কোভিড বিশ্বমারি চর্চায় এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন

বিষাণ বসু

 

আমাদের প্রজন্ম তো বটেই, তার আগের দুখানা প্রজন্মও বিশ্বমারি দেখেনি। বিশ্বমারি বা অতিমারি, (প্যানডেমিক-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে আপনার মনে যেটি-ই ধরুক) তা ঘটেনি গত একশো বছরে। অবশ্য ক্ষিদে বা আর্থিক অসাম্যকে যদি অসুখ হিসেবে ধরতে রাজি থাকেন, তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু আমরা আপাতত কোভিড অতিমারি নিয়ে কথা বলব। সে বিষয়ে লিখিত একখানা বই নিয়ে কথা বলব।

একটি অতিমারিকে অনেকগুলো দিক থেকে দেখা যেতে পারে, সে নিয়ে অনেকভাবে লেখা যেতে পারে। একটি তো দিনপঞ্জী লেখার মতো করে লেখা। রোজকার দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা লিখে চলা। সে লেখাও আবার বিভিন্নরকমের হতে পারে। পরিস্থিতিটা চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে দেখলেন, গৃহবন্দিত্বের একঘেয়েমিতে হাঁফিয়ে ওঠা মানুষ সমস্যাটাকে একইভাবে দেখবেন না। অসহায় মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত যে সমাজকর্মী, তাঁর অভিজ্ঞতার সঙ্গে অসুখে প্রিয়জনকে হারালেন যিনি, তাঁর শোকের অভিজ্ঞতা মিলবে না। আবার যিনি শুধুই ঘরে আটকা পড়ে তিতিবিরক্ত এবং যাঁর চেনা বৃত্তের মধ্যে একজনও মারা যাওয়া তো দূর, এমনকি গুরুতর অসুস্থও হননি, তিনি পুরো পরিস্থিতিটাকেই বিরক্তিকর বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখবেন। এঁদের প্রত্যেকের দিনপঞ্জী ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হবে এবং আজ থেকে কয়েক দশক বাদে কেউ এই কোভিডকালের নির্মোহ ইতিহাস রচনা করতে চাইলে, এই প্রতিটি বয়ানের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে। অবশ্য কোভিডে সামাজিকভাবে যাঁরা সবচাইতে বিপর্যস্ত হলেন, অর্থাৎ আর্থসামাজিক সিঁড়িতে সবচেয়ে নিচের সারির মানুষজন, তাঁদের বয়ান সরাসরি রক্ষিত হওয়া মুশকিল। উপরিউক্ত যেকোনও বয়ানের মধ্যেই তাঁদের স্বর মিশে থাকবে, মিশে রইলও হয়তো— আগামীদিনের ইতিহাসকারকে সেখান থেকেই সে বয়ান খুঁজে ছেঁকে নিতে হবে। আরেকভাবে লেখা সম্ভব, যা কিনা বিজ্ঞানের চোখে দেখা। অর্থাৎ, ভাইরাস-ঘটিত মহামারি যেহেতু, সেহেতু এই ভাইরাসের বিশেষত্ব, কেন বাকি ভাইরাসকে অতিক্রম করে এটিই বিশ্বমারি ঘটাতে পারল, এই ভাইরাসের মোকাবিলা কীভাবে করা গেল, অজানা অসুখের সামনে ভুল করতে করতেই কেমন করে চিকিৎসাবিজ্ঞান গ্রহণযোগ্য রাস্তাটি খুঁজে পেল, ভাইরাস প্রতিরোধই বা কোন পথে করা গেল, বা কোন পথ ধরে খোঁজার চেষ্টা হল, এই সবকিছু নিয়ে লেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রেও দিনপঞ্জী জাতীয় লেখায় ধরা থাকবে সাময়িক উচ্ছ্বাস, হতাশা, অভিজ্ঞতা (ভাল ও খারাপ, উভয়ই), আশা-নিরাশা সবই। একটু সময়ের দূরত্ব হলে সে লেখা ভিন্ন মাত্রা ও সম্পূর্ণতা পাবে। তৃতীয় আরেকটি রাস্তা হল, আর্থসামাজিক দিক থেকে অতিমারির অভিজ্ঞতাটিকে দেখা। ঠিক কেমন করে কারা আক্রান্ত হলেন, কারা বেঁচে গেল আর কারা প্রাণে বাঁচলেও সর্বস্বান্ত হয়ে গেল, আধুনিক বিজ্ঞান ঠিক কাদের বাঁচানোকে প্রায়োরিটি দিল— মোকাবিলার কস্ট-বেনিফিট-এর সূক্ষ্ম হিসেবনিকেশ কষা হল কোন অঙ্কে— এসব নিয়ে লেখা জরুরি, খুবই জরুরি। কিন্তু এই শেষ গোত্রের লেখার কাজটি দুরূহ, সম্ভবত সবচাইতে দুরূহ। কেননা হাজার তথ্যের ভিড়ে কোনটি যে সত্যি আর কোনটি মিথ্যে, কোন তথ্য ঠিক কী কারণে তাৎপর্যপূর্ণ, কোন ছোট্ট খবর কোন গুরুত্বপূর্ণ দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করছে, বিশেষজ্ঞদের মতকে ছাড়িয়ে কখন আপাত-গুরুত্বহীন কণ্ঠস্বরকে অগ্রাধিকার দেব— এই বিশ্লেষণ চটজলদি হয় না, এবং এমন গভীর অন্বেষণ ও অনুধাবনের মেধাও বাজারে সুলভ নয়। যদিও, এই শেষের পথ ধরেও অনেকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন— তাড়াহুড়ো করে দাঁড়-করানো সেই অগভীর বিশ্লেষণী প্রয়াস আলোকবর্তিকা হওয়ার পরিবর্তে বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠেছে।

