Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বৃত্রাসুর হন্তারক শম্ভু রক্ষিত

সুব্রত ঘোষ

 


লেখক বিজ্ঞানী, কবি ও প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে তার জন্যে কবির উপরে দোষারোপ অন্যায় – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

যাঁর কবিতা পাঠে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় চর্চা বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান প্রয়াত কবি, চিন্তাবিদ শিবনারায়ণ রায় ১৯৭৩ সালে লেখেন— “বাংলা ভাষায় এই ধরনের কবিতা বিশেষ পড়িনি— বরং মিল আছে আমার প্রিয় কোনও কোনও ফরাসি কবির সঙ্গে”, কবি শঙ্খ ঘোষ লেখেন ২০১৭ সালে— “…প্রতিমাকল্প আর ভাবনা বা দৃষ্টির জটিলবুননে নতুন একটা আকর্ষণ তৈরি করেছিল শম্ভু রক্ষিতের কবিতা। আমি সব সময়ে তাঁর কবিতা পড়ে গেছি…”, ওই একই সময়ে অগ্রজ কবি মলয় রায়চৌধুরী ঘোষণা করেন— “সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত কবি শম্ভু রক্ষিত”, বাঙালির চিন্তাজগতে সেই কবি কেন এত অচর্চিত, উপেক্ষিত— এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় আমাদের প্রজন্মের— আমাদের মানে আমরা যারা ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে এ কবির কবিতার নিয়মিত পাঠক। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ প্রশ্নের উত্তর দাবী করবেই।

শম্ভু রক্ষিতের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ অগস্ট, তাঁর মামার বাড়ি ১১ ঠাকুরদাস দত্ত লেনে। মৃত্যু ২৯ মে ২০২০ হলদিয়ার কাছে বিরিঞ্চিবেড়িয়া গ্রামে। সূতাহাটার পূর্ব শ্রীকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষার পর চলে এসেছিল হাওড়ায় মামাবাড়িতে দাশনগরের ঠাকুরদাস দত্ত লেনে। ব্যাঁটরা মধুসূদন পাল চৌধুরী স্কুলে শিক্ষা শেষ করে নরসিংহ দত্ত কলেজে ভর্তি হয় । কিন্তু চিরকাল বাঁধাধরা শিক্ষায় অনাগ্রাহী ছাত্রকে কলেজ বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি।

প্রথম মুদ্রিত কবিতা ‘মা’ পত্রিকায়, শিরোনাম ‘আমি বাঁচতে চাই’। ‘আমি বাঁচতে চাই’ এই চিন্তা আমরা পরবর্তীকালে ওর বহু রচনায় বারবার ভেসে উঠতে দেখি।

হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থাকলেও এই আন্দোলন নিয়ে ‘ব্লুজ’ নামে এক পত্রিকা প্রকাশ করত। পত্রিকা প্রকাশে এখানেই তার হাতেখড়ি। এ পত্রিকা বেশিদিন না চলায় ১৯৭০ সালে শুরু করে ‘মহাপৃথিবী’। ওর বাবা হাওড়ার দাশনগরে এক কারখানায় কাজ করতেন যারা লোহার সিন্দুক তৈরি করত। দারিদ্র যার চিরসঙ্গী পত্রিকা প্রকাশকালে তার অন্যথা হবার কথা নয়। ‘মহাপৃথিবী’ পত্রিকার কাগজ শম্ভু জোগাড় করত তখনকার দিনে প্রচলিত হাতে টাইপ সেটিং করা ও পায়ে দাবানো মেশিন যাকে ট্রিডল্‌ মেশিন বলা হত, একটা একটা করে পাতা ছাপানো হত, সেই রকম বিভিন্ন প্রেসে ঘুরে ঘুরে ছাঁট কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে এসে।

