দেশে প্রথম করোনা-আক্রান্তের সন্ধান পাওয়ার আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম আমরা : পিনারাই বিজয়ন

জয়ন্ত বসু

 

কথায় আছে ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সামলাতে কেরল সরকারের ভূমিকা দেখলে এই প্রবচনটি মনে আসাই স্বাভাবিক। ৩০ জানুয়ারি সে রাজ্যে যখন দেশের প্রথম করোনা-রুগির সন্ধান মেলে, তখন কেরল বাদ দিয়ে বাকি ভারতের কাছে করোনা-সংক্রমণ সুদূর চিনে হওয়া একটি ছোটখাটো মহামারির বেশি কিছু ছিল না।  কিন্তু ২০১৮ সালে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণে ১৮ জন মারা যাওয়ার পরে – করোনার মতো যেটিরও সংক্রমণের কেন্দ্রে ছিল বাদুড় বলে বিজ্ঞানীরা কেউ-কেউ দাবি করছেন – কেরল বিন্দুমাত্র দেরি না-করে নয়া ভাইরাস প্রতিরোধে যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। আর তাই, আজ, করোনা-প্রতিরোধে কেরল মডেল দেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চেও স্বীকৃতি ও প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে। এই মুহূর্তে (২ মে-র পরিসংখ্যান) গোটা দেশে মোট প্রায় ৩৮,০০০ আক্রান্তের মধ্যে কেরলে আছেন ৫০০-র মতো; আর ১,২২৩ জন মৃতের মধ্যে মাত্র চার জন। কেমন করে এমনটা সম্ভব হল? একান্ত আলাপচারিতায় উত্তর দিয়েছেন স্বয়ং সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন

 

প্রশ্ন: মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, কোভিড-১৯ সামলাতে আপনার নেতৃত্বে যেভাবে কেরল কাজ করেছে তার জন্য অভিনন্দনআপনার নেতৃত্বে কেরল সরকার কীভাবে গোড়া থেকে পরিকল্পনা শুরু করে, বিশেষ করে যখন আপনার রাজ্যেই দেশের প্রথম করোনাআক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল?

পি বিজয়ন: ধন্যবাদ। আসলে আমরা প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি দেশে একটি করোনা-রুগির সন্ধান পাওয়ারও আগে থেকে, বস্তুত জানুয়ারির দ্বিতীয় ভাগ থেকে। ফলে, যখন প্রথম কেস পাওয়া যায়, ততদিনে আমাদের রাজ্যস্তরে কন্ট্রোল রুম তৈরি,  তৈরি প্রতিটি জেলায় কন্ট্রোল রুম, এমনকী স্বাস্থ্য দপ্তরের আধিকারিকদের ও পুরসভাগুলিকে কী কী কাজ করতে হবে তার নির্দেশ দেওয়াও হয়ে গিয়েছে। সেইসময়ই আমাদের কোয়ারান্টিন কীভাবে হবে, বা আক্রান্তদের সঙ্গে সম্পর্কিত কন্টাক্ট লিস্ট বা যোগাযগের তালিকা কীভাবে তৈরি হবে, এমনকী চিকিৎসা-পদ্ধতিই বা কী অনুসরণ করা হবে; সবকিছুর স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) নির্দিষ্ট করা হয়ে গিয়েছিল।

প্রশ্ন: কিন্তু প্রথম দফায় কয়েকটি কেসের পর থামলেও তারপর আবার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে…

উত্তর: যখন মার্চ মাসে দ্বিতীয় দফার কেসগুলি আসতে শুরু করে, তখন আমরা ‘ব্রেক দ্য চেন’ পদ্ধতির প্রচার শুরু করি। সরকারি দফতরগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়, যতটা সম্ভব বেশি পরিমাণে প্রয়োজনীয় ওষুধগুলি তৈরি করতে ও মজুত রাখতে, আর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির কাছে অনুরোধ করাহয়, যাতে তারা বেশি পরিমাণে স্যানিটাইজার ও মাস্ক তৈরি করে তা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ও সিনেমা হলে সচেতনতার প্রচার শুরু হয়; শারীরিকভাবে দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি সামাজিকভাবে একজোট থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে জোরদার করতে প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাড়তি সাহায্য করা হয়, বাড়ানো হয় প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ।

প্রশ্ন: কিন্তু এই পুরো কাজটা করতে গিয়ে, করোনা সামলাতে লকডাউনের মতো সিদ্ধান্তে, সমাজের একটা বড় অংশের বিপদে পড়াটা অবশ্যম্ভাবীএই পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষদের জন্য কীভেবেছিলেন?  

উত্তর: আমরা আগে থেকেই একটা বড় আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করি, যাতে সমাজের কোনও অংশের মানুষ তাঁদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে সমস্যায় না-পড়েন, ও নিশ্চিন্তে ঘরে থাকতে পারেন। প্রথমে এই বন্দোবস্ত করার পর, তবেই আমরা লকডাউনে যাই, এবং, আপনার মনে থাকবে, সেটাও আমরা কেন্দ্র সরকারের আগেই ঘোষণা করেছিলাম।

প্রশ্ন : গোটা মডেলটা আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন ?

