Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এ মাসের কবি: অনিন্দিতা গুপ্ত রায়

এ মাসের কবি: অনিন্দিতা গুপ্ত রায় । আলোচনা: অরিত্র সান্যাল

অনিন্দিতা গুপ্ত রায়ের কবিতা

 

অন্তরে, অন্তরীণে…

 

পর্ব # এক

ফ্রেমের ভিতর থেকে তাকিয়ে আছি
কাচের এপার থেকে
অপলক মনি ভেদ করে
ঢুকে যাচ্ছে অশরীরী হাওয়ার আঙুল
নড়ছি না, কাঁদছি না, দেখছি না
নিজেকে টাঙিয়ে রেখেছি দেওয়ালে
সময় দূর থেকে গুনছে সংখ্যা
ক্যালেন্ডার অনাবশ্যক লাট খাচ্ছে ধুলোয়।

 

পর্ব # দুই

একথালা সাদা ভাতের এপাশে ওপাশে হলুদ সবুজ সবজি শুয়ে আছে। মাঝখানে চাকা করে কাটা এক টুকরো বেগুনভাজা। আচমকা জাতীয় পতাকার কথা মনে পড়ে। খিদে লেগে আছে তার গায়ে। বন্ধ দরজার ওপাশে কে যেন নড়ে ওঠে, সরে যায়। স্তব্ধ দুপুরই বুঝি…অবরুদ্ধ অলস বেলায়!

 

পর্ব # তিন

সকাল দুপুর বিকেল
খিদে কান্না ক্লান্তি
সমস্তই কিরকম গতানুগতিক।
ঢেকে রাখা মুখের আড়াল
কথা ও স্পর্শ থেকে দূরে
সন্ধে আসে, নিরুত্তাপ…
গৃহস্থালির চৌকাঠ জুড়ে
উদ্বেগ ঘন
ঋতুবদলের খোঁজ নিয়ে আসা
হাওয়া ফিরে চলে যায়
রাত্রিও এসে পড়ে নিয়ম মেনেই

শুধু ঘুম আসে না

 

পর্ব # চার

দুয়েকটা হরিণ, হাতির পাল এক আর কিছু ময়ূর। জনশূন্য পিচ রাস্তার ওপর বাদামী ঝরা পাতায় আলগোছে দুপুরের রোদ মাখছিল। নতুন পাতার রঙ সামান্য ঘন হয়ে মায়াবী এখন। পাখি ডেকে ওঠা স্তব্ধতার গায়ে এসে বসছিল ঝিঁঝিঁ গান, প্রণয়কাতর। এরকম একটি দুপুরকেই নাকি অনন্ত নামে ডাকা হয়…

মানুষ ছিল না বলে প্রকৃতিও জানেনি তখন।

 

পর্ব # পাঁচ

পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যটি
সবচেয়ে বড় দায়িত্বে আপাতত

দূর থেকে আকাশের তারা দেখার মত…অন্য শহর থেকে আমি, অপরাধী খুব, স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকি। দেখি খেলনাবাটি সামলে চুল বাঁধে নি ছোট্ট মেয়েটা সারাদিনে। দেখি কবে যেন আকাশের মত বড় হয়ে গেছে তার মায়াবী ডানা। দেখি তারই নিচে সে প্রাণপণ আগলে রাখছে আমাদের মা-পাখির টলোমলো উড়ান! তরকারি কাটতে কাটতে আঙুল কেটে ফেলি আমি। রক্ত ঘন হতে দেখি।

জিজ্ঞেস করতে ভয় পাই: তোমরা ঠিক আছো তো, বলো?
তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে তো মা, বলো?

 

পর্ব # ছয়

পরিমিতি অভ্যেস করি
অনাবশ্যক ভার হয়ে আছে কত কিছু
টের পেয়ে ছাঁটি– খিদে ঘুম কথা
অথচ দুচোখ উপচে আসা অকারণ জল
দিনে দিনে বেড়ে যায় শুধু…
অন্য অঙ্কগুলো শিখে ওঠা হয় না কখনও!

