Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অর্থনীতি পঙ্গুই ছিল, এরপর আবার করোনা

প্রতীপ নাগ

 




লেখক ট্রেড ইউনিয়নিস্ট ও রাজনৈতিক কর্মী।

 

 

 

একুশ দিনের লকডাউন; সৌজন্য— করোনা ভাইরাস। একদিকে জোর আলোচনা কত মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন বা লকডাউন কতদিন চলবে। আর অন্যদিকে করোনার প্রভাব ভারতীয় অর্থনীতি সামাল দিতে পারবে কিনা। ইতিমধ্যে শেয়ার বাজারে ধ্বস নেমেছে বিশ্বজুড়ে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। মূলধারার গণমাধ্যম ও সরকার বারবার বলে চলেছে করোনার ফলে শেয়ার বাজার ধ্বসেছে আর আর্থিক সঙ্কট বাড়বে। যদিও এই আর্থিক সঙ্কটের নানা উপাদান কয়েক বছর ধরেই ছিল। করোনা ভাইরাস তাতে স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে।

 

করোনা পূর্ববর্তী সময়ের আর্থিক অবস্থা

মোদি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার আগে থেকেই ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশ, যা বিগত পাঁচ বছরে নিম্নতম। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন সরলরৈখিক। গত অক্টোবর মাসে কর্মহীনতার হার পৌঁছেছিল ৮.৫ শতাংশে, যা ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ভারতীয় অর্থনীতির দুই চালিকাশক্তি রপ্তানি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ক্রমহ্রাসমান হচ্ছিল বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্কটের কারণে। বিশ্ব বাণিজ্যের গতি স্থির হওয়ার কারণে রপ্তানি হ্রাস পাচ্ছিল। অন্যদিকে ব্যালান্স শিট সঙ্কটের কারণে বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই দুটি ঢেউ ভারতের অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণ।

অর্থনীতি নোটবন্দি আর জিএসটি-র ধাক্কা খানিকটা সামলে উঠেছিল। প্রথমত আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম অনেকেটা পড়া যাওয়ার ফলে। দ্বিতীয়ত, নন ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর (NBFC) ক্রেডিট বুমের কারণে। এই ক্রেডিট বুম অস্থিতিশীল রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সঞ্চয়ন ঘটিয়েছিল, বুদবুদকে ফুলিয়ে। এই ফোলানো বুদবুদ ফেটে যায় ২০১৯ সালে।

যদিও মোদি দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পরে শেয়ার বাজার তার শিখরে পৌঁছেছিল। কিছুদিন পরে তা আবার ঝিমিয়ে পড়ে। এই ঝিমিয়ে পড়া শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করতে মোদি কর্পোরেট সংস্থাগুলির জন্য বিপুল কর ছাড়ের ঘোষণা করেন, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নিকরণ, শ্রম-আইন সংশোধনের মাধ্যমে শ্রমিকদের যতটুকু অধিকার ছিল তা কেড়ে নিয়ে পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়ানোর চেষ্টা চলে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চাবিকাঠি কোনও কোনও বিশেষ মুহূর্ত ছাড়া সম্মিলিতভাবে পুঁজিপতিদের হাতে থাকে। ফলে আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে তারা কী ভাবছেন তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শেয়ার সহ ফাটকা পুঁজির বাজারের সঙ্গে বাস্তব উৎপাদনের (শিল্প, কৃষি, খনিজ, পরিষেবা ইত্যাদি) চলনে হুবহু মিল না থাকলেও এই দুইয়ের মাঝে কোনও চিনের প্রাচীর নেই। দ্বিতীয়ত এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শেয়ার বাজার হল পুঁজিপতিদের ভাবনা-চিন্তা, আশা-আকাঙ্খা, আনন্দ-দুঃখের সূচক। পুঁজিপতিরা তাদের পরিচালিত ব্যবস্থা সম্পর্কে কী ভাবছেন তা বুঝতে শেয়ার বাজারের উত্থান পতন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

