Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভারত ও বিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে করোনা যা জানাল

রেজাউল করীম

 




লেখক চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক।

 

 

করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী মহামারি উত্তর-আধুনিক মানুষের সামনে এক অভূতপূর্ব বিপদের সূচনা করেছে। সহস্রাব্দের শুরু থেকে করোনা ভাইরাস নানারূপে বার বার নতুন নতুন আতঙ্কের সূচনা করেছে। উহানে প্রথম আক্রমণ শুরু হয়েছিল করোনা ১ দিয়ে। এর ফলে প্রায় হাজার দশেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। প্রতি শত সংক্রমিত ব্যক্তির ১১ জনকেই এই অসুখ থেকে বাঁচানো যায়নি। ২০০৩ সালের পর আর এর তেমন নতুন আক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। সহস্রাব্দের প্রথম দশকে করোনা যখন নতুন রূপে আবার আবির্ভূত হল, বিজ্ঞানীরা তার নাম দেন মধ্যপ্রাচ্য শ্বাস-পীড়া (MERS)। এর আক্রমণ ছিল আরও ভয়াবহ, আক্রান্ত ব্যক্তির প্রায় শতকরা ৩৬ জনের জন্য যা ছিল অত্যন্ত প্রাণঘাতী। সৌভাগ্যক্রমে সে হাজার আড়াই মানুষ মেরে তার বাণ সম্বরণ করেছে। মাঝে মাঝে এরা যে আসে না তা নয়, কিন্তু মহামারি হিসেবে তাদের দেখা পাওয়া যায় না। আরেকটি একই রকম সাংঘাতিক সংক্রমণ নিয়ে বিশ্বশুদ্ধু সবাই খুব চিন্তিত ছিলেন। তার নাম হল সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস। মহামারি সংঘটিত করে সে কিন্তু বিদায় নেয়নি। প্রতি বছর অন্তত হাজার খানেক মেরে সে ক্ষান্ত হয়, এই যা। এই করোনার বাজারেও সে আছে, গ্রামে গঞ্জে, গরিবের কুটিরে, বস্তিতে।

এই যে বিশ্বব্যাপী চরম আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা তা আক্ষরিক অর্থে সারা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। শেয়ার মার্কেট বড় পতনের সম্মুখীন হয়েছে, দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধির হার তলানিতে ঠেকেছে, তেলের দাম কমতে কমতে প্রায় দু দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচুতে অবস্থান করছে। এমনকি, পৃথিবী ব্যাপী নিরন্তর যে প্রাণঘাতী যুদ্ধ চলছিল, তারও সাময়িক বিরতি হয়েছে। সৌদি আরব ও ইয়েমেন এতদিনে শান্তি চুক্তি সই করেছে। যুদ্ধ বিপণন যাদের পেশা তারাও একটু থমকে আছে।

করোনা ভাইরাসের ব্যাপ্তি ও মারণ ক্ষমতার সঙ্গে যদি করোনার অন্য জ্ঞাতিগুষ্টির মারণ ক্ষমতার তুলনা করা যায় তাহলে বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। সার্স ও মার্সের মারণ ক্ষমতা কোভিড-১৯-এর চেয়ে বহুগুণ বেশি। আফ্রিকার গরীব দেশ থেকে যে অসুখ সিয়েরা লিওন, গিনি, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া, মালি, সেনেগাল হয়ে খোদ ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র লন্ডন, এমনকি আমেরিকা পৌঁছে গেছিল সেই এবোলার মারণ ক্ষমতাও করোনার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এবোলা থেকে যত রোগী ভর্তি হয়েছে তার শতকরা ৫৬ জন মারা গেছেন। এবোলা নিয়ে সব তথ্য পাওয়া না গেলেও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলি যে এই সংক্রমণে অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও আমেরিকা ও ইউরোপের গায়ে আঁচ তেমন লাগেনি। এবোলার গড় মৃত্যুহার প্রায় ৩৬-৩৭% হলেও বিশ্বজোড়া গেল গেল রব তেমন শোনা যায়নি।