এর পরের ঘটনা ১৯৭৫-এর ইন্দিরা গান্ধির জারি করা কুখ্যাত জরুরি অবস্থা ঘিরে। ইচ্ছামত লেখা চলবে না। লেখক, শিল্পী, চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ— সবার কণ্ঠ রুদ্ধ। এর বিরুদ্ধে সারা দেশময় এই সব মানুষ নিজেদের বেছে নেওয়া পথে প্রতিবাদ শুরু করল। কবি জ্যোতির্ময় দত্ত এক পত্রিকা প্রকাশ করতেন, শিরোনাম ‘কলকাতা’। তিনি প্রধানত শম্ভু রক্ষিতকে সঙ্গে নিয়ে এ পত্রিকার ‘বিশেষ রাজনীতি সংখ্যা’ প্রকাশের কাজে নেমে পড়লেন। পুলিশের সাঁড়াশি চাপে কোনও ছাপাখানা রাজি হবে না এর ছাপানোর দায়িত্ব নিতে। এমন কি এর সম্পাদকীয় কাজ করার জায়গা পাওয়াও সমস্যার। অবশেষে ডালহৌসি এলাকায় এক কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসের কর্তার দৌলতে এক জায়গা পাওয়া গেল। সমস্ত অফিস যখন ছুটি হচ্ছে তখন এখানে শুরু হচ্ছে বিশেষ কর্মযজ্ঞ। বেশ কয়েকটি প্রেস থেকে এক আধটা পাতা করে ছাপানোর ব্যবস্থা হত যাতে প্রেসের মালিক বুঝতে না পারেন গোটা ব্যাপারটা কী হচ্ছে। এভাবে এক কিম্ভূতকিমাকার রূপ নিয়ে প্রকাশ পেল ‘কলকাতা’ পত্রিকার ‘বিশেষ রাজনীতি সংখ্যা’— বর্ষা ১৯৭৫। এ সংখ্যায় স্থান পেয়েছিল অন্যান্য লেখার মধ্যে জ্যোতির্ময় দত্ত, গৌরকিশোর ঘোষ/রূপদর্শী/গৌড়ানন্দ, রবীন মন্ডলের গদ্য ও এর সাথে ‘সাক্ষ্য’ ও ‘রাজনীতি’ শিরোনামে শম্ভু রক্ষিতের দুটি কবিতা।

এদিকে সিদ্ধার্থ রায়ের পুলিশ তো চুপ করে বসে নেই। লেখকদের সবাইকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। শম্ভু রক্ষিত বুঝতে পারল পুলিশ ওর পেছনে। সব সময় সঙ্গে রাখত একটা নোংরা লুঙ্গি— পেছনে পুলিশ বুঝতে পারলে লুঙ্গিটা প্যান্টের ওপর চাপিয়ে নিত। একাধিকবার ওই লুঙ্গি পরে হঠাৎ বাজারের এক আলুওয়ালার পাশে বসে আলু বেচতে শুরু করে দিত।

দুজনেই পলাতক— জ্যোতির্ময় দত্তের এক চিঠি তাঁর স্ত্রী মীনাক্ষী দেবীর হাতে পৌঁছিয়ে দেবার দায়িত্ব শম্ভু নিজের ঘাড়ে নিল। মীনাক্ষী দেবী দরজা খুলে ওকে দেখে তো অবাক। ‘সেকি তুমি এখানে কেন?’ শম্ভুর উত্তর, ‘দূর, পুলিশ আমায় জিজ্ঞেস করলে বলব আমি ধোপা, বৌদির কাপড় নিতে এসেছি।’ বাড়ির কিছু নোংরা কাপড়ের পুঁটলি ঘাড়ে করে ‘ধোপা’ বেরিয়ে গেল।

শেষকালে ধরা পড়ল— অকথ্য অত্যাচারেও পুলিশ ওর সহযোগীদের হাল-হকিকতের কথা নিষ্কাশন করতে পারেনি। এটা করতে পারলে ওর সহযাত্রী আরও কয়েকজনের লালবাজারে একাধিক রাত কাটিয়ে ঠিকানা হত কোনও জেলখানায়। শারীরিক অত্যাচারকালে ওর পায়ের শিরায় পুলিশের লাঠির ঘায়ে বাঁ চোখটা গেল বিগড়ে। অন্য চোখটাও কিছুটা ধাক্কা খেল। শেষ জীবনে ও যে চোখে একবারেই দেখতে পেত না সেটা হয়ত ওর কাছের মানুষরাও বুঝতে পারেননি।

শম্ভু, জীবিকা বলতে আমরা যা বুঝি, কোনও দিন তার সন্ধান করেনি, হেলায় প্রত্যাখান করেছে খ্যতনামা প্রকাশনা সংস্থার চাকুরীর প্রস্তাব। কারণ ও চেয়েছে স্বাধীনতা। ‘মহাপৃথিবী’ পত্রিকাই ওর সারাজীবনের জীবিকা। ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশনার পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠিত হল অসুস্থ শম্ভু রক্ষিতকে সঙ্গে নিয়ে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিরিঞ্চিবেড়িয়ায়। শম্ভুর প্রয়াণ ২৯ মে।