 

পর্ব # সাত

সমস্ত আনাজ একইভাবে কেটে নিও। লম্বালম্বি চিরে মাঝখানে ফালা… ঠিক
যেরকম গোপন চিঠি ছেঁড়া হত কলঘরে!

খোসা ফেলবে না, গোলাপি খামের মত সরিয়ে রাখ আপাতত। সামান্য পোস্ত ছড়িয়ে ঝুরো ঝুরো ভেজে নিও পরে, অরুচি সারাবে– গেরস্থালির নুনে জিভ ভারী হলে। রাঁধুনি ফোড়ন এর গন্ধে  পাড়া ছাড়িয়ে যাওয়া ঝাঁঝে

যতক্ষণ না ক্ষোভ আনমনা হচ্ছে, নিভে আসছে, ততক্ষন কষতে থাকো। পুড়ে আসার আগেই জল ঢেলে দিও।
না হলে সমস্তই তেতো, ব্যঞ্জনই বলো বা সম্পর্ক!

 

পর্ব # আট

বিকেল নামার আগে মেঘ নেমে আসে। পূর্বাভাসে ভ্রুকুটি গভীর বুঝে বাসা ঘিরে গোল গোল উড়ে যায় চিল দম্পতি। নারকেল পাতার উচাটনে শেষদুপুর ভুল করে গোধুলি লেখে । ভয়ের বৃত্ত বড়ো হতে দেখি। অসময়ে সূর্য ডুবলে শীত খুব স্নায়ুর ভিতর। হাওয়ার শব্দ, বরফকুচির রূঢ় ঝরে পড়া…বুকের খাঁচায় আছড়ালে, কুয়োর গভীরে নেমে যায় ঘড়া ভরা জল… আচমকা দড়ি ছিঁড়ে। ফাঁকা চরাচরে শুধু হাওয়া শুধু ধুলো শুধু উড়ে আসা খড়কুটো। যেন এযাবত প্রয়োজন ভেবে যত জঞ্জাল জমিয়েছি বৃথা… উড়ে উড়ে চলে যায় বৃষ্টি মাথায় একা ভবঘুরে!

 

পর্ব # নয়

মুঠোর ভিতর বন্দি যে বাতাস তালু খুলে মুহূর্তে নিরুদ্দেশ তার স্বাধীনতার গায়ে কোন ডাকটিকিট বা নিশান নেই। দোয়াত উলটে দিনান্তের কালি গড়াচ্ছে নিভে যাওয়া মেঘলা লেবুপাতার ভাঁজে। লালবারান্দার পাশে অন্যমনস্ক বেড়ালছানার নিঃসঙ্গ চেয়ে থাকা আরেকটু পরেই কিরকম খর হয়ে উঠবে। নিয়ন আলোর নিচে অজস্র চড়ুই ঝাঁপ দিয়ে দিয়ে ধরতে চাইছে মৃত্যুতাড়িত বাদলপোকার ওড়াউড়ি।

দিনের শুরু নাকি শেষ– সে হিসেব ভুল হয়ে যাচ্ছে ওদেরও?
চশমা, দস্তানা ও মুখোশসবিহীন শিরিষ গাছ
সন্ধে মাথায় হা হা হেসে উঠছে শুধু।

 

পর্ব # দশ

এই স্পর্শরহিত অন্ধকারে
যখন বাতাসও ঢেকে নিচ্ছে মুখমাথাচোখকান…
সেসময় ওরা খুব হাতে হাত সন্ধ্যাতারার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে যুগ্মগান।
উড়িয়ে দিচ্ছে নাম লিখে রাখা কাগজের উড়োজাহাজ।
কথাদের মৃত্যু হলে মাঝখানে বেড়ে ওঠে জল, সেতুহীন।
মাটির স্পর্শ ছাড়া মরে আসে গাছ।
ওরা, এইসব সম্ভাবনাহীন আমাদের অপেক্ষারা…
পরস্পর ছুঁয়ে থাকে শর্তবিহীন।
আমরাই জানি না শুধু কতখানি স্তব্ধ হলে সব কথা বুঝে নেওয়া যায়!

