Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কেন অ্যামেরিকায়?

রাহুল রায়

 




লেখক পেশায় অধ্যাপক। বোস্টন, অ্যামেরিকা

 

 

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই পৃথিবীতে অ্যামেরিকার আসল রমরমা শুরু। আগেই ছিল, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের আঁচ প্রায় গায়ে না-লাগার ফলে সেটা যেন দারিদ্র আর যুদ্ধজর্জর পৃথিবীর আছে আরও প্রকট হয়ে দেখা দিল। মস্ত বড় দেশে ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর। সেখানে সবাই নিজের গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ায়, আর টাকা যেন বাতাসে উড়ছে, শুধু চেপে ধরার ইয়ত্তা।  এসব তো গেল মানুষের তৈরি। নায়াগ্রা ফলস, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, ইয়োলো-স্টোন— প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই কম কিসে! তা ছাড়াও আছে চোখ-জোড়ানো ক্যাম্পাস-ওয়ালা বিখ্যাত সব ইউনিভারসিটি, আর কী সব তাদের নাম— হার্ভার্ড, এমআইটি, কর্নেল, বার্কলে, ক্যাল-টেক— কত নাম করব। বছর বছর নোবেল প্রাইজের ফর্দে সাহিত্য ছাড়া প্রায় অন্য সব কিছুই এ দেশের লোকেদের দখলে।  আর, হু কেয়ারস ফর সাহিত্য! একেই বলে— খোদা জব দেতা, ছপ্পর ফাঁড়কে দেতা। বলাই বাহুল্য এই লোভেই আমার ছাত্র হয়ে আসা, ও ইঁদুরের কলে আটকা পড়ে যাওয়া এই সম্বৃদ্ধি ও মেধার প্রাচুর্যের দেশে।

সবই চলছিল ঠিকঠাক, ভাল-মন্দ মিলিয়ে, খালি সম্প্রতি হঠাৎ কোথা থেকে করোনা ভাইরাস ও তদ্ভূত কোভিড ১৯ অসুখ এসে সব একেবারে ওলটপালট করে দিল। প্রথমে শুরু হল চিনের থেকে, ওখানে নাকি ফ্লুর মত কী একটা অসুখে প্রচুর লোক মারা যাচ্ছে। তেরো কোটি লোকের দেশ, কিছু কমে গেলে কেউ জানতেও পারবে না। তা ছাড়া ইদানীং বড় বাড় বেড়েছে, ঝড়ে যদি একটু ভেঙেই যায় তাতে পৃথিবীর মঙ্গলই হবে। তবে শীগগিরই সেই অসুখ ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ল, আর লোক মরতে লাগল পটাপট। আমরা উত্তর অ্যামেরিকায় বসে তখনও মজা দেখছি— তোর ঘরে আগুন লেগেছে তো আমার কি? দিল্লি বহুদূর। তবে সপ্তাহ দুয়েক যাওয়ার পরই খবর এল নিউ ইয়র্ক সিটিতে নাকি কোভিড ১৯ ধরা পড়েছে। নাঃ, নিউ ইয়র্ক সিটি হচ্ছে সারা পৃথিবীর লোকের আস্তানা। ওখানে দু-একটা তো হতেই পারে। তবে বিপদ হল কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দাবানলের মত কোভিড ১৯ নিউ ইয়র্ক শহরে আছড়ে পড়ল, আর তাতে লোকের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে আরম্ভ করল লাফিয়ে লাফিয়ে।

