Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লেনিন কতদূর দেখতে পেয়েছিলেন?

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

 


লেখক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, পরিবেশবিদ

 

 

 

 

লেনিনের জন্মের ১৫০ বছর অতিক্রম করেছে। ১৯১৭ থেকে ১৯৯১, সোভিয়েত রাশিয়ার বিলুপ্তির সময় পর্যন্ত সোভিয়েত ব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে বিভিন্ন মহল বিভিন্ন সমালোচনা, কুৎসা এবং প্রশংসা করে গেছেন। সমালোচনা এবং কুৎসার একটি মুখ্য লক্ষবস্তু অবশ্যই সোভিয়েত ব্যবস্থায় “গণতন্ত্র”-এর অভাব। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে এই “গণতন্ত্র” বলতে বেশিরভাগ মানুষই বুঝিয়েছেন, পাশ্চাত্যে, বিশেষত পশ্চিম ইউরোপ বা মার্কিন দেশে “গণতন্ত্র”-এর যে ধারণা বিদ্যমান, সে ধারণাটিকে। মনে রাখা দরকার, সোভিয়েত ব্যবস্থা গড়তে চেয়েছিল এক উৎক্রান্তিকালীন সমাজ, যেখানে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না, উৎপাদকরাই উৎপাদনের উপকরণের মালিক হবে। অন্যদিকে, পশ্চিম ইউরোপ বা মার্কিন দেশ, সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা এবং উৎপদনের উপকরণে অনুৎপাদকদের মালিকানা রক্ষায় দায়বদ্ধ। এই দুই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী মতাদর্শ দ্বারা চালিত সমাজে গণতন্ত্রের ধারণা একই রকম থাকবে, এটা ধরে নেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। রুশ বিপ্লব, যা নভেম্বর বিপ্লব নামে পরিচিত, সেই ১৯১৭-র নভেম্বর থেকে লেনিনের জীবদ্দশা, অর্থাৎ ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সময়সীমায় বা তার কিছু পরে সোভিয়েত রাশিয়ায় গণতন্ত্র, অর্থাৎ সোভিয়েত মতের গণতন্ত্র কী অবস্থায় ছিল, তার কিছু পরিচিত এবং বিস্মৃত ঘটনার উল্লেখ করাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

বিভিন্ন পাশ্চাত্য লেখকের এবং প্রাক্তন সোভিয়েত নেতাদের লেখা থেকে জানা যায় যে লেনিনের মতের বিরোধীদের, যাঁরা এই সেদিন পর্যন্ত লেনিনের “কমরেড” ছিলেন, লেনিন নাকি নির্মমভাবে তাঁদের পদ থেকে হটিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের বাক-স্বাধীনতা হরণ করেছেন এবং পরবর্তী স্তরে তাঁদের কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন, অত্যাচার করার ব্যবস্থা করেছেন এবং বিচারের নামে প্রহসন করে তাঁদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ, সোভিয়েত শাসনে বিরুদ্ধ মতের কোনও স্থান ছিল না, অন্যথায়, পশ্চিমা গণতন্ত্রের কোনও রেশমাত্র লেনিনের সময়ে সোভিয়েত শাসনে ছিল না। আমরা প্রথমে এই বিষয়টি বিচারের জন্য ঐতিহাসিকভাবে জানা এবং কেবলমাত্র প্রমাণিত ঘটনার আশ্রয় নেব।