কবি শম্ভু রক্ষিত

শম্ভু রক্ষিতের কবিতা লেখা শুরু সতেরো বছর বয়সে, ধরে নেওয়া যায় ১৯৬৫। প্রথম কবিতার বই ‘সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ’— ১৯৭১। অন্যান্য একক কবিতার বই— ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ (১৯৭৩), ‘রাজনীতি’ (১৯৭৬), ‘সমসূত্র’ (১৯৭৯), ‘পাঠক অক্ষরগুলি’ (১৯৮১), ‘সঙ্গহীন যাত্রা’ (১৯৯১), ‘আমার বংশধররা’ (১৯৯৭), ‘আমি কেরর না অসুর’ (২০০৪), ‘ঝাড় বেলুনের জোট’ (২০১৩), ‘শম্ভু রক্ষিতের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (২০০৫ ও ২০১৫)। সম্মিলিত কাব্যগ্রন্থ: ‘সাম্প্রতিক তিনজন’ (১৯৭৩, সহযোগী কবি— দেবী রায়, সুব্রত ঘোষ), উত্তর দক্ষিণ (১৯৭৪; অসীমকুমার বসু, জ্যোতির্ময় দাশ, অজিত বাইরী), ‘সুব্রত রুদ্র/শম্ভু রক্ষিত’ (১৯৭৫), স্বরাহত নিষাদ (১৯৯০, জ্যোতির্ময় দাশ, আলোক ভট্টাচার্য, অসীমকুমার বসু, বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)। সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থ: বিদ্রোহ জন্ম নেয় (১৯৭৮)।

গদ্য রচনা: ছোট গল্প— ‘শুকনো রোদ কিংবা তপ্ত দিন অথবা নীরস আকাশ প্রভৃতি’ (১৯৭৪), উপন্যাস: ‘অস্ত্র নিরস্ত্র’ (১৯৮০)।

সম্মাননা: নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ওয়েব পত্রিকা ‘শব্দগুচ্ছ’ প্রদত্ত বিশেষ সম্মাননা, পঃবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ‘মধুপর্ণী’ পুরস্কার।

দুটো বই শম্ভু রক্ষিত যে ভাষায় উৎসর্গ করেছিল সেটা লক্ষ করার মত:

বই— ‘সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ’, উৎসর্গ:

ঈশ্বরের রোষ থেকে মানুষের ত্রাণ করার জন্য
আর এক ঈশ্বর-পুত্রের আত্মাহুতি ও রক্তদান

বই— ‘আমি কেরর না অসুর’, উৎসর্গ:

হে দেবজন, আমি বম্রক যদি স্বেচ্ছায়
আপনার চন্দনচর্চিত হাত, একবার রাখেন আমার কপালে—
সেজন্য ব্যঙ্গ মিনার বহন করে
পায়ে হেঁটে
আপনার সমীপবর্তী হয়েছি।
আবো যদ্দুস্যুহত্যে ক্যুৎসপুত্রং প্রাবো যদ্দস্যুহত্যে ক্যুৎসবৎসম।

এভাবেই কবি শম্ভু রক্ষিত তার উপস্থিতি জানান দেয়।

আর এক বই ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’তে কারও প্রতি ‎উৎসর্গ করা নেই অথচ তিনটে বাণী প্রথমেই উচ্চারিত। প্রথম ও তৃতীয়টি উপনিষদের, দ্বিতীয়টি রবীন্দ্রনাথের।

এ-জগৎ তাঁর ঐশ্বর্য।

.

আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার
চরণধূলার তলে।
সকল অহঙ্কার হে আমার
ডুবাও চোখের জলে।

.

তিনিই এই জগৎ হয়েছেন।

প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতার কয়েকটি লাইন:

আলোর পৃথিবীকে দেখার পরও আমি কখনো গবেষণা করিনি
কেন পৃথিবী আমাকে আকৃষ্ট করছে
সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ

(সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ)

একই কবিতায় কয়েক স্তবক পরে বলছেন:

আমার মুখ ও চিবুকের মধ্যে মৃত্যু অস্তিত্ব ও সৃষ্টির কারণ। আমার
মুখ ও চিবুকের মধ্যে অধ্যাত্ম জগৎ যেন কথাবার্তা বলছে এবং স্থান
কাল যেন চিন্তায় খণ্ড খণ্ড, যেন ভেঙেচুরে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে

কেবল নিজে নয়, অন্য মানুষেরা জীবন নিয়ে কেন এত আসক্ত সেটাই যেন কবির বিস্ময়। তিনি তো জীবন সম্বন্ধে এত উদাসীন, এত নিস্পৃহ। মনে রাখতে হবে এটি শম্ভু রক্ষিতের প্রথম বইয়ের প্রথম কবিতার কয়েকটি লাইন।

