স্মৃতি–বিস্মৃতি এবং বিমল কর

শতবর্ষে বিমল কর | সাহিত্যিক

দেবকুমার সোম

 


কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

একদা বহুপঠিত, বহুপ্রজ সাহিত্যিক বিমল কর। জন্ম সেপ্টেম্বর ১৯, ১৯২১। সোমবার। মেষরাশি। কর্কটলগ্ন। জন্মশতবর্ষে তাঁর নীরব স্মারণিক অনুষঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত অনুভূতি এই সামান্য লেখার উপজীব্য।

তাঁকে আমরা জানি ১৯৫০ দশকের অন্যতম জনপ্রিয় কথাকার হিসাবে। অধুনা মৃতপ্রায় এক সাহিত্য সাময়িক পত্রিকায় তিনি ছোটগল্প বিভাগের সম্পাদক কিংবা নির্বাচক এমন গোছের কিছু ছিলেন। ফলে পরবর্তীকালে বহু সাহিত্যিকের পথ ও প্রাসাদ দুই-ই ছিলেন আজকের পাঠকবিস্মৃত বিমল কর। বিমলের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যৌথ পরিবারে। মূলত রেল আর কোলিয়ারিকেন্দ্রিক নাগরিক ছিলেন তিনি। সেই মতো তাঁর সাহিত্যে আমরা পাই মফস‌্‌সল শহরের মধ্যবিত্ত মানুষগুলির সম্পর্কজনিত সাহিত্যরূপ। ১৯৫২ সালে শিবনারায়ণ রায় ও নারায়ণ চৌধুরী সম্পাদিত, বিমল কর প্রকাশিত উত্তরসূরী পত্রিকায় তাঁর ‘ইঁদুর’ গল্পটির জনপ্রিয়তা তাঁকে সাহিত্য জগতে নিয়ে আসে। এরপর ওই একই সময়ে প্রকাশিত হয় ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’ আর ‘আত্মজা’ (১৯৫৪) নামে দুটো গল্প, যা বিমল করকে কলকাতার বাণিজ্যিক সাহিত্যের বৃত্তে আলোচিত নাম হিসাবে জায়গা দেয়। এরপর থেকে টানা প্রায় চল্লিশ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি বাণিজ্যিক কাগজে বিভিন্ন রকমের গল্প বা উপন্যাস লেখেন। যা মূলত কাহিনিকেন্দ্রিক। একরৈখিক। তবুও মনস্তাত্ত্বিক উপাদান তাতে কিছু কম ছিল না। তাঁর কাহিনির বুননের কারণে বহু জনপ্রিয় বাংলা (‘বসন্ত বিলাপ’, ‘খড়কুটো’, ‘যদুবংশ’, ‘বনভূমি’) এবং হিন্দি (‘বালিকা বধূ’ ও ‘দিল্লাগি’) সিনেমা সমকালে তাঁর সাহিত্য থেকে নির্মিত হয়। এক কথায় বিমল কর ছিলেন সেদিনের পাঠকপ্রিয় এবং পাঠকের ইচ্ছাপূরণের কথাকার।

ছোটগল্পের সংজ্ঞা নিয়ে গোল পাকিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি মোটের ওপর ছোটগল্পের একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন, যা অবশ্যই তাঁর নিজস্ব। কোনও সর্বজনীন সংজ্ঞা তাকে বলা যায় না। অথচ, সেই সংজ্ঞাতেই এযাবৎকাল বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের সাফল্য–ব্যর্থতা নির্ধারিত হয়েছে। আমাদের গল্পপাঠের এই অভ্যাসের নিদর্শন বিমল করের সাহিত্যভুবন। অর্থাৎ বলার কথা এই যে, তিনি প্রথাবিরোধী ছিলেন না। শাস্ত্রবিরোধীও নয়। অভ্যেসবশত যে সাহিত্য সৃষ্টি হয়, সেই সাহিত্যের এক্সপায়ারি ডেট থেকে যায়। বিমল কর তার ব্যতিক্রম নন।