কর্পোরেট ঋণ ও ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা

২০১৭ সালে ক্রেডিট সুইস সংস্থার একটি রিপোর্ট ভারতের কর্পোরেট ঋণ নিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দেখা যায় যে বহু কর্পোরেট সংস্থা ঋণের সুদ দেওয়ার মতো মুনাফা অর্জন করতে পারছে না। এদের সংখ্যা মোটেই কম নয় এবং মোট কর্পোরেট ঋণের চল্লিশ শতাংশ মতো এদের হাতে। কর্পোরেট ঋণ পরিশোধ এমনভাবে হয় যার দ্বারা ঋণের আসল ও সুদ ধারাবাহিক কিস্তির মাধ্যমে ঋণদাতা ফেরত পায়। এই কিস্তিগুলিকে বলা হয় অ্যানুইটি পেমেন্ট। এই অ্যানুইটিগুলি এমনভাবে গঠিত হয় যাতে ঋণদাতা প্রথম দিকে তার সুদ বেশি বেশি করে নিয়ে নেয়। পরের কিস্তিগুলিতে মূলধন পরিশোধ করা হয়। আর ঠিক এই কারণেই ৪০ শতাংশ সংখ্যাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ এক বিপুল সংখ্যক বাণিজ্যিক সংস্থা তলিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত এদের অনেকেই সুদ ফেরত দেওয়ার অবস্থাতেই আটকে থাকবে। ফলত যে অর্থ তারা পরিশোধ করতে পারছেন না তা ব্যাঙ্কের খাতায় অনাদায়ী ঋণ (এনপিএ) হিসাবে পড়ে থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত এই লোকসানের ভার ব্যাঙ্কগুলিকে বইতে হবে। ক্রেডিট সুইস রিপোর্ট অনুসারে ৩৭৮ হাজার কোটি টাকার মোট ঋণের দুই-তৃতীয়াংশ এমন সব কোম্পানির হাতে আছে, যারা তার আগের ১২টি ত্রৈমাসিক সুদের ১১টিই দিতে পারেনি।

বিগত ৬০ বছরের তথ্য দেখলে বোঝা যায় যে কর্পোরেট ঋণ মোট জাতীয় আয়ের শতকরা হিসাবে বাড়ছে। এবং ২০০২-২০০৩ থেকে এই বৃদ্ধি অস্বাভাবিক দ্রুতগতি লাভ করেছে। এবং বাড়ছে অনাদায়ী থাকার পরিমাণও। এই অনাদায়ী ঋণের ৪০ শতাংশই আছে ধাতু, টেলিযোগাযোগ ও বিদ্যুৎ শিল্পে। যেহেতু এই তিনটি ক্ষেত্রের উপর অন্যান্য ক্ষেত্রগুলি নির্ভরশীল তাই এর প্রভাব ব্যাপক।

