শিক্ষার ‘লক আউট’

শাওন

 

 



সমাজকর্মী, ‘অধিকার’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত

 

 

 

“যব সে করোনা মহামারি চল রহি হ্যায়, তব সে স্কুল বন্ধ হ্যায়।” গ্রামীণ এলাকায় তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠরত ৪২ শতাংশ শিশু উপরের বাক্যটির একটি শব্দও পড়তে পারেনি। ঝাড়খণ্ডের লাতেহার জেলার কুটমু গ্রামের উচ্চবর্ণের কিছু পরিবার সরাসরি বলছে— “দলিত আদিবাসী বাচ্চারা স্কুলে গেলে আমাদের জমিতে কাজ করবে কে?” ওই গ্রামের স্কুলে একজনই শিক্ষক, তিনি উচ্চবর্ণের। ইচ্ছেমত স্কুলে আসেন। ওখানে দলিত ও আদিবাসী শিশুদের কেউই ওপরের বাক্যটির একটি শব্দও পড়তে পারেনি। অধ্যাপক জঁ দ্রেজ-এর নেতৃত্বে SCHOOL (School Children’s Online and Offline Learning) সার্ভে থেকে উঠে এসেছে এরকম আরও ভয়াবহ তথ্য। সার্ভে রিপোর্টটি ছোট, এই বছর আগস্ট মাসে করা। সকলে পড়ে ফেলতে পারেন। ভারতবর্ষের ১৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রায় ১৪০০টি তুলনামূলক দুঃস্থ পরিবারের মধ্যে এই সার্ভে করা হয়েছে। রিপোর্টে উল্লিখিত আরও কয়েকটি শিহরিত হওয়ার মত তথ্য দিয়ে আমাদের রাজ্যের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার চেষ্টা করব।

  • গ্রামে ৩৭ শতাংশ ও শহরে ১৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
  • অর্ধেকের বেশি ছাত্রছাত্রী (গ্রামে প্রায় ৬০ শতাংশ) গত একমাস কোনও শিক্ষকের মুখ দেখেনি।
  • গ্রামে ১৪ শতাংশ ও শহরে ২০ শতাংশ শিশু কোনও মিড ডে মিল/শুকনো খাবার/টাকা পাচ্ছে না। শুকনো খাবার যা দেওয়া হচ্ছে তা স্কুল চলাকালীন পাওয়া মিড ডে মিলের তুলনায় অনেক কম।
  • ১০-১৪ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ বিনা পারিশ্রমিকে গার্হস্থ্য শ্রমে যুক্ত হয়েছে, ৮ শতাংশ পারিশ্রমিক সহ কাজ করছে।
  • প্রায় অর্ধেক ছাত্রছাত্রী একটি-দুটির বেশি শব্দ বানান করে পড়তে পারছে না।
  • লকডাউন ঘোষণার সময় ক্লাস টু থেকে থ্রি-তে উঠেছিল যে শিশু সে এখন সব ভুলে ক্লাস ওয়ানের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ তার ক্লাস ফাইভে ওঠার কথা।
  • ১০-১৪ বছর বয়সী শিশুদের সাক্ষরতার হার ৯১ শতাংশ থেকে কমে গ্রামের ক্ষেত্রে হয়েছে ৬৬ শতাংশ এবং শহরে ৭৪ শতাংশ।
  • স্মার্টফোনের আবশ্যিকতার ফলে নিয়মিত পড়াশোনা করতে পারছে শহরে ২৪ শতাংশ এবং গ্রামে ৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী।

পশ্চিমবঙ্গের ১৩টি জেলায় শিক্ষা চালু রাখার প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে ৩৬৯টি পরিবারের এবং ৭২০৪ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে একটি সমীক্ষা চালান ১০০ জনেরও বেশি প্রাইমারি শিক্ষক এবং কিছু শিক্ষাবিদদের একটি সংগঠন ‘শিক্ষা আলোচনা’। তাঁদের রিপোর্ট Learning Together: The Opportunity to Achieve Universal Education-এও উঠে এসেছে প্রায় একইরকম চিত্র। ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টির ব্যাপারে এই সমীক্ষা আরও ভয়াবহ কিছু চিত্র তুলে ধরেছে। মিড ডে মিলের প্রশ্নে আমাদের রাজ্যের দিকে নজর দিলে দেখব, এ রাজ্যে প্রত্যেক শিশুর জন্য (জুন, জুলাই ২০২১) মাসিক সরকারি বরাদ্দ ছিল ২ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ২৫০ গ্রাম মুসুর ডাল, ২৫০ গ্রাম চিনি, ১০০ গ্রাম সয়াবিন এবং একটা দশ টাকা দামের সাবান। মে, ২০২১-এ যে পরিমাণ ডাল, চিনি এবং সয়াবিন দেওয়া হত তা জুন থেকে অর্ধেক হয়ে গেছে এবং ১ কেজি ছোলা তালিকা থেকে বাদ গেছে। আগস্ট, ২০২১ থেকে সয়াবিন দেওয়া বন্ধ হয়েছে।