আবার ওই বইয়েরই অন্য এক কবিতায় শম্ভুর নিবেদন:

আমি এক আবেগে এক নতুন মানুষ হয়ে উঠেছি
এক গভীর পরিবর্তন এসেছে আমার মধ্যে
…  …  …
…  …  …
আমি একজন স্বাধীন মানুষ
যা কিছু জীবন নয় তার সবটুকুকেই পরাভূত করতে পারি

(আমার সামনে, আমার চতুর্দিকে)

শম্ভুর বহু আলোচিত বই ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না‘র রচনাকাল দেখাচ্ছে ১৯৭১। তখন শম্ভুর বয়স ২৩। এর কবিতা নিয়ে নিজের চিন্তা দূরে সরিয়ে যত অন্যকৃত আলোচনা পড়া যায় তত নিজের চিন্তা লাট্টুর মত ঘোরপাক খায়। কবিতা শুরু হবার আগে বইয়ে যে তিনটি বাণীর সমাবেশ তার ওপর নির্ভর করে কখনও মনে হয় এর মূল সুর আধ্যাত্মিকতা। ওর কান্না যার জন্য সেই প্রিয় ধ্বনি কে? মনে হয় তাঁর প্রেমিকা। কারণ ১ নং কবিতার প্রথম লাইন:

তুমি ঈশ্বর কন্যা, তুমি আমাকে বিশুদ্ধ কবির জনক হতে সেদিন শেখালে

এই ঈশ্বর কন্যাই কবির প্রিয় ধ্বনি— এ নিশ্চয় মনের মত কবিতা লিখতে না পারার জন্য কান্না নয়। সে তাহলে শম্ভু রক্ষিতের কান্না হতে পারে না। কিছুটা ধরা যায়, কিছুটা অধরা নিয়ে এ এক অপূর্ব শব্দমালা। শম্ভু রক্ষিতকে ওর সারা জীবনের কাব্য নিয়ে যেভাবে পরবর্তীকালে চিনেছি এর সকল প্রকাশ ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’-র মধ্যে। কখনও লাইন থেকে লাইনে বিষয়ান্তরে চলে যায়, কখনও শব্দ নিয়ে লোফালুফি খেলে, নতুন শব্দ সৃষ্টি করে পাঠককে ধন্দে ফেলে, বেশিরভাগ সময়ে নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে, হ্রস্বীকৃত লাইন থেকে পরবর্তীতে পাঠককে দীর্ঘ পথ হাঁটায়, যতি চিহ্ণের তোয়াক্কা করে না, কবিতাটা শেষ হল কিনা বুঝতে না পেরে পাঠক পাতা ওল্টায়।

পূর্বাভাস গবেষণালব্ধ ফল দৃষ্টির আকর্ষণ
ঘুর্ণনের মাত্রা ঐসব অর্থভেদে, জাগতিক সত্য ও কল্পনার দ্বারা তার ব্যাখ্যা
পরিবেশন সতর্ক দল সেই তাপমাত্রা যেমন দীপ্তি সূর্য ফেনিল শান্তি
এই আলোড়ন, যন্ত্রপাতি,কীট সূর্যকিরণ আসে, ইহবাহ্য
নীহারিকা নক্ষত্রপুঞ্জ অগ্রসর হও, বিজয়ের স্বপ্ন বাস্তব, ঠিক যে-রকম গতি হয়
মহাশূন্যের যে-অংশ পরিবেষ্টিত সেখানেও চাঁদ ষোল আনা গোলাকার নয়

(কবিতা নং ৩৩)

প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না-র একাধিক কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন জ্যোতির্ময় দত্ত— ‘Lament for a Beloved Voice’ নামে। একই বইয়ের অন্য কবিতা অনূদিত হয় ‘Weeping for the Sound Sublime’ শিরোনামে, যার অনুবাদক গোবিন্দ চন্দ্র ঘোষ।

‘রাজনীতি’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল এপ্রিল ১৯৭৬। বইয়ের প্রথমেই শঙ্খ ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ ও জ্যোতির্ময় দত্তের যৌথ বিবৃতি সে সময়টাকে তুলে ধরার পক্ষে যথেষ্ট। এ বিবৃতির প্রথম বাক্যটা উপস্থাপিত করা হল:

ভারতবর্ষে আজ যেভাবে নাগরিকদের বিনাবিচারে কয়েদ করা হচ্ছে, সংবাদপত্রের হচ্ছে কণ্ঠরোধ, মানুষের একের পর এক স্বাভাবিক অধিকার ও সম্মান করা হচ্ছে হরণ, এবং যেভাবে কেবল হুকুমে-হুকুমে দেশের শাসন চালানো হচ্ছে, আমরা তার প্রতিবাদ করি।