 

পর্ব # এগারো

মুখে বলতে হবে না
আমি ঠিক বুঝে নেব।
যেভাবে পাখি বুঝে নেয় পাড়ের ঠিকানা,ভোরের সংকেত
পিঁপড়ে জানে বৃষ্টিসম্ভাবনা
আর চিনির পাহাড় যেতে কতখানি পথ…
না বলার ভেতরে যা যা বলা থাকে
বুঝে নিয়ে খুব স্তব্ধতায় পৃথিবীর গভীর অব্ধি
নামিয়ে দেব শিকড়বাকড়ের মায়া!
যেকোন মুহূর্তে চলে যেতে হয় যদি, যাবো।
তার আগে বলি শোনো… কতখানি পলি জমে আছে
কথার ভিতর
দেওয়ালগুলো আয়না হয়ে ওঠা দেখি আর লিখি বরং অসংলগ্ন রোজনামচা, গাছগাছালির ছটফট
জল দিতে দিতে ফিসফিস করি… আমি তো ডানাই দিয়েছি
আকাশ ছোঁবে নাকি সিলিং, ঠিক করে নিও।

 

পর্ব # বারো

হিসেবের খাতা নেই কোনো জমাখরচেরও না
ইচ্ছেমত দুপুর আর সকালকে জায়গাবদল করে দিই খেলাচ্ছলে
অনিয়মের হাওয়ায় উড়ে পড়ে বসন্তবৌরির হলুদ পালক…
মুঠির মাপ তুচ্ছ করেই হাত বাড়াই, ডানার বিভঙ্গে ভাবি আকাশ।
নিয়মবিহীন ভালবাসি।
রাগ দুঃখ অভিমানের ছদ্মবেশে
যা যা এসে দরজায় দাঁড়ায়
তাদের সবার পোশাকি নাম, ভুল পরিচয়…
ভ্রমের জানলা খুলে রেখে যায়, নিয়ম মতই।

বন্ধদিনের এই গান শেখাক…
আসলে নিয়মমাফিক বাঁচতে চাইনি কেউই, মরতেও না।

 

পর্ব # তেরো

স্পর্শ কুড়োতে কুড়োতে এতদূর…..

তিস্তা   ভুবনডাঙা    দেবদারু   বৃষ্টি    কৃষ্ণচূড়া   ক্যাকটাস  বেড়ালছানা     নুড়িপাথর   ধুলো    ছেঁড়াঘুড়ি    ধোঁয়া   স্টেশনচত্বর    কুয়াশা    স্বদেশ    রৌদ্র     মেঠোপথ    লিখিত-অক্ষর     ঘৃণা    চুম্বন     কানের লতির তিল    উল্লাস   ঝুরোফুল   আলো    বিষাদ  সমুদ্রতীর  জেলেডিঙি   রুমালচুরি    চিঠিরখাম   কাজললতা  আলপথ   চিলেকোঠা  গানেরখাতা    ব্ল্যাকবোর্ড   স্কুলবাড়ি   শস্যদানা     আগুন    বরফ    মাটি    চা-দোকান    সহজপাঠ   নাগরদোলা    ক্ষুধা    প্রেম   কান্না    আলসেমি   নিশান   সন্তানের মুখ    ভোর    অপেক্ষা   স্বপ্ন…

আরো আরো সহস্র অযুত সংখ্যাতীত…

কিছুই সন্দেহাতীত নয় জেনে স্পর্শসীমার বাইরে কতদূর যাব এরপর!