সোভিয়েতের পুরনো ক্যালেন্ডার মতে রুশ বিপ্লব সংগঠিত হয় ২৫ অক্টোবর, ১৯১৭, যা নতুন ক্যালেন্ডার মতে ৭ নভেম্বর, ১৯১৭। এই পুরনো ক্যালেন্ডার অনুসারে অক্টোবর ২৪, ১৯১৭, বলশেভিক পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব মিলিত হয়ে বলশেভিকদের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করা হবে কি না এবং হলে কীভাবে তা করা হবে এই নিয়ে আলোচনা চলছে। লেনিন ২৫ তারিখেই সোভিয়েতগুলোর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের এক নকশা পেশ করলেন। সভায় উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ লেনিনের সেই প্রস্তাবের যুক্তিগ্রাহ্যতা মেনে নিয়ে সেই নকশা অনুসারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিলেন। এই সভার দুজন মুখ্য প্রতিনিধি, গ্রিগোরি জিনোভিয়েভ এবং লেভ কামেনেভ লেনিনের এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। তাঁরা ২৪ অক্টোবর, ১৯১৭ বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিকে এক যৌথ চিঠি দিয়ে জানালেন:

আমরা গভীরভাবে নিশ্চিত যে এই সময়ে একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থান-এর অর্থ কেবল রাশিয়ার বিপ্লব নয়, আমাদের পার্টি এবং বিশ্ববিপ্লব নিয়েও এক জুয়া খেলায় লিপ্ত হওয়া। … ইতিহাসের, আন্তর্জাতিক সর্বহারা, রাশিয়ার বিপ্লবের এবং রাশিয়ার সর্বহারার কাছে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের নামে এইভাবে সমগ্র ভবিষ্যত বাজি রাখার একটাই ভবিতব্য— ব্যর্থতা। … এই যুদ্ধে পরাজয় মানে বিপ্লবের পরাজয়।

এই সভা থেকে বেরিয়ে গিয়ে জিনোভিয়েভ এবং কামেনেভ তাঁদের পূর্ব পরিচয়ের ভিত্তিতে মেনশেভিক পার্টির ঘনিষ্ঠ একজনকে লেনিনের বক্তব্য এবং জিনোভিয়েভ-কামেনেভের বক্তব্যের লিখিত দলিল দিয়ে দেন এবং তা ২৫ অক্টোবর ১৯১৭, বিপ্লবের পূর্ব মুহূর্তে মেনশেভিক পার্টির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে এই দুইজন তাঁদের ভুল স্বীকার করেন। লেনিন বিষয়টিকে একটি রাজনৈতিক প্রশ্নে রাজনৈতিক বিরোধিতা হিসেবেই গণ্য করেছিলেন, তাঁর নিজের “কর্তৃত্ব”-র ওপর চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেননি। তাই দেখা যায় সোভিয়েত সরকার গঠিত হওয়ার পর জিনোভিয়েভ, ১৯২১ সালে পেট্রোগ্রাদ (লেনিনের মৃত্যুর পর শহরটির নাম হয় লেনিনগ্রাদ) পার্টি সংগঠনের সর্বোচ্চ পদ পান। তিনি পেট্রোগ্রাদ সোভিয়েতের চেয়ারম্যান এবং বলশেভিক পার্টির পলিটব্যুরো-র পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেন। পরে যখন সোভিয়েত রাশিয়ায় তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠিত হয়, যা পরে কমিন্টার্ন নামে খ্যাত হয়, তিনি সেই সংগঠনের কার্যকরী কমিটির চেয়ারম্যানের পদ পান। কামেনেভ ১৯১৭ সালে, বলশেভিক বিপ্লবের পর সোভিয়েতগুলির বিপ্লবী কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রথম চেয়ারম্যান হন। পরবর্তীকালে, ১৯১৯ সালে কাউন্সিল অফ পিপলস কমিসারদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯১৯ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত তিনি পার্টির পলিটব্যুরো-র কার্যকরী কমিটির সদস্য থাকেন। ইতালিতে মুসোলনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতা হখল করলে তিনি ইতালিতে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত হিসেবে (১৯২৬-১৯২৭) প্রেরিত হন। লেনিনের “বিরোধিতা”-র জন্য বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় তাঁরা তাঁদের কাজের স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হননি।