আর, শিল্পবস্তুটা অমন সংজ্ঞানির্ভর হওয়ার কথাও নয়। এর ফলে একদা বাংলা ছোটগল্পের ভুবনে বিস্তারের যে সম্ভাবনা ছিল, সেই সম্ভাবনা খারিজ হয়ে গেছে ছোটগল্পের আঙ্গিক বাছাইয়ে রবীন্দ্রনির্দেশিত সংজ্ঞার নিক্তিতে। দু–একজন লেখক ছাড়া বাকিরা যেমন যথেষ্ট সাহসী হলেন না, পাঠ-অভিজ্ঞতায় পাঠকও তেমন স্বস্তিবোধ করলেন না। অন্তত এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে। বিমল কর ১৯৮২ সালে চাকরি পর্বে ইতি টানার সময় হয়তো অনুভব করেছিলেন বাংলা ছোটগল্পের কলেবর বদলে যাচ্ছে। যা কোথাও কোথাও সাহসী। কোথাও আবার অতি সাহসী। ১৯৮৮ সালে তিনি গল্পপত্র নামে একটা দ্বি–মাসিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। মূলত আঙ্গিকের নতুন সূত্র আবিষ্কারে। চার বছর পত্রিকাটা প্রকাশিত হয়ে তার প্রয়োজনীয়তা হারায়।

আমার পাঠ-অভ্যাসে কোথাও বিমল কর থাকার কথা নয়। থাকেননি। তবুও আরও বহু বহুপ্রজ সফল বাণিজ্যিক লেখকের মতো বিমল করকে ধারাবাহিকভাবে পাঠ করতে হয়েছে একদিন। বুঝতে হয়েছে তাঁর গল্পবিশ্বকে। বুঝেছি, পেশাগত কারণে তাঁকে সমকালীন থাকতে হয়েছে তাঁর অনুজপ্রতিম সাহিত্যিকদের সমাবর্তনে। তিনি নিজেকে খুব বেশি পালটেছেন এমনটা নয়। তবে টানা চল্লিশ বছর গল্প লেখার পরে যখন তিনি তাঁর গল্প লেখা থেকে অব্যহতি নিলেন, তখন নতুন কোনও শূন্যতা তৈরি হয়নি। আর এইজন্য এই শিরোনামে ‘এবং’ অব্যয়ের ব্যবহার রাখতে হল। কারণ বিমল করের নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠী তাঁর জীবদ্দশায় পালটে গিয়েছিল। যাঁরা মূলত গপ্পের টানে গল্প পাঠ করেন। বিমল করের ছোটগল্পের জগত নিয়ে আলোচনায় কেউ কেউ তাঁর গল্প লেখার সাযুজ্যে মঁপাসা আর চেকভের গল্প লেখার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। কেউ আবার ১৯৫০ দশকের পেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বিমলের সাহিত্যকে বিচার করতে চেয়েছেন। আমার ব্যক্তিগত ঝোঁক এমন অ্যাকাডেমিক আলোচনা এড়িয়ে চলা।

বিমল কর সারাজীবন লেখকবৃত্তি নিয়েই কাটিয়েছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, যেদিন তিনি লিখতে পারেন না, সেদিন তাঁর মনে হয় সেদিনের রুটিটা তাঁর উপার্জিত নয়। নিজের লেখাকে এইভাবে দেখার দৃষ্টিকোণ পেশাদারিত্বের নমুনা। যা বারবার নতুনের দাবিকে বুঝে নিতে চায়। যেটা না হলে সৃষ্টির দৈনন্দিনতায় ভাঁটা পড়ে। এই কারণে যে লেখক ‘যদুবংশ’, ‘দেওয়াল’-এর মতো সাহিত্য রচনা করেছেন, তিনি গোয়েন্দা গপ্পো, হাসির গপ্পো, রহস্য গপ্পো, প্রেমের গপ্পো জীবনভর লিখে গেছেন।