এপ্রিলের মাঝামাঝি— নিউ ইয়র্ক সিটি ছাপিয়ে সারা দেশে কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পড়েছে। আর মাত্র এক-দু মাসের মধ্যে অ্যামেরিকা সারা পৃথিবীর এপিসেন্টার বা কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। উনিশে এপ্রিলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ৮ লাখ লোকের দেহে করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে আর মৃতের সংখ্যা চল্লিশ হাজারের ওপরে[1]। এই সব নানারকম ভয়াবহ খবর আর তার সঙ্গে জড়িত নানান তথ্য, উপ-তথ্য, না-তথ্য সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে চতুর্দিক থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আমাদের সেল ফোন আর কম্প্যুটারে আছড়ে পড়ছে। খালি তফাৎ হল যে সমুদ্রের ঢেউয়ে মেকি কিছু নেই, কিন্তু এই খবর বা তথ্যের কোনটা যে ঠিক, কোনটা বেঠিক, আর কোনটা স্রেফ তৈরি করা জনমত সৃষ্টির জন্য অথবা কন্সপিরেসি থিওরি খাড়া করার জন্য তা বোঝার কম্ম আমার নয়। অন্যদিকে হোয়াইট হাউস থেকে আমাদের ‘অরেঞ্জ ম্যান’ ক্রমাগত নানান কথা বলে চলেছেন। টুইট-এরও অভাব নেই। যেমন প্রথম দিকে— এ কোনও ব্যাপার নয়, কদিনেই ঠিক হয়ে যাবে। ইদানীং বলছেন মে মাসের প্রথম থেকেই সব খুলে দেওয়া হবে। আগে অর্থনীতি বাঁচুক, পরে লোকের কথা ভাবা যাবে, ইত্যাদি। এই কাজটা হঠকারী হবে কি না, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে ব্যাপারে কংগ্রেস, সেনেট-এর সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। কিন্তু ট্রাম্প ইস বীইং ট্রাম্প!

তবে এই হট্টগোলের মধ্যেও কতগুলো তথ্য বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে— যেমন কোভিড ১৯-এর ব্যাপক সংক্রমণের জন্য এই দেশ আদৌ প্রস্তুত ছিল না, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলিতে সংক্রমণ ঠেকিয়ে রাখার জন্য মুখের ম্যাস্ক ও হাতের গ্লাভস, পরীক্ষা করার ‘টেস্ট-কিট’ যথেষ্ট পরিমাণে নেই। আর কোনও সহজবোধ্য ও সঙ্গতিপূর্ণ পরিকল্পনা সরকারের আছে বলে আদৌ মনে হচ্ছে না। কেন?

নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি ইত্যাদি জনবহুল প্রদেশে, এমনকি আমাদের ম্যাসাচুসেটস-এও সেলফ-ইম্পোসড কোয়ারানটিন করা হয়েছে। তাতে অধিকাংশ জনগণের মেলামেশার জায়গা, যেমন দোকানপাট ইত্যাদিতে ছ-ফুট সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং, মুখে ম্যাস্ক পরা ইত্যাদি কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু সবাই তাই করছে মনে করার কোনও কারণ নেই। ম্যাসাচুসেটসেও কোভিড ১৯-এর ঘটনা ও মৃত্যু তরতর করে বেড়ে চলেছে। কিন্তু ছোটখাটো দোকান, রেস্তোরা ইত্যাদি প্রায় বন্ধ থাকলেও বড় দোকানপাট, মল ইত্যাদি সব খোলা, আর তাতে লোকজন মুখে ম্যাস্ক না পরে বেশ দিব্যি ঘোরাফেরা করছে। আইনত কিচ্ছু করার নেই।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হল যে এত ধরনের ভয়াবহ খবর সত্ত্বেও এ দেশের জনগণের এক বেশ বড় অংশ বিশ্বাসই করে না যে কোভিড ১৯ এত ভয়ঙ্কর হতে পারে, বা এতে সংক্রামিত হয়ে কেউ মারা যেতে পারে। আর এই ব্যাপারে  আমাদের প্রেসিডেন্ট প্রায়ই আগুনের ওপর পাখার হাওয়া দিচ্ছেন।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মার্চ মাসের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এ দেশের স্কুল-কলেজ-ইউনিভারসিটিতে ‘স্প্রিং ব্রেক’ বা ‘বসন্তের ছুটি’ থাকে। ট্র্যাডিশনালি কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকে কলেজের ডরমিটরি থেকে বেরিয়ে পড়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য। আর তাদের অন্যতম জনপ্রিয় জায়গা হচ্ছে ফ্লোরিডার সমুদ্রতীর। এ বছরে, কোভিড ১৯ সম্বন্ধে নানা খবর ও তার সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং ইত্যাদি সম্বন্ধে নানা তথ্য (অবশ্যই নিয়ম বলা যাবে না, আজও কোনও পানিশেবল ম্যান্ডেট নেই) থাকা সত্ত্বেও শয়ে-শয়ে তরুণ-তরুণী এসবের কোনও পাত্তা না দিয়ে খোলামেলাভাবে মেলামেশা করেছে[2]। এটা জানা ছিল যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বয়সের বাধা মানে না, যদিও অল্পবয়স্কদের ওপর এর মারণক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু এটা তো তাদের জানা উচিত যে তাদের থেকে অন্যদের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর তাতে বয়স্করা, বিশেষ করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মারা যেতে পারে। কিন্তু তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়েছে যে লোকে মরে মরুক— পার্টি করা আমাদের ফান্ডামেন্টাল রাইট।