ডিসেম্বর, ১৯২০ সালে বলশেভিক পার্টির একটি কংগ্রেসে লেনিন সারা রাশিয়ায় বিদ্যুতায়নের প্রস্তাব রাখেন। আলঙ্কারিক অর্থে মঞ্চে রাশিয়ার একটি মানচিত্রে যেখানে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে, সেখানে সেখানে খুবই কম শক্তির বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সেই সময়ে মস্কোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এতটাই সীমিত ছিল যে যখন ঐ মানচিত্রের আলোগুলি জ্বলে ওঠে, তখন মস্কো শহরের অনেকটা জায়গা জুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। এই কংগ্রেসে লেনিন তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন: কমিউনিজম হল সোভিয়েত ক্ষমতা এবং সারা দেশের বিদ্যুতায়ন। এই সভায় কার্ল রাদেক উপস্থিত ছিলেন। তিনি এই দৃশ্য দেখে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে ওঠেন, “ইলেক্ট্রিফিকেশন, নাকি এলেক্ট্রো-ফিকশন”!

রাদেক তাঁর বন্ধু ও সহযোগীদের নিয়ে প্রকাশ্যে প্রচার শুরু করেন যে লেনিন বিদ্যুতায়ন নিয়ে তাঁর “অবাস্তব সব কল্পনার মাধ্যমে শ্রমিক-কৃষকদের বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন।” সময়টা ছিল ১৯২১ সালের শেষ দিক। রাদেক কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে চ্যূত হননি। তিনি জার্মানির সঙ্গে সোভিয়েতের শান্তি চুক্তির জন্য সোভিয়েত প্রতিনিধি দলে ছিলেন। মস্কোর সান ইয়াৎ-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটার পদ পান এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সদস্য ছিলেন।

১৯১৮ সালে রাশিয়ার অবস্থা ছিল শোচনীয়। জার্মানির সঙ্গে শান্তি চুক্তির কথা চলছে, তার সীমান্তে নানান বিদেশি শক্তির সেনাবাহিনী দিয়ে দেশটি কার্যত ঘেরাও হয়ে আছে। বৃটিশ, জার্মান, ফ্রান্স এবং মার্কিন দেশের গোয়েন্দাবাহিনী বলশেভিকদের বিরুদ্ধে সম্পত্তি-হারানো শক্তিগুলিকে একজোট করে নিয়মিত অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম চালাচ্ছে। এই অন্তর্ঘাত দমনে তৈরি হয়েছে রাশিয়ান সংগঠন “চেকা”। এই সংস্থার কাজ ছিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সবরকম সতর্কতা গ্রহণ করা। মইসেই উরিটস্কি এই সংস্থার দেশের মধ্যে উত্তরাঞ্চলে অন্তর্ঘাত আটকানোর জন্য কর্তা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। জারের সমর্থক সৈন্যবাহিনীর বিভিন্ন পদাধিকারীবৃন্দ জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ-বিরতি ঘোষণা করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে রাশিয়ার সরে আসাকে মেনে নেয়নি। সেনাবাহিনীর এই ক্যডেটবৃন্দ, নৈরাষ্ট্রবাদী সন্ত্রাসী এবং অন্যান্য সোভিয়েত-বিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলশেভিকদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা করে। উরিটস্কি এই রকম একটি পরিকল্পনা ফাঁস করে নেতৃস্থানীয় অনেককে গ্রেপ্তার করেন। প্রতিশোধ হিসেবে জারের সৈন্যবাহিনীর একজন ক্যাডেট, লিওনিড কান্নেগিসার অগস্ট ১৭, ১৯১৮ পিস্তলের গুলিতে উরিটস্কিকে হত্যা করে। এই পিস্তলটি তাঁকে দেন সে সময়ের একজন অতি শ্রদ্ধেয় সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী, বরিস সাবিনকভ, যাঁর কথা আমাদের আরও অনেকবারই বলতে হবে। সমাজতন্ত্রীদের পত্রিকা এই হত্যাকাণ্ডকে পরোক্ষে সমর্থন করে। তখন রাশিয়ায় বলশেভিক পার্টির বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ছাড়াও সমাজতন্ত্রী, মেনশেভিক, নৈরাষ্ট্রবাদী, সিন্ডিক্যালপন্থী সহ অন্যান্য নানান রাজনৈতিক ধারার পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হত। অনেক সোভিয়েতে এই সব রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিদের নির্বাচিত প্রতিনিধিও ছিলেন, কোনও কোনও সোভিয়েতে এঁরা সংখ্যার দিক থেকে বলশেভিকদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের পর বলশেভিকদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রীদের রাজনৈতিক বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে, কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি।

