একমাত্রিকতা, সমপ্রেম এবং আদালতে জয়: অধিকার কোন পথে?

শৌর্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে লড়াই মূলগতভাবে একটি আইনি অধিকার প্রাপ্তির লড়াই, আইন সংস্কারের উদ্যোগ। ‘মাইক্রোস্কপিক ফ্র্যাকশন’-এর পক্ষে রাস্তার লড়াইয়ের বদলে আদালতের লড়াই অনেক ক্ষেত্রে অনেক সুবিধাজনক হতে পারে এবং হয়েওছে। কিন্তু বৃহত্তর চিত্র দেখলে একমাত্রিকতার বিরুদ্ধে অন্যান্য লড়াইয়ের সঙ্গে সমপ্রেমের অধিকারের লড়াইকে মেলানোর চেষ্টা না হলে আগামী দিনে এই আইনি জয় বজায় রাখা কতদূর সম্ভব হবে সেটা ভাবা আশু প্রয়োজন। অধিকারের লড়াই শুধুমাত্র আদালত-নির্ভর হলে মুশকিল এই, যে আদালত আজ যে অধিকার দিয়েছে, আগামী দিনে পরিপ্রেক্ষিতের বদল হলে সেই অধিকার ফিরিয়েও নিতে পারে

 

১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে সরাসরি ব্রিটিশ ক্রাউন ভারতের শাসনক্ষমতা তুলে নেয়। এর প্রভাব আইনব্যবস্থায় ছিল প্রচুর। লাভক্ষতির অঙ্কে চলা কোম্পানির তুলনায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসন ছিল অনেক দক্ষ, এবং পাশাপাশি আইনব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ শুরু হয়। ১৮৬০ সালে পাশ হয় ভারতের পেনাল কোড, ফৌজদারি বিষয়ের জন্য সাধারণ আইন। কুইন ভিক্টোরিয়া যে সাম্রাজ্যের রানি, তথাকথিত ভিক্টোরীয় নৈতিকতার প্রভাব সেই আইনে পড়বে সেটা অবশ্যম্ভাবী ছিল, এবং পেনাল কোডের ছত্রে ছত্রে রয়েছে সেই সনাতন ঔপনিবেশিক মনোভাবের পরিচয়। কোডের ৩৭৭ ধারা তার এক প্রামাণ্য উদাহরণ। এই ধারা অনুযায়ী প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ— অর্থাৎ প্রজননক্ষম নয় এমন— যে কোনও যৌন সম্পর্ক শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সমকামিতা প্রাচ্যে কী ছিল, বা কতদূর গ্রহণযোগ্য ছিল, সেসবের লেশমাত্র বিচার না রেখে হাজার হাজার মাইল দূর-দেশীয় মনোভাব চাপিয়ে দেওয়া হল ভারতীয় ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনতার উপর। ইতিহাসচর্চা এ লেখার বিষয় নয়, কিন্তু এটুকু বলা যায় যে স্বাধীন ভারতীয় আইনব্যবস্থা, যা সরাসরি ঔপনিবেশিক শিকড়ে প্রোথিত, সযত্নে সেই মূল্যবোধকে টিকিয়ে রেখে চলেছে ২০১৭ সাল অবধি। শুধু কি আইনব্যবস্থা? সমাজের পরতে পরতে রয়েছে এই মূল্যবোধ, যে কারণে নভতেজ জোহার মামলা, যাতে অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট সম্মতিপূর্বক সমকামী সম্পর্ককে ফৌজদারি অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে, সেখানে বারংবার উঠে এসেছে সমকামিতার বিরুদ্ধে যুক্তি— ‘পশ্চিমি সমাজে সমকাম গ্রহণযোগ্য হলেও ভারতীয় সমাজে নয়।’ এই বক্তব্য আদৌ ঐতিহাসিক নাকি নিছক ঔপনিবেশিক প্রভুদের শিখিয়ে দেওয়া বুলির দেশীয় আত্তীকরণ, সেটা ভেবে দেখা দরকার। এই লেখা যদিও সীমাবদ্ধ সমকামিতা বা সমপ্রেমের অধিকার লাভের আইনি লড়াইয়ের বিবরণ এবং তার ব্যাখ্যার মধ্যে।

 