সচেতন পাঠক বুঝতেই পারছেন ভারতের ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায় আভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ঘিরে এ কবিতা গ্রন্থ। চতুর্থ মলাটে একটু অস্পষ্ট ছাপায় জ্যোতির্ময় দত্ত রচিত ‘শম্ভু রক্ষিতের গান’ শীর্ষক কবিতা এ বইকে অন্য মর্যাদা এনে দিয়েছে। অন্তর্ভুক্ত কবিতার সব কটির বক্তব্যই একেবারে সরাসরি— প্রতিবাদের কবিতা যেরকম পাঠক আশা করেন। ইচ্ছা করে এর অনেক কবিতা পাঠকদের সামনে হাজির করতে। আমি অসহায়।

লড়াইয়ের ভেতরে গিয়ে আমি মুঠি থেকে খুলেছি শব্দ
ও লড়াইয়ের মধ্যে থেকে আমি জীবিতের প্রতি শ্রদ্ধা আশা করেছি।
শব্দের মধ্যে গিয়ে আমি এঁকেছি হাজার শাসানি নকশা
ও ওই শব্দের মধ্যে দিয়েই আমি শত্রুকে পরাস্ত করব সাব্যস্ত করেছি।

(স্থায়ী বিপ্লব)

.

রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক রাজধানীতে বাস করে
রাজনীতিবিদরা এক বিভবশালী বিবুধের দ্বারে বসে
প্রেরণাপূর্ণ নরক সৃষ্টি করে
রাজনীতিবিদরা দেশপ্রেমসমৃদ্ধ গ্রাম ও শহরের মানুষদের শেখায়
‘নিতান্তই দলের একজন লোক’— তাদেরই দুর্দশার হেতু।

যারা কোনও শিশুদর্শকদের হয়ে ছবি আঁকে না
বা লাথিয়ে খামচে চেঁচিয়ে হাড় ভাঙবার যোগাড় করে না
রাজনীতিবিদরা সাধারণত তাদের উপর নির্ভর করে না
জনগণ নামক শ্রবণযন্ত্রে সাড়া জাগাবার উদ্দেশ্যে
রাজনীতিবিদরা কাগজে বেতারে পাঠায়
দেশ স্বাধীনতা পৃথিবী মঙ্গল বিষয়ে বিষ-অভিজ্ঞতা

রাজনীতিবিদরা রচনা করে এখনও কারাগার
পশু-সংস্করণ, রাক্ষস খোক্কসের সৃষ্টি-রহস্যের আদিকাণ্ড

তারা আধা পুরনো সমাজের মায়া পঞ্জিকার ভেতরে এখনও লুকিয়ে থাকে

(রাজনীতিবিদরা)

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে শম্ভু রক্ষিতের ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘আমি কেরর না অসুর’।

কবি শঙ্খ ঘোষ এক জায়গায় লিখেছেন— ‘বোঝানোর দায়িত্ব নয় কবিতার, কবিতা কেবল প্রাণিত করতে জানে।’ প্রাণিত করে পাঠককে। কবির কাজ সত্যানুন্ধান এবং এই অনুসন্ধান শুরু হয় আত্মানুসন্ধান দিয়ে এবং কবির হাতে এই অনুসন্ধানের একমাত্র অস্ত্র শব্দ। আত্মানুসন্ধান কবিকে এক প্রকট সংশয়ে আচ্ছন্ন করে। রবীন্দ্রনাথের কাছে শেষ জীবনের সমস্যা ছিল— ‘কে তুমি? মেলে না উত্তর।’ আলোচ্য কবিতায় কবির প্রশ্ন কে আমি? নিজের কাছে নিজে এক উত্তরহীন প্রশ্নচিহ্ণ। আমাদের বর্তমানের কবির স্বীকারোক্তি:

আমার মনের মধ্যে অস্থিরতা চলছে
আমি নদীর এই খালের ধারে গাছের ছায়ায় পাথরের ওপর
এই বন্দিশালার অস্থায়ী ছাউনির ভিতর
গৃধ্রকূট এবং গৃধ্রকূট শিখরের মতো দাঁড়িয়ে থাকছি
ভিতরে, অনুসন্ধানে কিসের একটা ক্ষোভ আর আক্রোশ
আমার মনকে অস্থির করে তুলেছে‘

(আমি কেরর না অসুর)