অগস্ট ৩০, ১৯১৮। ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন, দক্ষিণ মস্কো-র একটি অস্ত্র তৈরির কারখানা, হ্যামার এন্ড সিকিল-এর শ্রমিকদের উদ্দেশে একটি বক্তৃতা করে শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। তাঁর সঙ্গে দুজন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের মহিলা কর্মীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নির্দিষ্ট করা ছিল। এই দুজন লেনিনের সঙ্গে মস্কোতে খাদ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে আলোচনা করতে চাইছিলেন। এই সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীরা বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃত ছিল। অনেক সোভিয়েতে তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কথা শেষ করে লেনিন যখন তাঁর গাড়িতে ওঠার জন্য পা বাড়ান, তখন, অন্তত ৩১ জন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এই দুজন মহিলার একজন, যাঁকে পরে ফ্যানি কাপলান বলে সনাক্ত করা হয়, তিনি লেনিনকে লক্ষ্য করে তাঁর ব্রাউনিং পিস্তল থেকে দুটি, মতান্তরে তিনটি গুলি ছোঁড়েন। একটি গুলি লেনিনের কাঁধ ছুঁয়ে ঘাড়ে, দ্বিতীয়টি তাঁর ফুসফুস ছুঁয়ে এবং তৃতীয়টি লেনিনের কোর্ট ভেদ করে চলে যায়। প্রতিটি গুলিতেই বিস্ফোরক এবং বিষ মাখানো ছিল। অর্থাৎ, এই গুলি ব্যবহার করে হয়েছিল নিশ্চিত করে হত্যার উদ্দেশ্যেই। এই ব্রাউনিং পিস্তলটির মালিক ছিলেন বরিস সাবিনকভ, যাঁর নাম আগে করেছি। ফ্যানি কাপলান গ্রেপ্তার হন এবং তিনি বলেন যে বলশেভিকরা লেনিনের কথা মেনে সংবিধান সভার মাধ্যমে না গিয়ে অভ্যুত্থান করে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ বিপন্ন করেছে, তাঁর এই কাজ রাশিয়াকে বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই করা হয়েছে।

এর পর “চেকা” সমাজতন্ত্রীদের নেতাদের গ্রেপ্তার করে এবং তাদের জনসংযোগের মাধ্যমগুলিকে নিষিদ্ধ করে। মেনশেভিক সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, যারা ব্যক্তিহত্যা ও সন্ত্রাসের নিন্দা করে, তাদের রাজনৈতিক বিরোধিতার ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয় না। এই সময়ে একজন ব্রিটিশ গুপ্তচর গ্রেপ্তার হয়ে চেকা-র কারাগারে বন্দি ছিলেন। বন্দি বিনিময়ের পর ব্রিটেনে ফিরে তিনি একটি আত্মজীবনী লেখেন, যেখানে তিনি জানান যে কারাগারে ফ্যানি কাপলানকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হত এবং তাঁর সঙ্গে যথেষ্ট সম্ভ্রমপূর্ণ আচরণ করা হত। বেশ কয়েকজন পৃথিবী বিখ্যাত নৈরাষ্ট্রবাদী, যেমন এমা গোল্ডম্যান, সাবিনকভ বা প্রিন্স ক্রপোটকিন, এঁরা লেনিনের সঙ্গে দেখা করে কারাগারে সমাজতন্ত্রী এবং নৈরাষ্ট্রবাদীদের ওপর যাতে কোনও অত্যাচার না করা হয় এই মর্মে স্মারকলিপি দেন। লেনিন তাঁদের রাশিয়ার কারাগার পরিদর্শনের জন্য আহ্বান জানান। এই সময়ে বলশেভিকরা সমাজতন্ত্রী এবং নৈরাষ্ট্রবাদী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক রাজনৈতিক বিতর্ক চালিয়ে যান।