ভারতীয় আইনব্যবস্থাকে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের অন্যতম উদাহরণ ধরা হয়। একেবারেই ব্রিটিশ মডেলে সাজানো আইনব্যবস্থা যা ভিক্টোরীয় আমলের মনোভাবকে বহন করে চলেছে। ১৯৫০ সালে সংবিধান কার্যকরী হলে, যে আইনব্যবস্থা তৈরি হয়, সেটির চরিত্র বেশ জটিল। সংবিধান-পরবর্তী ভারত রাষ্ট্র তার ঔপনিবেশিক ইতিহাসকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলেনি, আবার সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সমাজ বদলের অন্তত তাত্ত্বিক প্রচেষ্টা জারি রেখেছে। ফলত, ঔপনিবেশিক বিভিন্ন আইন এবং প্রণালীকে রেখে দেওয়া হয়, একই সঙ্গে সেগুলোকে মৌলিক অধিকারগুলির অধীন করা হয়। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক আইনগুলি ততক্ষণই থাকতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করছে না। খর্ব করছে কি করছে না সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে বিচারবিভাগ। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক আইনের জীবন নির্ভর করছে বিচারবিভাগের ব্যাখ্যার উপর। ফলাফল, বহু আইনি ধারার প্রলম্বিত অবস্থিতি। শুধুমাত্র সমপ্রেম নয়, এই তালিকায় রয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারাও— ১২৪ এ, রাজদ্রোহ বা সিডিশন।

সাংবিধানিক নৈতিকতা (Constitutional Morality), নাকি সামাজিক নৈতিকতা (Societal Morality)? ভারতের সংবিধানের ক্ষেত্রে বলা হয় এটি একটি ট্রান্সফরমেশানাল ডকুমেন্ট। সংবিধানপ্রণেতারা জানতেন তাঁদের এমন এক সংবিধান বানাতে হবে, যা একটি আপাদমস্তক পশ্চাদপট সমাজকে প্রগতিশীল করে তুলতে চেষ্টা করবে। প্রতি পদে তাকে বাধা দেবে পুরনো ধ্যানধারণা, অন্ধবিশ্বাস এবং সংখ্যাগুরুর আধিপত্য। সুতরাং সংবিধান অন্যান্য বহু দেশের জন্য একটি নিছক রাষ্ট্রকাঠামোর দলিল হলেও, ভারতের মতো দেশে তাকে প্রগতিশীল সমাজের দিকনির্দেশনার কাজও করতে হবে। নৈতিকতার ধারণাকে শুধুমাত্র সমাজের উপর ছেড়ে দিলে চলবে না। মনে রাখা দরকার, তারা সংবিধান লিখতে বসেছিলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-বিদীর্ণ পটভূমিতে। অতএব সংবিধানকে শুধুমাত্র আইনি বৈধতা দেওয়ার দলিল নয়, সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে সঠিক পথে চালনা করার প্রামাণ্য ম্যানিফেস্টো করে তুলতে হত। অর্থাৎ যখনই কোনও প্রগতিশীল পরিবর্তনের প্রশ্ন আসবে, সেখানে সামাজিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা বোধের পরিবর্তে সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মাপকাঠিতে বিচার করতে হবে— এটাই ছিল সংবিধানের উদ্যেশ্য। সাংবিধানিক মূল্যবোধ অন্তর্নিহিত সংবিধানের প্রতিটি ধারার মধ্যে, প্রতিটি ধারা প্রণয়ন যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্যের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। সংবিধানের প্রস্তাবনা, মৌলিক অধিকারের চ্যাপ্টার এবং রাষ্ট্রের কর্তব্য বা Directive Principles of State Policyর মধ্যে।

 

মোটামুটি এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে ৩৭৭ ধারার কোর্টযাত্রাকে বোঝার চেষ্টা করা দরকার বলে মনে হয়। এই যাত্রার শুরু ২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্টের একটি রায়, নাজ ফাউন্ডেশন বনাম দিল্লি সরকার-কে দিয়ে। দিল্লি হাইকোর্ট সমকামকে অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দেয়। যুক্তি ছিল, ১৫ অনুচ্ছেদে লিঙ্গনির্ভর বৈষম্যের বিরুদ্ধে অধিকার দিয়েছে, সেখানে ‘সেক্স’ শব্দটির আওতায় সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনও আসে। অর্থাৎ, সমাজনির্ধারিত সংখ্যাগুরুর জেন্ডার রোল চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেও বৈষম্য সম্ভব। সংখ্যালঘু অংশ, তার ধ্যানধারণাকে সমাজ তার বদ্ধ ধারণার বশবর্তী হয়ে সমাজবিরোধী বলতে পারে না। সংখ্যালঘুর জীবন-যাপনের উপর, নিজস্ব ইচ্ছানুযায়ী চলার অধিকারের উপর সংখ্যাগুরুর জীবনযাপনের অভ্যেস চাপিয়ে দেওয়াও অতএব সংবিধান-প্রদত্ত বৈষম্যের বিরুদ্ধে অধিকারের পরিপন্থী। অর্থাৎ, সামাজিক নৈতিকতার সঙ্গে সংবিধানিক নৈতিকতার সংঘাত হলে, তুলে ধরা দরকার সাংবিধানিক নৈতিকতাকেই। এর ভিত্তিতে দিল্লি হাইকোর্ট রায় দেয়, যতদূর পর্যন্ত ৩৭৭ ধারা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্মতিমূলক যৌনতাকে অপরাধ গণ্য করছে, ততদূর পর্যন্ত এই ধারা অসাংবিধানিক। জোরপূর্বক যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ধারা বলবত থাকবে।

