তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার দায় আমাদের প্রত্যেকের

শোভন মুখোপাধ্যায়

 


মূল সমস্যাটি ভিজিবিলিটি-র। অর্থাৎ সমাজে এই তৃতীয় লিঙ্গের ঠিকঠাক দৃশ্যমানতা না থাকার জন্য গ্রহণযোগ্যতা নেই৷ সেই মুহূর্ত থেকে আমি ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুমের কাজ শুরু করি, যে উদ্যোগের নাম দেওয়া হয় ‘ত্রিধারা'। কলকাতা পুরসভার ১১২ নম্বর ওয়ার্ড অর্থাৎ বাঁশদ্রোণী থেকে কাজটা শুরু হয়৷ সেখানে মেট্রো স্টেশনের পাশে যে পাবলিক বাথরুমটি ছিল, সেটিই রাজ্যে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুম হিসেবে স্বীকৃতি পায়

 

এলজিবিটিকিউ। ট্রান্সজেন্ডার। কুইয়ার। এই শব্দগুলোর সঙ্গে সমাজ এখনও অভ্যস্ত নয়। এটা প্রথম বুঝতে পারি ২০১৭ সালে, যখন আমরা পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুম নিয়ে লড়াই শুরু করি। যে-ই ব্যাপারটা শুনত— এমন কোনও বাথরুম তৈরি করার কাজ করেছি বা LGBTQ কমিউনিটির সঙ্গে আমার খুব ভাল বন্ধুত্ব, তারাই ভেবে নিত আমিও বুঝি ওই কমিউনিটির। আমি জানি না আমি কমিউনিটির একজন হলেই বা কী এসে গেল, কিন্তু তারপর তার সঙ্গে আর কথাবার্তা এগোত না।

সমস্যাটা কোথায় জানেন? আমরা একজন মানুষকে রক্তমাংস-চিন্তাভাবনা দিয়ে গড়া একজন সুস্থ শরীর ও মনের মানুষ হিসাবে নয়, বিবেচনা করি তার জাত, ধর্ম, লিঙ্গ দিয়ে আর তাতেই হয় সমস্যা। সমাজের এখনও এই কঠিন রোগটি প্রতিরোধ করার ক্ষমতাই গড়ে ওঠেনি। গড়ে উঠবেই বা কেমন করে? ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয় নীল ছেলেদের রং আর গোলাপি মেয়েদের। যেখানে শৈশবেই বাচ্চাদের সামনে সামান্য রঙের লিঙ্গ-পরিচিতি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় সেখানে কেউ নিজের অন্তরের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের মতো করে বাঁচতে গেলে সমাজ কি তাকে ছেড়ে দেবে?

সুপ্রিম কোর্টের দরজা ভেঙে যখন কমিউনিটি প্রোটেকশন অফ রাইটস-এর অধিকার ছিনিয়ে আনল, আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের জয়ী মনে হলেও আসল লড়াইটা তো হবে সমাজের সঙ্গে। যে সমাজ এখনও নারীকেই পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়নি, সেখানে আরও এক লিঙ্গের স্বাধীনতা মেনে নেওয়া কি সহজ কথা! দিল্লি এখনও বহুদূর।

 