করোনা নিয়ে যে আতঙ্ক ও ত্রাস তার দুটি দিক আছে। প্রথমত এই ভাইরাস ধনী ও নির্ধনকে সমানভাবে আক্রমণ করছে। ইরানের প্রথম সারির এক ডজন ধর্মীয় ও প্রশাসনের কর্তা ইতিমধ্যে মৃত। ব্রিটেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী প্রথম দিকেই আক্রান্ত হন, তারপর একে একে এর শিকারের তালিকা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যুবরাজ চার্লস, প্রধানমন্ত্রী জনসন আক্রান্ত হন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তড়িঘড়ি ভাইরাস পরীক্ষা করে নিজেকে ভাইরাস-মুক্ত বলে ঘোষণা করেন। করোনার সম্ভাব্য আক্রমণের ছোবল থেকে যে কেউ মুক্ত নন, তাই সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছে। নইলে লাইবেরিয়া বা নাইজেরিয়ার দরিদ্র নিপীড়িত মানুষ যখন আক্রমণে কাবু ছিল আন্তর্জাতিক কলমচিরা তখন যোগনিদ্রায় ব্যস্ত ছিলেন।

করোনার আরেকটি দিক হল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর সংক্রমণের ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি হলেও (Base Reproductive number 2-3) এর মারণ ক্ষমতা (CFR) কম। করোনা সাধারণত একটু বয়স্কদের সহজেই কাবু করে ফেলে। বিশেষত যারা অন্য কোনও অসুখ যথা ডায়াবেটিস, শ্বাসজনিত পীড়া বা অন্য কোনও মারাত্মক অসুখ যা প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এমন অসুখে ভুগছেন। শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর হার নেই বললেই চলে। প্রথম তিনটি দশকের অল্পবয়সি ও যুবাদের মধ্যে এর মারণক্ষমতা যেখানে মাত্র ০.২% সেখানে ৬০ বছর বা তার বেশিদের ক্ষেত্রে এই হার প্রায় ৩৫ গুণ বেশি। সারা পৃথিবীজোড়া ক্ষমতার চূড়ায় থাকা বৃদ্ধ নেতাদের জন্য এরচেয়ে ভয়াবহ আর কীই বা হতে পারে।

করোনার সাম্যবাদী আক্রমণ যেমন একদিকে সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে তেমনি বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের কঙ্কালসার চেহারাটাও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে চলে এসেছে। বিশ্বে এক অক্ষের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে সম্পদের অসম বণ্টনের ব্যবস্থা করেছে তার সবচেয়ে ভয়াবহ ফল দেখা গেছে জনস্বাস্থ্যে সরকারি বিনিয়োগে। ইন্স্যুরেন্সভিত্তিক চিকিৎসা পরিকাঠামোর ফলে জনসংখ্যার একটা বড় অংশের কাছেই স্বাস্থ্যব্যবস্থার সুফল ধরাছোঁয়ার বাইরে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে উন্নত বিশ্বের পরিকাঠামো, পরিকল্পনা ও খরচের একটি প্রতিবেদন ১৯৮৮ সালে বের হয়। Future of public health নামক এই সুবিখ্যাত ও বহুপঠিত রচনাটি তৈরি হয় Naional academy of sciences ও Institute of Medicine-এর উদ্যোগে। তাঁরা তখন মত প্রকাশ করেছিলেন যে উন্নত বিশ্বের জনস্বাস্থ্য হল “ভঙ্গুর”। ২০০২ সালে তাঁরা আবার নতুন করে মনে করিয়ে দেন যে অবস্থার কোনও পরিবর্তন তো হয়নি বরং তা আরও বিশৃঙ্খল হয়েছে ও জনস্বাস্থ্যের জন্য চিকিৎসক, নার্স ও এপিডেমিওলজিষ্টদের যে দল প্রস্তুত করা উচিত ছিল তা হয়নি। একবিংশ শতাব্দীর নতুন নতুন সমস্যা মোকাবিলা করার মত ক্ষমতা তার নেই। সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে তাঁরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেন যে আমেরিকার প্রতি ১০০ জন জনস্বাস্থ্য কর্মীর ৪৫ জন আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে অবসর নেবেন ও তাঁদের বদলে অন্য কর্মী নিয়োগের কোনও পরিকল্পনা নেই। শুধু তাই নয় Government accountability office বলে যে, “no state is fully prepared to respond to a major public health threat”। ফেডারেল সরকারের খরচ বিশ্লেষণ করে জনস্বাস্থ্য বাজেটে বিপুল ঘাটতির যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়, দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালে তার প্রতিফলন হয়েছে। এর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বয়স্ক, কম আয়ের মানুষ ও ইন্স্যুরেন্স করার ক্ষমতা নেই এমন মানুষ। ফেডারেল বাজেট ১৩-১৭% কমে যাওয়া ও আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার অপারেশনে প্রচুর খরচ হওয়ার কথাও এই রিপোর্টে উঠে আসে। এই দুটি জায়গায় সরকার যে খরচ করে তার পরিমাণ ৩২৮ বিলিয়ন ডলার যা আমেরিকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করেছে। আমেরিকা চিকিৎসার উন্নত পরিকাঠামো তৈরি করে অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলার ব্যাপারে সফলতা অর্জন করলেও জনস্বাস্থ্যে সরকারী বিনিয়োগ কম করার ফলে দরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষ, অনিয়মিত কর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস তার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, কোভিড-১৯-এ যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অনেকেই খরচের ভয়ে প্রথম দিকে হাসপাতালমুখী হননি।