আমাদের সামনে উদাহরণ আছে, জেট এয়ারওয়েজ। ভারতের বিমান শিল্পের বাজারের অনেকখানি তাদের দখলে ছিল। আবু ধাবির এতিহাদ বিমান সংস্থা জেটের ২৪ শতাংশ শেয়ার কিনেছিল। ২০১৮র শেষে তাদের মোট ঋণ ছিল ৭৩০ কোটি টাকা এবং তারা ঋণশোধের কিস্তি দিতে পারেনি। এছাড়াও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনও তারা দিতে পারেনি। ফলে ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে জেট এয়ারওয়েজ মুখ থুবড়ে পড়ে। একই ঘটনা আমরা দেখেছি ২০১২ সালে কিংফিশার এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক নেতা, আমলা, আর পুঁজিপতি— এদের  অঙ্গুলিহেলনে গোটা দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দশ বছরে ব্যাঙ্কগুলি মোট ৭,০০,০০০ কোটি (১০১ বিলিয়ন ডলার) টাকার ঋণ মকুব করেছে, আর ডিসেম্বর ২০১৮-এর হিসেব অনুযায়ী তার আগের নয় মাস সময়ে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ১,৫৬,৭০২ কোটি টাকা। গত দশ বছরের এই ঋণ মকুবের একটা বড় অংশ (প্রায় চার-পঞ্চমাংশ) ঘটেছে ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর গত পাঁচ বছর সময়ে। কর্পোরেটদের প্রতি ব্যাঙ্কের এই বিচিত্র উদারতার খেসারত দিতে জনগণের তহবিলের টাকা দিয়ে ব্যাঙ্কের মূলধনে পুনর্বিনিয়োগ করা হচ্ছে। অর্থাৎ কর্পোরেট ব্যাঙ্কগুলিকে লুটে নেবে আর তারপর সেই দুর্বল ব্যাঙ্ককে বাঁচিয়ে তুলবে সাধারণ ভারতীয় জনগণ। এরা ব্যাঙ্কগুলির অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি শুরু করেছে। এই অনাদায়ী ঋণ শেষ পর্যন্ত দেশের গোটা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে ফেলবে বলে বহু সমালোচকই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ২০১৬-১৭র হিসেব অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির দেয় ঋণের পরিমাণ ছিল দেশের মোট ঋণের ৬৯ শতাংশ। অনেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারিকরণকে সব আর্থিক অসুখের একমাত্র দাওয়াই হিসেবে মনে করলেও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিও কিন্তু সমস্যামুক্ত নয়। আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক, অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক বা ইয়েস ব্যাঙ্কের মত অতিপরিচিত বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিতেও অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ কিছু কম নয়। সম্প্রতি ইয়েস ব্যাঙ্কের লালবাতি জ্বলে গেছে। তাকে বাঁচাতে মাঠে নামতে হয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে।

শুধু ব্যাঙ্ক নয়, আর্থিক ক্ষতির এই করোনা ভাইরাসের ছোঁয়াচ নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও লেগেছে। অথচ, এই প্রতিষ্ঠানগুলি গত পাঁচ বছরে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ ফুলে ফেঁপে যথেষ্ট বিকশিত হয়েছিল। এই মুহূর্তে NBFC-গুলির সুখের দিন সম্ভবত শেষ আর তার পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে ব্যাঙ্কের ওপর। কারণ ব্যাঙ্কগুলি NBFC-র সাফল্যের ওপর বাজি ধরে প্রচুর টাকা ধার দিয়েছিল তাদের। এই মুহূর্তে তাদের প্রচুর টাকা এই সংস্থাগুলির হাতে আটকে রয়েছে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস (IL&FS)-এর গণেশ উল্টে যাওয়ার ফলে গোটা আর্থিক বাজার কেঁপে উঠেছে। এই কঠিন পরিস্থিতিতেই গত বৎসরের শেষে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে প্রায় ১৫০০টি NBFC-র লাইসেন্স বাতিল করার কথা ভাবতে সরকার বাধ্য হয়েছিল।

সংস্থাগুলির আর্থিক সমস্যা ব্যাঙ্কগুলির জন্য আরও বড় বিপদের অশনি সঙ্কেত বহন করছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ঋণপ্রদানকারীদের আইনি সুরক্ষা বলতে কিছুই ছিল না। রাজনৈতিক যোগসাজশ আছে এমন ব্যবসায়ীদের থেকে ঋণ আদায় ব্যাঙ্কের পক্ষে কার্যত অসম্ভব ছিল। এই সব রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীরা ঋণ শোধ না করলে ব্যঙ্কের একমাত্র করণীয় ছিল ঋণ মকুব। এভাবে ব্যবসায়ীরা নিশ্চিন্তে ঋণের বোঝা সাধারণ করদাতাদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজস্ব পুঁজি বাড়িয়ে নিত। লাভ হলে তার, ক্ষতি হলে সাধারণ মানুষের। এখনও তারা লাভের ব্যক্তিকরণ এবং ক্ষতির সামাজিকীকরণের অধিকার ধরে রাখতে চায়। কিন্তু তার জন্য বাকিদের মূল্য চোকাতে হয়।

