Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তিনটি অণুগল্প

যুগান্তর মিত্র

 

চুপ

রাবেয়া থম মেরে বসে আছে দাওয়ায়। আরও ছটি পরিবারেরও যেন অখণ্ড নীরবতা।

পরশুদিন নাসিরের সৎকারের পর থেকে বাক্যহারা রাবেয়ার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। শুধু ভাবলেশহীন শূন্য দৃষ্টি তার।

আচমকা লকডাউনে আটকে গেল একই এলাকার সাতজন। মেরঠ থেকে কিষাণগঞ্জে যাচ্ছিল একটা পেঁয়াজের লরি। তাতেই উঠে বসেছিল ওরা। এরজন্য ড্রাইভারকে কিছু টাকা ধরে দিতে হয়েছে।

কিন্তু তারপর? ট্রেন-বাস বেবাক বন্ধ! প্রশ্ন ভাসিয়ে দিয়েছিল নাসির।

আগে তো ঐ পর্যন্ত যাই। তারপর দেখা যাবে। জবাব দিয়েছিল সুবল। তার বুদ্ধিতেই লরিতে চেপে বসা।

পেঁয়াজের বস্তা আর তীব্র ঝাঁজের সঙ্গে গাদাগাদি করে প্রায় খালি পেটেই ওরা চলে এসেছে কিষাণগঞ্জে। সেখান থেকে রাস্তা বা রেললাইন ধরে পায়ে হেঁটে নিজেদের গ্রামে। পথে কম যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি! যত বাড়ির কাছাকাছি এগিয়েছে, ততই উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপেছে বুক।

বাড়ি পৌঁছতেই ফুরফুরে শিমুল তুলোর ওড়াওড়ি। অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি সেই সুখবিলাস। পঞ্চায়েত থেকে বলে গেছে, বাড়ির বাইরে যাওয়া চলবে না চোদ্দদিন। প্রথম ধাক্কাটা সয়েও গেল। তবু তো পরিবারের সবাই এক ঠাঁই, পাশাপাশি। কিন্তু পরের ধাক্কাটা সামলানো গেল না। ঘরে ঢোকার খানিক পরেই নাসিরের হার্টফেল! আনন্দে নাকি এতটা পথ উজিয়ে আসার ধকলে, জানে না কেউ।

সেই থেকে রাবেয়া চুপ। কবরে মাটি দেওয়ার সময় গৃহবন্দি ছয় পরিবারের কাউকেই যেতে দেয়নি পঞ্চায়েত। সাত মাস ইটভাটায় কাজ, এতটা পথ একসঙ্গে ঘরে ফেরা! তারাও চুপ।

আতঙ্কে চুপ হয়ে আছে গোটা পাড়াও।

 

ডানা

ফেসবুক খুলে আপনমনে স্ক্রল করতে থাকেন প্রিয়তোষবাবু। দু-একটা পোস্টে লাইক বা কমেন্ট করেন। তবে বেশিরভাগই দেখে যান শুধু। ছেলে এবার দিল্লিতে ফিরে যাওয়ার আগে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে গেছে। প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে মেনে নিয়েছেন তিনি। তাঁর অবসরের অনেকটা সময় কেটে যায়।

কত অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা এখন কবিতা লিখছে! এসব পড়ে তিনি আনন্দ পান। হতাশাও আসে। নিজের কথা মনে পড়ে যায়। একসময় চোখ বন্ধ করে নানা কথা ভাবেন তিনি। কিশোর বয়সে কবিতা লিখতেন। বাবা খুশি হয়ে আলাদা একটা খাতাই কিনে দিয়েছিলেন কবিতা লেখার জন্য। মাও বলতেন, সময় পেলেই লিখবি আশু। এরপর বেসরকারি চাকরির জাঁতাকলে আটকে পড়লেন। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় মায়ের পীড়াপীড়িতে আগেভাগেই বিয়ে করতে হল। স্বল্প বেতন, তাই আর-একটু গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। সংসারের ঘূর্ণিপাকে অভিমানী কবিতা কালেভদ্রে ধরা দিত। সুরমা সেসব লেখা যত্নে রাখতেন তাঁর ছোট্ট টিনের বাক্সে। ক-বছর আগে সুরমা চলে গেলেন। পুত্র বিতানও ভালো চাকরি পেয়ে দিল্লিতে পোস্টিং। বছরে দু-তিনবার আসে বাবার কাছে।