নিজের অস্তিত্বের রহস্য জালে আচ্ছন্ন একবিংশ শতাব্দীর ভাষা অনেক বিজ্ঞান ঘেঁষা।

আমার হাত নিশপিশ করছে
আমার হৃদপিণ্ড আর্টারির মধ্যে চলছে চাঞ্চল্যকর কার্যকলাপ
আমি দেহ না আত্মা বদ্ধ না মুক্ত আমি কেরর না অসুর

(আমি কেরর না অসুর)

রবীন্দ্রনাথকে বলতে হয়েছিল— ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।’

কবি শম্ভু রক্ষিতের গদ্য আলোচনায় প্রবেশের আগে বাংলা কবিতার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে সমসাময়িক কবিরা প্রায় কেউই তাঁর প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। পরবর্তীকালে এক দল কবি বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী—‍ যাঁদের ঘিরে আধুনিক কবিতা কথাটা প্রচলিত হল— রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্তির ক্ষেত্রে অনেকটা সফল। এর পর এলেন ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠী বাংলা কবিতায় নতুন কিছু করার তাগিদে। এঁদের সবার কথা মনে রেখেও বলতে হয় শম্ভু রক্ষিত অনন্য, কারও ধার ধারেনি, কারোর তোয়াক্কা করেনি। এহেন শম্ভু রক্ষিতকে অপূর্ব সৃষ্টিধর প্রজ্ঞার অধিকারী বলা হলে মোটেই অত্যুক্তি হয় না।

গদ্যকার শম্ভু রক্ষিত

গদ্যকার শম্ভু রক্ষিত নিয়ে আলোচনা একেবারেই হয় না। কারণটা সহজেই বোঝা যায়— ওর গদ্য রচনা বড় সীমিত— একটি উপন্যাস ও এক ছোট গল্পের বইয়ের।

উপন্যাসের শিরোনাম ‘অস্ত্র নিরস্ত্র’ (১৯৮০) ও গল্পের বই ‘’শুকনো রোদ কিংবা তপ্ত দিন অথবা নীরস আকাশ প্রভৃতি’ (১৯৭৪)।

শম্ভু রক্ষিতের কবিতার পাঠক এ শিরোনাম দুই কানে আঙ্গুল দিয়ে শুনেও বলে দেবে এ শম্ভু রক্ষিতের রচনার নাম। বড়জোর ভুল করতে পারে— অন্তত গল্পের বইয়ের ক্ষেত্রে— এটাকে কবিতার বই বলে।

যেহেতু উপন্যাসটি আমি সংগ্রহ করতে পারিনি, গল্পের বইতে স্থান পাওয়া সাতটি গল্পের মধ্য থেকে তিনটি গল্প বেছে নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখব।

বইয়ের শিরোনামের একই শিরোনামের গল্প দিয়ে গল্প বলা শুরু। এ গল্প এক দারিদ্রপীড়িত কুঁজো নিতাইয়ের সংসারের কথা। এ সেই কুঁজো নিতাই যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল মাধুরী যে সেই সময়কার ম্যাট্রিক পাশ। এ গল্পে কবি শম্ভু রক্ষিতকে খুঁজতে গেলে মন দিয়ে আদ্যোপান্ত গল্পটা পড়তেই হবে— পাওয়া যাবে জীবন-কাহিনির এক রচনাকারকে। গল্পের শুরু যে কটা শব্দ দিয়ে যবনিকায় ঠিক সেই শব্দগুলোর ব্যবহার—

মিঠু কাটছে। চুনো, পুঁটি আর বিলু কাগজ ভাঁজ করে, রিল করে আঠা লাগিয়ে দিচ্ছে। দুলু জুড়ছে।

এ এক সংসার যা চলছে যেমন করে চলত। চলবে যেমন করে চলছে। কুঁজো নিতাইয়ের সংসার। এমন নিতাই তো সমাজে ছড়িয়ে আছে। এখানেই গল্পকার সমাজের চিত্রকার।

‘খনন’ গল্পে নায়কের নিজের কথায় নিজের মানসিক দোদুল্যমানতা, চঞ্চলতা প্রকাশের মাধ্যমে সময়ের দলিল পেশ করা হয়েছে। মানসিক শান্তির সন্ধানে নায়ক দিশেহারা— না আছে প্রেমে, না আছে প্রকৃতির মধ্যে, না আছে কর্মক্ষেত্রে। নায়ক বলে—

