Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্যান্ডেমিক করোনাভাইরাস ডিজিজ নাইন্টিন

বিষাণ বসু 

 




লেখক চিকিৎসক, গদ্যকার, প্রাবন্ধিক।

 

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড নাইন্টিন-কে প্যান্ডেমিক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ, বিশ্বের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভাইরাসঘটিত এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত এবং বাকি অঞ্চলও ঝুঁকির বাইরে নয়। কোভিড নাইন্টিন, অর্থাৎ করোনাভাইরাস ডিজিজ নাইন্টিন— বাংলা করলে কোভিড উনিশ— অর্থাৎ করোনা ভাইরাস পরিবারের সদস্যটির দাপটে বিশ্বজুড়ে যেমন ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে— এই পরিবারের ভাইরাস থেকে ইতোপূর্বে সার্স বা মার্স হলেও, এমন বিশ্বজোড়া দাপট তথা ঘোষিত অধিমারী (অর্থাৎ প্যান্ডেমিক) এই প্রথম।

এখনও পর্যন্ত যদ্দূর খবর, বিশ্বের একশো দশটিরও বেশি দেশ জুড়ে দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত— মারা গিয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। আশার কথা বলতে, কোভিড উনিশে আক্রান্ত মানুষজনের নব্বই শতাংশ রয়েছেন যে চারটি মাত্র দেশে— চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান এবং ইতালি— তার মধ্যে অন্তত দুটি দেশে— চিন ও কোরিয়া— নতুন করে অসুখ ছড়ানোর খবর এখুনি নেই। আবার অন্যদিকে, নতুন নতুন দেশে অসুখ ছড়ানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে— মৃত্যুর খবর আসছে নতুন অঞ্চল থেকে। পরিস্থিতি জটিল, নিঃসন্দেহে— এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনওরকম আন্দাজ পাওয়া মুশকিল।

কোভিড উনিশের সঙ্গে যাঁরা সার্স-এর তুলনা করছেন, তাঁদের জানিয়ে রাখা যাক, সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম অর্থাৎ সার্স-এ আক্রান্ত হন ছাব্বিশটি দেশের মানুষ— আক্রান্তের সংখ্যা আট হাজারের কিছু বেশি— সেটিকে প্যান্ডেমিক বলে দাগিয়েও দেননি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কোভিড উনিশের তুলনায় সার্স ছিল অনেক কম ছোঁয়াচে— কিন্তু ঢের বেশি প্রাণঘাতী। তাতে আশ্বস্ত হওয়ার কারণ নেই তেমন— কেননা, কোভিড উনিশ এতখানিই বেশি ছোঁয়াচে, যে, এত বেশিসংখ্যক মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা— তার সামান্য এক ভগ্নাংশ সংখ্যক মানুষ মারা গেলেও মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াবে অনেক।

কাজেই, সাবধানতা জরুরি। না, এর চাইতে ঢের বেশি সংখ্যক মানুষ এদেশে পথদুর্ঘটনায় মারা যান, অতএব কোভিড উনিশ নিয়ে না ভাবলেও চলবে— এই মতের সমর্থক আমি নই। ওই একই যুক্তিক্রম মেনে চললে তো ঘূর্ণিঝড় নিয়েও সরকারের বাড়তি ব্যবস্থাপনা নিষ্প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়— কেননা, ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা যা-ই দাঁড়াক, বছরভর দেশজোড়া পথদুর্ঘটনায় মৃত্যুর চাইতে বেশি না হওয়ারই সম্ভাবনা।

মেনে নিন, সাবধানতা জরুরি। কী কী ব্যক্তিগত সাবধানতা প্রয়োজন, সেগুলো আমার চেয়ে আপনিই ভালো জানেন। তবু, মনে করিয়ে দেওয়া যাক—

১. হাত ধোন। বারবার করে হাত ধোন। ব্যবহার করুন সাবান-জল অথবা অ্যালকোহল-যুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার।

২. বারবার কারণে-অকারণে মুখে-চোখে হাত দেবেন না— ওগুলো বদভ্যেস— কাটিয়ে উঠতে পারলে করোনা কেন, বহু দুর্ভোগ থেকেই বাঁচতে পারবেন।

