Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সারিগান

সারিগান -- সুদেষ্ণা মৈত্র

সুদেষ্ণা মৈত্র

 

তুমি যদি আস্থাশক্তি বলো
আমি তবে মৌচাকে মধু সামলাব
পায়ের আঙুল ধরে ছিন্নভিন্ন রেণু
কচলে উঠিয়ে দেব কৃষ্ণগন্ধ ছাপ।
দুমিনিট নীরবতা জানে— কতগুলি ভারবাহী দেহ
কাঁধ জুড়ে মেলে রাখে নিজেদের লাশ

তুমি যদি অন্ধভক্তি বলো
আমি তবে লিখে দেব রুজি-রোজগার
ওপাড়ার বুনো জাঁতাকলে
গান বাজে নাচ হয় এবং আরাম।
যে কথাটি লুকোতে এতটা জলঘোলা— পলাতক গুড়চিনি জানে
শ্রমের বানান জুড়ে শুধু মার নাম।

 

দলায় মাখন উঠে আসে এমন যন্ত্রণা দাও
নিভৃত ভৃত্যবোধ থেকে ছেঁকে নেওয়া
মজ্জাহীন চাপ চাপ তুলো তেল ত্বক তোমার বালিশ হোক আজ
আমার সূচালো দাঁতে অপ্রস্তুত অগাধ অগাধ জল
শুষে নিতে শুরু করা আজকের নয়।
লাল থেকে নীল আর নীল থেকে বর্ণক্ষরা ধূসর জলচ্ছবি
ব্যথা মুছে তৃপ্তি মুছে বধির করেছে সব অনুভূতি দাগ।
হাতুড়ি বা চুম্বন কোনও টানে জাগবে না আর।

এই ভৃত্য জাগরণ শুধুই থালার মাঝে মুঠো ভর্তি দলা—
ওঠাও ওঠাও

 

আমাকে তুমুল দানে উপযুক্ত করেছ ভিখারি
যে আগুন গ্রাস নেয় সেই পথে চলেছে হৃদয়
স্বরের ভবিষ্যতে বিনয়ের ভীতি জেগে বলে
তোমার দানের গতি যত দ্রুত যেন শেষ হয়
মেরুতে দণ্ড ডাকে আয় আয় হাওয়া বেঁধে ওঠ
চোখের গ্রন্থি বোঝে অশ্রু কেন এ অসময়
হে দাতা অমোঘ টানে গুটিয়ে ফ্যালো এ উপকার
যেখানে চড়ুই গানে অযথা পায়রা যোগ দেয়।

 

তোমার চোখের কাছে জল রেখে আসি
আমাদের এলোপথ কুচো পশমের মতো মাংস রেঁধে গেছে
দু চারটে অকালপ্রতিমা— কবে মরে গেছে
ভাঙা কলসির দাগে
তুমি যাও
যে উপমা ফুটতে শেখেনি তার ঘরে উনুন পোহাও

শীতের গোরস্থানে শিশু রোজ ফুল খেলে
‘মৃতজন্ম শেষ হলে তাদের জীবিত ভেবে গান লেখা হবে’
এমন প্রবাদ ধরে যে ঘোর গড়ায়
তাকে তুমি জল ভেবে তড়িঘড়ি স্নান কোরো নাগো

আমরা মাংস দিয়ে মেঝেকে করেছি লাল
বিষাদের থালা জুড়ে সাজিয়ে রেখেছি উপাচার
মধু দেখে মৌমাছি হেসে গেছে অপুষ্টি বলে
এ বিষাক্ত মাটি ছিঁড়ে দেহ ঢুকবে না আর দ্যাখো!
তুমি যাও,
ধৃতরাষ্ট্র সাজো।

 