এর বিরুদ্ধে আপিল হয় সুপ্রিম কোর্টে। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ দিল্লি হাইকোর্টের এই রায়কে বাতিল করে, এবং ৩৭৭ ধারাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনে। কোর্টের যুক্তিগুলি লক্ষণীয়। কোর্ট জানায়, ৩৭৭ ধারা কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা আইডেন্টিটিকে আক্রমণ করছে না, করছে নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে। অদ্ভুতভাবে, ‘…those who indulge in carnal intercourse in the ordinary course and those who indulge in carnal intercourse against the order of nature constitute different classes… and the people falling in the latter category cannot claim that section 377 IPC suffers from the vice of arbitrariness and irrational classification.’ যেহেতু ৩৭৭ ধারা একটি ‘যুক্তিপূর্ণ বিভাজন (reasonable classification) করছে, প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী যৌনতা করা এবং প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনতা করা মানুষদের মধ্যে। এছাড়া আসে প্রামাণ্য যুক্তি, সমকামী মানুষ সমাজে ‘microscopic fraction’। সহজ বাংলায়, কোর্ট যাই ভেবে লিখে থাকুক এর মানে দাঁড়ায়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংখ্যক মানুষের অধিকার নিয়ে আদালত ভাবিত নয়। উপরক্ত ভারতীয় সংবিধানের পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী, সাংবিধানিক নৈতিকতার বদলে আদালতের রায় মেনে নেয় যে প্রকৃতির নিয়ম এবং প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনকার্য সম্ভব, এবং হেটেরোসেক্সুয়ালিটিই একমাত্র পথ— সামাজিক নৈতিকতা স্বীকৃত পথ।

৩৭৭ ধারার সাংবিধানিকতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে পুনরায় প্রশ্ন ওঠে ২০১৬ সালে নভতেজ জোহার বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া মামলায়, যৌনতার অধিকার (রাইট টু সেক্সুয়ালিটি), সেক্সুয়াল অটোনমির অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি নিয়ে। এর রায় আসে ২০১৭ সালে, যেখানে অবশেষে এই অধিকারগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আদালত দিল্লি হাইকোর্টের যুক্তিগুলিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনে, এবং দিল্লি হাইকোর্টের রায়কে মান্যতা দেয়। সম্মতিমূলক যৌনসম্পর্ককে ৩৭৭ ধারার আওতা থেকে বার করে আনে এই রায়। সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষের নিজস্ব পছন্দের অধিকার, সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার, ব্যক্তিগত পরিসরে নিজস্বতা বজায় রাখার অধিকার স্বীকৃত হয়। মূলগতভাবে বলা যায়, সামাজিক নৈতিকতার বিরুদ্ধে, সংখ্যাগুরুর আধিপত্যের বিরুদ্ধে, ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এই রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রসঙ্গত, ৩৭৭ ধারা এখনও বর্তমান, কিন্তু নভতেজ জোহার মামলার রায় অনুযায়ী তার ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ শুধুমাত্র অসম্মত বা জোরপূর্বক সমকামের ক্ষেত্রে।