এক কথায় বলা যেতে পারে যে ভারতের অর্থনীতি জিডিপি তলানিতে। অর্থনৈতিক সঙ্কট চরমে। দেশে চাকরির আকাল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। শিল্পজগতে চরম দুর্দশা। সব মিলেমিশে এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতি। বাজারে কেনাকাটা কমছে, গাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা প্রায় তলানিতে। তাই ক্রেতারা নতুন করে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে ভোগ্যপণ্য কিনতে অনিচ্ছুক। এর জেরে টান পড়েছে লগ্নিতে। কোনও সংস্থাই হাত খুলে উৎপাদন বাড়ানোর উপরে জোর দিচ্ছে না। ফলে সংগঠিত ক্ষেত্রে শিল্পের উৎপাদন মাত্রা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নিম্নগামী। অন্য দিকে, রাজকোষের ঘাটতি লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে হয়েছে ৭.২ লক্ষ কোটি টাকা যা বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার ১০২.৪ শতাংশ। হবে নাই বা কেন। ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিতে জিএসটি বাবদ কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া অসম্ভব। নোট বাতিলের মতো তুঘলকি সিদ্ধান্ত অর্থনীতির অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে সংগঠিত ক্ষেত্রে প্রবলভাবে কাঁপুনি দেওয়া শুরু করেছে। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে আজকের এই স্ট্যাগফ্লেশন।

 

বিশ্ব অর্থনীতি

বিশ্ব অর্থনীতি বহুদিন ধরেই মন্দার কবলে। বলা যেতে পারে যে ২০০৭-২০০৮ সালের মন্দার কবল থেকে বিশ্ব অর্থনীতি এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এবং এই মন্দার চরিত্র এর আগে ঘটে যাওয়া আর্থিক সঙ্কটগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা। উনিশ শতকের শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাঙ্কিং সঙ্কটের থেকে উদ্ভূত মন্দা বা ১৯২৯-৩৯এর মহামন্দা বা ১৯৭৩ সালের তেল সঙ্কট থেকে উদ্ভূত মন্দা এক ঝটকায় গোটা বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থাটিকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেও তার নিষ্পত্তি হতে বেশি দিন লাগেনি। যুদ্ধ বা অন্যান্য বিভিন্ন কারণে অর্থনীতির পুনর্গঠন শুরু হয়েছে। কিন্তু এবারের মন্দা থেকে বেরোনোর রাস্তা কোন দিকে তা লাখ টাকার প্রশ্ন।

অনেকদিন আগেই বিশ্বের অর্থনীতির রথের চাকা ব্রেক কষে কষে চলছে। বিশ্ব বাণিজ্য বেশ কিছুদিন ধরেই কমতে কমতে গত বছরে তার আগের বছরের তুলনায় তিন শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে। চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি এবং ব্রিটেনের উত্পাদন শিল্পে মন্দা আগে থেকেই চলছে। শুধু তথাকথিত শিল্পোন্নত দুনিয়াই নয়, মেক্সিকো, তুরস্ক এবং আর্জেন্টিনার মতো “উদীয়মান অর্থনীতি”ও গভীর খাদে পড়ে আছে। চরম আর্থিক প্রতিকূলতার কারণে গত বছর শত বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সার্বভৌম ঋণে খেলাপি হয় আর্জেন্টিনা।

২০১৯ সালে গাড়ি শিল্পে অতি-উত্পাদনের সঙ্কট শুরু হওয়ার ফলে চিন, ভারত, জার্মানি, গ্রেট ব্রিটেন এবং অন্যান্য দেশে গাড়ি বিক্রি ব্যাপক হারে হ্রাস পায়, বিশেষত ছোট গাড়ি। এর ফলে গাড়ি উত্পাদনও হ্রাস পায়। জার্মানির ম্যানুফ্যাকচারিং বা উত্পাদন শিল্পেও, বিশেষত যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য শিল্পসরঞ্জামের ক্ষেত্রে একই চিত্র দেখা গিয়েছিল। ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে জার্মানি বিশ্বের প্রথম তিনটি দেশের মধ্যে অন্যতম। চিনে শিল্প-উৎপাদনের বৃদ্ধি তীব্র হ্রাস পায় এবং তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে সেই সব দেশে যারা চিনে সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি, গাড়ি ও কাঁচামাল রফতানি করে। ২০১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে, জার্মানি, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, আর্জেন্তিনা ইত্যাদির পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি উত্পাদন শিল্পে মন্দা শুরু হয়ে যায়। আসন্ন পতনের বিষয়ে ক্ষমতাসীন শ্রেণির কেষ্ট-বিষ্টুরা যে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন এ বিষয়ে অবাক হওয়ার মতো কিছুই নেই।