৩. রাস্তাঘাটে চলার পথে এদিক-সেদিক এটাসেটায় হাত দেবেন না— অকারণে রেলিং-এ হাত ঘষে ওঠা, বা দেওয়াল ধরে দাঁড়ানো ইত্যাদি ইত্যাদি— এ-ও সাধারণ সাবধানতার মধ্যেই পড়ে, মেনে চললে অনেক হ্যাপা থেকে মুক্তি পাবেন। নিজের মোবাইল ফোন নিজে ব্যবহার করুন, অন্য কারও মোবাইল পারতপক্ষে ব্যবহার করবেন না। সেটা একান্ত অসম্ভব হলে, বা মোবাইল কমন টেবিলে রাখা একান্ত অবশ্যম্ভাবী হলে, সেটি যতটা সম্ভব ভাল করে মুছে পরিষ্কার করে নিন। ধূমপায়ীদের উদ্দেশে বাড়তি সতর্কতা— বিড়ি সিগারেট ত্যাগ নেহাত না করতে পারলে, ভাগ করে কাউন্টার খাবার অভ্যেস আপাতত ত্যাগ করুন।

৪. আশেপাশে কেউ কাশছে দেখলে দূরত্ব বজায় রাখুন— অন্তত তিন-চার ফুট। এদেশে রাস্তাঘাটে এই সাবধানতা মেনে চলা কতদূর সম্ভব, জানি না অবশ্য। কিন্তু, রাস্তা থেকে বাড়ি ফিরেই প্রথম সতর্কবার্তা মাথায় রাখুন— অর্থাৎ হাত-মুখ ধুয়ে ফেলার কাজটুকু করুন।

৫. আপনি নিজে যদি কাশিতে ভোগেন, তাহলে পরহিতার্থে মাস্ক ব্যবহার করুন। আর, আপনি যদি কোভিড উনিশে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে এমন কারও পরিচর্যার সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাহলে নিজের সাবধানতার জন্যে মাস্ক ব্যবহার করুন। এছাড়া মাস্ক ব্যবহারের অর্থ, আপনি মাস্ক-এর অপচয় করছেন। আমি নই, কথা বলছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা— সন্দেহ হলে, ওয়েবসাইট দেখে নিন। এমনিতেও ওয়েবসাইটের দিকে নজর রাখুন— নতুন কিছু সতর্কতার প্রয়োজন হলে সেকথা জানতে পারবেন।

৬. উপরিউক্ত সতর্কবার্তার কারণ, এখনও পর্যন্ত যেটুকু বোঝা গেছে, কোভিড উনিশ ভাইরাস হাওয়ার মাধ্যমে ছড়ায় না। আক্রান্ত মানুষের কাশি বা হাঁচির সময় সামনের বাতাসটুকুতে যেটুকু মিশে থাকে, সেটা যদি আপনি নিজের শরীরে গ্রহণ করেন, ভয় তখনই। সাধারণত, হাঁচিকাশি থেকে নির্গত থুতু-কফ খুব বেশিদূর পর্যন্ত যেতে পারে না— সেজন্যেই ওই তিন-চারফুট দূরত্বের ফরমান। কাশি বা হাঁচির সময় যেটুকু ছিটে লেগে থাকে সামনের জিনিসপত্র বা কাপড়েচোপড়ে— আপনি যদি হাত লাগান সেখানে, এবং সেই হাত দেন নিজের চোখে-নাকে-মুখে, ভয় তখনও। সেজন্যেই হাত-মুখ ধোয়ার ফরমান— এদিক-ওদিকে হাত না দেওয়া বা বারবার চোখেমুখে হাত না লাগানোর সাবধানবার্তা।

৭. শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করা এবং ভাইরাস জাঁকিয়ে বসে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া— দুইয়ের মধ্যে যে সময়টুকু, তার নাম ইনকিউবেশন পিরিয়ড। কোভিড উনিশের ক্ষেত্রে এই পিরিয়ড ঠিক কদিন, বলা মুশকিল। মুশকিল, কেননা ভাইরাসের এই বিশেষ স্ট্রেইনটি বাজারে নতুন। ঠিক যেমন, আমরা জানি না, কাশি বা হাঁচি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসা ভাইরাস মানবদেহে না ঢুকে অন্য কোথাও রয়ে গেলে (যেমন দেওয়াল, বা সিঁড়ির রেলিং ইত্যাদি ইত্যাদি) কতদিন বেঁচে থাকতে পারে। আমরা এ-ও জানি না, গরম পড়লে বা রোদ্দুর বাড়লে ভাইরাস মরে যাবে কিনা— কোভিড উনিশের প্রকোপ কমবে কিনা। কাজেই, সেসব নিয়ে বোকা বোকা আশা না রাখাই ভালো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছেন, ইনকিউবেশন পিরিয়ড এক থেকে চোদ্দ দিন, যেকোনও কিছুই হতে পারে— আর সেজন্যেই, সন্দেহ হলে চোদ্দ দিন আলাদা রাখার ফরমান। আর একটা কথা বলে রাখা যায়, যেহেতু কোভিড উনিশ ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে, উপসর্গহীন মানুষের থেকে অসুখ সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি তেমন একটা নেই।