আইনজীবী মেনকা গুরুস্বামী ও অরুন্ধতী কাটজু

কীভাবে একটি রায়কে বিচার করা যেতে পারে? আদালতের রায় ও তার বাস্তবতা কতটা? ঘটনা হল, ভারতীয় উচ্চ আদালতের অধিকার বিষয়ক ব্যাখ্যার যা গতি ছিল সেই অনুযায়ী নভতেজ জোহার বা তার আগে নাজ ফাউন্ডেশন মামলার রায় বিচ্ছিন্ন নয়। জীবনের অধিকার বলতে জীবনের সঙ্গে আনুষঙ্গিক যা যা জড়িয়ে আছে সে সব কিছুর অধিকার স্বীকৃত হয়েছে সেই আশির দশকে। সত্তরের এমারজেন্সি ও তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের সরকারের কাছে নতিস্বীকারের ভূত সুপ্রিম কোর্টকে তাড়া করে বেড়িয়েছে বহুদিন। এমারজেন্সি-পরবর্তী কোর্ট সেই গ্লানিমুক্ত হতে শুরু করেছিল আইনের ‘প্রগতিশীল’ ব্যাখ্যা। অধিকার সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলির অর্থের বিস্তার ঘটানো শুরু হয়েছিল এতটাই যে সুপ্রিম কোর্টকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সুপ্রিম কোর্ট আখ্যা দেওয়া হয়। নভতেজ জোহার মামলার এক বছর আগেই পুট্টাস্বামী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নয় বিচারপতির বেঞ্চ মান্যতা দিয়েছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অধিকারকে (রাইট টু প্রাইভেসি)। এই রায়ের মূল ভাব অনেকক্ষেত্রেই প্রাইভেসি রায়ের কাছে ঋণী। সেই জায়গা থেকে দেখতে গেলে সুপ্রিম কোর্টের আইন ব্যাখ্যার গতি অনুযায়ী ২০১৩-র ৩৭৭ ফিরিয়ে আনার রায়টাই বরং একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল। নভতেজ জোহার রায় মূলগতভাবে একটি ভুল শুধরানো, এবং এর গুরুত্ব এই জায়গায় যে আইনের দিক থেকে দেখলে এই রায়ের উপর ভিত্তি করে সমপ্রেমীদের অন্যান্য বিভিন্ন অধিকার আদায়ের আইনি লড়াই শক্তিশালী হতে পারে। যেমন এই মুহূর্তে ভারতে সমপ্রেমী বিবাহের বৈধতা নিয়ে চলা মামলার শুনানি শেষ হয়েছে, রায়দান স্থগিত আছে। এই অধিকার স্বীকৃত হলে আইনের চোখে সমপ্রেমী দম্পতিদের অবস্থান অনেকটাই সুরক্ষিত হবে।

 

বরং নজর দেওয়া যাক কোন কোন যুক্তির বিরুদ্ধে সমপ্রেমের অধিকারকে দাঁড়াতে হয়েছে, কারণ এই আদালতে যতই জিত হোক, সমপ্রেমের অধিকারকে আদালতের বাইরে এখনও সেই একই যুক্তির সামনাসামনি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই মামলায় বেশ কিছু ইন্টারভিনিং অ্যাপ্লিকেশন ছিল, যেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন সমপ্রেমের বিরুদ্ধে তাদের মতামত জানিয়েছিল। একটি মতামত ছিল ৩৭৭ ধারা অঙ্গের অপব্যবহারকে রোধ করে, অতএব এটি সাংবিধানিক। উভলিঙ্গ মানুষ ছাড়া অন্যরকম কোনও যৌন আচরণকে সুরক্ষিত করা সাংবিধানিক নৈতিকতার বিরোধী। এছাড়া, ৩৭৭ ধারা লিখিত হয়েছিল দেশীয় ব্যবস্থা ও মূল্যবোধকে মাথায় রেখে, যেটা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আরওই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তি ছিল এলজিবিটিআইকিউ জনগোষ্ঠীর মানুষ বেশিমাত্রায় যৌন রোগে আক্রান্ত হন, সুতরাং সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার নামে যুবসমাজকে যৌন রোগের দিকে ঠেলে দেওয়া উচিত নয়। এই অধিকার স্বীকৃত হলে পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং যুবসমাজ টাকার বিনিময়ে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ যৌন সম্পর্কে উৎসাহিত হবে। শারীরবৃত্তীয় সত্যের উপর নির্ভর করে বানানো আইন কখনও অসাংবিধানিক হতে পারে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ত্ব অপমানজনক এবং ক্ষতিকারক আচরণের থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা, ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনতে যতই হাস্যকর লাগুক, ঘটনা হল আদালতের ফলাফল যাই হোক না কেন, সমপ্রেমের অধিকারকে সমাজে প্রতিনিয়ত এই একমাত্রিক, প্রকৃতির নিয়ম মার্কা সেক্সুয়ালিটির ধারণার সঙ্গে লড়াই করে চলতে হচ্ছে। ঘটনা হল, প্রকৃতির নিয়ম সংক্রান্ত যুক্তি এই রায়ের মাত্র চার বছর আগে স্বীকৃত হয়েছিল এই সুপ্রিম কোর্টের চত্বরেই। অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন ব্যাখ্যা যাই হোক, নভতেজ জোহার মামলার মাত্র চার বছর আগে ঔপনিবেশিক এবং একমাত্রিক মেজরিটারিয়ান সেক্সুয়ালিটির ধারণা মান্যতা পেয়েছিল, এবং তাঁর পরবর্তী চার বছর সেই ধারণাই আইন হয়ে রয়ে গেছিল। আদালতের ব্যাখ্যাও, অন্য সব কিছুর মতো, পরিপ্রেক্ষিত বা কন্টেক্সট-নির্ভর।