 

পর্ব # চোদ্দ

আস্ত একটা চিড়িয়াখানার মধ্যে
লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা।
নিজের ছায়ার পিছু দৌড় দিয়ে দিয়ে নেচেকুঁদে একাকার ।
মুখভঙ্গির মোহে আয়না ঘুরিয়ে দেখে…আহা মুগ্ধতা!
ঘড়ির কাঁটার স্থির চেয়ে থাকা
রোদ আর ছায়া মাপতে মাপতে টিকটিক হাসে
সমবেত হাসি ভেসে আসে
হো হো হি হি হা হা…

হাহাকার ভেবে আমি ভাতঘুম ভেঙে উঠে রুমাল বাড়াই অহেতুক।


কুয়াশার কথকতা: অনিন্দিতা গুপ্ত রায়ের কবিতা

অরিত্র সান্যাল

 

ভাস্কর্য বা চিত্রের দিকে তাকিয়ে থাকা আর কবিতার দিকে বা কবিতার কোনও অংশের দিকে তাকিয়ে থাকার মধ্যে একটি স্বাভাবিক মিল আছে, ঠিক যেরকম আছে একটি মূলগত পার্থক্যও। পার্থক্যটি খুব সম্ভবত এই কারণে যে – কবিতার ভাষা শব্দ নির্মিত – যে শব্দ আমাদের নিত্য ব্যবহার্য; আমাদের চেতনার উপাদান, তাকে রঙ; মৃত্তিকা বা পাথরের মতো চোখে দেখা যায় না। অথচ ধরা যাক, ‘কুয়াশার কথকতা’ – যে শব্দবন্ধটিকে আমি আবিষ্কার করি অনিন্দিতা গুপ্ত রায়ের ‘শ্রাবণজল, আমাকে নাও’ কাব্যগ্রন্থে – এই ‘কুয়াশার কথকতা’-র দিকে তাকিয়ে থাকলে একটি ম্যুরাল; একটি মূর্তি; আর একটি শব্দ-নির্মানকে দেখবার ধরণের মধ্যে যে একটি চরিত্রগত সাদৃশ্য আছে – তা উপলব্ধি করা যায়। তার কারণ কি এটাই নয় যে – ছবিটির থেকে, ভাস্কর্য থেকে, প্রকৃত কবিতার থেকে যে বোধ উঠে আসে সেটি আর ছবিটির মধ্যে, ভাস্কর্যের মধ্যে, কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না? কবিতা কবেই বা নিজের আয়তনের মধ্যে বন্দী থেকেছে?

একটু একটু করে মাটি ভাঙছে/ বিভ্রমের কালো জল/ ফুঁসে উঠে গিলে ফেলছে ঘর/ নিকোনো উঠোন, শাঁখাপরা হাত/ পিছলে যাওয়া সময় ভাঙছে দ্রুত/ হঠাৎ হাওয়ায় তারিখগুলো এলোমেলো/ পাঁজরের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে/ হেঁটে আসা নাছোড় স্মৃতির ভেতর সারারাত।/ দামামার শব্দে জেগে উঠল লোকালয়/ অথচ কী গভীর ঘুমে আঁকড়ে ধরি/ মাটি অথবা বালি ঝুরঝুর/ পাখিজন্ম বলো/ তুমি কি মুক্তি চাইছ এখন? – কবিতাটির নাম -‘ভাঙনকাল’। পাঠককুল যদি শিরোনামের সাহায্য না-ও পেতেন, এখানে অন্ধকারে ঘটে চলা ধ্বংসের তুমুল বহুমাত্রিক আলড়োনের আভাস পেতে অসুবিধে হত না। যখন স্থাবর গেল; অস্থাবর গেল; বিশ্বাস- নিঃশ্বাস – সব কিছুই তো কোনো জমির ওপর দাঁড়িয়ে অনুভব করতে হয় – সেটিও রাতারাতি চলে গেলে মনে হয় অন্ধকার ক্ষয়ে ক্ষয়ে গাঢ় হয়ে উঠছে ক্রমশ, কোনো উদ্ধার নেই।