বিশ্বব্যাঙ্ক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইন্টার আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক ইত্যাদি সংস্থা ল্যাটিন আমেরিকার ১৩টি দেশে একটি উল্লেখযোগ্য সমীক্ষা চালায়। তাঁরা তাদের সুদীর্ঘ রিপোর্ট পর্যালোচনা করে মন্তব্য করেছে—

  1. সরকারি জনস্বাস্থ্য ব্যয় ও বেসরকারি জনস্বাস্থ্য ব্যয় পরস্পরের পরিপূরক নয়।
  2. বেসরকারি ব্যয় স্বাস্থ্যসূচক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
  3. বেশি আয়ের মানুষের খরচ করার প্রবণতা ও তার বিনিময়ে লব্ধ ফল কম আয়ের মানুষের লব্ধ ফল থেকে আলাদা।
  4. বেসরকারি বিনিয়োগ কখনওই চিহ্নিত সূচক (যথা IMR, MMR) অনুযায়ী করা হয় না।
  5. বেসরকারি পুঁজি স্বাস্থ্যকে “বিনোদন পণ্য” বলে মনে করে।
  6. আয় বাড়লেও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়ে না, স্বাস্থ্য বিনোদনে খরচা অবশ্য বৃদ্ধি পায়।

এই রিপোর্টে একটি খুব চিত্তাকর্ষক বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চিত্তাকর্ষক এইজন্য যে বড়লোক দেশ ও গরীব দেশ, ধনী ও নির্ধনের চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়ার মানসিকতা সেখানে ফুটে উঠেছে। স্বাস্থ্য কি কেবলমাত্র একটি ভাবনা নাকি তা মাপার কোনও সূচক থাকা দরকার যার দ্বারা বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করা হবে? চুল ট্রান্সপ্লান্ট আর পুষ্টি কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এই সংক্রান্ত বিখ্যাত Murry (১৯৯৩) রিপোর্ট পড়লে বোঝা যায় যে ধনীরা যে অসুখে ভোগেন ও যা স্বাস্থ্য বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করেন তা মূলত স্বাস্থ্য বিনোদন। গরিবের জন্য সরকার ইন্স্যুরেন্সের পথ খোলা রেখেছে। যদি পয়সা খরচ করে কিনতে পারেন তাহলে হাসপাতালের দরজা খুলবে নাহলে বিনা খরচে চিত্রগুপ্তের খাতায় নাম লেখাতে হবে। ঠিক সেই ঘটনাটাই ঘটছে। আমেরিকায় জীবনশৈলী ঘটিত অসুখের প্রাদুর্ভাব, দুর্বল জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা, অত্যধিক চিকিৎসা খরচ এই সবকিছুর মিলিত প্রভাবে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভবিষ্যতে আমেরিকা যদি করোনার নতুন আঁতুড় ঘর হয়ে ওঠে তাহলে তা খুব বিস্ময়কর হবে না। মনে রাখতে হবে যে আমেরিকা কিন্তু সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যখাতে বিপুল বিনিয়োগ করে যদিও তার পেছনের দর্শনটি হল অতীব অন্তঃসারশূন্য, পলকা ও ভঙ্গুর।