 

করোনা ভাইরাসের প্রভাব

করোনা ভাইরাস ২০১৯ সালের শেষদিকে চিনে আবির্ভূত হয়েছিল কিন্তু চিন সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রাথমিকভাবে ধীর ছিল, যা সম্ভবত ভাইরাসের তীব্রতা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু অন্যান্য রাষ্ট্রগুলিও মহামারিতে জেরবার হওয়ার আগে নিতান্ত শুয়ে বসে ছিল। অবশেষে চিন দেশের বড় বড় অঞ্চলগুলিকে তালাবদ্ধ করে এবং অন্যান্য দেশগুলি চিনা লকডাউন অনুসরণ করে লক্ষ লক্ষ মানুষের চলাচলকে সীমাবদ্ধ করেছে। এর ফলে প্রাথমিক আঘাত পড়েছে পর্যটন, বিমান, আতিথেয়তা, রেস্তোঁরা, ইত্যাদি শিল্পের ওপর। এর পর এই আঘাত সংক্রামিত হয় খাদ্য, পোশাক, গৃহস্থালীর অন্যান্য জিনিসপত্র, ইত্যাদির চাহিদার ওপর। আরও অনেক শিল্পকেই এটি গ্রাস করেছে, যদিও সামগ্রিক প্রভাব যে কতটা হবে তা এখনও ঠাহর করা যাচ্ছে না। বাজারে কেনাকাটার ঘাটতি শিল্প বিনিয়োগেও ছায়া ফেলতে শুরু করেছে।

লকডাউন এবং শ্রমিকদের চলাচলের সীমাবদ্ধ সরবরাহ চেইনগুলিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। প্রথমদিকে চিনে, যা ‘বিশ্বের কারখানা’ হিসাবে পরিচিত, এবং তারপরে এশিয়া, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অংশে। চাহিদা হঠাৎ এমত ধাক্কা খাওয়ায় উত্পাদন কমে যাওয়া শুরু হয়। পড়তি উত্পাদন, সঙ্কুচিত চাহিদা এবং ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা কোম্পানিগুলির আয়ের ওপর থাবা বসায়। দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঢেউ দেখা যায় চারিদিকে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের চাকরি প্রশ্নের মুখে পড়ে, বিশেষত পরিষেবা খাতে যেখানে এই মার্চে লাখ লাখ লোক ছাঁটাই হয়। কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়ায় ক্রেতার সংখ্যা আরও কমতে থাকে যার প্রভাব পড়ে উত্পাদনে। আয় পড়ার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলি ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির ঋণদান ব্যহত হয় এবং মার্চের মাঝামাঝি বাজারে তারল্যের অর্থাৎ নগদ অর্থের সঙ্কট দেখা দেয়। এর প্রভাবে উত্পাদনে চিন থেকে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ধ্বংসযজ্ঞের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির উত্পাদন তার আগের বছরের একই সময়ের নিরিখে ১৩.৫ শতাংশ কমেছে (ম্যানুফ্যাকচারিং ১৫.৭ শতাংশ হ্রাস )। তদুপরি, বিনিয়োগ, রফতানি এবং আমদানি যথাক্রমে ২৪.৫, ১৫.৯ এবং ২.৪ শতাংশ কমেছে। শুধু চিনের সঙ্কোচনের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও লকডাউনে কার্যকর হওয়ার ফলে বিপুল পরিমাণে ক্ষতি হবে, বিশেষত বিমান সংস্থা এবং পর্যটন। ইত্যাদির ক্ষেত্রে।

