Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কাজের জগতের হালহকিকত বদলে দিচ্ছে করোনা

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 




লেখক তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, গল্পকার

 

 

 

সতেরো বছর আগে সার এপিডেমিকের পর আন্তর্জালভিত্তিক বাণিজ্য একলাফে অনেকগুণ বেড়ে গেছিল। এইবার আরও বেশি করে হবে সেটা। করোনা মহামারির মত বিপর্যয়ের সময় যে সমস্ত মানুষ কিছুটা বাধ্য হয়ে অনলাইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা শুরু করেছেন, তাদের এক অংশ হয়তো আর রোজকার দোকানবাজারে ফেরত যাবেন না। আন্তর্জাল বাণিজ্য এই সময়ে একবার সন্দিগ্ধ গ্রাহকের বিশ্বাস অর্জন করে নিতে পারলে, মানুষের ক্রয়-মানসিকতার বদল সম্ভব। অন্তত চিনে সেরকমই দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এরকম হবে সেটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে।

শুধু কেনাবেচাই নয়, চারদিকে যেমন দেখছি এই মহামারি শিল্প, শিক্ষা এবং বিনোদন সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। সমস্ত কিছুই বদলাচ্ছিল একটু একটু করে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই পরিবর্তনের গতি বেড়ে গেছে বহুগুণ। এরকম নয় যে আমরা যথেষ্ট তৈরি ছিলাম। কিন্তু যখন লকডাউনের ঘোষণা হল, কেউ পুরোপুরি থমকে দাঁড়াইনি। বরং দূর থেকেও কীভাবে কাজকর্ম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার ফিকির বের করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা বলছি, কারণ পূর্বপরিকল্পনামাফিক কিছু হয়নি। যেমন আমার নিজের কাজের ক্ষেত্রে। প্রথমে কথা ছিল ১৬ই মার্চ আমাদের অফিসের তথ্যপ্রযুক্তির সমস্ত কর্মী পরীক্ষামূলকভাবে একদিন বাড়ি থেকে কাজ করবে। ঝড়ের দিক বদলের মত অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছিল ঘণ্টায় ঘণ্টায়। তাই শুক্রবার ১৩ তারিখ হঠাৎ বলে দেওয়া হল সবাই বাড়ি থেকে কাজ করবে আগামী তিন সপ্তাহ (এখন সেটা বেড়েই চলেছে)। সবাই, সব দেশের অফিসে, সব রকমের কাজ। শুধু গাড়ির উৎপাদন বন্ধ, যদিও কারখানাগুলোয় কিছু আবশ্যিক কাজ চালু থাকবে।

ছিল বিড়াল, রাতারাতি হতে চাইল রুমাল। চাইলেই বুঝি সম্ভব? এই মুহূর্তে দূর থেকে সব রকমের কাজ করার প্রযুক্তি আমাদের হাতে নেই। অথবা থাকলেও, সারা পৃথিবীর কাজের চাপ নেওয়ার জন্য তৈরি নই এখনও। কিন্তু প্রয়োজন যখন আছে, আমার বিশ্বাস মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি সেই দূর থেকে কাজ হাসিল করার ভবিষ্যৎ অচিরেই কাছে এনে দেবে।

লেবার ব্যুরোর সংখ্যাতত্ত্ব বলছে আমেরিকার ২৯ শতাংশ কর্মী এমন কাজ করে যা বাড়ি থেকে করা যায়। তথ্যপ্রযুক্তিতে এই সংখ্যাটা প্রায় ৫০ শতাংশ। তবে খুব কম জায়গাতেই সেটা সর্বজনীনভাবে চালু হয়েছে। কিন্তু এই মহামারীর প্রকোপে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশের বেশি কাজ এখন দূর থেকে করার চেষ্টা চলছে। ইন্ডাস্ট্রি হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছিল, সেটা হঠাৎই হয়ে গেল ভবিষ্যতের বাড়িতে বসে কাজ করতে পারার এক বিশাল নিরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা। এটা অনেকটা করোনার প্রতিষেধকের মত। যথেষ্ট পরীক্ষা না করেই, রুগীদের উপর ব্যবহারের চেষ্টা। অন্য কোনও উপায়ও ছিল না যে! এই মুহূর্তে পুরোপুরি সফল নাও হতে পারে। কিন্তু চেষ্টা করতে গিয়ে আমরা যা জানব, ভবিষ্যতে সঠিক ব্যবহারিক প্রযুক্তি তৈরি করতে অনেক সুবিধা হবে।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি এইখানে। গত চার সপ্তাহ ধরে বাড়ি থেকে কাজ চলছে আমাদের। যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়াই। কিন্তু যেহেতু আমরা সবাই ল্যাপটপ ব্যবহার করি আর আমাদের কর্মীকুলের একটা বড় অংশ এমনিতেই বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে, কোনও নতুন প্রযুক্তির দরকার ছিল না। বদলটা হল আর কেউ নিজের নিজের অফিসে যাচ্ছে না, সে যেই দেশেই হোক। সবাই নিজের নিজের বাড়িতে ল্যাপটপ নিয়ে ড্রয়িং রুমে, শোবার ঘরে, রান্নাঘরে, বেসমেন্টে নিজের নিজের অফিস বানিয়ে নিয়েছে। এই অবস্থায় কাজ কেমন হচ্ছে?