‘শিক্ষা আলোচনা’র সমীক্ষা একটি চিত্র তুলে ধরেছে। সমীক্ষায় উল্লিখিত পরিবারগুলির আয় লকডাউনের কারণে গড়ে ৩০.৮ শতাংশ কমেছে। লকডাউনের আগে ও পরে তুলনা করে দেখা যাচ্ছে যে খাদ্যশস্য, ডাল, মাছ, মাংস ও সবজি গড়ে প্রতি পরিবারে যথাক্রমে ১৩.৮, ২১.৮, ৩২.৯, ৪৩.৬ ও ২৪.১ শতাংশ কম খাওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ শিশুদের পুষ্টির ওপর গুরুতর প্রভাব পড়ছে। এমনিতেই আমাদের দেশ শিশুদের অপুষ্টির হারের বিচারে গোটা দুনিয়ায় বিখ্যাত, সাব-সাহারান আফ্রিকাও এ বিষয়ে আমাদের পিছনে আছে। লকডাউনে অবস্থা আরও শোচনীয় হওয়ার চিত্র সামনে আসার পর সরকার দিন দিন মিড ডে মিলের বাজেট কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে।

এই যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে থাকছে, আর অনলাইন পড়াশুনোর ভেলকি চলছে, এতে শক্তিশালী হয়ে উঠছে শিক্ষাক্ষেত্রে ধনী আর গরীবের বিভাজন, শিক্ষা আরও বেশি করে অর্থনির্ভর হয়ে পড়ছে এবং বেসরকারিকরণের দিকেই এগোচ্ছে। বস্তুত কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া শিক্ষানীতির লক্ষ্য ঠিক এটাই।

অর্জিত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, সেই অধিকার অনেক ক্ষেত্রে খাতাকলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও— গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষার অধিকার আইন, ২০০৯-এর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ৩(১) ধারা অনুসারে ‘মৌলিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করা অবধি ছয় থেকে চোদ্দো বছরের প্রত্যেক শিশু নিজের পাড়ার স্কুলে বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার পাবে’। সকলের জন্য শিক্ষার ধারণা গোটা দেশে যতটুকু প্রসারিত হয়েছে, নয়া শিক্ষানীতির মাধ্যমে তাকে নাকচ করে দিতে হলে তার একটা প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। সামাজিক স্বীকৃতির একটা ভিত্তি লাগে। বর্তমানে আমাদের রাজ্যে যেভাবে সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের সংখ্যা, স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা, শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে— তা থেকে এটা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে শিক্ষার অধিকার আইন, ২০০৯ অনুযায়ী ‘শিক্ষার মৌলিক অধিকার’ থেকে বিচ্যুত হয়ে বর্তমানে আমাদের রাজ্য ক্রমাগত কেন্দ্র সরকার প্রস্তাবিত ‘নয়া শিক্ষানীতি, ২০২০’-র বাস্তব রূপায়ণের দিকে এগোচ্ছে। ‘করোনা থেকে সতর্কতা’ এই সামাজিক স্বীকৃতির কাজ করে চলেছে।

যদিও সামাজিক স্বীকৃতির ব্যাপারটিও যথেষ্ট গোলমেলে, যেহেতু শপিং মল, রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল সহ প্রায় সব কিছুই খোলা, কিছু বিধানসভায় উপনির্বাচনও হয়ে গেল, উৎসবের প্রস্তুতিও পুরোদমে চলছে। তবু স্কুল খোলার প্রশ্নে রাজ্য সরকার এবং কিছু বুদ্ধিজীবীরা এখনও বিতর্ক করছেন। মনে রাখতে হবে, যে মস্ত ক্ষতি ছাত্রছাত্রীদের হয়েছে তা পূরণ করার জন্য, নতুন করে পড়াশোনা আবার স্বাভাবিক করার জন্য ধৈর্য্যের সঙ্গে প্রচুর কাজ করতে হবে, প্রশিক্ষণ লাগবে। কবে শিক্ষার অবস্থা অন্তত আগের মত হবে আমরা জানি না, অথচ এখনও বিতর্ক হয়ে চলেছে স্কুল খোলা নিয়ে। SCHOOL সমীক্ষার রিপোর্টই বলছে গ্রামীণ এলাকায় ৯৭ শতাংশ ও শহরে ৯০ শতাংশ অভিভাবক চাইছেন অবিলম্বে স্কুল খুলুক। ‘শিক্ষা আলোচনা’র রিপোর্টে যথার্থই বলা হয়েছে— ক্ষতির মাত্রাটা কোন পর্যায়ে গেছে সেটা স্কুল খোলার পরই পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হবে।