করোনায় আমাদের দেশে মৃত্যুহার এখন পর্যন্ত বেশি নয়, আক্রান্তের সংখ্যা ও এখনও মাত্রাছাড়া হয়নি। যদিও আগামী সপ্তাহে এটি একটি সর্বকালীন রেকর্ড করবে ও ভয়াবহতায় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলার আশঙ্কা আছে। এ দেশের মূল সমস্যা হল, জনস্বাস্থ্য নিয়ে দেশনেতা ও সাধারণ মানুষ সমানভাবে অজ্ঞ। নানারকম ধর্মীয় কুসংস্কার ও বিচিত্র নারকীয় চিকিৎসা পদ্ধতি অবস্থা আরও জটিল করে তুলেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে স্বাস্থ্য বিনিয়োগ। এদেশে ভোট না এলে দেশের কর্তাদের জাতীয় কর্তব্য নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না। জনসংখ্যা যেমন একটা বড় সমস্যা তেমনি বড় সমস্যা হল সুস্পষ্ট স্বাস্থ্য নীতির অভাব। সংক্ষেপে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ে আলোচনা করা যায়।

১) স্বাস্থ্য বিনিয়োগ:

সারা বিশ্বে জিডিপির নিরিখে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যয় সবচেয়ে কম (শতকরা একভাগের কাছাকাছি)। মোট খরচের ৮৫.৬% ভোক্তার নিজস্ব ব্যয় (out of pocket expense)।

দেশে যেসব রোগে মানুষ মারা যান আর যেসব রোগ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির আওতার বাইরে তার মধ্যে সুন্দর সাদৃশ্য আছে। ইন্স্যুরেন্স কভারেজ পেতে হলে রোগী যখন ইন্স্যুরেন্স করছেন তখন কোনও দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগলে চলবে না। তার জন্য প্রিমিয়াম বেড়ে যাবে বা সুবিধা আদৌ পাবেন না। প্রধানমন্ত্রী যে যোজনা ঘোষণা করেছেন সেখানে মোট পাঁচ লক্ষ টাকার সুবিধা পাওয়া যাবে। দেশে পরিবারের গড় সাইজ ৪.৮ অর্থাৎ মাথা পিছু ১ লক্ষ টাকা। যেহেতু, সরকারি ব্যবস্থায় শয্যার আকাল (প্রতি ১০,০০০ মানুষ পিছু ৭টি শয্যা আছে), তাই ঐ সামান্য টাকা দিয়ে যে চিকিৎসা সম্ভব হবে না তা সহজেই অনুমেয়।

এই দেশে বয়স্কদের যে কয়েকটি রোগে মৃত্যু হয় তার একটা তালিকা দেওয়া যেতে পারে।

IHD – 15.4 lakhs
COPD – 9.6 lakhs
Cancer – 7.8 lakhs
Stroke – 7.3 lakhs
Diarrhoea – 7.2 lakhs
Respiratory infection – 5.1 lakhs
TB – 4.3 lakhs
Asthma – 2.5 lakhs
Diabetes – 2.5 lakhs

প্রতি বছর ২৬০০০ লোক হৃদরোগে, ১৬০০০ স্ট্রোকে, ১০০০ সোয়াইন ফ্লুতে, ১২১৫৪ তড়িদাহত হয়ে, ১২৭৪৮ জন অ্যাক্সিডেন্টে, ২০২০১ জন ছাদ থেকে পড়ে, ২১৬৪৬ জন বিষ খেয়ে, ৩০১৮৭ জন জলে ডুবে মারা যান। প্রতিদিন প্রায় ১২০০ জন টিবিতে ও সমসংখ্যক মারা যান স্রেফ না খেতে পেয়ে। জনসংখ্যার ৫৯ ভাগ রক্তাল্পতায় ভোগে ৩১% বাচ্চা দুবেলা খেতে পায় না, আর মোট শিশু মৃত্যুর ৩২ ভাগ শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় মারা যায়।

এই তালিকাটা সরকারের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। এই তালিকা দেখলে সহজে অনুমান করা যায় যে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী না করতে পারলে দেশের এই মৃত্যুমিছিল বন্ধ হবে না। মারণ রোগের বেশিরভাগ গরীব মানুষের, কিছু কিছু পুষ্টির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। অনেকগুলি জীবনশৈলী ঘটিত সমস্যার সঙ্গেও। এমন নয় যে কোনও একটি ব্যবস্থা রাতারাতি তৈরি হয়ে যাবে। স্বাস্থ্যনীতি পরিচালনার দর্শনটি আগে স্থির করতে হবে। গগনচুম্বী অট্টালিকা নাকি গ্রামের মহল্লা ক্লিনিক কোনটা দরকার? প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নাকি যন্ত্রনির্ভর চিকিৎসা, অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নাকি আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা, wellness centre না PHC? দেশে টীকাকরণের সার্বিক হার কম। প্রতি বছর অন্তত ১৫% শিশুর টীকাকরণ হয় না। অনেকে একটা ডোজ নিয়ে বাকিগুলো নেন না। যে দেশে ১৩৭ কোটি মানুষের নাগরিকত্ব পরীক্ষা করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয় সে দেশে হাজার হাজার পরিকল্পিত টীকাকরণ কর্মসূচি শুধু ছুঁচ বা সিরিঞ্জ কিম্বা স্বাস্থ্যকর্মীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা না করার জন্য বাতিল হয়।