৮. করোনা ভাইরাস একটি বড় পরিবার— এবং পরিবারের অনেকগুলিই প্রাণীজগতের সংক্রমণ ঘটায়। এদের কোনও কোনওটি প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে আসে অথবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাণীদেহ প্রায় ভাইরাসের ভাঁড়ার হিসেবে কাজ করে। কোভিড উনিশের ক্ষেত্রেও কি তেমন কিছু ব্যাপার আছে? সার্সের ক্ষেত্রে ছিল বেড়াল, মার্স-এর (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম) ক্ষেত্রে উট। কোভিড উনিশের ক্ষেত্রে কী? বিশেষত, যখন অসুখ প্রথম ছড়িয়েছিল মাছের বাজার থেকেই?? না, এখনও নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। যাঁরা চিকেন খাওয়া ছেড়েছেন, তাঁদের বলি, ভালো করে রান্না করে খেলে ভয়ের কিছু নেই। শুধু কাঁচা মাংস ধোয়াধুয়ি বা মশলা মাখানোর পর ভালো করে হাত ধুয়ে নেবেন— সাবান দিয়ে।

৯. কোভিড উনিশে মারা গিয়েছেন যতজন, আক্রান্ত তার চেয়ে বহুগুণ বেশি— কেননা, মারণক্ষমতার বিচারে কোভিড উনিশ সার্স কি ইবোলা-র চেয়ে অনেক পেছনে। আবার আক্রান্ত হয়েছেন যাঁরা, সংক্রমণ ঘটেছে তার চাইতে অনেক বেশিগুণ মানুষের দেহে— কেননা, সার্স-এর চাইতে কোভিড উনিশ অনেক বেশি ছোঁয়াচে।

১০. আক্রান্ত হলেও খুব ভয় পাওয়ার কিছু নেই— কেননা, অসুখ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছায় কম ক্ষেত্রে। কার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হবে আর কার হবে না, বলা মুশকিল। কিন্তু, বয়স্ক মানুষ, বা যাঁরা ভুগছেন ডায়াবেটিস, কিডনি বা ফুসফুস বা হার্টের অসুখে, বা যাঁদের রক্তচাপ বেশি অথবা যাঁরা ক্যানসারে আক্রান্ত— এককথায়, যাঁদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কোনও না কোনও কারণে কমতির দিকে— ঝুঁকি তাঁদেরই। উপসর্গ আর পাঁচটা সাধারণ সর্দিজ্বরের চাইতে আলাদা কিছু নয়। অর্থাৎ, জ্বর, ক্লান্তি, শুকনো কাশি। অনেকের আবার নাক দিয়ে জল পড়া, হাঁচি, নাক বন্ধ, গায়ে-হাতেপায়ে ব্যথা বা পাতলা পায়খানা এসবও হতে পারে। আবারও বলি, অধিকাংশের ক্ষেত্রেই তেমন কিছু বাড়াবাড়ি হয় না— পনেরো কি কুড়ি শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া পর্যন্ত গড়ায়।

১১. নিজে যদি হাঁচি বা কাশিতে ভোগেন, স্বার্থপর না হয়ে অন্যের বিপদের কথা মাথায় রাখুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিখিয়েছেন কাফ হাইজিনের কথা— হাঁচিকাশির সময় মুখ ঢাকুন অবশ্যই— কিন্তু, হাতের তালু দিয়ে মুখ না ঢেকে ঢাকুন কনুইয়ের উল্টো দিক দিয়ে। একটু অবাক শুনতে লাগলেও যুক্তিটা বুঝুন— আমরা হাতের তালু দিয়েই সব কাজ করি, খাই, হাত লাগাই এদিকওদিক— হাঁচি-কাশি থেকে নির্গত ভাইরাস তালুবন্দি করলেও ছড়িয়ে দেওয়া যায় চারপাশে, এমনকি, হয়ত, হাঁচি-কাশি দিয়ে যতদূর ছড়াতে পারতাম, তালু দিয়ে ছড়িয়ে দিতে পারলাম আরও বেশি। কনুইয়ের উল্টোপিঠ সচরাচর বাকিদের সংস্পর্শে আসে না। অতএব, সেদিক থেকে নিরাপদ। আর, তা নাহলে, রুমালে মুখ ঢেকে হাঁচুন/কাশুন— আর তারপরই রুমাল ভরুন পকেটে। আপনার ভাইরাস, আপনার পকেটে। রুমাল কাচার দায়িত্বটুকুও নিজেই নিন।