২০১৭ থেকে ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুম দিয়েই আমাদের কাজটা শুরু হয়৷ তার আগে ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে আমরা একটা পত্রিকা প্রকাশ করতাম। সেই পত্রিকায় কমিউনিটির বিষয় নিয়ে লেখালেখির সূত্র ধরে আমি ও আমার সঙ্গীরা ক্রমশ বুঝতে পারলাম যে শুধু লেখালেখি করে কাজ হবে না৷ সঙ্গে সঙ্গে এমন কিছুও করতে হবে যাতে প্রত্যক্ষভাবে কমিউনিটির উন্নতি হয়। সেইসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে জাতীয় ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিনহার সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়৷ এইখানে জানিয়ে রাখা দরকার, যে সময়টার কথা আমি বলছি অর্থাৎ ২০১৭ সাল, সেইসময় আমার বয়স ছিল উনিশ বছর। রঞ্জিতাদি প্রথমে আমাকে বলেছিলেন, যে কাজ সরকারের করার কথা, তারা কিছু করতে পারছে না বা করছে না, সেখানে তুমি একটা উনিশ বছরের বাচ্চা ছেলে, তুমি কী করবে? তা সত্ত্বেও আমি চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম। তারপর বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুমের কথাটা মাথায় এল। কমিউনিটির নানা মিটিং-এ কথা বলতে গিয়ে শুনেছিলাম, ওঁরা বলছেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চাকরি তো অনেক দূরের কথা, সামান্য পে অ্যান্ড ইউজ টয়লেটও ওঁদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, যাঁরা ট্রান্স মেন, অর্থাৎ পুরুষ, তাঁদের সাধারণত কোনও সমস্যা হয় না। তাঁরা সাধারণভাবে পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন৷ কিন্তু যাঁরা নারী, বহিরঙ্গে নারী কিন্তু গলার স্বর অনেকটা পুরুষের মতো, যাঁদের সমাজ হিজড়ে নাম দেয় ও ইতরবিশেষ ভাবে, সমস্যাটা মূলত তাঁদেরই। তাঁদেরকে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট টয়লেটে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বরঞ্চ টিটকিরি করা হয় (‘তোদের জন্য এখানে কোনও বাথরুম নেই! তোরা তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করতে পারিস, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপড় তুলে কর!’)। এমনকি গালাগালি দিয়ে বা মেরে তাড়িয়ে দেওয়াও হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই একজন নারী পুরুষদের ওয়াশরুমে ঢুকতে পারেন না৷ শুধুমাত্র লিঙ্গ বাইনারির বাইরে থাকার কারণে তাঁরা খুব সাধারণ অথচ একটা জরুরি পরিষেবা থেকে বঞ্চিত থাকেন।

এই জায়গা থেকেই আমার কাজের শুরু। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার মনে হয়েছিল, মূল সমস্যাটি ভিজিবিলিটি-র। অর্থাৎ সমাজে এই তৃতীয় লিঙ্গের ঠিকঠাক দৃশ্যমানতা না থাকার জন্য গ্রহণযোগ্যতা নেই৷ সেই মুহূর্ত থেকে আমি ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুমের কাজ শুরু করি, যে উদ্যোগের নাম দেওয়া হয় ‘ত্রিধারা’। কলকাতা পুরসভার ১১২ নম্বর ওয়ার্ড অর্থাৎ বাঁশদ্রোণী থেকেই কাজটা শুরু হয়৷ সেখানে মেট্রো স্টেশনের পাশে যে পাবলিক বাথরুমটি ছিল, সেটিই রাজ্যে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুম হিসেবে স্বীকৃতি পায়৷ এরপরে কলকাতার আরও ১৩টি জায়গায় ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুম গড়ে ওঠে৷ টাইমস অফ ইন্ডিয়া তাদের সর্বভারতীয় সংস্করণের প্রথম পাতায় এই ঘটনা নিয়ে স্টোরি করেছিল।

ভারতবর্ষে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুম তৈরি হয়েছিল ভোপালে। ধরুন, ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুমটা ভোপাল শহরের কেন্দ্রস্থলে, যেমন আমাদের কলকাতার ধর্মতলা অঞ্চল। কিন্তু গড়িয়া অঞ্চলে কোনও ট্রান্সজেন্ডারের টয়লেট যাওয়ার প্রয়োজন হল, সে কি ধর্মতলায় গিয়ে সেই প্রয়োজন মেটাবে? তাই শহরে একটি-দুটি ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুমের কোনও উপযোগিতা নেই। আমরা প্রথম থেকেই চেয়েছিলাম, শহরের বা রাজ্যের সবকটি পাবলিক টয়লেট ট্রান্সজেন্ডারদের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হোক।

