না থাকলেও। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে শুধুমাত্র শাসক বদলের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদকে পরাস্ত করা যাবে না৷ বিজেপি গেলে আপ আসবে। বাংলাতেও আমরা পরিবর্তন দেখেছি। তাতেও কাজের কাজ খুব একটা কিছু হয়নি। তাই যতক্ষণ না সমাজের খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষকে জড়িয়ে নিয়ে, আমাদের যুক্তিবোধ, বিজ্ঞানবুদ্ধি, মানবিকতাকে জাগ্রত করে একটা সর্বাঙ্গীন আন্দোলন গড়ে উঠছে, যেখানে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনাও পরিপক্ব হবে, আমাদের সকলকে ততদিন কথা বলে যেতে হবে, নানাভাবে চেষ্টা করে যেতে হবে। কথায় যুক্তির, তথ্যর ভুল থাকলে তা শোধরানোর জন্য তৈরি থাকতে হবে।