শঙ্খ ঘোষ: বিবেকের প্রদীপ

তৌফিক জহুর

 



কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও সম্পাদক

 

 

 

 

 

আমাদের বেড়ে ওঠা কালে (নব্বই দশক) বাংলাদেশের যাঁদের স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েছি তাঁরা (কবি শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ, কবি সৈয়দ শামসুল হক, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন) সকলেই অনন্তের পথে পাড়ি দিয়েছেন। অগ্রজদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেশামেশির সুযোগে সে সময় আরও দুজন কবির নাম তাঁদের মুখে শুনেছি। একজন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আর একজন কবি শঙ্খ ঘোষ। ধীরে-ধীরে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও শঙ্খ ঘোষের সাহিত্য দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত হই। কিন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস থেকেই যাবে চিরটাকাল, এই দুইজন কবির সান্নিধ্যলাভে ব্যর্থ হলাম।

শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১)। কবি, সাহিত্য সমালোচক, রবীন্দ্র গবেষক। কবির প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। তাঁর পিতা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, মাতা অমলা ঘোষ। ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের চাঁদপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন কবি শঙ্খ ঘোষ। পিতার বাড়ি বরিশাল জেলার বানারীপাড়া গ্রামে এবং কর্মস্থল বাংলাদেশের পাবনায় হওয়ায় তিনি সেখানে বড় হন এবং পাবনা জেলার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫১ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় কলা বিভাগে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, শিমলাতে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা সাহিত্যে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে কর্মজীবনের ইতি টানেন। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ১৯৭৭ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ সালে লাভ করেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’। ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইওয়া রাইটার্স ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৭ সালে ‘মূর্খ বড়, সামাজিক নয়’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেলেন নরসিংহ দাস পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে ‘ধুম লেগেছে হৃৎকমলে’ রবীন্দ্র পুরস্কার, সরস্বতী পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে ‘রক্তকল্যাণ’ অনুবাদের জন্য সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে বিশ্বভারতীর দ্বারা দেশিকোত্তম পুরস্কার, ২০১১ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরস্কার।

একলা হলে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে

শঙ্খ ঘোষের জন্ম বাংলাদেশে। জীবনের সূচনা ও বিকাশ এখানে হওয়ায় সে স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছেন সারাজীবন। তিনি একজন বিবেকবান মানুষ সত্তা। তাঁর মানবিক মূল্যবোধ হৃদয়ের ভালোবাসা প্রকৃত অর্থে মানুষের জন্যই। বিবেকবান হওয়ার জন্য। “সন্ধ্যানদীর জলে” নামে তাঁর বাংলাদেশ বিষয়ক লেখালেখি নিয়ে একটি সঙ্কলন গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। অনেকগুলো পর্ব আছে সে গ্রন্থে। প্রথম পর্বেরর নাম ‘একুশে একাত্তর ও নববর্ষ’; পড়েই বোঝা যায় এখানে কী কী বিষয় তিনি লিখেছেন। প্রথম রচনাটির নাম ‘কালো মাটির কালো পুতুল’। লক্ষণীয় যে লেখাটির  প্রকাশকাল ১৯৭১ সাল। শুরুতেই তিনি প্রশ্ন করেছেন, “ইয়াহিয়ার সৈন্যরা ইত্তেফাকের অফিস গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তাহলে জসীম উদ্দীন থেকে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ— বাংলাদেশের এই কবিরা কোথায়?” স্পেনের গৃহযুদ্ধে যেমন আলবের্তি ও তাঁর বন্ধুরা লিখছিলেন উদ্বুদ্ধ করার জন্য, বাংলাদেশের কবিরাও কি তাই করছেন? বেঁচে আছেন তাঁরা? নাকি তাঁরা লোরকার মতো প্রাণ দিয়েছেন? ১৯৭১ সালে নৃশংস মানবতাবিরোধী গণহত্যার সেই ভয়াল সময়ে বাংলাদেশের মুক্তবুদ্ধির মানুষগুলোকে নিয়ে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁর ভয়ের মূল কারণ সৈন্যদের প্রথম লক্ষ্য থাকে সেই মাথাগুলো যাঁরা জাতীয়তাবাদী অথবা যাঁরা প্রশ্ন করেন নিজেদের পরিচয় নিয়ে, যাঁদের কাছে সবার উপর মানুষ সত্য। অবশ্য পরেই তিনি প্রকাশ করেছেন, ভয় নয় এই কবিদের জন্য তিনি গর্ববোধ করেন, কবিতার জন্য গর্ববোধ করেন। তিনি জানেন, দীর্ঘ পঁচিশ বছর এ দেশের সত্তাকেন্দ্রের সন্ধান করেছিলেন কবিরা। তিনি বিস্মিত হয়ে বলেছেন, কীভাবে ধ্বংসময় আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ উচ্চারণ করছে প্রেমের কবিতা। প্রেমের একটা পংক্তি মিছিলের শ্লোগান হয়ে উঠছে। পুরো প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, দেশের কবিতা লিখতে হবে ভেবে কীভাবে দেশাত্মবোধক একটি চেহারা ঠেসে গিয়েছিল কবিতার ভেতর। বাংলাদেশের কবিরা সে জায়গা থেকে বের হয়ে এসে ভালোবাসার কথাই বলে এসেছিলেন। দিনে দিনে গড়ে তুলেছিলেন আত্মসন্ধানের ব্রত। তখন এক অজানা ভবিষ্যৎ সামনে। তিনি কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছিলেন না। ঠিক কতটা জটিল হবে কাঙ্খিত পরিণাম। কতটা মূল্য দিতে হবে সে পরিণামের জন্য। কিন্তু তবুও তিনি বুঝতে পারছিলেন, বিপ্লবের এক নিঃসন্দিগ্ধ মূর্তি জেগে উঠেছে দেশ জুড়ে, প্রবাহিত হচ্ছিল জাতির মধ্যে নিজেদের আইডেন্টিটির প্রশ্নে। তিনি বলছেন, আমাদের এ আত্মপরিচয়ের পথ তৈরি করছিল বাংলাদেশের কবিতা।