বলশেভিক পার্টির মধ্যে অনেকেই এই সমাজতন্ত্রী এবং নৈরাষ্ট্রবাদী ধারা থেকে বলশেভিক হয়েছিলেন, এঁদের অনেকের মধ্যেই এই পূর্বের ভাবধারা প্রভাব বিস্তার করে। বলশেভিক পার্টির বিভিন্ন কংগ্রেসে এই সব প্রবণতা প্রকাশ পায়। পার্টির মধ্যে যাতে এই সব ভাবধারা নিয়ে খোলাখুলি বিতর্ক হতে পারে, সেই জন্য লেনিন পার্টির মধ্যে যাঁরা সংখ্যালঘু মতের অনুসারী, তাঁরা যাতে তাঁদের বক্তব্য সবাইকে জানাতে পারেন, সেই মর্মে তাঁদের নিজস্ব সেক্রেটারি, দলিলের অনেকগুলি কপি করার জন্য মিমিওগ্রাফ যন্ত্র এবং সংখ্যাগুরু অংশের বক্তব্য জন্য যতটা সময়, ঠিক ততটাই সময় বরাদ্দ করেন। এইরকমই একটা কংগ্রেসে রাদেক বিদ্যুতায়ন নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। পরবর্তী সময়ে জিনোভিয়েভ, ট্রটস্কি, বুখারিন প্রমুখ ব্যক্তিরাও এই সুযোগ পান। কিন্তু লেনিনের জীবনের ওপর আক্রমণ সংগঠিত হওয়ার পর এবং বিরোধীদের পক্ষ থেকে প্রকাশ্য বিরোধিতার পরিবর্তে গোপন বিরোধিতার পথ গ্রহণ করায় সোভিয়েত সমাজে খোলামেলা আলোচনার পরিসর অনেকটা ব্যাহত হয় সন্দেহ নেই।

১৯১৮ সালে এইরকম এক সোভিয়েত-বিরোধী কাজের জন্য সাবিনকভ-কে চেকা গ্রেপ্তার করে। সাবিনকভের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি ফরাসি সরকারের সহায়তায় সোভিয়েত-বিরোধী এক অভ্যুত্থানের আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত। বস্তুত, ফরাসি সরকারের দূতাবাসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীও সাবিনকভের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন। সোভিয়েত আদালতে সাবিনকভ এই অভিযোগ মেনে নেন এবং রাজনৈতিক দিক থেকে তাঁর কাজ কেন যুক্তিপূর্ণ সে বিষয়ে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন। সোভিয়েত-বিরোধী কাজের জন্য সাবিনকভের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত। কিন্তু সাবিনকভের সোভিয়েত-বিরোধী কাজের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রমাণিত হওয়ার পর তাঁর মৃত্যুদণ্ড রোধ করে তাঁকে দশ বছরের কারাবাসের আদেশ দেওয়া হয়। ফ্যানি কাপলানের মত তাঁকেও কারাগারে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়। তিনি তাঁর ইচ্ছামত বই, পত্রপত্রিকা আনাতেন। তাঁকে লেখার সুবিধা দেওয়া হয়। তিনি তাঁর আত্মজীবনী, মেময়ার্স অফ এ টেররিস্ট, এখানেই সম্পূর্ণ করেন। এই আত্মজীবনী থেকেই জানা যায় কীভাবে তিনি লেনিন ও উরিটস্কি-কে হত্যার জন্য নিজের পিস্তল হত্যাকারীদের পৌঁছে দিয়েছিলেন।

ভিক্টর সার্জ প্রথম জীবনে নৈরাষ্ট্রবাদী ছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ায় এসে তিনি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ট্রটস্কিপন্থী বলে পরিচিতিলাভ করেন, যদিও তাঁর সঙ্গে ট্রটস্কির ছাড়াছাড়ি হয়। তাঁর মত ছিল যে, যে সমাজে বৌদ্ধিক চর্চা খুব উচ্চ মান স্পর্শ করে সেই সমাজে এক ধরনের খোলামেলা পরিবেশ থাকতে বাধ্য। ১৯২২ সালে তিনি সমসাময়িক ফ্রান্স এবং রাশিয়ার তুলনা করে লেখেন, রাজনৈতিক অর্থনীতির বইয়ের বিচারে রাশিয়ায় সারা ইউরোপের তুলনায় বেশি ভালো চর্চা হচ্ছে। সেই সব চর্চার সবটাই রাশিয়ার সেই সময়ে অনুসৃত আর্থিক নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ এমনও নয়, আর এখানেই রয়ে গেছে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে রাশিয়ার জোরের জায়গা। তিনি দেখিয়েছেন যে কেবলমাত্র মস্কোতেই ২৫ থেকে ৩০টি পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। রাশিয়ার রাজ্য গ্রন্থাগার চিকিৎসাবিদ্যা থেকে শুরু করে সর্বহারার কৃষ্টি বিষয়ে নানান বই প্রকাশ করে। যুবকদের জন্য দুটি এবং নারী বিষয়ক একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। লাল ফৌজ থেকে ছয়টি পত্রিকা বের হয়। প্রতিটি ট্রেড ইউনিয়ন তাদের নিজস্ব মুখপত্র প্রকাশ করে। এই পত্রপত্রিকাগুলির জন্য কোনও কেন্দ্রীয় নজরদারির ব্যবস্থা নেই। সোভিয়েত ব্যবস্থার বিরোধী পাভলভের গবেষণার জন্য বলশেভিক রাশিয়া বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করে। অনেক সমাজতন্ত্রী নেতা এবং তাত্ত্বিক, যাঁরা রাশিয়াতে থাকতে চাননি, তাঁদের রাশিয়ার বাইরে গিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসের জন্য বাধা সৃষ্টি করা হয়নি।

লেনিনের কাছে সোভিয়েত দেশের গণতন্ত্র বলতে জারের আমলে বাকরুদ্ধ দেশের শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির স্বাধীনতাই অগ্রাধিকার পেত। এ কথা লেনিন কখনও গোপন করেননি। তাই তিনি সর্বদা চাইতেন এই শ্রমিক-কৃষকদের জন্য গণতন্ত্র কী করে আরও বেশি বেশি করে প্রসারিত করা যায়। এই মর্মে তিনি অসুস্থ অবস্থাতেও পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে ক্রমাগত নোট এবং চিঠি পাঠিয়ে গেছেন। ২৩ ডিসেম্বর, ১৯২২ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠানো তাঁর একটি নোটে তিনি প্রস্তাব করছেন যে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি। তাঁর প্রস্তাব ছিল যে সংখ্যাটি বাড়িয়ে ১০০ বা নিদেনপক্ষে ৫০ জন করা হোক। এর ফলে কমিটির মধ্যে ছোট ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে মত-বিরোধের সম্ভাবনা কমে আসবে। এই নতুন সদস্যদের আসতে হবে শ্রমজীবী শ্রেণি থেকেই, এর ফলে পার্টির মধ্যে ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে। ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে তিনি আবার তাঁর নোটে জানান যে শ্রমিক ও কৃষক, যে দুই শ্রেণির ওপর নির্ভর করে সোভিয়েত দেশ চলছে, তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এই দুই শ্রেণি থেকে প্রতিনিধি নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মান বাড়ানো দরকার। তাঁর ডিসেম্বর ২৬-এর নোটের রেশ ধরে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিকে আবার জানান যে ১৯১৭ থেকে ১৯২২, এই পাঁচ বছরে সোভিয়েত রাশিয়া এক নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ করেছে যেখানে বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিকরা কৃষককে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কিন্তু বলশেভিকরা জারের আমলের পুরনো ব্যবস্থা পেয়েছে, দুর্ভিক্ষর বিরুদ্ধে এবং শান্তির জন্য যে ন্যূনতম নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে, সেই সুবিধা ব্যবহার করে শ্রমিকদের নিজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থাকে এখন চাঙ্গা করা দরকার। তাঁর মতে প্রস্তাবিত এই নতুন সদস্যদের সবাইকেই আসতে হবে নীচুতলার শ্রমিকদের মধ্য থেকে, যাঁরা গত পাঁচ বছরে সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রশাসনে ছিলেন না, যাঁদের সঙ্গে গতর-খাটানো শ্রমিকদের যোগাযোগ আছে এবং যাঁরা কখনও কোনও ধরনের শোষণমূলক কাজে যুক্ত ছিলেন না। লেনিন তাঁর অন্য একটি লেখায় (বেটার ফিউয়ার, বাট বেটার) বলেছেন যে সোভিয়েতের হাতে দুটি উপাদান আছে— সেই সব শ্রমিকরা, যাঁদের সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে টেনে আনা গেছে। এঁদের যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আর দ্বিতীয়টি হল শিক্ষা, জ্ঞান এবং প্রশিক্ষণ, কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ায় এগুলি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় অপ্রতুল। তিনি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন যে আমাদের শিখতে হবে। এই কাজে অগ্রগামী শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আনাই কাজ।

লেনিন নেতৃত্ব দিয়ে যাদের জন্য রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন, তাদের অধিকার, তাদের ভালো থাকা, তাদের দিয়ে তাদের জন্য রাষ্ট্র চালানোই ছিল লেনিনের অগ্রাধিকার। তাঁর এই উদ্দেশ্য লেনিন কখনও গোপন করেননি। একটার পর একটা লেখায় তিনি তাঁর এই উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন স্পষ্ট ভাষায়। বলশেভিকরা ক্ষমতায় আসার পর লেনিন যে সব ডিক্রি জারি করে সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রের সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলেন, সমাজের সমস্ত স্তরে একটু একটু করে শ্রমজীবীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তা থেকেই লেনিনের অগ্রাধিকারের একটা পরিচয় পাওয়া যায়। লেনিন তাঁর জীবিত কালে যতদূর দেখতে পেয়েছিলেন, সোভিয়েত রাষ্ট্র এবং তার পরিচালনায় যে পার্টি, এই দুটি উপাদান কী কী বিপদের মুখে পড়তে পারে এবং কীভাবে সেই বিপদকে মোকাবেলা করতে হবে, তার কিছু কিছু রাস্তার তিনি সন্ধান করছিলেন। তাঁর কিছু কিছু ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই ঘটেছে। এইদিক থেকে তাঁর অর্ন্তদৃষ্টির গভীরতার কথা মানতেই হয়। এই সব সমস্যা ও সঙ্কটের কিছু কিছু সমাধান লেনিনের পথে হয়েছে বা হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে, কোনও কোনওগুলি আবার নতুন বাঁক নিয়েছে, যে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি লেনিন দেখে যেতে পারেননি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্টের সমস্যা ও সঙ্কটের রহস্য আজও ভেদ হয়নি। তবে লেনিন সমাজতান্ত্রিক সমাজের যে শ্রেণির প্রাথমিকতা নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন, তার রূপায়ণযোগ্য বিকল্প এখনও দৃশ্যমান নয়।