বিদ্যারূপেণ… — অতিমারি ও আমাদের শিক্ষাঙ্গন

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

গত প্রায় দেড় বছরের অতিমারিকালে ২০২০-তে লকডাউন ও আনলক, ২০২১-এ আংশিক লকডাউন এবং পুনরায় আনলক পেরিয়ে সমস্ত কাজকর্ম ও পরিষেবা পুনরায় আরম্ভ হয়েছে। অকস্মাৎ চারপাশে তাকিয়ে দেখলে এই দুনিয়ায় কোভিড বলে কোনওকালে কিছু ছিল বলে মনে হয় না। শহর ও শহরতলির মানুষ পুজোর বাজার করতে ভিড় করছেন। মাত্র কয়েকমাস আগে রাজ্যে প্রথামাফিক বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, জননেতা ও নেত্রীরা যথারীতি পুনরাভিষিক্ত হয়েছেন। ইতোমধ্যে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে ও চলে গিয়েছে, স্থানে-স্থানে উপনির্বাচন হয়েছে, গণপরিসর ধাপে-ধাপে পুনরুন্মোচিত হয়েছে। বাকি সবই চালু হয়েছে, কেবল এখনও আমাদের শিক্ষাঙ্গনটি দ্বাররুদ্ধ।

গত মাসদুয়েক ধরে কোনও-কোনও রাজ্যে ধাপে-ধাপে স্কুল খোলার পালা শুরু হলেও, এ-রাজ্যে তা ঠেলে দেওয়া হয়েছে পুজোর পরে— নভেম্বরে। অবশ্য শুধু এ-রাজ্যেই নয়, গত ১৭ মাস ধরে ছাত্রছাত্রীদের কীভাবে পড়াশোনার চর্চার মধ্যে রাখা যায়, তা নিয়ে গোটা দেশেই তেমন কোনও উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা দেখা যায়নি। ইউনেস্কো-র সাম্প্রতিক হিসেব বলছে, প্রতি এক মাস স্কুল বন্ধ থাকলে ছাত্রছাত্রীরা প্রায় দু মাস পিছিয়ে যায়। সেই হিসেবের নিরিখে, এই ১৭ মাস স্কুল বন্ধ থাকার দরুণ শিশুরা প্রায় ৩৪ মাস পিছিয়ে গেল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

অধ্যাপক জঁ দ্রেজ-এর নেতৃত্বে ভারতবর্ষের ১৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রায় ১৪০০টি তুলনামূলক দুঃস্থ পরিবারের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছে। SCHOOL (School Children’s Online and Offline Learning) নামে সেই সমীক্ষার ফলাফল বলছে, গ্রামে ৩৭ শতাংশ ও শহরে ১৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা পুরোপুরি গিয়েছে কোভিডের গ্রাসে। সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন মাধ্যমে পাঠচর্চা চালু রাখার একটি বিকল্প পথ পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা কতিপয় সুবিধাপ্রাপ্ত ও তার বাইরের বিপুলসংখ্যক সুবিধাহীন পরিবারের মধ্যে সুযোগের বৈষম্যকে বহুগুণ প্রকট করেছে। ওই সমীক্ষা থেকেই জানা যাচ্ছে, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সুযোগ নিয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করতে পেরেছে শহরে ২৪ শতাংশ এবং গ্রামে মাত্র ৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। এর অর্থ, ২০১০ সালের শিক্ষার অধিকার আইন ও সাম্প্রতিক নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির মৌলিক ভাবনাভিত্তি যে সর্বজনীন শিক্ষার অঙ্গীকার, বাস্তবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা চলেছে তার সম্পূর্ণ উলটোপথে।