তবে মূল প্রশ্ন থেকেই যায়, সামাজিক ক্ষেত্রে সেই সমানাধিকার আসতে কতদিন? যদিও এই লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে সাংবিধানিকতার প্রশ্ন আদালতের বিচার্য, অন্তত বাস্তবিক তাই হয়ে গেছে, তার মানে এই নয় যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা তুলে ধরার কোনও দায় নেই। যে সংবিধানের শপথ নিয়ে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব নিচ্ছেন, সেই অনুযায়ীই তাঁদের সেই মূল্যবোধ তুলে ধরার কথা। তাঁরা কতদূর এ বিষয়ে, বা আরও বিস্তৃত করলে, সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি পালনে আগ্রহী? ঔপনিবেশিক বিভিন্ন আইনি ধারা বাতিল করার ক্ষেত্রে তাঁরা কতটা নিজেরা উদ্যোগী হন? ফলাফল, আদালতকেই এই দায়িত্বের মুখোমুখি হতে হয়। বাস্তবতা এই, যে আদালতের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে জটিল প্রশ্নের কঠিন (পড়ুন সংখ্যাগুরুর একমাত্রিকতার বিরোধী) উত্তর বলানো তাঁদের ভোটব্যঙ্ককে নিরাপদ করতে পারে, কিন্তু সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য শুধুমাত্র আদালতের আইনি ব্যাখ্যা বেশিদূর সাহায্য করতে পারে না। কারণ উপর্যুক্ত যে যুক্তিগুলি সমপ্রেমের বিরোধীরা আদালতে দিয়েছিল সেই যুক্তিগুলি সংখ্যাগুরুর যুক্তি, এবং সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে যাওয়া ভোটনির্ভর রাজনীতির পক্ষে মুশকিল। যে কারণে কেন্দ্রের ঠুনকো আপত্তিতে দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে তাঁর নিয়োগ আটকে যাওয়ার মূল কারণ সৌরভ কিরপালের কাছে তাঁর সেক্সুয়াল পরিচিতিই। ৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে লড়াই মূলগতভাবে একটি আইনি অধিকার প্রাপ্তির লড়াই, আইন সংস্কারের উদ্যোগ। ‘মাইক্রোস্কপিক ফ্র্যাকশন’-এর পক্ষে রাস্তার লড়াইয়ের বদলে আদালতের লড়াই অনেক ক্ষেত্রে অনেক সুবিধাজনক হতে পারে এবং হয়েওছে। কিন্তু বৃহত্তর চিত্র দেখলে একমাত্রিকতার বিরুদ্ধে অন্যান্য লড়াইয়ের সঙ্গে সমপ্রেমের অধিকারের লড়াইকে মেলানোর চেষ্টা না হলে আগামী দিনে এই আইনি জয় বজায় রাখা কতদূর সম্ভব হবে সেটা ভাবা আশু প্রয়োজন। অধিকারের লড়াই শুধুমাত্র আদালত-নির্ভর হলে মুশকিল এই, যে আদালত আজ যে অধিকার দিয়েছে, আগামী দিনে পরিপ্রেক্ষিতের বদল হলে সেই অধিকার ফিরিয়েও নিতে পারে। ১৯৭৩ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট নারীর গর্ভের সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে অধিকার দিয়েছিল, মনে রাখা দরকার ২০২২ সালে সেই মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সে অধিকার ফিরিয়ে নিয়েছে। মনে রাখা দরকার সত্তর-আশির দশকের ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত এবং ২০২২ সালের ফ্যাসিজমের জোরদার হাওয়া লাগা মার্কিন রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিত। তুলনামূলক আলোচনা যদি কিছুমাত্র শিক্ষা দেয়, তাহলে আইনি জয়কে রাজনৈতিক জয়ে পরিণত করার ক্রমাগত চেষ্টা না করলে অধিকার ধরে রাখা মুশকিল।


*লেখক আইনজীবী, কলকাতা হাইকোর্ট

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...