২০১০ সালে প্রকাশিত ‘শ্রাবণজল, আমাকে নাও’ কাব্যগ্রন্থটির এই কবিতাটি উল্লখের একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। এখানে অনিন্দিতার কবিতার কিছু বৈশিষ্ট্য আলাদা করে লক্ষ্য করা যায়। অনিন্দিতার কবিতায় ঢেউয়ের মতো পর পর বিমূর্ত চিত্রকল্প আসে – এটি তাঁর কবিতার একটা গুণ। ধাপে ধাপে চিত্রকল্প মিলে খুব শান্ত প্রস্তাবনার একটি কবিতাতেও চঞ্চলতার প্রভাব রচনা করে। ‘ভাঙনকাল’ কবিতাটির মধ্যে দিয়ে যে অস্থিরতা প্রকাশ পেয়েছে, সেই অস্থিরতা, আমার মনে হয়, অনিন্দিতার কবিতায় ভাষা ব্যবহারের একটা দ্যোতক হিসেবে মানিয়ে যায়। স্থির, শান্ততার থেকে পাঠককে একটা উপদ্রুত অন্ধকারের বিপন্নতায় নিয়ে আসার প্রবণতা তাঁর মধ্যে আছে – খুব সম্ভবত অনিন্দিতা সেই পৃথিবীকে দেখে ফেলেছেন, যে পৃথিবী নিজের মধ্যে প্রেম মাধুর্য আকর্ষণ নিয়েও প্রকৃতিগতভাবে ক্ষমাহীন ও নিষ্ঠুর থেকে গিয়েছে। এই মন্তব্যটির সমর্থন পেতেই আরেকটি কবিতাতে যাওয়া যাক, কবিতার নাম ছলাৎ। কাব্যগ্রন্থ –আছি (২০১৫)। নাম থেকে স্বরবর্ণ খুলে/ আশেপাশে, চতুস্পার্শে, ক্রমাগত ব্যঞ্জনে/ ছয়ের অধিক ঋতু, ঋতুকাল শারীরিক/ ফাল্গুন হয়ে ওঠা ভাঙছে/ এসকল কুড়িয়ে ফেরো, ঘরমুখী/ গান গাইবার ছলে রাধিকাপ্রবণ মেয়ে/ অহংকারের শরীর ও ট্যাটুর বিষন্নতা/ উপহার দিলো/ তুমি বললে গান, বললে রাত্রি, বললে ছায়ার উপখ্যান/ ক্রিয়াপদ খুঁজেই পেলেনা যথাযথ/ আয়না রঙের ত্বক ভেদ করে/ রক্ত ঘন হয়ে এলো/ রক্ত গাঢ় হয়ে এলো

এই কবিতার শরীরে তাকিয়ে দেখলে একের পর এক বিমূর্ত চিত্রকল্পের – অলীক, ওলটপালট বাস্তবতার কাচের টুকরো মিশ্রিত ঢেউ ছাড়া আর কী প্রতিভাত হয়? একটি মুগ্ধতাবোধের কবিতা পরিণতি পাচ্ছে রক্তের ঘন হয়ে যাওয়ায়, গাঢ় হয়ে যাওয়ায়। এই চোরাস্রোতটিই তাঁর কবিতায় সর্বদা উপস্থিত, কখনও কখনও প্রকট, প্রচ্ছন্ন অধিকাংশ সময়েই। কিন্তু এ ছাড়া কবিতায় আরো একটি দিক প্রতিভাত। সেটি অবশ্য সমগ্র কবিতা শিল্পেরই একটি দিক, শুধু তা সবার মধ্যে থাকে না বলে অনিন্দিতার মধ্যে আরো সবিশেষভাবে নজরে আসে। আমার মনে হয়, ভাষা কবিতার বাহন নয় – ভাষা নিজেই একটা ঘটনা। তার মধ্যে একজন কবির ছটফটানি, সাঁতার, চীৎকার, উড়ান, যুদ্ধ, নীরবতাই কবির কবিতা হয়ে ওঠে। যে কবিতার আলাদা করে কোনো ‘মানে’ নেই। কবিতাটাই পৃথিবীর মানে হয়ে ওঠে। অনিন্দিতার কবিতায় একটি রাধিকাপ্রবণ মেয়ের শরীর ও শরীরের ভিতর মিলে মিশে একাকার একটা বাস্তবতার জন্ম দেয়। সেই বাস্তবতার সামনে আমরা রাখতেই পারি ‘কুয়াশার কথকতা’ শব্দবন্ধটিকে।

 