শ্রমজীবী মানুষের ওপর এক ভয়ঙ্কর আঘাত নেমে আসতে চলেছে। বিশেষ করে ঠিকা শ্রমিক, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষ বা যাঁদের স্থায়ী চাকরি নেই এবং ফুরনে কাজ করেন তাঁদের ওপর। যাঁদের কোনও সঞ্চয় অবশিষ্ট নেই বা সঞ্চয় করার মতো আয় নেই এবং সামাজিক সুরক্ষা ও জন-পরিষেবা থেকে বঞ্চিত তাঁদের অবস্থা অধিকতর ভয়ানক হবে। সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মহিলারা কারণ এই ধরনের কাজে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি মাত্রায় নিযুক্ত হন এবং একইসংগে তাদের ঘরের ও সন্তানদের সমস্ত সমস্যা সামলাতে হয়।

 

এদেশের কথা

এর আগেই ভারতের কথা আলোচনার সময় আমাদের দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার কথা তুলে ধরেছি। মড়ার ওপর কতটা খাঁড়ার ঘা পড়বে? এককথায়, করোনা ভাইরাস জনিত লকডাউনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা। শিল্প প্রতিষ্ঠানের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক থেকে নির্মাণ কর্মী, ঠিকাদার সংস্থার অধীনে কর্মরত শ্রমিক থেকে রেস্তোরাঁর কর্মচারী, এঁদের প্রায় সকলেই অসংগঠিত৷ এই দেশের শ্রম শক্তির ৯৩ শতাংশ অসংগঠিত শ্রমিক।

বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখা যাক। সারা বিশ্বে ইতিমধ্যে প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। সঙ্কটে থাকা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়বে। যেহেতু পুঁজিবাদ একটি বিশ্ব-ব্যবস্থা তাই আমাদের কোনও রেহাই নেই। কর্মসংস্থানহীনতা, সুদের বৃদ্ধি, আর্থিক ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষের তৃতীয় কোয়ার্টারে জিডিপি বৃদ্ধির হার সামান্য ওপরে উঠেছিল (৪.৫-৪.৭ শতাংশ)। সরকারি পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী আর্থিক বর্ষের প্রথম দুই কোয়ার্টারে এই হার নিম্নগামী হয়ে ৪-৪.৫ শতাংশে সীমিত থাকবে। করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাসায়নিক, বস্ত্র, অটোমোবাইল ও ঔষধ শিল্প। কারণ এই শিল্পগুলি কাঁচামালের জন্য চিনের উপর নির্ভরশীল। ইলেকট্রনিক শিল্পের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ চিন থেকে আমদানি করা হয়। ১/৩ যন্ত্রাংশ ও ২/৫ জৈব রাসায়নিকের জন্য ভারত চিনের ওপর নির্ভরশীল। ভারতের রপ্তানি বাণিজ্যে চিনের স্থান তৃতীয়। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে বিমান চলাচল বন্ধ করার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ আসন সংরক্ষণে ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। মার্চের প্রথমে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রের বৃহত্তম এয়ারলাইন্স গো এয়ার-এর বক্তব্য, করোনা ভাইরাসের কারণে আসন সংরক্ষণ কমে গেছে। ফলে, তৃতীয় কোয়ার্টারে আয় যথেষ্ট কমবে। ২০২০-২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্পোরেট কর আদায়ের ধার্যমাত্রা ১১.৫ শতাংশ ধাক্কা খাবে।

ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অরগ্যানাইজেশনের সভাপতি শরদ কুমার স্রফের মতে, শ্রমনিবিড় শিল্প যেমন রত্ন ও গহনা, হস্ত ও কারুশিল্পের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে কর্ম সঙ্কোচন শুরু হয়ে গেছে। মাত্র ৪ ঘন্টার নোটিসে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা লক্ষ লক্ষ অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষদের বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে সরকার। ভারতের এক বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত মজদুর পরিযায়ী শ্রমিক। তাদের কর্মস্থলে না আছে রেশন কার্ড, না আছে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা। ফলে, আমরা দেখেছি, সারা দেশ জুড়ে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের হাইওয়ে ধরে হেঁটে চলা। ইতিমধ্যে রাস্তায় চলতে চলতে মারা গেছেন ২৬ জন। আক্রান্ত হয়েছেন পুলিশের দ্বারা। আর দিল্লির ঘটনা তো আমরা সবাই দেখেছি।