অতএব, সারা পৃথিবীর লোকেদের কাছ থেকে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে— এত ইউনিভারসিটির শিক্ষা, এত মেধা, এত নোবেল প্রাইজ থাকা সত্ত্বেও ও দেশে করোনা ভাইরাস এত দ্রুত ছড়াচ্ছে কী করে? সেখানে কি দেশের সরকারের কোনও ভূমিকা নেই? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আরও একটা উদাহরণের দিকে তাকানো যাক।

সাউথ ডাকোটা প্রদেশে সিউ ফলস শহরে ‘স্মিথফিল্ড পর্ক প্রসেসিং প্ল্যান্ট’ নামের একটা মস্ত ‘প্রসেসিং প্ল্যান্ট’ আছে যা এই প্রদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ, সেখান থেকেই কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পড়ছে[3]। কিন্তু সাউথ ডাকোটার রিপাবলিকান গভর্নর ক্রিস্টি নোয়েম সেই প্ল্যান্ট বন্ধ করা তো দুরের কথা, সিউ ফলস শহরের ডেমোক্র্যাটিক মেয়র পল টেনহাকেন-এর ঐ শহরে ম্যান্ডেটরি কোয়ারানটিনের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ নাকচ করে দিয়েছেন। এখানে বলে রাখা দরকার যে ক্রিস্টি নোয়েম ট্রাম্পের খুব ঘনিষ্ঠ।

এ দেশের ব্যাপারে যারা বিশেষ ওয়াকিবহাল নন তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞাসা করতে পারেন বর্তমানের এই মহামারি বা প্যান্ডেমিক-এ কে রিপাব্লিকান, কে ডেমোক্র্যাট, কে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ— এসব গুরুত্বপূর্ণ কেন হবে? বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলা যেতে পারে যে— হয়, হয়, জানতি পারো না।

আসলে এ দেশে এই ব্যাপারের অনেকখানিই রাজনৈতিক। আর আরও খানিকটা এ দেশের লোকদের মনোভাব। কীভাবে?

১৯১৮-১৯২০ সালে কোভিড ১৯-এর মতোই স্প্যানিশ ফ্লুতে ভারতে এক কোটির বেশি লোকের মৃত্যু হয়[4]। সুতরাং ভারতের মতো জনবহুল দেশে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে কতজন যে মারা পড়বে তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। বর্তমান বিজেপি সরকার গরুর মূত্র, দেশি গরুর দুধে সোনা, পুষ্পক রথ, ও হিন্দুত্বের আরও সব উদ্ভট মহান কীর্তির প্রচার করা সত্ত্বেও কোভিড ১৯ সামলাতে সারা দেশে ‘লকডাউন’ জারি করেছে, ও তা ভাঙলে শাস্তিও পেতে হচ্ছে— এ খবর পাওয়া যাচ্ছে। আর এর জন্য সংক্রমণ অনেকখানি ঠেকিয়ে রাখা গেছে। এটা ঘটনা। এই জন্য মোদি ধন্যবাদার্হ।

কিন্তু অ্যামেরিকায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্রমাগত কোভিড ১৯-এর ক্ষমতা ছোট করে দেখছেন ও এর সংক্রমণ থামানোর জন্য বিশেষ কোনও সিদ্ধান্ত বা পলিসি নিচ্ছেন না। উলটে কী করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব কিছু খুলে দেওয়া যায় সেই কথা বলে চলেছেন। এর ফলে কোভিড ১৯ মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের নানান সিদ্ধান্ত ও কার্যপ্রণালী ঠিক করে নিতে হচ্ছে। বলা বাহুল্য যে তাদের কেউ রিপাবলিকান আর কেউ ডেমোক্র্যাট, ও তারা তাদের পার্টি-লাইন অনুযায়ী চলছে।