এই যে এতগুলো কথা আমি বললাম এতক্ষণ, এর সবই আপনি জানেন— জেনে গিয়েছেন। চারপাশে এত হইচই, না জেনে উপায়ই নেই। বাড়তি কিছু কিছু পয়েন্টও হয়ত জেনেছেন— কিন্তু, তার মধ্যে সবগুলো যে সঠিক, এমন না-ও হতে পারে। মাথায় রাখবেন, সাবধান হওয়ার পদক্ষেপগুলো বাদ দিলে এ অসুখের চিকিৎসা কিম্বা প্রতিষেধক, কোনওটিই পাওয়া যায়নি এখনও।

কিন্তু, দুদিন আগে, এই অসুখ এবং প্যান্ডেমিক সতর্কবার্তা নিয়ে বলতে গিয়ে  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধিকর্তা যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো মাথায় রাখা জরুরি। না, শুধুমাত্র করোনা থেকে একা বাঁচার জন্যে নয়— যেকোনও সঙ্কটের মুহূর্তে সবাই মিলে বেঁচে থাকতে কথাগুলো জরুরি। প্রতিটি সঙ্কটই শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ— কোভিড উনিশের বিপদও কেটে যাবে নিশ্চিত, আজ না হলে কাল— এই বিপদ থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়া গেলে আখেরে ভালোই হবে, তাই না?

তিনি বলেছেন, পাঁচটি পি— ইংরেজি বর্ণ পি-এর কথা।

  1. প্রিভেনশন— অর্থাৎ রোগপ্রতিরোধের উপরেই সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া।
  2. প্রিপেয়ার্ডনেস— অর্থাৎ বিপদ মোকাবিলায় প্রস্তুতির গুরুত্ব।
  3. পাবলিক হেলথ— অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যে জোর দেওয়া।
  4. পলিটিকাল লিডারশিপ— অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা।
  5. পিপল— এবং, এইটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— আমজনতার সচেতনতা ও সক্রিয় সহযোগিতা ভিন্ন কিছুই হওয়া সম্ভব নয়।

অতএব, একা বাঁচার আশা করা স্রেফ আহাম্মকি— সবাই মিলেই বাঁচতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি— কিন্তু, সেই সদিচ্ছা যাতে অটুট থাকে, সেটা নিশ্চিত করাও আমাদেরই দায়িত্ব।

কয়েকটা গল্প বলি:

১. চিনদেশ। একটি বিশেষ অঞ্চলে অজানা জ্বরে ভুগতে শুরু করলেন বহু মানুষ। মারাও যেতে থাকলেন অনেকে। কিন্তু, যে ডাক্তার এই অসুখের কথা প্রথম বললেন, সরকার পেছনে লাগল তাঁরই। রীতিমতো ঘটা করে তাঁকে স্বীকার করতে হল, তিনি গুজব ছড়িয়েছেন। আর শেষমেশ সেই অসুখেই মারা গিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন, না, তিনি মিথ্যে বলছিলেন না। অসুখের প্রকোপ বাড়তে থাকলে সেই বিশেষ অঞ্চলটিকে ঘিরে রাখা হল, মানুষের ঘরের বাইরে বেরোনো নিষিদ্ধ হয়ে গেল। বলপূর্বক ঘরের দরজা কাঠের পাটা দিয়ে সিল করে দেওয়া, পুলিশ দিয়ে টেনেহিঁচড়ে লোকজনকে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া— তথাকথিত নাগরিকস্বার্থে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ভিডিও আপনি, সম্ভবত, দেখেছেন। জানি না দেখেছেন কিনা, সেসব সরকারি ভিডিও, যেখানে হাস্যকরভাবে দেখানো হয়েছে আক্রান্ত মানুষেরা হাসপাতালের বেডের পাশে বহাল তবিয়তে নাচাগানা করছেন?? আর হ্যাঁ, কোভিড উনিশের খবর অনেকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন যাঁরা, চিনদেশের সেরকম তিনজন সাংবাদিক বেমালুম বেপাত্তা বেশ কিছুদিন ধরেই।