জীবনের প্রথম পর্বে বিমল করকে আর্থিক দুঃখকষ্ট নিয়ে সাহিত্যজীবন চালাতে হয়েছে। পরের দিকে যেমন তাঁর আর্থিক স্থিতি এসেছে, লেখকজীবনেও এসেছে স্বীকৃতি। কিন্তু সেই স্বীকৃতি মূলত বণিক সভ্যতার বিভিন্ন দেনাপাওনা মিটিয়েই আসে। এসে থাকে। বিমল করের স্বীকৃতি একটু দেরিতেই এসেছে। তাঁকে নিয়ে যাঁদের সুখস্মৃতি আমরা পাই, তাঁরাও সকলে প্রায় সাহিত্যিক সহকর্মী। কিংবা অনুজ লেখক। যাঁদের লেখা তিনি বিশেষ পছন্দ করতেন। অর্থাৎ আড্ডাপ্রিয় মানুষটা নিজস্ব একটা ঘেরাটোপের ভেতরেই থাকতে স্বস্তিবোধ করেছেন। থেকেছেন। নিরীক্ষণ করেছেন মধ্যবিত্ত জীবনের ছোটখাটো ত্রুটি–বিচ্যূতিকে। সে–সব হয়ে উঠেছে তাঁর সাহিত্যের ভুবন।

বিমল কর তাঁর সাহিত্য নির্মাণে জটিলতাকে প্রশয় দেননি। বাক্যবিন্যাসে নিটোল থাকতে চেয়েছেন। এবং শেষাবধি একটা অতৃপ্তি জিইয়ে রেখেছেন। তাঁর এই মান্য স্টাইল পরবর্তীকালে বাংলা গল্পে এক পর্যায় পর্যন্ত বিশেষ আলোচিত ছিল। বিমল তাঁর সাহিত্যে সরাসরি রাজনীতির প্রসঙ্গ আনেননি। তাঁর অভিপ্রেতও ছিল না। তাঁর সাহিত্যদর্শন ছিল সম্পূর্ণ রাজনীতি-বিবিক্ত। তাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক অবক্ষয় তিনি রচনা করেছেন (যেমন তিনপর্বে লেখা ‘দেওয়াল’ উপন্যাস) রাজনীতিকে আড়ালে রেখে। লেখক চরিত্রের সম্পর্কের মধ্যে টানপোড়েন কিংবা অর্থ অর্থাৎ টাকাপয়সার কারণে মানুষের মানবিক দোষগুলো গোপন অসুখের মতো কেমন ক্রমশ ছোঁয়াচে হয়ে ওঠে তা দেখিয়েছেন। অথচ, কারণকে চিহ্নিত করেননি। সেই প্রসঙ্গ থেকে নিজেকে বিযুক্ত রেখেছেন।

বিমল কর তাঁর লেখায় বহু ক্ষেত্রে রহস্যকে উপাদান হিসাবে ব্যবহার করেছেন। অলৌকিক কিছু রহস্য উপাদান হিসাবে ছড়িয়ে আছে তাঁর সাহিত্যভুবনে। রোজকার জীবনে আমরা যে–সব অলৌকিকতার (এখানে শব্দটাকে লৌকিক নয়, এমন অর্থে ব্যবহার করা হল। এই ব্যবহারের সঙ্গে অতিন্দ্রীয়তার কোনও সম্পর্ক নেই) মুখোমুখি হই, তাকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন তিনি। এমনকি তাঁর কিশোর উপযোগী কিকিরা চরিত্র অথবা ‘কাপালিক আজও আছে’ উপাখ্যানে আমরা লৌকিকতার বিপরীতে অন্য এক উত্তর পেয়ে যাই। লেখক যে উত্তরটা হাজির করেন, তা আমাদের ইচ্ছাপূরণের সঙ্গে মানানসই। অর্থাৎ বিনোদনমূলক।

