নৈরাশ্যের অবসাদ থেকে সক্রিয়তার আশা

অম্লান বিষ্ণু

 



শিক্ষক, সমাজকর্মী

 

 

 

২০২০-র আগস্ট মাস। প্রথম লকডাউন পেরিয়ে তখন সরকারি আনলক পর্ব শুরু হয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক প্রাথমিক শিক্ষক একদিন সকালে দেখলেন, এক কিশোর গ্রামের রাস্তায় কিছু একটা ফেরি করার চেষ্টা করছে। বাহন, পুরনো সাইকেল, তাতে ঝোলানো একটা ছোট্ট ক্যান। মাস্টারমশাইর কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে ছেলেটা জানায়, সে মিষ্টি বিক্রি করে। এলাকার ময়রার কাছ থেকে অল্প কিছু মিষ্টি কিনে ফেরি করতে আসে। সে এলাকারই একটি বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনের ছাত্র। স্কুল বন্ধ, অসুস্থ বাবা দীর্ঘদিন কাজ করতে পারেন না। এদিকে কোভিড অতিমারির কারণে মায়ের কাজ চলে গেছে! অথচ বাড়িতে ঠাকুমা, ঠাকুর্দা ও ছোট বোন সহ ছটা পেট! অগত্যা নবম শ্রেণির কিশোরটির উপরেই এখন সংসারে উপার্জনের দায় বর্তেছে।

গত দু-বছরে ভারতের নানা প্রান্তের এমন হাজার হাজার ঘটনাবিন্দু জুড়ে জুড়ে সিন্ধু রূপ পেয়েছে। কিন্তু সরকার পাথরের মত নীরব! শুধু কি সরকার? আমরাই বা কতটুকু করতে পেরেছি? লোক সমুদয়ের যে একটা বিশেষ সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা আছে, সে-কথা কি আদৌ মানি আমরা?

সম্প্রতি শিক্ষকদের মঞ্চ ‘শিক্ষা আলোচনা’র সমীক্ষা লার্নিং টুগেদার-ও সেই প্রশ্ন-চর্চার কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কী আছে এই সমীক্ষায়? পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার মূলত গরিব, প্রান্তিক ও শ্রমজীবী পরিবারের ৭,২০৪ জন শিক্ষার্থী ও ৩৭৯টি পরিবারকে নিয়ে এই সমীক্ষাটি করেছেন প্রায় কয়েকশো সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক। এই অতিমারিতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ও মানসিক অবস্থা, তাদের পরিবারের অবস্থা কী – এসব জানার জন্যই সমীক্ষা। সমীক্ষার ফলাফল, এক কথায় বলতে গেলে, খুবই উদ্বেগের! অতিমারির প্রায় পৌনে দু বছর পুরো সমাজজীবনকে যেমন ওলট-পালট করে দিয়েছে, তেমনি শৈশব-কৈশোরকেও ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারের অতলে। যদিও এসবই চর্বিত চর্বণ। সবটাই সবার জানা। কিন্তু আমাদের অনুভূতির গোড়ায় যে মরচে জমতে শুরু করেছে দীর্ঘদিন ধরে, তা ঝেড়েমুছে ফেলার অভ্যাস তো কবেই ভেসে গেছে ভাগীরথী-অলকানন্দার জলে! সুতরাং, যতদিন না পর্যন্ত ‘আমি’ সরাসরি আক্রান্ত হচ্ছি, ততদিন কেবল নৃত্যে-গীতে মজে থাকলে অসুবিধা কোথায়? কিছুদিন আগে বাংলাদেশ নিবাসী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একটি সভায় কথাপ্রসঙ্গে বলছিলেন যে, তিনি যখন বিভিন্ন বই পড়ার ব্যাপারে লোকেদের কাছে জানতে চান, তাঁরা সোৎসাহে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেন। কিন্তু যখনই তিনি সেই বই সম্পর্কে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে উদ্যোগী হন, তখন তাঁরা সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চান। সেই সভায় অধ্যাপক আবু সায়ীদ খেদের সঙ্গে বলেন, “আসলে আমি বুঝতে পারি, তাঁরা বইটি দেখেছেন কিন্তু পড়েননি!”— আমাদের অনেকেই এই অতিমারিকে দেখেছি, এখনও দেখছি কিন্তু পড়ে, বিশ্লেষণ করে আমাদের করণীয় কী তা ঠিক করতে পারছি কি? অন্যরা তো আছেনই, এমনকি শিক্ষকদের একটা অংশও তো বেশ সুখেই আছেন!