ভারতবর্ষের মতো দুর্বল আর্থসামাজিক পরিকাঠামোর দেশে, শিক্ষাঙ্গন শুধুমাত্র শিশুর শিক্ষার সঙ্গেই যুক্ত নয়, তা শিশুর পুষ্টির সঙ্গেও যুক্ত। অতিমারি ও লকডাউনে স্কুলে মিডডে মিল অনিয়মিত হয়েছে, যার ফলে অনেক শিশুর দুপুরের খাওয়াটুকুও ঠিকঠাক জোটেনি। পূর্বোক্ত সমীক্ষায় প্রকাশ, গ্রামে ১৪ শতাংশ ও শহরে ২০ শতাংশ শিশু কোনও মিডডে মিল/শুকনো খাবার/টাকা পাচ্ছে না। শুকনো খাবার যা দেওয়া হচ্ছে, তা স্কুল চলাকালীন পাওয়া মিডডে মিলের তুলনায় অনেক কম। অনেকক্ষেত্রে অতিমারি কোপ বসিয়েছে পারিবারিক আয়ে, তদুপরি স্কুল না-থাকায় বাড়িতে বসে বা খেলাধুলায় সময় কাটানো অনেক পরিবারেই বিলাসিতা, ফলত স্কুলছুট শিশুটি শ্রমিক হিসেবে যোগদান করেছে পাশের চায়ের দোকানে বা গ্রামের বাইরের ইটভাটায়৷

জঁ দ্রেজের সমীক্ষা আরও বলছে, ১০-১৪ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ বিনা পারিশ্রমিকে গার্হস্থ্য শ্রমে যুক্ত হয়েছে, ৮ শতাংশ পারিশ্রমিকসহ কাজ করছে। স্কুল পুরোপুরি না খুললে এই সমীক্ষা করা সম্ভব নয়, কিন্তু এটুকু নিশ্চিত যে অতিমারি শেষে স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের তালিকা প্রস্তুত করতে বসে আমাদের শিউরে উঠতে হবে৷ অতিমারির সময়ে বাড়িতে বন্ধ থাকা-কালে শিশুরা পারিবারিক নানা চাপ, এমনকি অত্যাচারেরও সম্মুখীন হয়েছে। চাইল্ডলাইন হেল্পলাইনে আসা ফোনের সংখ্যা ৫০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যার অধিকাংশই বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত অভিযোগ।

ওপরের আলোচনা থেকে এটুকু আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে এই মুহূর্তে আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্কট শুধুমাত্র শিক্ষাক্ষেত্রের মধ্যে আবদ্ধ নেই, এই সঙ্কটের অভিঘাত ও অনিবার্যতা শিক্ষাঙ্গন ছাড়িয়ে সমাজের গভীরতর স্তরে শিকড় নামিয়েছে। এমতাবস্থায়, আমরা শরণাপন্ন হয়েছি নানা শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞের। তাঁরা তাঁদের লেখায় যেমন সমস্যাটির বহুস্তর ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন, ঠিক তেমনি অতিমারি পরিস্থিতিতে ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে সমাধানের দিকনির্দেশ দিয়েছেন৷ স্কুল খোলার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও আমাদের দেশেই অন্যান্য রাজ্য কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে ও অতিমারি সংক্রমণকে কীভাবে মোকাবিলা করছে, তার তথ্য ও পরিসংখ্যান নিয়ে রইল চন্দ্রকান্ত লহরিয়া-র একটি সবিস্তার প্রতিবেদন৷ সেটি ছাড়া এই সংখ্যায় লিখেছেন, সুমন কল্যাণ মৌলিক, সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, স্বপন ভট্টাচার্য, অম্লান বিষ্ণু, শাওন এবং বিহঙ্গ দূত

অন্যান্য বিভাগের মধ্যে সাহিত্যিক বিমল করের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রইল একটি স্মরণ-আলেখ্য। শুরু হল অশোক মুখোপাধ্যায়ের একটি ধারাবাহিক নিবন্ধ। আর সমস্ত নিয়মিত বিভাগ— যেমন, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, বিশেষ নিবন্ধ, অন্যগদ্য, অণুগল্প, ফটোফিচার, অনুবাদ সাহিত্য, অণুগল্প এবং ধারাবাহিক উপন্যাস ও রচনাগুলিও থাকল। থাকল স্টিম ইঞ্জিন, সবুজ স্লিপার, ডিসট্যান্ট সিগনাল, হুইলার্স স্টল এবং ভালো খবর-এর মতো বিশেষ বিভাগগুলিও।

ভালো থাকবেন…

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে
দেবব্রত শ্যামরায়

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...