এই লকডাউনে সবচাইতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন রিক্সা-ভ্যান চালক, নির্মাণ মজদুর, গৃহ পরিচারিকা আর ‘ভদ্র, মধ্যবিত্ত’ সমাজের কাছে অচ্ছ্যুৎ যৌনকর্মী আর বস্তিবাসী মানুষজন। এঁরা মজুরি না পেলে সংসার চালাতে পারবেন না৷ এই শ্রমিক-কর্মচারীদের রোজগার কমে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে৷ বাজারে চাহিদা আরও কমে যাবে৷ একদিকে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হলে এরা কাজ ফিরে পাবেন না। সেই ‘সুদিন’ কবে আসবে বলা মুশকিল। অন্যদিকে এই অজুহাতে ইতিমধ্যেই বহু জায়গা থেকে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কথা ভেসে আসছে যা আগামীদিনে আরও ঘনীভূত হবে। আর্থিক সঙ্কটের খবর মালিকশ্রেণি ভালই রাখেন এবং তারা মুখিয়ে আছেন এই সুযোগের ফয়দা তোলার।

মোটের ওপর বলা যায় যে এমনিতেই আর্থিক অবস্থা ভালো নয়৷ বন্ধের ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, যদিও এছাড়া করোনা রোখার উপায় নেই৷ তবে এই স্তব্ধতার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে দেশে৷ কত দিন, কত মাস তার প্রভাব থাকবে, সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়৷

 

অতঃকিম

এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার এখনও কোনও সদর্থক ভূমিকা দেখাতে পারেনি। রাজ্য সরকারগুলি সীমিত ক্ষমতা, ঋণের বোঝা, ইত্যাদি মরাকান্না কেঁদে চলেছে, যদিও রাজনৈতিক আনুগত্য কেনার খেলায় মাৎস্যন্যায় আগের মতোই চালু আছে। আর কেন্দ্রীয় সরকার কিছু করতে পারে না তা নয় তবে গত গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে তারা প্রমাণ করেছেন যে তাদের সাধ ও সাধ্য দুটিই আছে, তবে তা এক বিশেষ শ্রেণির জন্য— মালিক শ্রেণির জন্য। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কয়েকদিন আগে কিছু পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করছে তবে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনায় পরে আসছি।

২১ দিন লকডাউনের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ১.৭০ লক্ষ টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এ নিয়ে অনেকেই গদগদ। কিন্তু ভাল করে খতিয়ে দেখলে পরিষ্কার যে এর মধ্যে প্রচুর জল মেশানো আছে। বহু চালু প্রকল্পগুলিকে এই ঘোষণার মধ্যে ঢুকিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে এই আর্থিক প্যাকেজটিকে। যেমন গ্রামীণ ১০০ দিনের কাজের শ্রমিকদের (MGNREGA) ন্যূনতম মজুরি ২০ টাকা বৃদ্ধির ঘোষণা একটি বড় ধাপ্পা। ২৩ মার্চ, ২০২০ কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক ঘোষণা করেছে যে, ১ এপ্রিল থেকে ১০০ দিনের কাজের (MGNREGA) মজুরি বাড়ানো হয়েছে। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে মজুরি প্রতিবছর এপ্রিল থেকে বাড়ানো হয় আইন মেনে । সেটা প্যাকেজে ধরে নেওয়া হয়েছে। প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত আরও কিছু। যেমন স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির জন্য ২০ লক্ষ টাকার ঋণ। এই গোষ্ঠীগুলি আগেই ১০ লক্ষ টাকা ঋণ পেত। এখন সর্বোচ্চ ২০ লক্ষ টাকা ঋণ পাবে। প্রথমত ঋণ অনুদান নয়, তা সুদ সহ ফেরত দিতে হবে। এছাড়া এই সঙ্কটের বাজারে ঋণ নিয়ে তাঁরা কোথায় বিনিয়োগ করবেন। অভাব অনটনের ফলে অনেকেই এই ঋণের টাকা ভেঙে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ঋণের ফাঁদে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?