তবে এর একটা উজ্জ্বল উল্টো দিকও আছে। ‘শিক্ষা আলোচনা’র সমীক্ষায় সেদিকটাও উঠে এসেছে। বেশকিছু শিক্ষক, অধ্যাপক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং অল্প সংখ্যক হলেও স্থানীয় কিছু মানুষ নির্দিষ্ট এলাকার শিশুদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে বিকল্প পথের খোঁজ চালু রেখেছেন। প্রতিবেদনের মুখবন্ধে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী এই বিষয়টির উপরেই জোর দিয়ে বলেছেন, “করোনা অতিমারিতে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়বে। তাই স্কুল খুলে গেলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন ভাবার কারণ নেই। বরং তখন আমরা প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ বুঝতে পারব।” অধ্যাপক চৌধুরীর কথায়, “বিদ্যালয় শিক্ষার পাশাপাশি সমুদয়ের অংশগ্রহণও জরুরি। স্বেচ্ছা-শিক্ষক হিসেবে এলাকার সচেতন মানুষের নিয়মিত বিকল্প পঠনপাঠন চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই শিখন ফাঁক পূরণ করা বেশ খানিকটা সম্ভব।” লার্নিং টুগেদার পড়তে পড়তে আমরা প্রান্তিক, খেটে খাওয়া মানুষের চরম দুর্দশার পাশাপাশি কিছু কিছু অন্যরকম ভাবনার মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসটাকেও দেখতে পাই। পূর্ব মেদিনীপুরের এক শিক্ষক লিখছেন, তাঁদের স্কুল বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, তাই লকডাউনের সময়ে স্কুলে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছিল না। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাওয়ার উপরেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। ফলে তাঁরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কিছুতেই যোগাযোগ করে উঠতে পারছিলেন না। স্কুল প্রত্যন্ত এলাকায়, আর সেখানে যেহেতু বেশিরভাগ ‘দিন আনি দিন খাই’ লোকের বাস, ফলে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও খুবই সীমাবদ্ধতা ছিল। তাই উপায় না দেখে তাঁরা প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেন। তাদের মাধ্যমেই শুরু হয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ। সামান্য হলেও কিছুটা অন্তত পড়ালেখার আদানপ্রদান শুরু করা সম্ভব হয়। এলাকার গৃহশিক্ষকদেরও তাঁরা বিনা পারিশ্রমিকে একেবারে কর্মহীন পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর ব্যাপারে রাজি করাতে পারেন। আসলে, ঠিক এই সামগ্রিক ও সামাজিক যোগদানকেই পুস্তিকাটির পূর্বকথনে বৃহত্তর আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী। প্রতিবেদনের পাতা উল্টোতে গিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে দেখি শিক্ষার্থীদের ২৮ শতাংশ এই পৌনে দু বছর-এ শিক্ষকদের কাছ থেকে কোনও সুবিধা নিতে পারেনি। এদের এখনই আমরা স্কুলছুট বলে দিতে পারছি না ঠিকই, তবে শিক্ষক এবং লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত এমন লোক বা অন্যরাও অনেকেই জানেন যে এরা অনেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিক, দিনমজুর হিসেবে যুক্ত হয়েছে। স্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকেই লেখাপড়ার সঙ্গে এই শিক্ষার্থীদের অনেকেরই যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং সবকিছু আগের মত স্বাভাবিক হয়ে গেলেও এরা নিয়মিত স্কুলে পৌঁছাতে পারবে কিনা সে বিষয়েও গুরুতর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সমীক্ষকরা লক্ষ করেছেন যে যে এলাকায় পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির হার বেশি, সেখানে লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিশেষ করে আমরা যখন দেখতে পাচ্ছি যে, এই অতিমারিতে রাজ্যজুড়ে মাছ, মাংস খাওয়ার পরিমাণ কমেছে যথাক্রমে ৩৩ ও ৪৪ শতাংশ। ডাল ও সবজির পরিমাণ সঙ্কুচিত হচ্ছে ২২ ও ২৪ শতাংশ। সরকারি রেশন ব্যবস্থার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও  চাহিদা অনুযায়ী আটা ও চালের জোগান ১৪ শতাংশ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ। মোট আয়ের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৩১ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থনৈতিক সঙ্কটের মাত্রা আন্দাজ করতে নিশ্চয়ই এই তথ্যগুলোই যথেষ্ট। বুদ্ধি খরচ করে খুব একটা বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না।