আগেই বলা হয়েছে সাউথ ডাকোটার রিপাবলিকান গভর্নর কৃষ্টি নোয়েম ম্যান্ডেটরি বা সেলফ-ইম্পোজড, কোনও কোয়ারানটিন করতে রাজী নন। অন্যদিকে ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাটিক গভর্নর গ্যাভিন নিউসম মহামারি আরম্ভ হওয়ার সম্ভাবনার প্রথম থেকেই স্কুল-কলেজ ও নানান পাবলিক প্লেস বন্ধ করে ও সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং ইত্যাদির ব্যাপারে জনমত তৈরি ও সেলফ ইম্পোজড কোয়ারানটিন করার ফলে এই প্রদেশে সংক্রমণ আপেক্ষিকভাবে অনেক কম। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে লস এঞ্জেলস জনসংখ্যা অনুযায়ী নিয় ইয়র্ক সিটি-র ঠিক পরে। আবার, এর কিছু ব্যতিক্রমও আছে। যেমন আমাদের ম্যাসাচুসেটস-এর রিপাবলিকান গভর্নর চার্লি বেকার প্রতিদিন কী খোলা থাকবে, আর কী থাকবে না, আর বর্তমান পরিস্থিতিতে লোকেদের কী করতে হবে সেই নিয়ে নিয়ম জারি করে চলেছেন রোজ। অবশ্যই গভর্নর বেকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

এ তো গেল কোভিড ১৯-এর সঙ্গে লড়াই করার ব্যাপারে ফেডারাল (সেন্ট্রাল) ও স্টেট গভর্নমেন্ট-এর পলিসি বা না-পলিসি। তা ছাড়াও এ দেশে নানান আইন-কানুন মানা বা না-মানার ব্যাপারে এক মস্ত বড় পারটিসিপেন্ট হচ্ছে এ দেশের লোকজন। এ এক অদ্ভুত দেশ! পৃথিবীর জনগণের ধারণা যাই হোক না কেন এ দেশে অশিক্ষা-কুশিক্ষার কোনও অভাব নেই। বিশেষ করে এ দেশের মধ্যভাগ ও দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে। সেখানে জনগণের অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ, ও সেখানে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, বর্ণবিদ্বেষ দেশের পূর্ব ও পশ্চিম প্রদেশগুলি থেকে অনেক বেশি। এরাই ট্রাম্পের ও রিপাবলিকান পার্টির সবচেয়ে বড় সমর্থক। আর যেহেতু ট্রাম্প বলে চলেছেন যে— এ কিছু নয়, শীগগিরই সব ঠিক হয়ে যাবে। অথবা সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং নিয়ে কড়াকড়ি করার কারণ নেই— এরা তাই-ই মানছে। আগেই সাউথ ডাকোটার রিপাবলিকান গভর্নর ক্রিস্টি নোয়েম-এর কথা বলা হয়েছে। তার সঙ্গে হাত ধরার লোকের কোনও অভাব নেই।

কোভিড ১৯-এর মোকাবিলা করার ব্যাপারে জনগণের আরও একটা বিশেষ ভূমিকা আছে, যাকে বলা যায় ইউনিকলি অ্যামেরিকান, অর্থাৎ এ দেশের লোকেদের মানসিক চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত। ষোলশো শতাব্দীর প্রথম দিকে, প্রধানত ইংল্যান্ড থেকে যখন ভাগ্যান্বেষী লোকজন এ দেশে এসে বসবাস করতে শুরু করে তখন এদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশ ছিল অত্যন্ত রুক্ষ ও নিষ্করুণ। সেই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তারা এ দেশ বাসযোগ্য করে তুলেছে। আর তার ফলে এ দেশের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই, এ দেশের ভাষায় যাকে বলে ‘ফিয়ার্সলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’— তাই হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ আমি আমার মত অনুযায়ী যা ইচ্ছে তাই করব। বলা বাহুল্য যে এই নির্ভীক ও স্বাধীনচেতা চরিত্রের লোকজনই এ দেশকে সমৃদ্ধি ও মেধার চূড়ায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে, ও করে চলেছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এই সম্পূর্ণ স্বাধীনচেতা চরিত্রই আবার নানান সমস্যারও জন্ম দিয়েছে।