উত্তর: প্রথমত, আমরা কড়া ব্যবস্থা নিই যাতে মানুষ শারীরিকভাবে কাছাকাছি আসতে না-পারেন ও সংক্রমণকে সার্বিকভাবে আটকানো যায়। দ্বিতীয়ত, আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ-মতো যত বেশি সম্ভব করোনার টেস্টিং করাই; যাতে ইতিমধ্যে আক্রান্ত মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায়, তাঁদের কাছাকাছি এসেছেন এমন মানুষদের সঠিক তালিকা অর্থাৎ কন্টাক্ট লিস্ট প্রস্তুতকরে তাঁদের আলাদা করা যায়, ও তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন কিনা সে দিকে নজর রাখা যায়। এবং তৃতীয়ত, কোভিড-আক্রান্ত রুগিদের সারিয়ে তোলার জন্য বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই তিনদফা পরিকল্পনাই আমাদের করোনার বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে সাহায্য করেছে।

প্রশ্ন : মানুষের সাহায্য কতটা পাচ্ছেন ?

উত্তর: মানুষ অসম্ভব সাহায্য করছেন। অনেকেই নিজে থেকে কোয়ারান্টিনে চলে গিয়েছেন, অন্যরা নিজেরাই সমস্যা আছে বুঝতে পেরে কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করছেন। অনেকে আবার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্বাস্থ্য দফতর বা পুরসভাগুলিকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সাহায্য করছেন। কেরলকে এখন অবধি অতিমারি থেকে রক্ষা করতে সাধারণ মানুষের ভূমিকার কথা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে, আমরা এখনও বিপদের বাইরে নই; এবং তাই, আমাদের প্রত্যেককে বিধিনিষেধগুলি মেনে চলতে হবে। কোনওমতেই আমাদের রক্ষণকে দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।

প্রশ্ন: কেরলে করোনা থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার এত উঁচু হার, যা কিনা দেশের গড়ের তুলনায় অনেক বেশি, সেই প্রবণতাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

উত্তর: কৃতিত্ব পুরোটাই কেরলের অত্যন্ত শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার। এর সূত্রপাত রাজ্যের প্রথম মন্ত্রিসভার সময় থেকে, যা কমরেড ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ-এর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল। পরবর্তী কালে সেই ধারাটাই আমরা বজায় রেখেছি। এর ফলেই আমরা শিশু ও মায়েদের মৃত্যুর হার কমাতে, বা মৃত্যুর গড় বয়স বাড়াতে এতটা সফল হতে পেরেছি। মনে রাখতে হবে, যখন গ্যাট চুক্তির মধ্যে স্বাস্থ্যকে বাজারি পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা হয়েছিল, তখন একমাত্র কেরলই জনস্বাস্থ্য বিষয়টিকে লাভজনক ব্যবসায় পালটে ফেলার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। পরবর্তী বছরগুলিতেও আমাদের সরকার জনস্বাস্থ্যে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে ও আরদ্রাম মিশনের মতো প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যাতে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে পরিকাঠামো ও পরিষেবার ধারাবাহিক উন্নতি ঘটানো যায়। আমরা ভাইরোলজি-সহ অন্যান্য চিকিৎসা-সংক্রান্ত গবেষণাতেও উৎসাহ দিচ্ছি। জনস্বাস্থ্যর ওপর এই জোর দেওয়ার ফলেই আজ করোনা-রুগিদের এতটা উন্নত মানের পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছে ও এত বেশি সংখ্যক মানুষকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হচ্ছে। এমনকী বয়স্ক মানুষদেরও আমরা বাঁচাতে পেরেছি।

প্রশ্ন: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউন উঠে গেলে আর একবার করোনাসংক্রমণের ঢেউ আসতে পারেআপনাদের প্রস্তুতি কেমন ?  

উত্তর: আমরা সবরকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি আছি। আমরা ইতিমধ্যেই ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকাল রিসার্চ’-এর কাছে প্লাজ্‌মা থেরাপি প্রয়োগের অনুমতি নিয়েছি। এছাড়া, সব জেলায় কোভিড–১৯ হাসপাতাল তৈরি হয়ে গিয়েছে, ইতিমধ্যেই আড়াই লক্ষ বাড়তি বেড প্রস্তুত, আইসোলেশন-এর জায়গাও তৈরি। এছাড়াও আমরা শিল্প-সংস্থাগুলিকে অনুরোধ করেছি এগিয়ে আসতে। পাল্লাক্কাড়ে যথেষ্ট রেস্পিরেটর ও ভেন্টিলেটর তৈরির কাজ চলছে; চলছে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী তৈরিও।

প্রশ্ন: তার মানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলানোর ব্যাপারেও আপনি আত্মবিশ্বাসী…

উত্তর: আমরা যতই প্রস্তুত থাকি না কেন, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, গোটা পৃথিবী আজ এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এটা একটা সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি, এবং আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি এ বিষয়ে যতটা জ্ঞান আমরা এখন অবধি পেয়েছি তার ওপর দাঁড়িয়ে এই অতিমারির সঙ্গে লড়ার। ফলে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে সেরা যেটা আমরা করতে পারি, তা হল আমাদের যাবতীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে এই লড়াইয়ে কাজে লাগানো, ও এটা আশা করা যে আমরা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতব।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4657 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...