কথায় কথায় উত্তর ২৪ পরগনার একটা ঘটনার কথা মনে এল। হাবড়ার এক বন্ধু এই অভিজ্ঞতার কথা সোশাল মিডিয়াতে তুলে ধরেছিলেন। লকডাউনের প্রথম দিকে তখন সবে একে একে মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। পাড়ায় হরেক কিসিমের ফেরিওয়ালার দেখা মিলছে। কয়েকদিন ধরে তাঁদের পাড়ায় প্যান্ট শার্ট গুজে, পায়ে ভাল জুতো পরে ঠ্যালা নিয়ে এক ভদ্রলোক আসছিলেন। সবজি সহ আরও অনেককিছু নিয়ে। কথা কম বলেন। কিছু কিনতে গেলে চটজলদি কাজ সেরে এগিয়ে যান। ভদ্রলোকের মাথায় টুপি, চোখে সস্তার সানগ্লাস, মাস্কে মুখ ঢাকা। দেখে মনে হয় সংক্রমণ আটকানোর ব্যাপারে খুব সচেতন। হঠাৎ একদিন ভদ্রলোক ফেরি করতে এসেছেন। কথকের পাশের গলি থেকে এক ভদ্রমহিলা তার ছোট মেয়েটিকে নিয়ে বেরিয়ে এসে পাতিলেবু আছে কিনা জানতে চাইলেন। ভদ্রলোক ‘নেই’ বলে এগিয়ে চললেন। কিন্তু ততক্ষণে ওই ঠেলাগাড়িতে থাকা পাতিলেবুগুলো ভদ্রমহিলার চোখে পড়ে গেছে। তিনি তো নাছোড়বান্দা! পিছু পিছু গিয়ে পাতিলেবু দেখিয়ে, তাঁর কাছে না বিক্রির কারণ জানতে চাইলেন। এরপর ভদ্রমহিলা আপাদমস্তক লোকটিকে লক্ষ করে বললেন, ‘আপনি ক্যামেলিয়ার বাবা না?’ ভদ্রলোক ধরা পড়ে গিয়ে টুপি ও সানগ্লাস খুলে ম্লান হেসে বললেন, ‘সেই জন্যেই তো আপনাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম বৌদি!’ জানা গেল ওই ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক উভয়ের মেয়েই একই স্কুল এবং গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে। লকডাউনে বন্ধ থাকায় ভদ্রলোক যে কোম্পানিতে চাকরি করেন তারা মাইনে বন্ধ করে দিয়েছে। সেই কারণে তিনি এই কাজ করছেন। মেয়ে খুব অভিমানী তাই তাকে তিনি সত্যিটা বলার সাহস অর্জন করতে পারেননি। মেয়ের মা অবশ্য সত্যিটা জানে। এর সঙ্গে মিল আছে এমন অনেক ঘটনা ‘শিক্ষা আলোচনা’র সমীক্ষায় উঠে এসেছে। আসলে, সত্যিটা রূঢ় হলেও সেটার মুখোমুখি হওয়াটাই যে বাস্তবতা; সেই চর্চায় অনেকদিনের জমে থাকা ধুলোকেও হেলায় উড়িয়ে দিয়ে গেছে এই অতিমারি। হতাশা-ই যে কখনও ‘আশা’র আধার হয়ে উঠতে পারে সে বিশ্বাসও জাগাতে পেরেছে এই দুঃসময়।

এরই মাঝে আরও আশার কথা হল, এই সময়ের মধ্যে কেবলমাত্র শিক্ষকদের তরফেই নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরে লেখাপড়া চালুর ব্যাপারে আওয়াজ তো উঠেছেই, এমনকি নাগরিকদের একটা অংশ একেবারেই নিজস্ব উদ্যোগে নিয়ম করে শিক্ষার্থীদের পঠনপাঠন চালু করেছেন। এই ধরনের বিভিন্ন প্রচেষ্টাকে একসূত্রে গেঁথে নিয়েই সাফল্যের পথে এগোনো সম্ভব। তাই প্রতিবেদনটিতে সার্বিক শিক্ষার সুযোগ-এর কথা বলা হয়েছে। লার্নিং টুগেদার থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে ‘শিক্ষা আলোচনা’র বন্ধুরা স্বেচ্ছা-শিক্ষকদের সুবিধার জন্য একটা সহজবোধ্য মডিউল তৈরির ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করছেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শেখার ফারাক কমানোর জন্য পূর্বের ও বর্তমান পাঠের সঙ্গে মিলিয়ে কীভাবে দ্রুত তাদের পার্থক্য কমিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে কিছু বার্তাও আমরা এই প্রতিবেদন থেকে পেতে পারি। পারস্পরিক এই উদ্যোগ বা যৌথখামারই তো জাতিকে উন্নত করে তোলে। আর এর মধ্যেই আছে সমস্যা থেকে নিস্তার পাওয়ার জিয়নকাঠি। সর্বজনীন শিক্ষার যে সুযোগের কথা সমীক্ষকরা তুলে ধরলেন, সেটা আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। সমাজের সব স্তরের মানুষের যোগদান নিশ্চিত করতে পারার প্রয়াসকে বন্ধ করে দেওয়ার যে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ তার উপরে এই সম্মিলিত সামাজিক প্রয়াস যে কুঠারাঘাত করবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

অধ্যাপক চৌধুরী লিখছেন—

এই সমীক্ষা এমন কিছু বাস্তব ও যুক্তিযুক্ত পথ দেখাতে চাইছে, যা আমাদের শিক্ষার্থীদের কেবল শিক্ষাবিজ্ঞান মেনে শেখাবেনা বরং সবদিক থেকেই তাদের ভাল থাকার সুযোগ করে দেবে। আমরা ভাগ্যবান যে আমাদের রাজ্যে এমন একদল শিক্ষক আছেন যাঁরা এই দুঃসময়েও বড় কিছু ভাবতে পারেন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের রেখা প্রস্তুত করতে পারেন। আমাদের শিশুদের বাঁচাতে, জাতিকে বাঁচাতে এঁদের ব্যর্থ হতে দেওয়া যায় না!

সত্যিই, সবাই মিলে যখন নতুন করে সেতু গড়ার সুযোগ এসেছে, অন্ধকার যতই থাক সেটা তো আর হাতছাড়া করা চলে না!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...