আমরা ঠিক কী করলাম? আমরা কি ইতিমধ্যে তৈরি থাকা পুরুষ ও নারীর পাবলিক ওয়াশরুমের পাশে ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য আলাদা কলঘর বানালাম? না, সে অনুমতি, আর্থিক সামর্থ্য ও সংস্থান কোনওটাই আমাদের ছিল না, নেইও। আর তার দরকারও নেই। আলাদা করে ট্রান্সজেন্ডার ওয়াশরুমের জন্য কিউবিকল তৈরি করার কোনও দরকার নেই। কারণ ট্রান্সজেন্ডাররা তো ট্রান্স-মেন বা ট্রান্স-উওমেন। তারা স্বচ্ছন্দে পুরুষ বা মহিলাদের জন্য তৈরি ওয়াশরুমে যেতে পারেন, যদি না তাদের বাধা দেওয়া হয়। এই বাধাটা পুরোপুরি সামাজিক বা মানসিক বাধা। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে পুরুষ ও মহিলা শব্দের পাশে লিখিয়ে নিলাম তৃতীয় লিঙ্গ বা রূপান্তরকামী বা ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি, যারা আমাদের ত্রিধারা। অর্থাৎ বড় বড় অক্ষরে লেখা রইল, এই ওয়াশরুম পুরুষ, মহিলা ও রূপান্তরকামী মানুষের জন্য তৈরি করা হয়েছে। একটা ভিজিবিলিটি তৈরি করতে চাইছিলাম, আর এই দৃশ্যমানতা থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হতে শুরু করল একধরনের গ্রহণযোগ্যতা।

এছাড়াও আমরা পাবলিক বাসে ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলাম। ট্রান্সজেন্ডারদের পুরুষ বা মহিলা কোনও আসনেই বসতে দেওয়া হত না৷ পরবর্তীকালে আমাদের সমাজের ‘সংবেদনশীল’ সহনাগরিকরা বাসে বাসে ট্রান্সজেন্ডার লেখা স্টিকারগুলি ছিঁড়ে ফেলেন।

একইভাবে নেতাজিনগর বিদ্যামন্দির স্কুলে প্রধানশিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের উৎসাহে ও সমর্থনে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আমরা প্রায় সপ্তাহব্যাপী ট্রান্সজেন্ডার সচেতনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পেরেছিলাম। শিক্ষকদের সহায়তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার সচেতনতা শিবির করেছিলাম, অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিলাম, বাচ্চাদের মধ্যে সচেতনতা ও ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি সহমর্মিতা গড়ে তোলার সেটা প্রথম ধাপ। আর আজকের প্রজন্ম যদি সচেতন হয়ে উঠতে পারে, তাহলে আগামীকালের সমাজ ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি আরেকটু সহমর্মী ও সহনশীল হয়ে উঠতে পারবে। পৃথিবী তাদের জন্য আরেকটু বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। কিন্তু এই ধরনের উদ্যোগে সেই স্কুলটাই প্রথম এবং শেষ অর্থাৎ অদ্বিতীয় হয়েই রয়ে গেল, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের বাকি কোনও স্কুল এগিয়ে এল না। LGBTQ শব্দটাতেই সবার আতঙ্ক।

 

মাঝেমধ্যে হতাশা গ্রাস করে আমায়। সমাজের এমন এক অংশের মানুষদের জন্য কাজ করছি, যাঁরা ইতিহাসের কাল থেকেই প্রান্তিক। এঁদের একটু ভালভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপনের অধিকার আদায়ের জন্য আমি ও আমার মতো অনেকই লড়াই করছেন। লড়াইটা শুরু হয়েছে মাত্র। অনেক পথ হাঁটা বাকি। কিন্তু লড়াই করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনও উপায় নেই। কারণ স্বাধীনতা কেউ কাউকে এমনি এমনি দেয় না, স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হয়। এই পৃথিবীকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার দায় আমাদের প্রত্যেকের।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...