এক ধরনের কাজ খুবই ভালো হচ্ছে, এমন কি আগের থেকেও ভালো। যেখানে একা বসে মাথা খাটিয়ে কাজ করার ব্যাপার, অসুবিধাটা কোথায়? কিন্তু যেসব কাজে সবাই মিলে আলোচনা করে নতুনভাবে ভাবার দরকার, সৃজনশীলতার প্রয়োজন আছে সেখানে ফলাফল অত ভালো বলা যায় না। সবচেয়ে মুশকিল সেখানে নয়। আসলে আমরা তো অফিসে গিয়ে শুধু কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে কাজ করি না। পারস্পরিক একটা আদানপ্রদান চলে, একটা মানসিক সংযোগ তৈরি হয়। সেটা না থাকলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনশীলতা কমে যেতে বাধ্য। দূর থেকে কাজ করলেও, মাঝেমধ্যে সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হওয়া প্রয়োজন, নাহলে মানসিক অবসাদ অবশ্যম্ভাবী। সেটা এই মুহূর্তে সম্ভব নয় যদিও। বাড়ি বসে কাজের যত রকমের ব্যবহারিক সফটওয়্যার আছে যেমন ওয়েবেক্স টিম, মাইক্রোসফট টিম, স্কাইপ এদের ব্যবহার বেড়ে গেছে বহুগুণ। ঠিক যেমন হাসপাতালে ডাক্তার আর নার্সরা রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়ে যাচ্ছেন, ঠিক তেমনি এইসব সফটওয়্যার টুলসের সহায়তায় যারা বহাল আছেন তারাও কিন্তু দিনরাত খাটছেন যাতে এগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু রাখা যায়। না হলে যে অর্থনীতি পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে!

কিন্তু আমাদের মতন গাড়ির কারখানায় সব কাজ তো আর ভিডিও কনফারেন্স করে হয় না। যে কোনও গাড়ি বানানোর জন্য হাজার হাজার যন্ত্রাংশ প্রয়োজন হয় যেটার জোগানদার আবার বহু ছোট বড় কোম্পানি। তারা আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে সঙ্গে একযোগে যন্ত্রাংশের নকশা নিয়ে কাজ করে। আবার সেটা যখন তাদের কারখানায় তৈরি হয় তার গুনগত মান পরীক্ষার জন্য আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা তাদের কারখানায় সশরীরে হাজির হন। দেশে বিদেশে এইসব কারখানায় আবার কবে যাওয়া সম্ভব হবে বলা মুশকিল। তাহলে? সৌভাগ্যবশত আমরা ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরীক্ষামূলকভাবে ভার্চুয়াল রিয়ালিটিকে হাতিয়ার করার কথা ভাবছিলাম। এর সাহায্যে ইঞ্জিনিয়াররা পরিদর্শনে না গিয়ে দূর থেকেই যন্ত্রাংশের পরীক্ষানিরীক্ষা করতে পারবেন। এমন একটা ব্যবহারিক উপকরণ হল মাইক্রোসফটের হলোলেন্স। এগুলো কিছু সংখ্যায় চালু করার কথা ছিল ২০২১ থেকে। কিন্তু যেই মুহূর্তে করোনার ঢেউ আছড়ে পড়ল, ভবিষ্যত বর্তমানে চলে এল। গত তিন সপ্তাহে এই প্রযুক্তি কিনে পরীক্ষা করে দেশে বিদেশে বিভিন্ন যন্ত্রাংশের কারখানায় পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে। শুধু তথ্যপ্রযুক্তি নয়, অদূর ভবিষ্যতে বিভিন্ন উৎপাদনশিল্পে দূর থেকে কাজ করার জন্য এরকম অনেক ব্যবহারিক প্রযুক্তির আবির্ভাব হবে বলাই বাহুল্য। রোবোটিক্সের ব্যবহার উৎপাদন ক্ষেত্রে বাড়ছিল ধীরে ধীরে, তার গতি চতুর্গুণ হল। ব্যবসায়ের একটি ক্ষেত্র যেখানে ক্রেতা আর বিক্রেতার সংযোগ— সেইসব জায়গায় রোবটের ব্যবহার সবচেয়ে দেরিতে আসবে এমন ভাবনা ছিল। করোনা দাবার সেই চাল পালটে দিয়েছে। খুচরো বিক্রির ক্যাশিয়ারের মত চাকরিও যে এত সহজে মানুষের হাত ফসকে চলে যাবে সেটা কে জানত? শুধু সেটাই নয়, এরকম বহু কাজ যেখানে মানুষকে নিজে গিয়ে করতে হয়, রোবটের ব্যবহার এর মধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে। আমাজনের ফিলিং সেন্টারে মানুষ আর দেখা যাবে না বেশিদিন। আমি এই বিষয়কে উপজীব্য করে একটা গল্প লিখেছিলাম মাস কয়েক আগে, সেটা যে একলাফে বর্তমান হয়ে যাবে কক্ষনও ভাবিনি।