আজো আমি ভালবাসতে চাই। কিন্তু আমার নানারকম চিন্তা আমার ভালবাসার রাজপথে এত অবিন্যস্ত খোয়ানুড়ি ছড়িয়েছে যে, আমার পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল ; তবু ঠিক জায়গায় শরীর ডুবোতে পারলাম না।

গল্পের বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ গল্পের উপস্থাপনা রীতি পাঠককে ছুটিয়ে বেড়ায়, দিকভ্রান্তও করে। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে উল্লম্ফন এত বিচিত্র যে পাঠক দিশাহীন হয়ে অনেক পথ পরিক্রমা করে নিজের অজান্তে আবার নিজের ঠাঁই খুঁজে পান। কেবল এই গল্পে নয় আরো কয়েকটা গল্পে গল্পকার অনেক জায়গায় …. ফাঁক দিয়ে রেখেছেন। এ কেবল অসম্পূর্ণতা নয়, মনে হয় পাঠককে আহ্বান— ‘এসো আমার সহযোগী হয়ে গল্পের কিছুটা তুমিও পূরণ করো।’ এভাবেই পাঠককে টেনে নিয়ে গেছেন।

‘অমালোকিত উৎসমুখে’— এ গল্পের সারাৎসার কী? গল্পের কোন উচ্চারণে গল্পের সারকথা প্রকাশ পেয়েছে— এ প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে?

বস্তুত সুখ এবং শান্তির চেয়ে পৃথিবীতে আর বড় কিছু নেই। মনের অপেক্ষাও মানুষের শত্রু আর নেই, মন মানুষকে কখন কোথায় নিয়ে যায় তার স্থিরতা নেই, মনকে বিশ্বাস নেই।

.

জীবন আসলে সূত্র-সন্ধানী হিংস্র কুকুরের মত।

.

যন্ত্রণা বলতে তুমি কিছু বোঝ, যন্ত্রণা কতরকমের তা তুমি জানো, তুমি বকুল ফুলের ঝরে যাওয়ার যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছ কোনওদিন?

.

তুমি থাকবে কাজ আর কাজ নিয়ে। তুমি কাজের যন্ত্র। কাজ তোমার চেয়ে বড়। জীবনের অন্য কোনও পরিচয় জানবে না। কাজই তোমার একমাত্র লোভনীয় জীবন এবং কর্মের ক্ষেত্রই হল কর্মীর পৃথিবী, যার বাইরেটা শুষ্ক এক যুগের ভূখণ্ড।

.

… নতুন এই জগতকে নতুন করে গড়ে তোলার চাইতে বড় অন্য কিছু কি কল্পনা করতে পারো? আসলে কি জানো, জানা জগতই লোকের প্রিয়। অজানায় সে পা ফেলতে চায় না। নতুন সমাজের কথা শুনলে লোকে মারতে আসে। … এখন তাই প্রয়োজন নতুন সমাজ, নতুন মানুষ, পবিত্রিত মাটির।

এ এক অদ্ভুত গল্প যেখানে ঘন ঘন পট পরিবর্তন হয়। বহু চরিত্র এসে হাজির হয়— এক স্বামিজী, এ্যালিস ল্যান্ড, তথাগত। সে জন্য এর সারাৎসার নিয়ে এত দোদুল্যমানতা। তবু পাঠক কি সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেবেন? যদি তাই হয় তবে তো এ গল্পের মধ্য দিয়ে কবি শম্ভু রক্ষিতকে মানুষের দুঃখ লাঘবের জন্য এক সমাজের পরিবর্তনকামী মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে দ্বিধা থাকে না— যদিও পরিবর্তনের পন্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

চিরসখা হে

পাড়ার লোক বলে দাবী করা যায় না তবে শম্ভু হাওড়ায় থাকত বলে প্রতিবেশী বলা যায়। কবি দেবী রায় আমার এক পাড়ার লোক। দেবী রায়ের বাড়িতেই শম্ভুর সঙ্গে প্রথম আলাপ। এই বয়সে স্মৃতি ঠিকঠাক চলে না। তবে যতদূর মনে পড়ছে সেটা গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ দিকে হবে। চাকুরীসূত্রে আমি তখন ধানবাদে, প্রতি শনিবার বাড়ি আসা। দেবী রায়ের বাড়িতে আমাদের আড্ডা বসত প্রায় প্রতি রবিবার। আলোচনা কেবল কবিতা নিয়ে। বয়সের হিসাবে এ দুজনের মাঝামাঝি আমার অবস্থান।