অবশ্য শুধু বিতর্কের মধ্যে ব্যাপারটা আবদ্ধ নেই। আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন সময় বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী, ছাত্র সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন স্কুল খোলার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন, আন্দোলন করেছেন। প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই তাঁদের গ্রেফতার করে অতিমারি আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। বাঁকুড়ায় কিছু ছাত্রছাত্রীকে তো অস্ত্র আইনে মামলা দেওয়া হল। বোঝা যাচ্ছে যে রাজ্য সরকার কোনও মতেই স্কুল খুলতে নারাজ। এই প্রেক্ষিতে সমাজের একটি শক্তিশালী অংশের থেকে আওয়াজ ওঠা প্রত্যাশিত ছিল। ধরা যাক, স্কুল বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে অসংগঠিত শ্রমিক কিংবা স্বনিযুক্ত ছোট কর্মীদের মতোই গত দেড় বছর ধরে দেশের সমস্ত গবেষণাগার, গবেষকদের ফেলোশিপ, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন বন্ধ থাকল বা কমিয়ে দেওয়া হল। তাহলে আন্দোলনের চেহারাটা আজ কেমন হত? শিক্ষক বন্ধুরা কি সেক্ষেত্রে আওয়াজ তুলতেন না? ডিএ বৃদ্ধির দাবিতেও তো তাঁদের অত্যন্ত সংগঠিতভাবে আন্দোলন করতে দেখা যায়। উদয়ন পণ্ডিতের উত্তরসূরিরা কি তাহলে ভারতের সাধারণ জনতার পক্ষ ছেড়ে, শুধুই আর পাঁচটা শাঁসালো চাকুরিজীবীর মতই ধনীদের পক্ষের হয়ে উঠলেন? তাঁদের সংগঠিত কন্ঠস্বরকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা সম্ভবত কোনও সরকারের নেই। এ কথা তাঁরাও বিলক্ষণ জানেন। তা সত্ত্বেও এই আশ্চর্য মৌনতা সত্যিই হয়তো সামাজিক ব্যাধির প্রকটতাকেই চিহ্নিত করছে। আমরা আশা রাখি যে তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবছেন, সংগঠকের কাজ করছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আমরা ‘শিক্ষা আলোচনা’র সমীক্ষার কয়েকটি দিক উল্লেখ করলাম মাত্র। লকডাউনের মধ্যেও শিশুদের শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না করার অদম্য প্রচেষ্টা, শিক্ষাপদ্ধতির অভিনবত্ব, স্কুল খোলার পর কী কী করণীয় তার অনুসন্ধান করা ও ধারণা দেওয়া এবং সবশেষে আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া যে জনশিক্ষা একটা সামূহিক দায়িত্ব— এই সবই তাঁরা যে নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন তাতে আশা করার কারণ আছে যে উদয়ন পণ্ডিতরা হারিয়ে যাননি নিশ্চয়ই। তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, নিজেদের দায়িত্ব পালন করা এবং সরকারকে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করানো— এই দুটি কাজের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই, বরং একে অপরের পরিপূরক।

অর্থাৎ, প্রথমত শিক্ষা নিয়ে ও স্কুল খোলা নিয়ে গণ-আলোচনা ও গণ-আন্দোলন একটা জরুরি বিষয় হিসেবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্কুল খুলে গেলেই এই আলোচনা ও আন্দোলনের পরিসর ও প্রাসঙ্গিকতা থেমে যাচ্ছে না। প্রশ্নটা শুধু স্কুল খোলার নয়। যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে ও হয়ে চলেছে সেটা মেরামতের কাজে হাত লাগানো এবং সামগ্রিকভাবে শিক্ষা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের কাজে হাত লাগানো— দুটোই জরুরি। বলা চলে যে, নাগরিক সমাজ ও সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনের কাছে ইতিহাস এই দীর্ঘমেয়াদি বৃহত্তর কর্মসূচির দায়ভার আরোপ করেছে। একে এড়িয়ে যাওয়া চলে না।

শেষ করব অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ও জঁ দ্রেজ-এর ২০১৩ সালের বই An Uncertain Glory, India and its Contradictions (বাংলা: ভারত— উন্নয়ন ও বঞ্চনা) থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করে—

সুবিধাভোগীরা সাধারণভাবে বেশ ভাল ফল করে, তাদের কৃতিত্ব এই যে, তারা সুযোগ নষ্ট করে না। এদের সাফল্য সর্বপ্রথম দেখা দেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতেই, তার পর ক্রমশ তা গোটা বিশ্বের পরিসরে উন্মোচিত হয়, এবং ভারতীয় ও বিদেশি উভয়েরই সম্ভ্রম জাগায়। এর পর দেশ মহোৎসাহে এই ‘জাতীয় সাফল্য’ উদযাপন শুরু করে। তদুপরি, এই ফার্স্ট বয়রা, এবং ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় ফার্স্ট গার্লরাও, ‘দেশকে গর্বিত করার জন্য’ পাওয়া বিপুল শ্রদ্ধার্ঘ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে থাকে, অবশ্যই মানানসই বিনম্রতার সঙ্গে। আর, এরই মধ্যে লাস্ট বয়, এবং বিশেষত লাস্ট গার্লরা, মোটামুটি ভদ্রস্থ শিক্ষার অভাবে এমনকি পড়তে লিখতেও পেরে ওঠে না।

নাগরিক সমাজ তার সামাজিক দায়িত্বটি এড়িয়ে গেলে, বিগত কয়েক দশকের সামান্য অগ্রগতিটুকু নস্যাৎ করে দিয়ে এই অসাংবিধানিক স্কুল ‘লক আউট’ উপরের চিত্রকেই স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...