যে কোনও দেশের সমাজই এক যৌথ পরিবারের মতো। এখানে পরিবারের সব সদস্য যদি তার স্বাধীন পথে চলে তাহলে সেই পরিবার দ্রুত ভেঙে পড়তে বাধ্য। কিন্তু এই পরিবার যে সহজে ভেঙে পড়ে না তার কারণ এই পরিবারের মাথায় একজন থাকেন যিনি নিয়ম-কানুন ঠিক করেন, ও পরিবারের সবাইকে তা মেনে চলতে হয়। যে কোনও দেশ এক বৃহত্তর মানব-পরিবার, আর তার মাথায় দেশের সরকার। সব দেশ না হলেও অ্যামেরিকার ক্ষেত্রে সেই মাথা হল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার। এই সরকারই এ দেশের লোকজনের প্রতিনিধি হয়ে নিয়ম-কানুন তৈরি করে, ও সেই নিয়ম-কানুন যাতে সবাই মেনে চলে তার ব্যবস্থা করে। সমস্যা হল সেই ফিয়ার্সলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট লোকজন এটা অত্যন্ত সন্দেহের চোখে দেখে। তাদের কাছে এটা একটা অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ। সুতরাং তা মানার দরকার নেই— আমি আমার ইচ্ছেমত চলব, তুমি সরকার হও, আর যেই হও, তুমি বলার কে হে? এই সরকার-বিরোধিতা যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে তার অন্যতম উদাহরণ ১৯৯৩ সালে টিম ম্যাকভে ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ওকলাহোমা সিটিতে মুরা সরকারি ভবন বম্ব দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা, যাতে একশো আটষট্টিজন মারা যায়, আহতের সংখ্যা পাঁচশোরও বেশি।

আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বন্দুক-জড়িত রক্তপাত বা গান-ভায়োলেন্স এ দেশে একটা নিত্ত-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ-দশ-কুড়িজন নিহত কোনও ব্যাপারই নয়, আর ছেলে-বুড়ো-শিশু এ থেকে কারওই নিস্তার নেই। আমি নিশ্চিত যে অন্য দেশের লোকেরা ভাবে— এ দেশে কি আইন বলে কিছু নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু কিছু লোকে মনে করে ‘বেয়ারিং আর্মস ইস আওয়ার ফান্ডামেন্টাল রাইট।’ এমনকি বন্দুকবাজিকে এ দেশে ‘গ্লোরিফাই’ করা হয়। কাউট্রি ওয়েস্টার্ন মুভিতে জন ওয়েন, ক্লিন্ট ইস্টউড— এদের কথা মনে পড়ে? আর এই লোকেদের প্রধান সমর্থক হল রিপাবলিকান পার্টি ও বর্তমানে তাদের নেতা ডনাল্ড ট্রাম্প, আর বেশ কিছু বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গ। এরাই করোনা ভাইরাস সম্পর্কীয় কোনও নিয়মই মানতে রাজী নয়। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং আবার কী? আমি যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারি। কে কী বলবে? বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মত কোভিড ১৯ সম্পর্কে কোনও কিছু না মানা এদের কাছে ফান্ডামেন্টাল রাইট। তাতে সমাজের, অন্য লোকের ক্ষতি হয় হোক[5]

সুতরাং করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে কোনও নির্দেশ আশা করা যায় না। এ দেশের বেশ এক বড় অংশ বিশ্বাস করে কোভিড ১৯ সামলানো নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। এদের সঙ্গে জুটেছে কিছু আলট্রা কন্সারভেটিভ ধার্মিক লোক, যারা বিশ্বাস করে শুধু প্রভু যীশুর কাছে প্রার্থনাতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এ দেশের কর্ণধার আজ একরকম কথা আর কাল আর একরকম কথা বলছেন। বলাই বাহুল্য যে এ দেশের লোকের কপালে এখনও অনেক দুঃখ পাওয়া বাকি আছে।


[1] Center for Systems Science and Engineering at Johns Hopkins University
[2] It is our fault young people refuse to stay home. Laura Kalmes, March 26, 2020. https://www.ozy.com/news-and-politics/its-our-fault-young-people-refuse-to-stay-home/293136/
[3] AP News, April 14, 2020
[4] Coronavirus: What India can learn from the deadly 1918 flu। Soutik Biswas, https://www.bbc.com/news/world-asia-india-51904019, March 18, 2020.
[5] Why America Is Uniquely Unsuited to Dealing With the Coronavirus. Uri Friedman, Atlantic Magazine, March 25, 2020.  https://www.theatlantic.com/politics/archive/2020/03/coronavirus-united-states-vulnerable-pandemic/608686/