স্বাভাবিকভাবেই এইরকম অপ্রস্তুত অবস্থা আমাদের বারোমাস তিনশ পঁয়ষট্টি দিন। করোনার মত মারণব্যাধি আটকানোর মতো যেমন আমাদের পরিকাঠামো নেই, তেমনই সঠিক স্বাস্থ্যাভ্যাসও গড়ে ওঠেনি। যে দেশে নেতারা দূর থেকে ভাষণ দিয়ে ভাষণের বিষয়বস্তুও ভুলে যান সে দেশে সবকিছুই সম্ভব।

সঠিক জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা তখন সম্ভব, যখন আধুনিক শিক্ষার বিস্তার হয়। গত জনগণনায় দেখা গেছে যে পরিবারে মা অন্তত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ নিয়েছেন তাদের সন্তানসংখ্যা সীমিত ও তাদের শিশুমৃত্যুর হার কম। কেরল এক্ষেত্রে উজ্জ্বল উদাহরণ। উত্তর প্রদেশ ও ওড়িশার মধ্যে তুলনা করলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয়। ওড়িশায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি শূন্যের কাছে। পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুর অবস্থা একরকম। অথচ বিহার ও উত্তর প্রদেশ জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রথম সারিতে। এই রিপোর্ট থেকে এটাও পরিষ্কার ছোট পরিবারের সঙ্গে শিক্ষা ও আয়ের সাযুজ্য আছে, ধর্ম বা জাতের নয়।

সুতরাং জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির সঠিক রূপায়ণে সবচেয়ে বেশি কার্যকর হল রাজনৈতিক সদিচ্ছা। শিক্ষা সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক, WHO এই কথাটি উচ্চারণের পর পাঁচটি দশক অতিবাহিত হয়েছে। এ দেশের জনস্বাস্থ্যের হাল প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় খারাপ। শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক মজবুত।

করোনা লকডাউনে কেউ সরকারি নিষেধের তোয়াক্কা করছে না। শাসকদলের নেতা বড় জমায়েত করবেন না বলে নিজেই মিছিল নিয়ে বেরোচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী সপারিষদ পুজো করতে বেরিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতা সদলবলে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারের উপর চড়াও হচ্ছেন। ল্যাটিন আমেরিকার থেকে ভারতের অনেক কিছু শেখার আছে। কিউবা, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলার সংক্রমণ সংখ্যা ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে ও তাদের “response swift, serious and enduring” বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম প্রশংসা করেছে। সিঙ্গাপুর আরেকটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ। সেখানে সংক্রমণ বাড়লেও মৃত্যু বাড়ে না। কেরলও প্রমাণ করেছে যে মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। অবরুদ্ধ মানুষের জন্য যথাযথ অর্থনৈতিক প্যাকেজ দিয়ে আপৎকালীন ব্যবস্থাও সম্ভব।

জনস্বাস্থ্য অবহেলিত থাকলে দেশ সুস্থ থাকবে না। দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য অভিন্ন, সুষম, আধুনিক ও এক মানের চিকিৎসা ব্যবস্থা যতদিন না দেওয়া হবে ততদিন এক একটা মারণ ব্যাধি আসবে  ও দেশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। দেশের মানুষের সুস্থিতি ও নিরাপত্তার জন্য চাই সব সাম্প্রদায়িক নিয়মের বদলে অভিন্ন আইন, সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবাজেটের বৃদ্ধি ও শ্রীনাথ রেড্ডি রিপোর্টের যথাযথ প্রয়োগ। যে দেশে গণতন্ত্র যত প্রসারিত সে দেশের মানুষ তত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় জনস্বাস্থ্য তত সুন্দরভাবে অনুসরণ করে। আইসল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে ইত্যাদি দেশের জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার দর্শন থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। দেশের জন্য শুধু ছাপান্ন ইঞ্চির খাঁচা নয়, ছাপান্ন ইঞ্চির হৃদয় চাই।