যৌবনে সুরমা প্রায়ই বলতেন, একটা কবিতার বই বের করো। সংসার আর ছেলের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে বই ছাপানোর বিলাসিতা দেখাতে পারেননি তিনি। এখন ফেসবুক খুললেই দেখতে পান তরুণ-তরুণীরাও কত কবিতার বই বের করছে। কদিনই-বা লেখালেখি করছে তারা! তবু সাহস দেখাতে পারছে, যা তাঁর ছিল না।

আজকাল চোখ বুজলেই আশুতোষবাবু অজস্র বই দেখতে পান। চেনা-অচেনা। ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে তাঁর আশেপাশে। একটার মলাটে নিজের নাম দেখে চমকে ওঠেন তিনি। আলোকিত হয়ে ওঠে তাঁর মুখ। একসময় নিজেও ডানা মেলে উড়তে থাকেন সুখস্বপ্নে! চোখ মেলতে ইচ্ছে করে না তাঁর।

 

রুপোলি আঁশ

সামনে ল্যাপটপ খোলা। একটা লেখা নিয়ে ভাবতে ভাবতে জলের গ্লাস হাতে তুলে নেয় রায়হান। হঠাৎ দমকা বাতাসের মতো হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার ঘরে। হকচকিয়ে যায় সে। কে হেসে উঠল! ঘরে তো কেউ নেই! আচমকা চোখ পড়ল আয়নায়। তারই প্রতিবিম্ব, অথচ চোখে কৌতুক, মুখে হাসির আলখাল্লা!

তুমি কে?

কোনও জবাব না-দিয়ে শুধু তার চোখে চোখ রাখে প্রতিবিম্ব। তারপর নিজের চুলে হাত বোলায়, জামার কলার ঠিক করে। রায়হানের উপস্থিতিকেই যেন অগ্রাহ্য করতে চাইছে সে।

আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না? কে তুমি? বিরক্ত হয় রায়হান।

একই কথা ব্যঙ্গকণ্ঠে বলে প্রতিবিম্ব। দাউদাউ রাগে রায়হান হাতের গ্লাস থেকে জল ছুঁড়ে দেয় আয়নায়। সেই জল ছিটকে আসে তার গায়ে। বুক-পেট-হাত-মুখ সর্বত্র জলের ছিটে লাগে। প্রতিবিম্ব হো হো করে হেসে বলে, তাকিয়ে দেখো নিজের দিকে।

রায়হান আবিষ্কার করে, তার সারা শরীরে রুপোলি আঁশ ভরে গেছে। চেষ্টা করেও তুলতে পারছে না সে!

–উঠবে না, যতই মেহনত করো।
–মানে?
–তুমি তো আঁশের আড়ালেই থাকতে চাও সারাক্ষণ। সবকিছু দেখেও দেখো না, শুনেও শোনো না। নিজের বৃত্ত ছাড়া কিছু বোঝো?

দমবন্ধ হয়ে আসে রায়হানের। প্রবল অস্বস্তি কাটাতে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে, রাস্তায় চলাচল-করা লোকজনের গায়েও রুপোলি আঁশে ভরা। তার মতোই। খানিকটা দূরে একজনকে দেখতে পায় সে, যার গায়ে কোনও আঁশ নেই। সম্মোহিতের মতো তার দিকে এগিয়ে যায় রায়হান। কাছাকাছি এসে লোকটাকে চিনতে পারে সে। প্রতিবাদী এই লোকটা গতমাসেই খুন হয়েছে না? যাকে সে একসময় খুব পছন্দ করত!

থমকে দাঁড়ায় রায়হান। ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যায় লোকটা। রায়হান তাকিয়ে থাকে নিজের শরীরময় রুপোলি আঁশের দিকে।