২।

২০০৬-এ প্রকাশিত আমিও ব্যালেরিনায়, তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থতে, ফিরে গেলে অনিন্দিতার পথ চলার অনেকটা দেখা যায়, ভাষা স্বাভাবিকভাবেই একটু অন্যস্বাদের ছিল। সেখান থেকে একটি সম্পূর্ণ কবিতা উদ্ধৃত করার বাসনা সম্বরণ করছি না। কবিতার নাম ‘ মোমজন্ম বা আলোকথা’।

এক।। একলা মোমবাতি জ্বলছিল। দহনের কথা নয়, আলোর কথা বলতে চাইছি। উষ্ণতার কথাও। মনে কর একটা সন্ধে, অথবা একটা সম্পর্ক। একটুখানি কেঁপে যাওয়া, অল্প অল্প গলে যাওয়া  বাতিদান ঘিরে।/ সামান্য একটা ফুঁ, আমরা তো জানি/ না হয় ফিরিয়েই নিলে আরও কিছুক্ষণ!

দুই।। বরং একটু অন্যভাবে বলা যাক। ফলজন্ম, পাতাজন্ম বা নিছক নুড়িজন্ম পেলে কী হত ভাবা যাক। তুমি স্তব্ধ হয়ে যেতে, কিছুটা একাও। (এখনও কি যথেষ্ট নও?) আঙুলহীন, তাই জড়াতে পারতে না এই হাত। চুম্বন ফিরিয়ে দিতে অপারগ, কিন্তু ফুঁদিতেও তো পারতে না। নুড়ি, আঙুর, পদ্মপাতা –/ আর জ্বলন্ত মোমবাতি।/ মাঝখান দিয়ে বয়ে যেত রবীন্দ্রসঙ্গীত।

তিন।। যদি অন্যকিছু না ভাবতে পার তাহলে সরাসরি মোমজন্মই হোক। গলে যাচ্ছি, পুড়ে যাচ্ছি এই আমি। তর্জনীতে প্রত্যাখ্যান। এত ভয় যে এবার মুখই ফিরিয়ে নাও। দুই ভুরুর মাঝখানে দল খাই, যেন পেণ্ডুলাম। মাথার চুলে সহস্র দীপাবলি। সেই আলোর কথাই, আবারও। শেষ গলনবিন্দু জুড়ে একটা জোনাকি। আর জোনাকিও নক্ষত্র হয়ে যায় কখনও কখনও। আমি বিশ্বাস করি।

বাক্য ছোট। পূর্ণ যতির সুস্পষ্ট প্রয়োগ। ভাষার প্রতি আচরণ তুলনায় আবেগপ্রবণ, কিন্তু যথাযথ। অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গী পৃথক ছিল। তখন পৃথিবীও হয়ত একটু অন্যই ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দিতার কবিতা সংশয়ে দীর্ণ ও আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। সেখানে ‘আমি বিশ্বাস করি’ – উচ্চারণটির মতো প্রত্যয়ী বাক্য হয়ত নেই – বরং সেখানে ত্রস্ত কবি ধাওয়া করে চলেছে একটা আলোকবিন্দুকে। বাস্তব থেকে বাস্তব অব্দি টানা কোনও পথই সেখানে একরৈখিক নয়।

‘আমিও ব্যালেরিনা’ কাব্যগ্রন্থের বারো বছর পর প্রকাশিত ‘অববাহিকার লেখাগুলি’-তে ফিরে এলেই ভাষার শিফটটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। অস্পৃষ্ট ছাঁকনিতে/ গলে যাচ্ছে যে জ্যোৎস্না/ তার নাম ভালবাসা/ তলানিতে আটকে থাকা/ দানাদার অন্ধকার/ তারও নাম ভালবাসা/ আলো অথবা অন্ধকার/ কোনও একটা তো তোমাকে নিতেই হবে/ নামহীন হয়ে ওঠা অবধি (অবিকল্প)