২. বিবিসি-র রিপোর্ট, গতমাসের আগেই, ইরান সরকার চব্বিশজনকে গ্রেফতার করে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে। আরও একশো আঠারোজনকে সতর্ক করা হয়, একই কারণে। করোনা আক্রমণের তথ্য যথাসম্ভব চেপে যাওয়ার চেষ্টা হয় সরকারের তরফে। যে চেষ্টা না হলে ইরানে কোভিড উনিশের এতখানি বাড়াবাড়ি, হয়ত, হত না। ইরান সরকার অবশ্য বিবিসি-র এই রিপোর্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দিয়েছে।

৩. বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তিশালী দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। করোনা আতঙ্কে যখন কাঁপছে সারা বিশ্ব, সেদেশের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত পরীক্ষাপদ্ধতিকে পাত্তা না দিয়ে ব্যস্ত ছিল নিজস্ব পথ অনুসন্ধানে। শেষমেশ সিডিসি-র পদ্ধতি অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয় এবং তাঁরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পদ্ধতিকেই শিরোধার্য করেন। কিন্তু, ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হয়ে যায়— এইধরনের অসুখকে বাগ মানাতে চাইলে যে সময়টুকুর গুরুত্ব অসীম। দেশের প্রেসিডেন্ট নিজস্ব বার্তায় করোনার বিপদকে সবসময়ই লঘু করে দেখাতে চেয়েছেন। জানিয়েছেন, আরে প্রতিবছর তো এদেশে পঞ্চাশ হাজার মানুষ ফ্লু-তে ভোগেন, মারাও যান কয়েকজন— করোনা তার থেকে আলাদা কীসে!! বলেছেন, সাধারণ ফ্লু থেকে কোভিড আলাদা কিছুই না, শরীর একটু-আধটু খারাপ লাগলে অফিসকাছারি করতে অসুবিধে তো কিছু নেই। হোয়াইট হাউসের সহযোগীরা কোভিড উনিশের বিপদকে লঘু করে দেখিয়েছেন। সচেতনতা বৃদ্ধির আবেদনকে বিরোধীদের চক্রান্ত বলে দেখাতে চেয়েছেন। খাস প্রেসিডেন্ট আর তাঁর সহযোগীরা বিপদকে লঘু করে দেখিয়েছেন, আমজনতাকে বিভ্রান্ত করেছেন— আর, এই সুযোগে সেদেশে বেড়ে ওঠার পরিসর পেয়েছে কোভিড উনিশ।

তিনটে উদাহরণ। তিনটে দেশ। তিনরকম শাসনব্যবস্থা।

প্রথমটি যদি তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক হয় (বা একনায়কতন্ত্র), দ্বিতীয়টি ধর্মভিত্তিক, আর তৃতীয়টি তো যাকে বলে গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা।

মোদ্দা কথাটা এই, কোনও একটি বিশেষ শাসনব্যবস্থাই শাসকের সদিচ্ছা নিশ্চিত করতে পারে না। নিশ্চিত করতে পারে না আমনাগরিকের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের অধিকার। সচেতন থাকার দায়িত্ব আপনার আর আমার। ওই যে, যাকে বলে, অতন্দ্র প্রহরা। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা যাক, প্রাথমিকভাবে আর্সেনিকাম বা হরিতকি-ভেজানো জল খাইয়ে ভাইরাস ঘায়েলের নিদান বাতলানোর পর নিজেদের সামলে নিয়ে, অন্তত এই সঙ্কট মোকাবিলায়, আমাদের দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা বেশ সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে।

আরও একটা কথা, মার্কিন দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা কত?? না, সঠিক করে বলা মুশকিল। সন্দেহ যতজনের, পরীক্ষা মোটেই ততজনের করা হচ্ছে না। বা বলা ভালো, করা যাচ্ছে না। আগেই বললাম, গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর, তারপরেও, বিমাভিত্তিক চিকিৎসাব্যবস্থার ফলে, অনেকেই পরীক্ষা করিয়ে উঠতে পারছেন না। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিদিন যতজনের পরীক্ষা হচ্ছে, আমেরিকায় করা হচ্ছে তার এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশমাত্র। অবশ্য, দিনদুয়েক আগে সেদেশের সবকটি বিমাসংস্থা একজোট হয়ে জানিয়েছেন, কোভিড উনিশের মোকাবিলার স্বার্থে তাঁরা গ্রাহকদের সঙ্গে যথাসম্ভব সহযোগিতা করবেন— পরীক্ষা আর চিকিৎসা যাতে ঝামেলাহীন হতে পারে, তা নিশ্চিত করবেন। আশা করা যাক, তেমনটাই হবে।

