Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাগুলির ফলে গরিব মানুষ তাঁদের সমস্ত মর্যাদা হারাতে বসেছেন

হর্ষ মন্দর

 




লেখক মানবাধিকার কর্মী এবং নিবন্ধকার। বর্তমান নিবন্ধটি ‘দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর মুদ্রিত সংস্করণে গত ২৭শে মার্চ ‘Lockdown and the poor’ শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ওই দিনই পত্রিকাটির ই-সংস্করণেরও অঙ্গীভূত হয়।

 

 

“আমি করোনাতে মরব না। তার আগেই আমি খিদেয় মরে যাব।”

এক ডজনেরও বেশিবার বিলাপটা শুনলাম। পুরনো দিল্লিতে। কিছু তরুণ বন্ধু সেখানে হাজারখানেক গৃহহীন মানুষকে খাবার দিচ্ছিল। খুবই ক্ষুদ্র, অসহায় একটা উদ্যোগ। কেবল এই বার্তাটা দেওয়ার চেষ্টা করা যে, তোমাদের সঙ্গে আছি।

“এখন যা চলছে নোটবন্দি তার কোনও তুলনাতেই আসে না। বুঝেই উঠতে পারছি না কীভাবে বেঁচে থাকব, আদৌ বেঁচে থাকব কিনা…” সেই গৃহহীনদের আরেকজন বললেন।

এর এক ঘণ্টা পরে আমি অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের ত্রাণ প্যাকেজটা পড়ছিলাম। তাঁর স্বঘোষিত লক্ষ্য– এই করোনাভাইরাস লকডাউনের ফলে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা আসবে তার থেকে গরিবদের রক্ষা করা। তিনি বলেছেন, কেউ যেন না খেয়ে না থাকে। পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। হতাশও।

নির্মলা সত্যিই বিশ্বাস করেন, পরিবার পিছু মাসে ৫ কেজি করে অতিরিক্ত চাল বা গম; ১ কেজি করে ডাল; বয়স্ক, প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ এবং বিধবাদের জন্য এক হাজার করে টাকা; তিন মাস জন ধন অ্যাকাউন্ট থেকে মহিলাদের দেড় হাজার করে টাকা; গ্যাস সিলিন্ডারের ফ্রি কানেকশন; এবং কৃষকদের দুই হাজার টাকা করে ট্রান্সফার করে ‘কেউ যেন না খেয়ে থাকে’– এই লক্ষ্য পূরণ হবে?

প্রধানমন্ত্রী মোদিও কোভিড উনিশের বিপজ্জনক ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বা নিতে হবে সে নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে তিনটি ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু সেই সব ব্যবস্থা দেশের কয়েক লক্ষ অসংগঠিত শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক এবং নিঃস্ব সর্বস্বান্ত মানুষের জীবনে যে ভয়াবহ দুর্দশা নামিয়ে আনবে তার ভগ্নাংশ সম্পর্কেও না তিনি, না নির্মলা কেউ কিছু বললেন!

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে গরিবদের নামমাত্র উল্লেখ করলেন এবং সিভিল সোসাইটিকে তাদের ক্ষোভ উপশম করতে বলে দায় সারলেন। নির্মলা অবশ্য গরিবদের নিয়ে কিছু বললেন। কিন্তু তিনিও মনে হল মনে করছেন যে, গরিব পরিবারগুলিকে এককালীন অল্প কিছু খাদ্য এবং কিছু নগদ টাকা দিয়ে দিলেই যে সুনামির মুখোমুখি তাঁরা হতে চলেছেন তার থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ট রসদ হয়ে যাবে।

এগুলি প্রয়োগ করাও বিস্তর সমস্যাসাপেক্ষ। যেমন ধরুন, এই লকডাউনের মধ্যে তাঁরা অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলবেন কী করে? আর সবচেয়ে বড় কথা হল, খাবারের সবচেয়ে বেশি দরকার যাদের– যেমন পথশিশু, গৃহহীন, প্রতিবন্ধকতা যুক্ত মানুষেরা বা প্রান্তিক এবং ভবঘুরে জনজাতিরা– তাদের কোনও অ্যাকাউন্টও নেই, কার্ডও নেই।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আমাদের অর্থনীতি– যা মূলত দাঁড়িয়ে আছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ওপর এবং যা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সঙ্কটাপন্ন অবস্থায়– এই দেশজোড়া লকডাউনের ফলে তার ওপর কি ধ্বংসাত্মক অভিঘাত পড়বে সে নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করা হল না। অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে দেখাচ্ছিলেন, মাত্র প্রথম দুদিনের লকডাউন অর্থনীতিতে যা প্রভাব ফেলেছে তা গোটা নোটবন্দি পর্যায়ের প্রভাবের সঙ্গে সমতুল্য। এবং  আরও বলছিলেন, এই গোটা লকডাউনের পরে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট নিম্নগামী  হয়ে থাকা অর্থনীতির একেবারে রসাতলে গিয়ে পৌঁছনোর সম্ভাবনা প্রবল। তাঁর এই ভয়ানক মূল্যায়নের সত্যতা বোঝার জন্য কোনও অর্থনীতির ট্রেনিং-এর প্রয়োজন পড়ে না।