কোনও যতিচিহ্ন নেই, শেষের তিনটি ডট ছাড়া – সুতরাং কবিতাটি পড়বার সময় একটি রুদ্ধশ্বাস গতির প্রস্তাবনা থেকে যায়। দুটি বিপরীত বিমূর্ত ইমেজের যে একই মানে – ভালবাসা – এই সত্য মেনে নেওয়ার মধ্যে কবির শান্ত থিতিয়ে আসা দৃষ্টির প্রভাব ছেয়ে আছে। আর আছে একটা সুপ্ত উদাসীনতা। তাও হয়তো পৃথিবীকে মেনে নেওয়ার থেকেই উঠে এসেছে। এই সূত্রেই, আরেকটি কবিতার উদ্ধৃতি নেওয়া যেতে পারে – নির্দিষ্ট পর্বের কবিতার সামান্যগুণটি তাতে সহজে প্রকাশ পায়। জানা ও নাজানার মাঝখান দিয়ে এক ছায়া হেঁটে যায়/ তার স্থান বদলানোর সঙ্গেই/ ছায়াটি কখনও আয়না হয়ে ওঠে, কখনও কাচ/ ঠিকরে আসা রঙের ভেতর গড়িয়ে যাওয়া সন্তাপ/ আঠালো হতে থাকে  তাকে অবয়বে গাঁথি/ প্রসবকালীন স্ফীতি নিয়ে টলটল করে ওঠা অপেক্ষা/ অসহ্য হয়ে আসছে দেখে তার বিপরীতে আলো ধরি/ যেন সমস্ত পারদ মুছে যাবে স্বচ্ছতার দিকে/ তারপর যাত্রাপথের কথা গছগাছ করে নিলে/ আর কোনও গমনের ঋজুপথ নেই (প্রতিফলনের সূত্রটি)

জটিলতার কথা অনিন্দিতার ২০০৬ সালের কবিতাতেও ছিল, কিন্তু প্রকাশভঙ্গীতে ‘কুয়াশার কথকতা’ তখনও বিস্তারলাভ করেনি।

 

৩।

কবির কাছে নিজের পাঠকদের সম্বন্ধে পূর্বধারণা থাকা কি খারাপ?তা কি কোনওভাবে তাঁর লেখায় প্রভাব বিস্তার করে? যে কবি জানেন না, প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি কাদের জন্য লেখেন, বা বলা ভাল তাঁর কবিতার উপভোক্তা কারা – তিনি যারপরনাই স্বাধীন। তাঁর সামনে রুচির কোনো অনুশাসন- বিধিনিষেধ থাকারও কথা না। কিন্তু এক শ্রেণীর অর্ধমনস্ক কাব্যপ্রয়াসীর ধারণা, যে কবি নিজের পাঠক সম্পর্কে সচেতন তিনি কোনওমতেই আর মুক্ত চিন্তায় বিচরণ করতে পারেন না – তিনি শুধু পাঠক সম্বন্ধে ধারণা রাখার অপরাধে দুষ্ট হয়েই তুলনায় কম তন্ময়, ঝুঁকিহীন লেখায় ব্রতী হয়ে পড়বেন।

এই সমস্ত সমীকরণ গোলমাল হয়ে যায় যখন কবিতা মূলত ফেসবুকে লিখিত হয়। ফেসবুক অনস্বীকার্যভাবে একটি কোলাহলমুখর খোলা দেওয়াল, যেখানে পাঠকের/ দর্শকের/ শ্রোতার তাৎক্ষণিক মন্তব্য; ‘লাইক’; ‘লাভ’-এর মতো প্রতিক্রিয়া ইন্সট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেসনের কাজ করে। এ যাবৎ অনিন্দিতার যে কবিতা পড়েছেন পাঠক তার সব ক’টিই পুস্তক থেকে চয়ন করা বা অথবা খুঁজে পাওয়া পত্রিকায়, মুদ্রিত অবস্থায়। এর থেকে আরো মাসখানেক পিছিয়ে গেলেই হয়ত লেখাগুলি সুপ্ত ছিল ডায়েরির, মোবাইলের বা কম্পিউটারের পাতায়। অর্থাৎ একটি দীর্ঘ সময়কাল নিভৃতি তাদের ঘিরে রেখেছিল। কিন্তু নিম্নোল্লিখিত কবিতাটি অনিন্দিতা ফেসবুকেই লিখেছেন:

স্পর্শ কুড়োতে কুড়োতে এতদূর…..