বিমল সাহিত্যকে দেখতে চেয়েছেন একজন দ্রষ্টার চোখ দিয়ে। কতকটা যেন ছককাটা চিত্রনাট্যের মতো। যেমন ‘দেওয়াল’ উপন্যাস প্রসঙ্গে তিনি আমার লেখা, নির্বাচিত রচনাবলী, ১ম খণ্ড-তে জানিয়েছেন:

যুদ্ধের সময় আমি কলকাতায় বারো আনা কাটিয়েছি। বউবাজারে কাকার বাড়িতে যখন থাকতাম, এ আর পি–র চাকরি করতাম, কলেজের খাতায় নাম লেখানো ছিল, তখন আমি এই শহরের এই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনের অনেক যন্ত্রণা ও গ্লানির চেহারা দেখেছি। সেই সঙ্গে দেখেছি তখনকার রাজনৈতিক আবহাওয়া, সামাজিক ভাঙন, মনুষ্য চরিত্রের লোভ লালসা, তার নৈতিক পতন, মানবিক মূল্যবোধের অপমৃত্যু।

বিমল করের সাহিত্যের স্পিরিটটা হল চেকভ-সদৃশ কিংবা গোর্কির মতো। পার্থক্য এই, তাঁর নির্মিতিতে কোথাও প্রবলভাবে ইচ্ছাপূরণের কথাও থেকে গেছে।

আজকের বাঙালির একমাত্র লক্ষ্য সফলতা। অথচ, সফলতার কোনও চালু মানদণ্ড বা সূচক নেই। পুরোটাই আপেক্ষিক। ফলে সফলতার কোনও শেষ নেই। আজ একে অন্যকে পায়ে নীচে পিষে নিজেকে তুলে ধরার নাম বিশ্বায়ন। তাই, সাফল্যের জন্য আমরা সবসময় হন্যে হয়ে দৌড়াই। বিবিধ প্যাঁচালো কায়দা করি। এই একই কারণে আজকের বাণিজ্যিক সাহিত্য, বিশেষত গদ্যসাহিত্যের হতশ্রী অবস্থা এত প্রকট। এত করুণ। কারণ, আজকের বাণিজ্যিক লেখকেরাও সফলতার জন্য সবসময় দৌড়ে যাচ্ছেন। তাঁদের যে খুব দ্রুত জনপ্রিয় হতে হবে। খুব দ্রুত কামিনী–কাঞ্চনের এই সমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে হবে। ফলে সেদিন বিমল কর সাহিত্যে বিনোদনের যে মানক তৈরি করেছিলেন, আজ তার প্রাসঙ্গিকতা পালটে গেছে। আজকের পাঠকও ইচ্ছেপূরণ চায়। তবে সেই ইচ্ছাপূরণে থাকে চটক আর চমক। থ্রিল। থ্রিলার। বিমল করের সাহিত্যে সেই থ্রিল না থাকায় তা তামাদি হয়ে গেল।

এই যন্ত্রণা কেবল বিমল করের নয়, তাঁর সমসাময়িক বহু জনপ্রিয় সাহিত্যিকের। এক সময় যাঁদের জীবনযাপন ছিল সম্রাটের মতো। যেমন একালেও বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক পরিবেশে (?) কিছু সামন্তপ্রভু সাহিত্যিক আর পত্রিকা সম্পাদক রয়েছেন। যাঁরা সফলতাকে মানত্য দেন। সার্থকতাকে নয়। সমস্যা হল এমন জমাকালো সাহিত্যজীবন বানিয়ে তোলা। জীবন থেকে বিযুক্ত। ফলে তার এক্সপেয়ারি ডেট থাকে। থেকে যায়। আজকের বহুপ্রজ বহুপঠিত সাহিত্যিকদের কাছে তাই বিমল করের নিঃশব্দ জন্মশতবর্ষ খানিকটা লাল সংকেতই বটে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...