কবিতা লিখি তবে ভয় হত ওগুলোর প্রকৃত চরিত্র নিয়ে। ওরা দুজনে কবি এটা আমি কেন অনেকেই মেনে নিয়েছে। আমার কবিতাও প্রকাশ পেতে শুরু করল প্রধানত হাওড়া থেকে প্রকাশিত ‘সম্রাট’, ‘সিন্ধুসারস’… আর নাম মনে করতে পারছি না।

এই করে ১৯৭৩ গড়িয়ে এল। আমি স্থানান্তরিত দুর্গাপুরে। আমার মতে সেটাই কলকাতার প্রথম বইমেলা। মেলা বসেছিল এ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্ট্‌স্‌-র সরু ফালি জায়গায়। সেখানে আড্ডা মারতে মারতে শম্ভুই প্রথম প্রস্তাবটা তুলল— আমাদের একটা যৌথ কবিতার বই বার করা যাক। সবাই রাজী। ‘সাম্প্রতিক তিনজন’ প্রকাশ পেল ২৬ সেপ্টেম্বর। আমার সাহসটা বেড়েই চলল। দেবী রায়ের কথা মত একটা বই আমি পাঠিয়ে দিলাম মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ভারতীয় চর্চা বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান শিবনারায়ণ রায়ের কাছে। ভুল বললাম – দুটো বই পাঠিয়েছিলাম এক সঙ্গে। অন্যটা ওই বিভাগের আর এক অধ্যাপক অতীন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের জন্য।

কিছুদিন পর দুর্গাপুরের ঠিকানায় চিঠি এল শিবনারায়ণ রায়ের কাছ থেকে, আমাকেই লেখা।

‘আপনারা তিনজনেই যে কবি সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। আপনার কবিতা আমার খুব ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে আপনার জগৎটা আমার জগতের খুব কাছের।’ শম্ভু সম্বন্ধে ওনার প্রশংসা বাক্য তো এ রচনার প্রথমেই স্থান দিয়েছি।

দুর্গাপুর বাস কালে শম্ভুর এক একটা পোস্টকার্ড ভয়ে ভয়ে হাতে তুলতাম। সব সময়ে ওর আদেশ আসত ‘পাঁচটা কবিতা শীঘ্র পাঠান’। একটা নয় দুটো নয় পাঁচটা, কখনও আটটাও হত। কেবল নিজের পত্রিকার জন্য নয়, অন্য অনেক লিট্‌ল্‌ ম্যাগাজিনের ও ছিল সোল ডিস্ট্রিবিটর।

তখন আমার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘চিঠি সিরিজের কবিতা’-র সল্‌তে পাকানো হচ্ছে। এই সময় শম্ভুর পোস্টকার্ড। পাঁচটা কবিতা পেয়ে এরকম উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় আমি আপ্লুত। এর আগে অনেক পাঁচ পাঠিয়েছি, এ রকম উচ্ছ্বাস তো দেখিনি। শম্ভু লিখল— ‘বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এক নতুন সংযোজন’। একটু বাড়াবাড়িই মনে হয়েছিল। তবু হাজার হোক কবি বন্ধুর প্রশংসা— একে একপাশে সরিয়ে রাখি কী করে।

ইতোমধ্যে আমি কলকাতায় চলে এসেছি, থাকি ঢাকুরিয়ায়। শম্ভুর সঙ্গে যোগাযোগ আরও বেড়ে গেল। তখন ‘মহাপৃথিবী’ মধ্যগগনে। হঠাৎ শম্ভু আমার বাড়িতে বসে প্রস্তাব পাড়ল— ‘এর পরের সংখ্যাটার আপনি সম্পাদক হোন।’ নিজের যোগ্যতার কথা শিকেয় তুলে রাজী হয়ে গেলাম। এই সংখ্যায় শিবনারায়ণ রায়ের পুরো চিঠিটা স্থান পেয়েছিল। এর পর ‘মহাপৃথিবী’ পত্রিকার সাথে যোগাযোগ নিবিড়তর হল।

আবার কলকাতা ত্যাগ। কেবল বছরে একবার বইমেলায় দেখা হত। আবার কলকাতায় ফিরে এসে বই ছাপানো নিয়ে কিছু কাজ করেছিলাম। শেষবার ফোনে কথা হয়েছিল বছর চারেক আগে— শম্ভুর সমগ্র সৃষ্টি নিয়ে একটা বড় মাপের কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম। অসুস্থ অবস্থায় শম্ভু হ্যাঁ বলেছিল। ওটাই আমার সঙ্গে ওর শেষ কথা।

।।জরাভারাতুরে নবীন করো ওহে সুধাসাগর।।

কবি শম্ভু রক্ষিতের শেষযাত্রা

ঋণ: