ইউক্রেনের কথা— জার সাম্রাজ্যের অধীন থেকে সোশালিস্ট রিপাবলিক

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, পরিবেশবিদ

 

 

 

আজকের ইউক্রেনের অবস্থা বুঝতে গেলে আমাদের চোখ ফেরাতে হয় এই ইউক্রেন রাষ্ট ও জাতি গঠনের প্রক্রিয়ার দিকে। অধীনতা ও স্বাধীনতা— এই দুই বিপরীত বিন্দুর মধ্যে দুলতে দুলতে যে ইউক্রেন-কে আজকে আমরা দেখছি, তার ইতিহাসের দিকে তাকানো জরুরি।

১৯১৭ সালে এক প্রবল সমাজবিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে। জার-সাম্রাজ্যের রাশিয়া ছাড়াও আরও চারটি বড় সমাজতান্ত্রিক রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। ডিসেম্বর ৩০, ১৯২২ তৈরি হয় রাশিয়ান এবং ট্রান্সককেশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটেড সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকসমূহ, আর এর পাশাপাশি জন্ম হয়  ইউক্রেনীয় এবং বেলারুশিয়ান সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস। এই পাঁচ খণ্ড নিয়ে তৈরি অঞ্চলটি তামাম দুনিয়ার কাছে পরিচিত ছিল সোভিয়েত রাশিয়া নামে। সোভিয়েত দেশে রাশিয়ান রিপাবলিক ছিল সবচেয়ে বড়।

রাশিয়ার জারের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বলশেভিকরা ছাড়াও সামিল ছিল সমাজ-গণতন্ত্রী আদর্শে বিশ্বাসীরা (যাদের বলা হত সোশ্যাল ডেমোক্রাট এবং সোশ্যাল রেভোলিউশানারি), নৈরাজ্যবাদীরা, জাতীয়তাবাদীরা এবং অন্যান্য অনেক জাতিসমূহ। এদের মধ্যে বলশেভিকরা ছিল হয়তো সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি। জারের সমগ্র রাশিয়াতে অন্যান্য জাতিসত্তাগুলির কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে আমল না দিয়ে তাদের নির্বিচারে রুশীকরণ করার নীতির ফলে এই গোষ্ঠীগুলি জার-সাম্রাজ্যের বিরোধী অবস্থানে চলে যায়।

জার এবং তাঁর সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধের জন্য এত নানান ধরনের মানুষ এবং মতাদর্শের অনুসারীদের কাছে বলশেভিকদের চারটি আবেদন ছিল সরল ও তাই অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য।

১) জার-এর স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থার অবসান,
২) সমানাধিকারের ভিত্তিতে স্বাধীন এবং মুক্তভাবে এমন এক বিকল্প রাষ্ট্র-ব্যবস্থা গঠন, যে রাষ্ট্রের মধ্যে স্ব-ইচ্ছায় বিভিন্ন জাতিগুলি অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে, চাইলে অন্তর্ভুক্তির পর এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে স্বাধীন অস্তিত্বও বজায় রাখতে পারবে,
৩) বৃহৎ রাশিয়ার বাইরে থাকা জার-সাম্রাজ্যের অধীনস্থ সব জাতিগুলির ওপর রুশীকরণ প্রক্রিয়ার অবসান ঘটানো, এবং
৪) চলমান এই বিশ্বযুদ্ধে জারকে সমর্থনের পরিবর্তে যুদ্ধকে সমাজ-বিপ্লবে পরিবর্তিত করা।

জার-সাম্রাজ্যের আওতায় বৃহৎ রাশিয়ার বাইরে থাকা নানান জাতিগুলির কাছে জার সাম্রাজ্যের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। জারের আমলে শাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রাধান্য ছিল রুশ ভাষার, জার চাইতেন তাঁর সাম্রাজ্যের অধীনের প্রজাবৃন্দ এই রাশিয়ান ভাষাতেই কথা বলবে, রাশিয়ান চার্চের ধর্মমত মানবে, তাদের নাম-ধাম তারা রুশী কায়দায় রাখবে। এই রুশীকরণের ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি ছিল। যেসব অন্য সংস্কৃতির জাতিগুলি কয়েক শতাব্দী ধরে এই রুশী আগ্রাসনের শিকার, বলশেভিকদের এই চার আবেদন তাঁরা মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন এবং তাঁদের স্থানিক ও বৃহৎ রাশিয়ার বাইরে থাকা সত্তার যথাযথ সম্মান ও প্রতিনিধিত্ব পেতে পারবেন, এই ভরসায় তাঁরা রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত রিপাবলিক গড়ার সময় সেখানে যোগ দেন।

 

রুশ বিপ্লব-উত্তর জাতিসত্তার প্রশ্ন

রুশ বিপ্লবের পর, গৃহযুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে বৃহৎ রাশিয়ার বাইরে থাকা, বিভিন্ন জাতিসত্তা-র বাসভূমি যে ভৌগোলিক অঞ্চলগুলি ছিল, সেগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রিপাবলিক বা ইউএসএসআর গড়ার নীতিমালা প্রণয়ন করেন জোসেফ স্তালিন।

স্তালিনের এই নীতিমালার ভিত্তিতে বৃহৎ রাশিয়া ছাড়া পরবর্তীকালে আরও যে ১৪টি সোশালিস্ট রিপাবলিক নিয়ে ইউএসএসআর গঠিত হয়, তারা এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া, উজবেকিস্তান, মোলডাভিয়া, ইউক্রেন, বিয়োলোরাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, আর্মেনিয়া, তাজিকিস্তান, কাঝাখাস্তান, কিরিঘিজিস্তান। সর্বমোট ১৫টি রিপাবলিক।

এই ইউএসএসআর-এ ১৪০টি ভিন্ন জাতি ছিল। এই জাতিগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের সময় পর্যন্ত সময়ে (১৯১৪-১৫ সাল) প্রবল রুশীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়; এই বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের ক্রমাগত পরাজয় হওয়া শুরু হওয়ার সময় থেকেই এই রুশ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই সময়কালে হাপসবুর্গ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যেমন ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, প্রায় সেরকমভাবেই রাশিয়ান সাম্রাজ্যের ইউরোপের লাগোয়া অংশে, যেমন রোমানিয়া, পোল্যান্ড ইত্যাদি পশ্চিম ইউরোপমুখী অঞ্চলগুলিতে এক ধরনের বুর্জোয়া জাতীয়বাদের উদ্ভব ঘটে এবং এই জাতিগুলি রুশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

রুশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অন্য জাতিগুলিও অবস্থান নেয়। কিন্তু ইউরোপ-কেন্দ্রিক এই জাতীয়তাবাদ ছিল চরিত্রের দিক থেকে রাজনৈতিক। এই জাতীয়তাবাদ চাইত তাদের “এথনিক সত্তা” অতিক্রম করে বুর্জোয়া অর্থে নতুন জাতি-রাষ্ট্র গঠনের পথে যেতে। অন্যদিকে, রাশিয়ার অন্যান্য অংশে ঘটে এক বিপরীত প্রক্রিয়া, এই অঞ্চলে “এথনিক সত্তা” রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাতিগঠনের পথ না নিয়ে তাদের “এথনিক সত্তা”-কেই বেশি গুরুত্ব দেয়।

আর একটি ভিন্ন প্রক্রিয়া অনেকের অগোচরে রাশিয়ায় শুরু হলেও লেনিন সেই প্রক্রিয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে আত্মস্থ করেন। দানিয়ুব উপত্যকা অঞ্চলে জারের আমলেই একটু একটু করে আধুনিক শিল্পের প্রসার ঘটার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় সেখানে শিল্প-শ্রমিকের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে, পাশাপাশি এই সব অঞ্চলের একদল মানুষের চেতনায় তাদের “এথনিক সত্তা” প্রতিষ্ঠার তাগিদ ক্রমে ক্রমে ইউরোপীয় ধাঁচের জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ার উন্মেষ ঘটে। রাশিয়ার সমাজে এই সব প্রক্রিয়ার সম্মিলিত ফল দাঁড়ায় যে জারের রুশীকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বলশেভিকরা ছাড়াও উঠতি-জাতীয়তাবাদী এবং এই ১৪০টি জাতি জারের শাসনের তীব্র বিরোধী অবস্থান নেয়। এদের মধ্যে বলশেভিকরা জারের রুশীকরণ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করা ছাড়াও সমাজে জাতিগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলে এক বিকল্প নীতি এবং সেই নীতির ভিত্তিতে এক বিকল্প রাষ্ট্র-ভাবনার প্রকল্প রাশিয়ার মানুষদের কাছে হাজির করে। এই বিকল্প-ভাবনার মাধ্যমেই বলশেভিকরা শেষ পর্যন্ত সোশালিস্ট রেভোলিশানারি বা এসআর গোষ্ঠী, মেনশেভিক, সিন্ডিক্যালিস্ট ইত্যাদি সামাজিক সাম্যে বিশ্বাসী মানুষ ও গোষ্ঠীগুলির রাজনীতি ও কার্যপ্রণালীর সীমাবদ্ধতা রাশিয়ার মানুষদের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয় এবং এইসব গোষ্ঠীর অনেকেই তাঁদের পূর্বের অবস্থান বদল করে বলশেভিকদের সঙ্গে যোগ দেন বা অনেকে বলশেভিকদের সঙ্গে একসঙ্গে জারের বিরোধিতায় সামিল হন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই বলশেভিকদের নেতৃত্বে জারকে উচ্ছেদ করে বলশেভিকরা মূল রাশিয়ান সাম্রাজ্যের এক বড় অংশে ক্ষমতা দখল করে ১৯১৭ সালে। বলশেভিকরা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের বিকল্প নীতিমালা প্রয়োগ করার জন্য জার-আমলের আমলাতন্ত্রের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তারা জার-প্রতিষ্ঠিত আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে তাদের নির্মিত জাতি-বিষয়ক নীতিমালা রূপায়ণ করতে গিয়ে দেখে যে, যে শাসনতন্ত্র দিয়ে সব জাতিসত্তার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, সেই শাসনতন্ত্রের সংখ্যাগুরু অংশই জারের রুশীকরণ প্রক্রিয়ার মতাদর্শের দিক থেকে সক্রিয় সমর্থক। যে দ্রুততায় জাতিসত্তা নিয়ে বলশেভিক কার্যক্রম অন্যান্য জাতিগুলির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারত, বিষয়টি তেমন গতি পায়নি।

এই সমস্যা সম্পর্কে বলশেভিকরা সম্ভবত বিপ্লবের আগেই সচেতন হয়। এই সমস্যার রূপ এবং তার সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে ১৯০৪ সালে স্তালিন লেখেন তাঁর বিখ্যাত পুস্তিকা, “The Social Democratic view on the National Question”. এই পুস্তিকায় তিনি বলেন,

A new class has entered the arena— the proletariat— and, with it, a new “national question,” has arisen— “the national question” of the proletariat. And the “national question” raised by the proletariat differs from the “national question” of the nobility and of the bourgeoisie to the same degree that the proletariat differs from the nobility and the bourgeoisie.

Let us now discuss this “nationalism.”

What is the Social-Democratic view of the “national question”?

The proletariat of all Russia began to talk about the struggle long ago. As we know, the goal of every struggle is victory. But if the proletariat is to achieve victory, all the workers, irrespective of nationality, must be united. Clearly, the demolition of national barriers and close unity between the Russian, Georgian, Armenian, Polish, Jewish and other proletarians is a necessary condition for the victory of the proletariat of all Russia.

That is in the interests of the proletariat of all Russia.

পরবর্তীকালে জাতিসমস্যা সংক্রান্ত তাঁর বিখ্যাত পুস্তিকায় স্তালিন জাতি বলতে বোঝান— ১) যাঁদের সম্প্রদায়গত ভাষা আছে (Community of Language), ২) যাঁদের সম্প্রদায়গত নিজস্ব বাসভূমি আছে (Community of Territory), ৩) যাঁদের সম্প্রদায়গত অর্থনৈতিক জীবন আছে (Community of Economic Life) এবং ৪) যাঁদের মধ্যে একই ধরনের মানসিক গঠন আছে, অন্যথায় যাঁদের একটি নিজস্ব জাতীয় চরিত্র রয়েছে (Community of Psychological make-up, i.e., National Character), তাঁরাই জাতি বলে পরিগণিত হবেন।

স্তালিন এই জাতি সমস্যা প্রশ্নে আরও স্পষ্ট করে বলেন তাঁর “Marxism and National Question” নামক গ্রন্থে, যেটিকে আজ পর্যন্ত জাতি সমস্যা সংক্রান্ত প্রশ্নে মার্কসবাদীরা “শেষ কথা” বলে ধরে নেন। সেই গ্রন্থে স্তালিন বলেন,

…none of the above characteristics taken separately is sufficient to define a nation. More than that, it is sufficient for a single one of these characteristics to be lacking and the nation ceases to be a nation.

রুশ বিপ্লবের ইহুদি বংশোদ্ভূত নেতা হিসেবে গোড়ার দিকে ছিলেন কার্ল রাডেক, গ্রিগরি জিনোভিয়েভ— এঁরা দুজনেই আদতে ছিলেন ইউক্রেনীয়, ট্রটস্কি-র মতো আরও অনেক ইহুদি বংশোদ্ভূত বলশেভিক নেতাও ছিলেন এই বিপ্লবের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। বলশেভিক পার্টির গৃহীত মত ছিল যে ইহুদিরা কোনওমতেই একটি “জাতি” নয়। তিনি লেখেন,

It is possible to conceive of people possessing a common “national character” who, nevertheless, cannot be said to constitute a single nation if they are economically disunited, inhabit different territories, speak different languages, and so forth. Such, for instance, are the Russian, Galician, American, Georgian and Caucasian Highland Jews, who, in our opinion, do not constitute a single nation.

জাতি হিসেবে পরিগণিত হওয়ার জন্য স্তালিন যে চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলে ছিলেন, তার মধ্যে “মানসিক গঠন”-এর বিষয়টি বলশেভিক বিপ্লবের পরবর্তী কালে অনেকাংশে উপেক্ষিত হয়। স্তালিন লেখেন,

… any Government is under no moral or legal obligation to take cognizance of these scattered psychological facts, and to twist the individual threads into collective texture.

স্তালিন স্পষ্টভাবে বলেন যে, জাতি বা ধর্ম নয়, শ্রেণিই হল একমাত্র বাস্তব সামাজিক একক (social unit)। পুঁজিবাদের আওতায় জাতি কতকগুলি বিবদমান শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে— সমাজতন্ত্র যতই সাম্যবাদের পথে অগ্রসর হবে, ততই রাষ্ট্রের মতো জাতিও বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হবে। তিনি লেখেন,

It is the nationalist, not the socialist, who believes in the collective consciousness of the members of an ethnic group.

স্তালিনের মত ছিল,

…the nation is a historical phenomenon, which like every other historical phenomenon, is subject to the law of change, has its history, its beginning and end.

স্তালিন সোভিয়েত রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে বলেন,

Unification and amalgamation, rather than segregation and preservation of the ethnic units which compose the multinational state.

 

জাতির প্রশ্নে লেনিনের মত

সোভিয়েত রাষ্ট্রে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগুলির সম্পর্কে লেনিন এই “Unification and amalgamation”-এর পরিবর্তে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে সংযুক্তি ও বিযুক্তির অধিকারকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। তিনি সোভিয়েত সংবিধানে জাতিগুলির সোভিয়েত দেশ থেকে বিযুক্তির অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর মত ছিল যে বিযুক্তির অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে সোভিয়েতগুলির মধ্যে সীমান্ত-বিরোধের সুষ্ঠু নিরসন সম্ভব হবে। পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রাপথ হতে পারে “through the proletarian state which creates merely the possibility for the abolition of national oppressuion.”

বলশেভিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার এক বছর পর, ১৯১৮ সালে এই সব নীতিমালা রূপায়ণের প্রশ্ন উঠল। কিন্তু তখনও জার-প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থার কোনও মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো যায়নি, জার যেসব প্রশাসক দ্বারা অন্যান্য জাতিগুলির ওপর পীড়ন চালাতেন, সেই একই প্রশাসনকে দিয়ে বিপরীত কাজ করানোর অসম্ভাব্যতা বলশেভিক শাসকরা উপলব্ধি করতে শুরু করলেন। ততদিনে প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে সমাজতন্ত্র টিঁকবে কিংবা টিঁকবে না। লেনিন ১৯১৮ সালে লিখলেন, একাধিক লেখায়,

The interests of socialism are indeed superior to the right of self determination.

লেনিন হয়তো খানিকটা বাধ্য হয়েই তাঁর পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে আসেন। লেনিনের মৃত্যু ঘটে ১৯২৪ সালে আর সেই সময় থেকেই গৃহযুদ্ধ, অন্তর্ঘাত ও অন্যান্য নানা অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ কারণে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের অগ্রাধিকার পরিবর্তিত হতে থাকে।

 

ব্রেস্ট-লিটোভস্ক চুক্তি ও তারপর

তৎকালীন পোল্যান্ড আর আজকের বেলারুশ-এর ব্রেস্ট-লিটোভস্ক শহরে মার্চ ৩, ১৯১৮ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যে শক্তিটি “সেন্ট্রাল পাওয়ার” নামে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, অটোমান সাম্রাজ্যের হয়ে জোট বেঁধেছিল, তাদের সঙ্গে বিবাদীপক্ষ হিসেবে বলশেভিক রাশিয়া এক যুদ্ধ-বিরোধী চুক্তি করে। এই চুক্তির শর্ত হিসেবে জারের রাশিয়ার দখলে থাকা রাশিয়ান সাম্রাজ্যের ইউরোপীয় অংশের প্রায় অর্ধেক এই ‘সেন্ট্রাল পাওয়ার’ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। যেমন, রাশিয়ান সাম্রাজ্যের দখলে থাকা পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, এবং লাটভিয়ার একাংশ পড়ে জার্মানির ভাগে। ইউক্রেন, ফিনল্যান্ড, এস্টোনিয়া এবং লাটভিয়ার বাকি অংশকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। এই সময় থেকেই ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিতে থাকে। বেসারবিয়া অঞ্চল যায় রোমানিয়ার ভাগে এবং অটোমানদের হাতে যায় ককেশাসের মধ্যেকার আর্মেনীয় অংশটি।

এই চুক্তির ফলে বলশেভিক রাশিয়া তার অতি সরেস চাষের জমির বৃহৎ অংশ ছাড়াও কয়লাখনির ৮০ শতাংশ, এবং শিল্পগুলির প্রায় অর্ধেক হারিয়ে বসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি এবং তার জোটের শক্তিগুলির পরাজয়ের ফলে ১৯১৯ সালে যে ভার্সাই চুক্তি হয়, তাতে ব্রেস্ট-লিটোভস্ক চুক্তির অনেকগুলি ধারা বাতিল হয়ে গেলেও পোল্যান্ড এবং বাল্টিক রাজ্যগুলি এবং ফিনল্যান্ড স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই রয়ে যায়। খেয়াল করা দরকার যে ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটে, তখন এই অঞ্চলগুলি থেকেই বিযুক্তি-পর্ব শুরু হয়। আর আজকের রক্ত-লাঞ্ছিত ইউক্রেনের বর্তমান খুঁজতে গেলে আমাদের পক্ষে এই অতীতচারিতা প্রায় অবধারিত হয়ে ওঠে।

 

সোভিয়েত আমল

১৯৩১-৩২ সাল থেকেই সোভিয়েত রাশিয়ার এক স্থান থেকে দেশের বিভিন্ন অংশে বৃহৎ রাশিয়ার নাগরিকদের পাঠানো শুরু হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষুদ্র বা মাঝারি মাপের জাতিগুলির বহু মানুষকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে, মূলত নির্মাণকাজে বিভিন্ন রিপাবলিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। এই জন-চলনের জন্য একটি অঞ্চলের জন-বিন্যাস বা “ডেমোগ্রাফি” প্রায় অপ্রত্যাহারযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

ইউক্রেন দেশটি মোট ২১টি ‘অবলাস্ট’ বা ‘জেলা’তে বিভক্ত। এই ২১টি জেলার মধ্যে ৩-৪টি ‘অবলাস্ট’ ছাড়া বাকিগুলিতে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ইউক্রেনবাসী প্রধানত ইউক্রেনীয় ভাষাতেই কথা বলে। একটা কথা এখানে বলে রাখা প্রাসঙ্গিক যে ইউক্রেন মূলত এক দ্বিভাষিক রাষ্ট্র, যেখানে রাশিয়ান-ইউক্রেনীয় বা ইউক্রেনীয়-রাশিয়ান-ব্যতীত অন্যান্য ইউক্রেনীয় ভাষার চল রয়েছে। ২০২২ সালে দেখা যাচ্ছে যে সারা ইউক্রেন জুড়ে মোট কুড়িটি ভাষা দেশের প্রায় সর্বত্র চালু আছে। ইউক্রেনের জনসংখ্যার প্রায় ৬৭ শতাংশ ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত, আর ৩০ শতাংশ মানুষ বৃহৎ রাশিয়া অঞ্চল থেকে এখানে বিভিন্ন সময়ে বসবাস করতে এসেছেন। অন্যান্য জাতির মানুষ রয়েছেন প্রায় ৩ শতাংশের মতো। এই চিত্র ২০০১ সালের জনগণনা মতে। ১৯৮৯ সালের জনগণনা মতে বৃহৎ রাশিয়া থেকে এসে এখানে থিতু হওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ইউক্রেনের তৎকালীন মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশের মতো।

 

রাষ্ট্র-সীমানা নির্ধারণ ও সোভিয়েত

জারের শাসনের রাশিয়া যখন সোভিয়েত রাশিয়া-তে রূপান্তরিত হল, তখনও সোভিয়েত রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের নির্মিত রাষ্ট-সীমানা নির্ধারণের নীতির চেয়ে গুণগতভাবে ভিন্ন কোনও নীতি প্রণয়ন করে উঠতে পারেনি। জারের আমলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির যেসব অঞ্চলে স্রেফ সামরিক হামলা চালিয়ে সেগুলিকে বৃহৎ রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, সোভিয়েত রাশিয়া কোনও অজ্ঞাত কারণে সেইসব অঞ্চলগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার না করে এই অঞ্চলগুলির ওপর জারের আমলের সীমান্ত দেখিয়ে সেখানে তাদের দাবি জোরের সঙ্গে বহাল রাখে। এমন দুটি অংশ ছিল বাল্টিক অঞ্চলের লাটভিয়া-লিথুয়ানিয়া-এস্টোনিয়া, ফিনল্যান্ডের একাংশ, যাকে তখন বাল্টিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হত, ইউক্রেনের বড় অংশ এবং পোল্যান্ডের একাংশ। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ক্ষেত্রে এই অঞ্চলগুলির জটিল ভৌগোলিক অবস্থান এবং কোন শক্তির আধিপত্যে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলগুলি থাকবে, সেই বিষয়টি নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে।

 

সোভিয়েত শাসনের নানা দিক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে, ১৯৩৯-এর গোড়ায় দেখা যায় যে সমগ্র সোভিয়েত রাশিয়া জুড়ে, প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং সিদ্ধান্তকারীর ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত প্রতি ৫ জন সোভিয়েত নাগরিকের মধ্যে তিনজনই বৃহৎ রাশিয়ান জাতিভুক্ত। এই সম্প্রদায়ের মানুষরা ঐতিহাসিকভাবেই, সেই জারের আমল থেকে সোভিয়েত আমল পর্যন্ত, শিক্ষা-দীক্ষা, আর্থিক সক্ষমতা, শাসনকাজের অভিজ্ঞতা, কারিগরি দক্ষতা, সামরিক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি প্রায় সব বিভাগেই সোভিয়েত রাশিয়ার অন্যান্য রিপাবলিকের নাগরিকদের চেয়ে অনেক অগ্রসর অবস্থায় ছিল। ফলে সামরিক বাহিনি, কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চস্তরে তারাই স্বাভাবিকভাবে সারা সোভিয়েত দেশ জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সিদ্ধান্তগ্রহণকারীর ভূমিকা নেয়। সর্বত্র তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সারা সোভিয়েত রাশিয়াতেই বিপুল পরিমাণে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, শিক্ষক, প্রশাসক ইত্যাদি পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ ছড়িয়ে পড়ে এবং জনবিন্যাসের বিরাট পরিবর্তন ঘটে। এর সঙ্গে যোগ হয় “সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ” কাণ্ড, মেয়াদের আগেই পরিকল্পনা শেষ করার উদগ্র তাগিদে বিপুল দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকবাহিনি দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে চালান করার প্রক্রিয়া। এই চলনের পরিমাণটা শিহরণ জাগানোর মতো— এক এক লপ্তে, ধরা যাক ইউক্রেন থেকে ৩৫ হাজার শ্রমিক পরিবার সোভিয়েত কাঝাখস্থান-এর কোনও একটি নির্মাণ অঞ্চলে পাঠানো হল, তেমনই তিবিলিস থেকে পাঠানো হল প্রায় শাখালিন-এর কাছে, সংখ্যাটা হয়তো ৩১ হাজার শ্রমিক পরিবার। এছাড়া তুর্কি-ভাষী, জার্মানভাষী, কিছু কিছু সংখ্যালঘু মুসলমান ধর্মের মানুষদের পূর্বতন ক্রিশ্চান-অধ্যুসিত অঞ্চলে পাঠানোর প্রকল্পও নেওয়া হয়। পূর্বতন অটোমান প্রভাব বলয়ে থাকা এই মানুষরা পূর্বতন অটোমান সাম্রাজ্যের বা জার্মান সাম্রাজ্যের সমর্থক হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়ায় রয়ে গেছে, আসন্ন যুদ্ধে এরা হয়তো রাশিয়াকে আক্রমণকারী বাহিনির ‘পঞ্চম বাহিনি’ হিসেবে কাজ করবে, এই ধারণার বশবর্তী হয়ে এদেরকে ছড়িয়ে দেওয়ার ধারণা নীতি হিসেবে গৃহীত হয়! পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে এই ধরে নেওয়াতে গুরুতর ভ্রান্তি ছিল, নাৎসি অধিকৃত ইউরোপে দেশে দেশে যেমন স্ব-ইচ্ছায় অসংখ্য খিদমতকার ও পঞ্চমবাহিনি জুটে গিয়েছিল, সোভিয়েত রাশিয়াতে তেমনটা দেখা যায়নি! কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক সোভিয়েত নাগরিক অনভিপ্রেত নিপীড়নের শিকার হন, কার্যত এঁদের অনেকেই মতাদর্শের নিরিখে উগ্র জাতীয়তাবাদী দলে নাম লিখিয়ে সোভিয়েত ব্যবস্থার বিরোধী অবস্থানে চলে যান। এই শিবির-বদলের দায় পরোক্ষে কিন্তু সোভিয়েতের তৎকালীল নীতিমালার রূপায়ণের মধ্যেই লুকিয়েছিল।

 

সোভিয়েত জাতিগুলির মধ্যে বিভ্রান্তির উদ্ভব

সোভিয়েত নাগরিকদের মধ্যে যে অংশটি বৃহৎ রাশিয়ান জাতিভুক্ত ছিলেন না, ১৯৩৯-এর গোড়ায় তাঁদের অনেকেই অনুধাবন করেন যে, যে জাতিগত সাম্যের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁরা তাঁদের জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ ত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, সেই সাম্যের ধারণা যতটা না বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে, তার চেয়েও বেশি রয়ে গেছে কাগজেকলমে। লেনিন-কথিত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে ছাপিয়ে চলে গেছে যেকোনও মূল্যে সমাজতন্ত্র গড়া এবং সেই শিশু সমাজতন্ত্রকে যেকোনও মূল্যে রক্ষা করা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে দেখা যায় যে, নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বৃহৎ রাশিয়ান জাতি, মোট সোভিয়েত নাগরিকের ৫২ শতাংশ, বাকি ৪৮ শতাংশ নাগরিকের ২০ শতাংশ ইউক্রেনীয় এবং অবশিষ্ট ২৮ শতাংশ নাগরিকের মধ্যে সোভিয়েতের অন্যান্য ১৩৫টি ‘এথনিক গোষ্ঠী’ ছিল। সোভিয়েত জনসংখ্যার দ্বিতীয় বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী ইউক্রেন সেই জারের আমল থেকেই রুশীকরণ প্রক্রিয়ার বিরোধী ছিল। বলশেভিক নেতাদের মধ্যে অনেক ইউক্রেনীয় নেতার আমরা দেখা পাই, যেমন জর্জি পিয়াটাকভ, ক্রিশ্চিয়ান রাকভস্কি, লাজার কাগানোভিচ ইত্যাদি।

সোভিয়েত আমলে এই রুশীকরণ প্রক্রিয়া ক্ষেত্রবিশেষে আরও তীব্র আকার নেয়। এই বিষয়টি নিয়ে মস্কো এবং ইউক্রেনের কমিউনিস্টদের মধ্যে বিতর্ক চলতেই থাকে এবং এই রুশীকরণকে ঘিরে নতুন করে ইউক্রেনে জাতীয়তাবাদের বীজ উপ্ত হয়, যা আজকে একটি সুগঠিত রূপ নিয়েছে। ইতিহাসের দিকে নজর করলে দেখা যায়, লেনিনোত্তর সোভিয়েত রাশিয়া জাতিসত্তাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ বনাম সমাজতান্ত্রিক সমাজগঠন, এই বিতর্কের মতাদর্শগত সমাধানে নতুন কোনও রাস্তা দেখাতে পারেনি। মূলত মতাদর্শগত এই প্রশ্নের সুষ্ঠু নিরসন তো হয়ইনি, বরং ১৯৩০-১৯৩৭ সালের সময়কালে, যে ঘটনাগুলি সোভিয়েত পার্টির মতে ‘পার্টি শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া’, আর বুর্জোয়া দুনিয়ার মতে যা ‘গ্রেট পার্জ’, সেই প্রক্রিয়ার শিকার হন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে সংখ্যাগুরু অংশ, শোচনীয়ভাবে, ইউক্রেনীয় নাগরিক এবং ইহুদি।

ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী এবং ইউক্রেনের কমিউনিস্টরা এই তথ্য আজও বিস্মৃত হননি, যা তাঁদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের অনেক বিবৃতিতেও উঠে আসছে।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ইউক্রেন

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একেবারে শুরুর দিকেই নাৎসি বাহিনি আগ্রাসন চালিয়ে ইউক্রেন দখল করলেও সেখানে কোনও ইউক্রেনীয় মানুষকে নাৎসি প্রশাসক নিযুক্ত তারা করতে ব্যর্থ হয়; জার্মানি থেকে আমদানি করা একজন নাৎসি প্রশাসক সেই দায়িত্ব নেয়। এই ব্যবস্থা চলে ১৯৪১-এর শেষ থেকে ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত, যখন সোভিয়েত লাল-ফৌজ নাৎসি বাহিনিকে ক্রমাগত বার্লিনের দিকে ঠেলতে থাকে।

রাশিয়াতে জারের আমল থেকেই ইহুদিদের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষ ছিল, সোভিয়েত আমলে সেই বিদ্বেষের ধার খানিকটা কমলেও, তা রাশিয়ান সমাজে ফল্গুধারার মতো বহমান ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু এক বছর আগে, ইউক্রেন-অঞ্চলে ইহুদির সংখ্যা ছিল ১৫ লক্ষ (১.৫ মিলিয়ন)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভার্সাই চুক্তি মোতাবেক ইউক্রেন-লাগোয়া যেসব অংশ সোভিয়েত রাশিয়ার ভাগে পড়েছিল, সেই অংশগুলি, যেমন গ্যালিশিয়া, পশ্চিম ভোলহাইনিয়া, উত্তর বুকোভিনা এবং দক্ষিণ বেসারাবিয়া, শেষ পর্যন্ত সোভিয়েতভূমির অন্তর্ভুক্ত হয়। এই অঞ্চলের ইহুদি জনসংখ্যা ইউক্রেনের ইহুদি জনসংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই অঞ্চলের মোট ইহুদি জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২৪.৫ লক্ষ (২.৪৫ মিলিয়ন)।

যুদ্ধের প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সোভিয়েত বাহিনি দ্রুত পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। নাৎসি সৈন্যদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ইউক্রেনীয় নাগরিকদের নানা অঞ্চলে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অভিজ্ঞতার অভাবে এই বিষয়টিতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা দেখাতে সোভিয়েত প্রশাসন বেশ খানিকটা ব্যর্থতার পরিচয় রাখে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ইউক্রেন থেকে সোভিয়েত বাহিনি ৪০ লক্ষ (৪ মিলিয়ন) অসামরিক মানুষকে নিরাপদে উরাল অঞ্চলে স্থানান্তরিত করতে সক্ষম হয়, যাদের বৃহদংশ এই যুদ্ধের আঁচ থেকে শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান। এই প্রক্রিয়া সমাপ্ত হতে হতেই নভেম্বর ১৯৪১-এ জার্মান নাৎসি বাহিনি প্রায় পুরো ইউক্রেনের দখল নেয়।

গ্যালিশিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলের মানুষরা তাদের জার্মান উৎস ছেড়ে রুশীকরণ মানতে নিমরাজি ছিল, এখন জার্মান-বলা এবং জার্মান সংস্কৃতির মানুষদের “শাসক” হিসেবে পেয়ে নানান ধরনের মানুষ, সংখ্যার দিক থেকে তারা মোট জনসংখ্যার এক নগণ্য অংশ মাত্র, তারা জার্মান বশ্যতা মেনে নেয়, কেউ কেউ হয়তো ব্যক্তিগত লাভের আশায় নাৎসিদের সহযোগীও হয়ে থাকবে। তবে এই ঘটনাও ইতিহাস নথিবদ্ধ করেছে যে, গ্যালিশিয়া অঞ্চলেও নাৎসি-বিরোধী গোপন আন্দোলন জার্মান শাসকদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। যাঁদের মনে ‘জার্মান-ব্রাদারহুড’-এর স্বপ্ন ছিল, তাদের কাছেও বিষয়টি অতি দ্রুত মরীচিকাতে পর্যবসিত হয়। জুন ৩০, ১৯৪১, ইউক্রেনের স্থানীয় বলশেভিক-বিরোধী জাতীয়তাবাদীরা ইউক্রেনের ‘স্বাধীন রাষ্ট্র সত্তা’-র কথা ঘোষণা করে এবং নাৎসি-জার্মান-মুক্ত এক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে। বিপুল নাৎসি-সৈন্য সমাবেশের মাধ্যমে এই ‘বিদ্রোহী’দের গ্রেপ্তার করা হয় এবং এঁদের (যাদের অনেকেই ছিলেন ইহুদি) নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে ‘হলোকস্ট’-এর সূচনা করা হয়। নাৎসিরা সর্বত্র যেমন ভার্সাই চুক্তিকে পদদলিত করেছিল, তাদের সেই মানসিকতার সঙ্গে তাল রেখে তারা গ্যালিশিয়াকে পোল্যান্ডের সঙ্গে জুড়ে দেয় (ততদিনে পোলান্ড নাৎসিদের দখলে চলে এসেছে), বুকোভিনা-কে তার যুদ্ধ-সঙ্গী রোমানিয়াকে ‘প্রত্যর্পণ’ করার পাশাপাশি নিয়েস্তার অঞ্চল থেকে বুহ নদীর দক্ষিণ কিনার পর্যন্ত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের ভারও রোমানিয়াকে দিয়ে অঞ্চলটির নামকরণ করে ট্র্যান্সনিট্রিয়া। এই অঞ্চলের রাজধানী করা হয় অডেসা-কে, যে অঞ্চলটি সেই সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এক পরিব্যাপ্ত ঝগড়া ও বাদানুবাদের অঞ্চল হিসেবে বিরাজ করছে। ইউক্রেনের বাকি অংশ নাৎসি বাহিনির কাঁটা লাগানো জুতোর তলায় চলে যায়।

 

নাৎসি-অধীকৃত ইউক্রেনের দুর্দশা

ইউক্রেন-এ নাৎসিরা তাদের ‘ইহুদি সমস্যা’-র ‘ফাইন্যাল সলিউশন’ রূপায়ণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৪৪ সালের শেষে দেখা যায় যে তারা দখল-করা ইউক্রেনে ১৫ লক্ষ (১.৫ মিলিয়ন) ইহুদিকে হত্যা করেছে, ৮ লক্ষ ইউক্রেনীয় নাগরিককে আরও পুবের অঞ্চলে বিস্থাপিত করেছে, কিয়েভের বাবিন ইয়ার, যাকে ইউক্রেনের আউটসউইটজ বলা হয়ে থাকে, সেখানে ৩৪ হাজার নারী-শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ বহু সক্ষম ইহুদি-নিধন পর্ব সমাধা করেছে। নাৎসিরা ইউক্রেনে তাদের খাদ্য সংগ্রহের নীতিকে নৃশংস পর্যায়ে নিয়ে যায়। ফলে এই অঞ্চলের ব্যাপক মানুষের মধ্যে নাৎসি-বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে এবং এই অংশের মানুষের দ্বারা সংগঠিত অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ নাৎসিদের যুদ্ধপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এক মস্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

প্রায় সমস্ত শহরাঞ্চল থেকে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গুটিয়ে নেওয়া হয় এবং সেই খাদ্য নাৎসি সৈন্যবাহিনির জন্য বরাদ্দ করা হয়। ইউক্রেনের ২২ লক্ষ (২.২ মিলিয়ন) নাগরিককে জার্মানিতে দাস-শ্রমিক হিসেবে পাঠানো হয়। জার্মান শাসক প্রথমেই আঘাত হানে ইউক্রেনের সাংস্কৃতিক কাজের ওপর, ইউক্রেনীয় ভাষায় প্রচারিত বই-পত্র-পত্রিকা-নাটক-গান-কনসার্ট-এর ওপর সেন্সরশিপ চালু হয় এবং পরে প্রায় নিষিদ্ধ করা হয়। সোভিয়েত আমলের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা গুটিয়ে নিয়ে কেবল বুনিয়াদি স্তরের বিদ্যালয় পঠনের ব্যবস্থা হয়, জার্মান পাঠ্যপুস্তকও আমদানি শুরু হয়, ফলে প্রাথমিক স্তরে পরোক্ষে জার্মান তথা নাৎসি সংস্কৃতি প্রচারে উৎসাহ দেওয়া হতে থাকে।

সোভিয়েত আমলে যে ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চের নামে মাত্র অস্তিত্ব ছিল, তাকে বিরাট আকারে পুনরুজ্জীবিত করা হয়।

এই নৃশসতার মধ্যেও একদিকে নাৎসি-বিরোধী ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী শক্তি, অন্যদিকে কমিউনিস্ট গেরিলাবৃন্দ নাৎসি আগ্রাসন ও দখলদারির বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন ও তীব্র লড়াই জারি রাখে। নাৎসিদের যেসব দলিল সোভিয়েত ও মিত্রবাহিনি পরবর্তীকালে হাতে পেয়েছে, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৪১ সালের শেষের মধ্যেই ইউক্রেনে ৯ লক্ষ ইহুদি নিহত হয়। লাটভিয়ার রিগা কনসেন্ট্রেশন ক্যম্পে ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে ইউক্রেনে বসবাসকারী জার্মান বংশোদ্ভূত ইহুদিদের নিধনকার্য সম্পাদিত হয়। বাকিদের পোল্যান্ডের বিশেষভাবে নির্মিত হত্যাপুরী, চেলম্‌নো-তে গ্যাস প্রয়োগে হত্যা করা হয়।

 

ইউক্রেনের প্রতি যুদ্ধোত্তর সোভিয়েত মনোভাব

ইউক্রেন কমিউনিস্ট পার্টির এক হিসেব মতে ইউক্রেনের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ নাৎসি শাসনের সময় নাৎসিদের সঙ্গে সহযোগিতা করেনি, বরং জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বহু মানুষ কমিউনিস্ট গেরিলাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে।

আশ্চর্যের কথা হল, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যখন সোভিয়েত লালফৌজ ইউক্রেনকে নাৎসি দখলমুক্ত করে, তখন ইউক্রেনের অধিবাসী এবং গেরিলাদের সম্পর্কে সোভিয়েত শাসকদের মনোভাব ও যুদ্ধ-উত্তর পরিস্থিতির মূল্যায়নের আমূল পরিবর্তন ঘটে। বার্লিন থেকে যে সব ইউক্রেনীয় দাস-শ্রমিকবৃন্দ আধমরা অবস্থায় বেঁচে ফেরেন, বা লালফৌজের যে সব সৈনিক যুদ্ধবন্দি হিসেবে মুক্তি পেয়ে মুক্ত সোভিয়েতভূমিতে পা রাখেন, তাঁদের অধিকাংশকেই ‘নাৎসি-চর’ বা ‘ক্ষতিকর জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ ইউক্রেনীয়’ বলে ধরে নেওয়া হয়। এই সব লালফৌজিদের ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়, পরে তাদের দূরদূরান্তে চালান করা হয়। জার্মানি-ফেরত শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। আগের বর্ণিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলির আলোকে এই সব ব্যক্তিদের প্রত্যেককে ‘নাৎসি’ বা আজকের ভাষায় ‘নব্য নাৎসি’ আখ্যা দিয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন করা কতটা বাস্তবসম্মত সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সব প্রশ্ন থেকেই সমাজতন্ত্রের বিপরীতে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়, তা অবশেষে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হওয়ার যাবতীয় উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আজকের ইউক্রেন, তার নানান পরতকে বুঝতে এই গোলমেলে ও জটিল অনতি-অতীতের ঘটনাবলির প্রভাব বিচারের দরকার হয়ে পড়ে।

 

আজকের ইউক্রেন

কেজিবি-র প্রাক্তন অধিকর্তা হওয়ার সুবাদে ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ অবস্থা, বিভিন্ন শক্তির মধ্যে ভারসাম্য ইত্যাদি বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত থাকারই কথা। ন্যাটো যুদ্ধগোষ্ঠী যে রাশিয়াকে ইউরোপের দিক থেকে ঘিরতে চাইছে, আর ন্যাটোর সেই উদ্দেশ্য সফল করতে গেলে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করা যে জরুরি, সেই কথা বুঝেই পুতিন আগেই বেলারুশকে নিজের দলে টেনেছেন, ক্রিমিয়াকে নিজের বলয়ে ঢুকিয়েছেন, ইউক্রেনের তিনটি বৃহৎ রাশিয়ান অধ্যুষিত অঞ্চলকে ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। এই কাজের মাধ্যমে তিনি ইউক্রেনের চারপাশে একটি সরু বলয় গড়ে ন্যাটো গোষ্ঠীর অগ্রগতির সামনে একটি বালির বাঁধ দিয়ে প্রয়াসী হয়েছেন।

কিন্তু ইউক্রেনের ভৌগোলিক বিস্তার এতটাই যে সেই ইউক্রেন যদি ন্যাটো প্রভাবে চলে যায়, তবে সামরিক দিক থেকে রাশিয়ার এবং অবশ্যই পুতিনের যে নিজস্ব আর্থিক স্বার্থ তেল-গ্যাস-রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় রয়েছে, তার সমূহ ক্ষতি নিশ্চিত। তাই ইউক্রেনের ওপর এই আক্রমণ এবং ইউক্রেন যে ‘নব্য নাৎসি মতাদর্শের সূতিকাগার’, এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ আসলে ‘নব্য-নাৎসি’-বিরোধী লড়াই, এমন একটা জিগির তুলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ইউক্রেনীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে সেই অতীতের নাৎসি আখ্যা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলেছে।

ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদ সময়ে সময়ে উগ্রভাব ধারণ করেছে এ কথা সত্যি, এটাও হয়তো সত্যি যে আজকের দুনিয়ার অর্থনীতি-রাজনীতির বাস্তবতায় জাতীয়তাবাদ যে নব্য নাৎসি রূপ নিতে পারে এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়, কিন্তু পুতিনের এই সব যুক্তির বিরুদ্ধে তার নিজের দেশে তার নিজের কাজকর্ম আমাদের কি নব্য নাৎসি ঘরানার কথা মনে করায় না? যে যুক্তি দেখিয়ে ১৯৩৯-এ নাৎসি বাহিনি চেকোশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ডে আগ্রাসন চালিয়েছিল, ইতালি তৎকালীন আবিসিনিয়াতে, বা আধুনিক যুগে ন্যাটো শক্তি ইরাকে বা লিবিয়ায়, তার বয়ানের সঙ্গে পুতিনের প্রেস বিজ্ঞপ্তির বয়ানের অন্তর্নিহিত মিল আমাদের শিহরিত করে।

এই যুদ্ধ শুরুর আগে, পুতিনের প্রত্যক্ষ নির্দেশে পতন-উত্তর রাশিয়ার সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সংগঠন, ‘মেমোরিয়াল’-কে নিষিদ্ধ করা হয়। পুতিন-বিরোধী আন্দোলনের নেতা, আলেক্সেই নাভাল্‌নি-র ওপর পুতিন সরকার বিষ প্রয়োগ করে। রাশিয়ার অভ্যন্তরে পুতিনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের একটা আঁচ পাওয়া যায় সেই দেশের মান্য সংগঠন, লেভাদা সেন্টার পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে। এই সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে যে সমীক্ষার আওতায় থাকা (প্রায় ১০ শতাংশ নাগরিকের ওপর ৫-৬ বছর ধরে করা সমীক্ষা) ৫২ শতাংশ রাশিয়ান নাগরিক মনে করে যে তারা যেকোনও সময়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হতে পারে; ৫৮ শতাংশ নাগরিক মনে করে যে তাদের বেআইনি এবং অযৌক্তিকভাবে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। অর্থাৎ, সে দেশে এখনই একটি সন্ত্রাসের আবহাওয়া বিরাজ করছে। মানুষের এই ধারণার যে বাস্তব ভিত্তি রয়েছে, তা এই ইউক্রেনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সে দেশে যে সব ঘটনা ঘটেছে, তার থেকে খানিকটা আঁচ পাওয়া যায়। পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ-বিরোধী বিক্ষোভে বহু মানুষ সামিল হয়েছেন, মার্চ ৪, ২০২২ পর্যন্ত এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে সেই সময় পর্যন্ত পাঁচ হাজার মানুষকে পুতিন-সরকার গ্রেপ্তার করেছে। এই গ্রেপ্তার, হুমকি সত্ত্বেও রাশিয়ার ৫৮টি মুখ্য শহরে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।

পুতিনের এই ‘নব্য-নাৎসি’-বিরোধী হুঙ্কারের প্রকৃত অর্থ অনেকের হয়তো চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। ভূতপূর্ব পশ্চিম জার্মানি, যা কালক্রমে অবিভক্ত জার্মানিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং যা আধুনিক ইউরোপের নব্য-নাৎসিবাদের আসল সূতিকাগার, সেই নব্যনাৎসিবৃন্দ পুতিনের এই ‘নব্য নাৎসি’-বিরোধী জেহাদকে সামনে রেখে নিঃশব্দে সংগঠিত হচ্ছে। এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতে এই প্রথম জার্মানি তার বহুদিনের ঘোষিত নীতি— যুদ্ধরত কোনও দেশকে জার্মানি কোনওরকম অস্ত্রসাহায্য দেবে না— সেই নীতি থেকে সরে এসে তারা ইউক্রেনকে অস্ত্রসাহায্য করবে বলে ঘোষণা করেছে। এর ফলে জার্মানির যুদ্ধাস্ত্র বেচাকেনা আবার চাঙ্গা হতে শুরু করেছে, যে লক্ষণটি দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালের বিপজ্জনক অবস্থার দিকে পৃথিবীকে আবার নিয়ে যেতে পারে। জার্মানি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও একতরফাভাবে তার নিজের সামরিক বাজেটে বাড়তি ১০০ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করেছে; মনে রাখা দরকার এই পরিমাণ অর্থ জার্মানির বর্তমান জিডিপি-র প্রায় ২ শতাংশ!

বিষয়টির অন্য একটি দিকও রয়েছে। পূর্ব ইউক্রেন, যেখানে পুতিন তার যুদ্ধ চালাচ্ছে, সেখানে অতীতের জার্মান মাতৃভাষার বহু মানুষ রয়েছেন। ইতিমধ্যেই ইউক্রেনকে অস্ত্রসাহায্য করার ‘ন্যায্যতা প্রমাণ’-এর জন্য জার্মানি বলেছে যে ইউক্রেনে জার্মানভাষীদের স্বার্থরক্ষা তার ‘মর‍্যাল ডিউটি’। হয়তো এর মাধ্যমেই জার্মানি আবার হিটলারকথিত ‘লেবেনস্রাম’-এর দাবি ফিরিয়ে আনতে চাইছে!

এই যুদ্ধ ঘিরে আন্তর্জাতিক স্তরে দুটি দেশের ভূমিকার উল্লেখ না করলেই নয়। একটি আমাদের দেশ ভারত এবং অন্যটি আমাদের প্রতিবেশী দেশ, চিন। আগে ভারতের ভূমিকা নিয়ে দু-চার কথা বলা যেতে পারে। রাশিয়ান সৈন্য যখন ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে, তখন ভারতের প্রতিরক্ষা পরামর্শদাতা শ্রী শিবশঙ্কর মেনন বলেন যে, “Moscow had legitimate interests in Ukraine and the annexation was an internal issue.” ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বিবৃতি দিয়ে বলেন, “India would oppose unilateral measures, such as sanctions against the Russian Government in response to Kremlin’s action.”

ইউক্রেন নিয়ে এ বছর জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যে বৈঠক ডাকা হয়, তাতে ভারত অনুপস্থিত থাকে। আবার ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়াকে নিন্দা করে নিরাপত্তা পরিষদের যে বৈঠক হয়, সেই বৈঠকে প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোটদানের সময়েও ভারত অনুপস্থিত থাকে। গত ২৬ এপ্রিল, ২০২২ ভারতের বিদেশ বিষয়ক মন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, “We have to find a way to return to diplomacy and to do that, the fighting must stop.”

অন্যদিকে চিন মার্কিন দেশ ও ন্যাটো-জোটকে ধিক্কার জানিয়ে বলেছে এই দুই জোট রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ সামাজিক সুরক্ষার দিকে যথেষ্ট মনোযোগ না দিয়ে এই অঞ্চলে অশান্তি সৃষ্টি করছে। যদিও চিন রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে নিন্দা করেনি। চিন যদিও রাশিয়ার ক্রিমিয়া-গ্রাসকে স্বীকৃতি দেয়নি, তেমনি নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়াকে নিন্দা করার প্রস্তাবে ভোটের সময় অনুপস্থিত থেকেছে।

আজ থেকে আট দশক আগে, ইউরোপের এই অঞ্চলগুলি ঘিরে দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠেছিল। সেই অতীত দিনের মতো আজও এই অঞ্চল রাজনৈতিক দিক থেকে ‘দাহ্য বস্তু’তে পরিপূর্ণ। বিশ্বের অর্থনীতির যে সঙ্কট এই দুই বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল, তা বিশ্ব-অর্থনীতির অভ্যন্তর থেকে অপসৃত হয়েছে এমন নয়। বিশ্বে শক্তির ভারসাম্যের গুরুতর পরিবর্তন ঘটে গেছে এই কয়েক দশকে। তাই আগে দরকার যুদ্ধ থামানো, আক্রমণকারীকে চিহ্নিত করা, ধিক্কার জানানো। এই যুদ্ধ-বিরোধিতা হয়তো নতুন কিছুর জন্ম দেবে আগামীতে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...