এছাড়াও সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, কৃষক ভাতা, ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা বলা আছে। এমন অনেক সুবিধা এই প্যাকেজে দেখানো আছে যা তাঁরা আগেই পেতেন। নতুন করে প্রাপ্তির ভাঁড়ার যৎসামান্য।

এবার আসা যাক রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রেপো রেট, রিভার্স রেপো রেট কমিয়েছে। রেপো রেট ০.৭৫ শতাংশ, রিভার্স রেপো রেট ০.৯০ শতাংশ এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে রাখা ব্যাঙ্কগুলোর নগদ জমার অনুপাত পুরো ১ পারসেন্টেজ পয়েন্ট কমানোর কথা ঘোষিত হয়েছে। স্বল্প সময়ের জন্য ব্যাঙ্কের অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে রেপো বলা হয়। তারা নিজস্ব সিকিউরিটিগুলি অল্প সময়ের জন্য বিক্রি করে এবং সেগুলি দ্রুত কিনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।  রিভার্স রেপো রেট এর ঠিক উলটো। একই সঙ্গে ব্যাঙ্ক (গ্রামীণ ও সমবায় ব্যাঙ্ক সহ) এবং ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফসি) থেকে নেওয়া মেয়াদি ঋণের কিস্তি পরিশোধ তিন মাস পিছিয়ে দেওয়ার ঘোষণা হয়েছে।

সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশের গত ফেব্রুয়ারি থেকে শেয়ার বাজারে যে ধ্বস নেমেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণা সেই প্রক্রিয়াটিকে আটকাতে। এমনি অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ হু হু করে বেড়ে যাওয়ার ফলে ব্যাঙ্কগুলি ধুঁকছে। তাদের ঋণদানের ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে যাকে পরিভাষায় বলা হয় তারল্যের সঙ্কট বা লিকুইডিটি ক্রাইসিস। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে বিভিন্ন পুঁজিপতিরা কীভাবে একের পর এক ব্যাঙ্কের টাকা মেরে এদেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার লালবাতি জ্বালাতে উদ্যোগী হয়েছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই পদক্ষেপ আসলে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে এই সমস্ত পুঁজিপতিদের হাতে অর্থের সঞ্চার ঘটানো। সেই টাকা যাতে শেয়ার বাজারে আসে এবং বাজার চাঙ্গা হয়। অর্থাৎ পুঁজিপতিরা যাতে শেয়ার কেনাবেচা করতে পারেন। হ্যাঁ, এমনকি নিজেদের শেয়ারগুলিও। শেয়ার বাজার, ফাটকা পুঁজি ও কল্প-কাগজ কিভাবে আজকের অর্থনীতিতে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল তা নিয়ে বর্তমান পরিসারে খুব একটা আলোচনা করার সুযোগ নেই। কিন্তু একথা বাস্তব এই আর্থিক ক্রিয়াকাণ্ডের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে আমাদের অর্থনীতিতে। সেই কারণে লক্ষ লক্ষ বেকার বা গরীব অর্ধভুক্ত বা অভুক্ত থাকলেও সরকারের টনক নড়ে না। ৩ লক্ষের উপর কৃষক আত্মহত্যা করলেও সরকার সে বিষয়ে নামমাত্র কিছু কথা বলা ছাড়া পুরো সদর্থক পদক্ষেপ গত ২৫ বছর ধরে দেখাতে পারে না। কিন্তু শেয়ার বাজার সামান্য নামলেই নৈব নৈব চ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলি সেই কথা আরেকবার স্পষ্ট করে দিয়ে গেল।