কতদিন মাটি শস্য হয়ে জন্ম নেয়নি।
কতদিন শস্য মাটি মাটি আদর পায়নি।
আমরা তবু বীজক্ষেত্র ধরে ক্রমাগত পায়ের আখরে
ঢেলে যাচ্ছি ক্রোধ।
ঢেলে যাচ্ছি রোগ।
আলের ওপর শুয়ে গান গাই শিস দিই
ভান করি হৃদয় ভাঙার।
তৃপ্তিবোধে চুকচুক মোহদম্ভ জিভ জন্ম লয়।
আমাদের মাঠে কোনও গরু নেই হাল নেই নেই বৃষ্টিপাত
পাথরে গামছা বেঁধে উঠে যায় কৃষি থেকে আমার শাবক।

প্রার্থনা জুড়ে লিখি—
শ্রমিকের মতো তার ঘাম হোক। কাম হোক।
তেষ্টা মরে যাক…

 

ঘাম থেকে বাসি রুটির গন্ধ পেয়ে আমি চুরি করি ফেরিওয়ালার ঝুড়ি। ঝুড়িতে লুকানো বাচ্চা মেয়ে। ঝুড়িতে লুকানো দুদিনের স্নান। খাবলে খাবলে উঠিয়ে আনি দুই রাতের গাছের হাঁপড়। পেটে হাত বোলানোর কণ্ঠ। ফেরিওয়ালা আমার দিকে বুক ভরে তাকায়। আহা! খিদে পেয়েছে? ভাত আনি? ফেরিওয়ালা আমার দিকে ঘুম ঢেলে তাকায়। আহা! বিছানা চাই? একটা চট এনে ধরি? ফেরিওয়ালা গান গাইতে থাকে। গানে কত নদী। গানে কত গ্রাম। গানে কত রাষ্ট্র— যেন হাঁসফাস করছে— যেন বাড়ি যেতে চাইছে। আমি জানি ওর কুঁড়েঘরটা আর নেই। আমি জানি ওর ছোট ক্ষেতটি শুকিয়ে গেছে। আমি জানি ওর দরজা বলে আর কিছু নেই। শুধু কড়িকাঠ কড়িকাঠ আর কড়িকাঠ…

আমি ঝুড়িটুকু ফেরত দিয়ে দিয়েছি। ওর মেয়েটা আকাশ খুঁজছিল…

 

গায়ের থেকে একটা মোমবাতি পিছিয়ে যাচ্ছে আর
ভ্রমের মতো জন্ম নিচ্ছে রাত।
এইবার পেটের গায়ে মাছি বসিয়ে আমি
আমেজের সন্ধানে খাটিয়ে নেব মশারি।
মশারি বরাবর নিরাপত্তার অহঙ্কার দেবে কিন্তু
রাজনীতি করবে না। এমন কত
ছেঁড়া জমিদারি কেটে নিজের মতো খাঁচা গুছিয়ে নিয়েছি!
খাঁচার বাইরে বেড়ালছানা ওঁৎ পেতে লকলকে।
খাঁচার বাইরে কৃষ্ণঠাকুর হাঁটু মুড়ে অপেক্ষায়…
একটা মাছি আর একটি পেট এই জুড়েই গ্যালারি।
উপভোক্তা এবং দর্শক।
আমার বাড়ির চারপাশে কীটনাশক শুধু
অন্য ঘামের গন্ধ এড়াতে। মঞ্চহীন জরুরি অবস্থাও
এই শীতঘুম ভাঙাতে পারে না।

 

এখনও পালকের গায়ে হাত রেখে পড়ে আছে রাজা
আকাশ তীব্র কাঠিন্যে সোজা হয়ে বসে আছে চাঁদ
আমাদের এ সময় গান গাওয়া মানা
আমাদের রক্তে তেরচা শোক বা উপমা
কিছুই বজায় নেই আজ।
রাজা উঠে বসে— বস্ত্র সামলায়
ঘুমের ওষুধ থেকে দুচারটে বড়ি ছুঁড়ে দেয় অপার মহিমায়
পালকের রং
পালকের দাবি দাওয়া
পালকের নিজের বাড়ি
এমনকী পালকের মায়ের নামও আমরা
কেটে ফেলি লিস্ট থেকে

বিদ্রোহ আসলে সখা— অজুহাত
ক্ষমতার পায়ে পায়ে জুতোর মাপের।