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের তরফে অনুরোধ এল, মানস প্রতিম দাসের ‘শতাব্দীর বিশ্বমারি’ বইটি পড়ে দেখার। এবং রিভিউ করার। বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মানসবাবু যথেষ্ট পরিচিত নাম। আকাশবাণীতে বিজ্ঞান-বিষয়ক অনুষ্ঠানের প্রযোজনা করেন, নিয়মিত লেখালিখি করেন, বিভিন্ন পুরস্কারও পেয়েছেন। কোভিড বিশ্বমারি নিয়ে তাঁর বইটি যে এই বিষয়ক চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হবে, তা পড়ার আগেই অনুমান করা যায়।

কোভিড অতিমারিকে সবদিক থেকেই দেখেছেন মানসবাবু। এমনকি, কোভিডের প্রসঙ্গ টেনে অতীত অতিমারি বা অতীত মহামারির কথাও এনেছেন। যথাসাধ্য আলোচনা করেছেন। টিকার ইতিহাস ও টিকার বিজ্ঞান নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন। অধ্যায়ের বিভাজন দেখলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। অধ্যায়গুলোর নাম যথাক্রমে, ভাইরাস ও ভবিষ্যৎ, বিশ্বমারি: না-মানুষী উৎস (অর্থাৎ বিভিন্ন পশুপাখি থেকে কেমন করে মানুষের মধ্যে সংক্রামক অসুখ-বিসুখ ছড়ায়, সে নিয়ে আলোচনা), প্লেগ ছড়ানোর কাহিনি, প্লেগের জীবাণুর খোঁজে, কলেরার কালযাত্রা, বিশ্বযুদ্ধ শেষে বিশ্বমারি, কোভিড কবলে, কোভিডকাল: জীবনের ছেঁড়া ছবি (প্রসঙ্গত বলে রাখি, কোভিড নিয়ে আমার লেখালিখির যে ছোট সঙ্কলনটি ধানসিঁড়ি থেকে প্রকাশিত, তার শেষ অধ্যায়টিরও নাম, ‘কোভিডকাল— ছেঁড়া ছবি’। মানসবাবুর বই আমি তার আগে পড়িনি, সম্ভবত তিনিও আমারটি পড়েননি। কোন বইটি আগে বেরিয়েছে, বলা মুশকিল। আশা করি, তিনি আমার বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আনবেন না।), কিউবা ও ভিয়েতনামের পরিস্থিতি, বিশ্বমারি বুঝতে গণিত, বিশ্বমারি ও কুসংস্কার, ভারতে টিকা ব্যবহারের ইতিহাস। এসবের আগে রয়েছে একখানা চমৎকার ভূমিকা— প্রাক বা উত্তরকথা।

ভূমিকাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কেননা অন্যান্য অসুখের টিকা তৈরি করতে অনেক সময় লাগলেও কোভিডের টিকা এত তাড়াতাড়ি, তাও আবার এত বিভিন্ন রকমের টিকা, কী করে সম্ভব হল এবং কেন-ই বা এতরকমের টিকা, তার উত্তর মানসবাবু দিয়েছেন ভূমিকাতেই। টিকা নিয়ে বিভ্রান্তির বাজারে কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