যদি কখনও কোনও গুজব ছড়ায় যে কোনও সহৃদয় ব্যক্তি খাবার বিতরণ করছেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রায় পদপিষ্ট হয়ে যাওয়ার মতন ঘটনা ঘটছে। বয়স্ক, প্রতিবন্ধকতা যুক্ত মানুষ, মহিলা এবং শিশুরা এই অমানবিক প্রতিযোগিতায় পিছনে পড়ে যাচ্ছেন স্বাভাবিকভাবেই। খাদ্য বিষয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য, অপর্যাপ্ত, এবং সর্বোপরি তাঁদের মর্যাদার জন্য চরম হানিকর। তাঁরা কাজ চান, দয়া চান না। যদি রাষ্ট্রের কোনও পদক্ষেপে তাঁদের কাজ না থাকে, তবে তাঁদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করাটা সর্বোচ্চ সরকারি দায়িত্ব হওয়া উচিত। এটা মোটেই কোনও ব্যক্তিবিশেষের কৃপার বিষয় নয়।

এখনও অন্তত তিন সপ্তাহ তাঁদের যুঝতে হবে। খিদে কিন্তু বাড়ছে ভয়ঙ্করভাবে।

অনেকেই বলছেন শহরে এখন যেহেতু তাঁদের কাজ নেই– ফলে খাবারও নেই– তাই তাঁদের জন্য গ্রামে ফিরে যাওয়াটাই ভালো। সেখানে তাঁরা নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকতে পারবেন, মানসিকভাবেও ভালো থাকতে পারবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রেন বাস সব দুমদাম ক্যানসেল হতে থাকে। ভারত সরকার বিদেশ থেকে অভিবাসীদের আনার জন্য মেডিকেল স্টাফ সমেত চার্টার প্লেনের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু তার নিজের গোটা দেশে ছড়িয়ে থাকা এই কয়েক লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক– যাঁরা কাজ এবং খাদ্যের অভাবে এক অবর্ণনীয় অবস্থায় আটকে পড়ে রইলেন– তাঁদের জন্য কোনও দায়িত্ব অনুভব করল না।  যদি তারা কোনওরকমে আন্তঃরাজ্য সীমান্তগুলিতে পৌঁছাতে পারতেন তবে সেখানে তাদের পুলিশ পেটাত। সেটাও যদি লুকিয়ে-চুরিয়ে পার করতে পারতেন, তবে তাদের হেঁটে বা সাইকেলে হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নিজেদের গ্রামে পৌঁছতে হত, এবং এই পুরো পথটাই তাদের লড়তে হত খিদে এবং পুলিশের নজরদারি সঙ্গে।

ট্রাক ড্রাইভাররা দেশের বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়েছেন, সেখানে তাঁদের শোধন করানো হচ্ছে, যা থেকে তাঁদের পালানোর কোনও রাস্তা নেই।

স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য একটা ছোট আর্থিক প্যাকেজ বাদ দিয়ে আর এমন কিছুই ঘোষণা করা হয়নি যা দিয়ে দরিদ্র জনসাধারণ এই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাঁদের সুষ্ঠু স্বাস্থ্যপরিষেবা পাওয়া সুনিশ্চিত হয়। তাঁরা কোথায় পরীক্ষা করাবেন? সেখানে কি তাঁদের পয়সা দিতে হবে? আর তাঁদের জন্য হসপিটাল বেড, ভেন্টিলেটর ইত্যাদির ব্যবস্থাই বা কোথায় হবে? আমরা কি স্পেন বা নিউজিল্যান্ডের কাছ থেকে শিখে এই অতিমারির সময়টুকু সমস্ত বেসরকারি হাসপাতাল এবং চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোকে সরকারি আওতায় আনতে পারি না? তা না করা হলে কিন্তু গরিবরা যে শুধু খিদেয় মরবেন তাই নয়, এই ভাইরাস তাঁদের আক্রমণ করলে বিনা চিকিৎসাতেও মরবেন।

যেহেতু প্রধানমন্ত্রী এই অভূতপূর্ব সঙ্কটে দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাই অনেকেই এ সময় তাঁকে নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছেন। পি চিদম্বরম ঘোষণা করেছেন এই যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী তার কমান্ডার-ইন-চিফ। অনেক মুখ্যমন্ত্রীও একই সুরে কথা বলেছেন। সবিনয়ে জানাচ্ছি, আমি কিন্তু এই চরম গরিব বিরোধী লকডাউনটাকে সমর্থন করতে পারছি না। আচ্ছা আমরা কি তাইওয়ান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার দৃষ্টান্ত থেকে শিখতে পারতাম না? তারা কিন্তু দেশজুড়ে লকডাউন জারি না করেই এই ভাইরাসকে মোকাবিলা করেছে। আমাদের অবশ্যই এটা প্রত্যাহারের কথা ভাবা উচিত।

ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে মঙ্গলসাধনের ইচ্ছা ও ক্ষমতা কোনওটাই আমাদের রাষ্ট্রশক্তির দেখা যাচ্ছে না। মহাত্মা গান্ধির শিক্ষা মনে করবার এর চেয়ে ভালো সময় আর হয় না। তিনি বলেছিলেন, যখনই কোনও দোলাচলে পড়বে তোমার জানা সবচেয়ে আর্ত মানুষটির কথা ভাবো। ভেবে দেখো, যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা তাঁর জীবনের মান এবং স্বাধীনতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হচ্ছে কি না। আমার সঙ্গে আজকে এরকম কিছু মানুষের দেখা হল। সরকার যে ব্যবস্থাগুলি নিয়েছে তা হয়তো আমাকে-আপনাকে সুরক্ষা দেবে, কিন্তু তাঁদের একটা সম্মানজনক এবং আশাব্যঞ্জক জীবনের সম্ভাবনা স্রেফ ধ্বংস করে দেবে।