আর এদেশে?? এসবিআই ইনশিওরেন্সের প্রধান জানিয়েছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্যান্ডেমিক ঘোষণা করার পর, অনেক বিমাগ্রাহকই কোভিড উনিশে আক্রান্ত হলে বিমার সুবিধা পাবেন না— কেননা, মহামারী (এপিডেমিক) বা অধিমারী (প্যান্ডেমিক) বেশ কিছু পলিসির আওতার বাইরে। আপনার পলিসিটি কোন দলে পড়ছে? পয়সা দেওয়ার আগে আণুবীক্ষণিক অক্ষরগুলো পড়ে নিয়েছিলেন তো!! এদেশেও স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি বিমাব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার পাকা বন্দোবস্ত হচ্ছে— এমনকি সরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবাটুকুও— সে ব্যবস্থা মেনে নেওয়া নিরাপদ হবে তো??

ইতালিতে পরিস্থিতি বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলোর সঙ্গে তুলনীয়। আক্রান্ত প্রচুর— মানুষ মারা যাচ্ছেন শয়ে শয়ে। ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন যত, রয়েছে তার চেয়ে অনেক অনেক কম। চিকিৎসার বা চিকিৎসা-পরিকাঠামোর র‍্যাশনিং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি অসুস্থ যিনি, নাকি চিকিৎসা করলে সেরে ওঠার সম্ভাবনা যাঁর সবচাইতে বেশি— চিকিৎসার মুহূর্তে অগ্রাধিকার পাবেন কে? কাকে দেওয়া হবে প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর? নৈতিক দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ চিকিৎসকেরা।

আপনি মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারেন, সন্দেহ হলেই সেই মানুষটার থেকে রাখতে পারেন চারফুট দূরত্ব, বাড়ি ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে গরম চায়ের কাপ পাশে নিয়ে টিভির পর্দায় দেখে নিতে পারেন কোভিড উনিশের লেটেস্ট পরিস্থিতি। কিন্তু, চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা?? সন্দেহভাজন তো বটেই, নিশ্চিত আক্রান্তের কফটুকু মুছে সাফসুতরো করে রাখা, কিম্বা শরীরের কাছে গিয়ে হৃদস্পন্দন শোনা— দূরত্ব বজায় রাখার প্রশ্নই আসে না। না, বিশ্বাস করুন, ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরাও মানুষ, তাঁদেরও জীবন আপনারই মতো মূল্যবান, বাড়ি ফিরে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে তাঁরও। আর, নিজের কাশি হলে, তিনিও সন্তানকে বলেন, দেখছিস তো কাশছি, একটু দূরে গিয়ে বসতে পারিস না, মা!!

সাবধান হোন। হাঁচছেন/কাশছেন এমন মানুষের থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।

কিন্তু, প্লিজ, আপনার চিকিৎসক যাঁরা, তাঁদের আরেকটু কাছের মানুষ ভাবার অভ্যেস করুন।

 

তথ্যসূত্র:

  1. https://www.who.int/news-room/q-a-detail/q-a-coronaviruses
  2. https://www.who.int/dg/speeches/detail/who-director-general-s-opening-remarks-at-the-media-briefing-on-covid-19—11-march-2020
  3. https://www.theatlantic.com/ideas/archive/2020/03/incompetence-exacerbated-by-malevolence/607696/
  4. https://news.un.org/en/story/2020/03/1059261
  5. https://www.theatlantic.com/politics/archive/2020/03/trump-coronavirus-threat/607825/
  6. https://foreignpolicy.com/2020/03/09/truth-coronavirus-china-trump-pence/
  7. https://www.theverge.com/2020/3/10/21173970/insurance-coronavirus-treatment-testing-coverage-cigna-aetna-humana-pence
  8. https://m.economictimes.com/wealth/insure/health-insurance/your-health-insurance-policy-might-not-cover-coronavirus-in-these-situations/articleshow/74570246.cms