শিক্ষায় করোনার কী প্রভাব? অনলাইন শিক্ষা তো চলছিলই, কিন্তু প্রথাগত স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি কেউই এর জন্য তৈরি ছিল না। হঠাৎ করে সব বন্ধ করার ঘোষণা হল এবং এখন যা দেখা যাচ্ছে এই বছর (আমেরিকায় জুনে শিক্ষাবর্ষের শেষ) আর কোনও বিদ্যাক্ষেত্র খোলার সম্ভাবনা নেই। আমার নিজের ছেলে মেয়ে হাইস্কুলে পড়ে। হঠাৎ এই ঘোষণায় স্কুল দুদিন বন্ধ ছিল বটে, কিন্তু তারপর জুম ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। শুধু অঙ্ক, ইংরাজি এইসব বিষয় নয়, ছবি আঁকার ক্লাস, ব্যায়াম এইসবও করাচ্ছে। পরীক্ষামূলক কাজ থাকলে তার ভিডিও তুলে স্কুলের ওয়েবসাইটে পাঠানো হচ্ছে। দেখে তো মনে হয় ক্লাস ভালোই হচ্ছে। কিন্তু বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে অবশ্যই সবাই মনমরা। এই যুগের ছেলেমেয়েরা যারা ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, ফেসবুক জাতীয় সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারে এত আগ্রহী থাকে, তারা জীবনের এমন ভার্চুয়াল হয়ে যাওয়টা মেনে নিতে পারছে না একদম। সবচেয়ে দুঃখের কথা এই বছরের সিনিয়রদের। স্কুলের শেষে যে যার কলেজে ছড়িয়ে পড়বে, বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলিটাও একবার করতে পারবে না। আজকেই দেখলাম জাপানে ভার্চুয়াল সমাবর্তন উৎসব হচ্ছে। হয়তো সেটাই আগামী দিনের নিয়ম হয়ে দাঁড়াবে।

অন্তত এই মুহূর্তে এটা বাধ্যতামূলক। সব রকমের মুখোমুখি ক্লাস, সম্মেলন বাতিল হয়ে যাচ্ছে এই মুহূর্তে। এই যেমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কনফারেন্স ছিল নিউ ইয়র্কে, ফেব্রুয়ারি মাসে। চিন থেকে অনেক রিসার্চারের আসার কথা ছিল। চিনের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, তারা যোগ দিয়েছিলেন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। এখন তো সব কিছু বাতিল। ফেসবুকের কনফারেন্স এই বছর হবে না। আমার নিজের যাওয়ার কথা ছিল ফ্লোরিডায় অ্যারিবার কনফারেন্সে মার্চ মাসে, ততদিনে সব সম্মেলনই বাতিল হতে শুরু করে দিয়েছে। আমাদেরটাও হয়নি। ভিডিও কনফারেন্সটাই হয়তো ভবিষ্যত। এটা শুধু সম্মেলনেই সীমাবদ্ধ নেই। সব কাজ যেমন ভার্চুয়াল হবার দিকে এগোচ্ছে, অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়াও। এই ব্যবস্থা চালু হয়েছিল ২০১৪ সাল থেকেই। কিন্তু তার ব্যবহার বেশি ছিল না। করোনা এই ব্যবসার নিবু নিবু সলতেতে উপুর করে তেল ঢেলেছে সেকথা বলাই বাহুল্য। পড়লাম (নিজের অভিজ্ঞতা নয়), এইরকম অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া নাকি অনেক বেশি অন্তরঙ্গ হচ্ছে। বোধহয় পশ্চিমী সভ্যতায় সবার সামনে প্রাণ খুলে কাঁদতে পারা যেত না। এখন সবাই যখন নিজের নিজের বাড়ির থেকে ভিডিওতে যোগ দিচ্ছে, মনের ভার হালকা করতে আর কোনও বাধা নেই।

করোনার মহামারি একসময় আমাদের বাগে চলে আসবে। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব তৈরি করতে গিয়ে কর্মজগতের এমন কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, তার অনেকটা পাকাপাকিভাবে রয়ে যাবে। আমরা সবাই যখন আমাদের কাজের জায়গায় ফিরব, অনেকের কাজের জায়গায় থাকবে যন্ত্র। অথবা ততদিনে জায়গাটাই উঠে গেছে, পাকাপাকিভাবেই বাড়ি থেকে কাজ করা বহাল হবে। অর্থনীতির কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর প্রভাব প্রাথমিকভাবে খারাপ হবে অবশ্যই। অফিস পরিকাঠামোর চাহিদা কমে যাবে, বিমান এবং হোটেল পরিষেবা ক্ষেত্রেও মন্দা দেখা যাবে। নিত্যদিনের কাজের জায়গায় রোবট বসে গেলে, সেইসব মানুষগুলো যাদের ভাত মারা গেল, তারা খাবে কী?

নদীর এক কূল ভাঙলে, আর এক কূলে বসতি গড়বে মানুষ। সেটা আগেও হয়েছে। এবারেও হবে নিশ্চিত। সেই আশাতেই বাঁচতে হবে।