তিস্তা   ভুবনডাঙা    দেবদারু   বৃষ্টি    কৃষ্ণচূড়া   ক্যাকটাস  বেড়ালছানা     নুড়িপাথর   ধুলো    ছেঁড়াঘুড়ি    ধোঁয়া   স্টেশনচত্বর    কুয়াশা    স্বদেশ    রৌদ্র     মেঠোপথ    লিখিত-অক্ষর     ঘৃণা    চুম্বন     কানের লতির তিল    উল্লাস   ঝুরোফুল   আলো    বিষাদ  সমুদ্রতীর  জেলেডিঙি   রুমালচুরি    চিঠিরখাম   কাজললতা  আলপথ   চিলেকোঠা  গানেরখাতা    ব্ল্যাকবোর্ড   স্কুলবাড়ি   শস্যদানা     আগুন    বরফ    মাটি    চা-দোকান    সহজপাঠ   নাগরদোলা    ক্ষুধা    প্রেম   কান্না    আলসেমি   নিশান   সন্তানের মুখ    ভোর    অপেক্ষা   স্বপ্ন…

আরো আরো সহস্র অযুত সংখ্যাতীত…

কিছুই সন্দেহাতীত নয় জেনে স্পর্শসীমার বাইরে কতদূর যাব এরপর!

(অন্তরে, অন্তরীণে: পর্ব তেরো)

ভাষা বদলে গিয়েছে – স্বাভাবিক ভাবে, অথবা কালের নিয়মে অথবা পরিস্থিতির চাপে। অথবা তিনটিই একসঙ্গে সমানভাবে সক্রিয় ছিল। সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশকের শুরুর বছরেই ভুবনজোড়া এই যে মহামারীর তাণ্ডব তার ফলে গোটা বিশ্বই গৃহবন্দী হয়ে পড়ে। এটি একটি অভূতপূর্ব বিপত্তি হয়ে দাঁড়ায় সর্বার্থেই। সমস্ত সাহিত্যপত্র প্রকাশনা রদ করে দেয়। মানুষ যে যৎসামান্য বাইরে ঘুরে বেড়াত প্রকৃতি অথবা প্রকৃতিহীনতার মাঝে তার সবটাই গুটিয়ে আসে ঘরের চৌহদ্দিতে। এই অবস্থায় এক কবি, যিনি ভাষার মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকেন – তিনি কী করতে পারেন? তিনি সে-ই কবিতাটাই লিখবেন যে-টি তাঁর কাছে আসছে। চতুর্দিক যখন ঘন অন্ধকারে পরিবৃত, কবি তখন আলোর দিকে সাঁতরে চলেছেন।এই সহজ উচ্চারণ অনিন্দিতার জীবনে এক পর্বান্তর। রোদ, স্বাভাবিকভাবেই, কুয়াশা সরিয়ে দেখা দিয়েছে।

দুয়েকটা হরিণ, হাতির পাল এক আর কিছু ময়ূর। জনশূন্য পিচ রাস্তার ওপর বাদামী ঝরা পাতায় আলগোছে দুপুরের রোদ মাখছিল। নতুন পাতার রঙ সামান্য ঘন হয়ে মায়াবী এখন। পাখি ডেকে ওঠা স্তব্ধতার গায়ে এসে বসছিল ঝিঁঝিঁ গান, প্রণয়কাতর। এরকম একটি দুপুরকেই নাকি অনন্ত নামে ডাকা হয়…/ মানুষ ছিল না বলে প্রকৃতিও জানেনি তখন। (পর্ব চার)

কবিতার প্রকাশ ভঙ্গিমায় এই সহজতাকে আর কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়– খুব সম্ভবত এখানেই অনিন্দিতা তাঁর আত্মগত কথনের টোনটি খুলে নিরাভরণ হয়েছেন, আর যেখানে হন নি, সেখানে নিঃসঙ্গতাকেও খানিক উৎফুল্লতার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। এটিকেও একটি বিদ্রোহই বলা যায়।