প্রায় সবদিক কভার করার সুবিধে অসুবিধে দুইই আছে। একদিক থেকে যেমন কোভিডের দিনগুলোকে ফিরে দেখতে এই বই অত্যন্ত কার্যকরী এবং ইতিহাসের প্রেক্ষিতে কোভিডকে দেখতেও এ বই সাহায্য করে— আবার আরেকদিকে, সবকিছু কভার করতে গেলে কোনও দিকই তেমন গভীরে অনুধাবন করা সম্ভব হয় না— সে সমস্যা এ বইয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে। অর্থাৎ মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ভালো ছাত্রের পরীক্ষার খাতার মতো, উত্তরে পয়েন্ট কিছু মিস্ করা হয়নি, কিন্তু তার বেশি কিছুও লেখা নেই। কথাটা মানসবাবুর প্রয়াসকে ছোট করার জন্য বলা নয়— কমবেশি দুশো পাতার মধ্যে এমন দুঃসাহসী প্রয়াস যাঁরাই করবেন, সবার ক্ষেত্রেই এই সীমাবদ্ধতা অনিবার্য। তদুপরি অতিমারি চলাকালীন যথাসম্ভব নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকে দেখার চেষ্টা, বিশ্লেষণ করার চেষ্টা— প্রত্যহ ভেসে আসা বিজ্ঞানের মোড়কে হাজারো জঞ্জালের মধ্যে থেকে সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্য ছেনে নেওয়া— কাজটা সহজ নয়, সেই পরিশ্রমজনিত ঘামের দাগ লুকানোর কাজটিও কঠিন। অতএব, মানসবাবুর বইটি যতখানি সুখপাঠ্য হতে পারত, ততখানি হয়নি। এমন সমালোচনা সত্ত্বেও বলি, বইটি পড়া উচিত।

যে অধ্যায়টি আমাকে বিশেষভাবে চমৎকৃত করেছে, সেটি অবশ্যই ‘বিশ্বমারি বুঝতে গণিত’। অনবদ্য। টিকা আসার আগে-পরে বাজারে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ শব্দবন্ধ মুড়ি-মুড়কির মতো ঘুরে বেরিয়েছে। সে জিনিস খায় না মাথায় মাখে, সে কথা কজন বুঝেছেন বলা মুশকিল, এমনকি ডাক্তাররাও মোদ্দা বিষয়টা জানলেও তার পেছনের গাণিতিক তত্ত্বটা সবসময় জানেন না— ঠিক জলের মতো করে না হলেও মানসবাবু সেই জটিল তত্ত্ব সর্বজনবোধ্য ভাষাতেই বুঝিয়েছেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, বিশ্বমারি ও কুসংস্কার। এমন সর্বগ্রাসী অসুখ কেমন করে মানুষকে অসহায় কুসংস্কার-বিশ্বাসী করে তোলে, তার একটা আভাস এই অধ্যায়ে রয়েছে। আফসোস, এই অধ্যায়টি মানসবাবু আরেকটু বিস্তারে লিখলেন না!!

আর শেষ অধ্যায় নিয়ে আফসোস বা অনুযোগ নয়, একদম জোরালো দাবি রাখছি। ভারতে টিকা-ব্যবহারের ইতিহাস নিয়ে মানসবাবু যেটুকু লিখে ছেড়ে দিয়েছেন, তা স্টার্টার পরিবেশন করে মেইন কোর্স না খাওয়ানোর সামিল। এমন গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস নিয়ে আরেকটু লিখবেন না! ঔপনিবেশিক শাসনে জনস্বাস্থ্যকে ঔপনিবেশিক প্রভুদের সুবিধেমতো ব্যবহার, ‘নেটিভ’-দের স্বার্থকে অবহেলা— আবার উপনিবেশের সুবাদেই ‘আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান’-এর প্রবেশ— এই দ্বন্দ্ব নিয়ে মানসবাবু লিখবেন, এই আশা রইল। না, আশা নয়, দাবি। এ নিয়ে মানসবাবু বিশদে লিখুন, এই দাবি।

বইয়ের ছাপা-বাঁধাই দিব্যি। প্রচ্ছদ খারাপ নয়, তবে উল্লেখযোগ্যও নয়। শেষের পাতার একেবারে নিচ অবধি ছাপা, আর তারপরই বাঁধাই— মনে হতে থাকে, কিছু পাতা হয়তো মিসিং। বইয়ের দাম চারশো টাকা রাখার পরেও একখানা সাদা পাতা জুড়তে এমন কার্পণ্য কেন!!

শতাব্দীর বিশ্বমারি
মানস প্রতিম দাস
প্রথম সংস্করণ — ২০২২
এভেনেল প্রেস
দাম — চারশো টাকা
 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...