শঙ্খ ঘোষের কাব্যের সংখ্যা ২৬ (কাব্য সংগ্রহ বাদে), গদ্যগ্রন্থ ৪৩টি। শিশুদের জন্য সৃষ্টি করেছেন ২৩টি বই। বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারভিত্তিক সঙ্কলন ৫টি, অগ্রন্থিত রচনা সঙ্কলন ২টি ‘মুখজোড়া লাবণ্য’ ও ‘অগ্রন্থিত শঙ্খ ঘোষ’। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ১১২। এই বিশাল সমুদ্র ভাণ্ডারে যতটুকু ডুব দিতে পেরেছি মনে জেগেছে সীমাহীন বিস্ময়। শ্রদ্ধায় নতজানু হয়েছে হৃদয়। কাব্যের সীমানা প্রশস্ত করেছেন তিনি। বিবর্তনের পথে তিনি পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। মানুষ সত্তার এমন জাগ্রত বিবেক সাহিত্য আঙিনায় আর রইল না। যুগের জ্বালা যন্ত্রণা ও নৈরাশ্যের বিরুদ্ধে তাঁর কলম বারবার বিপ্লবী হয়েছে। মানবতা বোধের উদার হৃদয় নিয়ে তিনি লিখে গেছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। দেশ, কাল, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য বারবার শুভবোধ ও আশাবাদ জাগ্রত করার মানসে তিনি বলে গেছেন কবিতায়, গদ্যে। শঙ্খ ঘোষ ছিলেন রবীন্দ্রগবেষক। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় রবীন্দ্র যুগের কবিরা চিরকালই রবীন্দ্রনাথের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিভার বিকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ তাঁরা রবীন্দ্রনাথ থেকে নিজেদের আলাদা করতে পারেননি। ডুবে গেছেন রবীন্দ্রনাথে। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ গবেষণা করেছেন। আচ্ছন্ন হয়ে মিশে গেছেন। প্রভাবিত হয়েছেন এমন বিষয় কোনও আলোচক, সমালোচক বলতে পারেননি। মনোভঙ্গির দৃঢ়তা আর অগাধ পাণ্ডিত্য তাঁকে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তিনি হয়েছেন সময়ের সবচেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। জাতির সত্যবাক বিবেক। তাঁর কবিতা চলমান জীবনের জীবন্ত ভাষার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং সৎ কবিতায় পরিণত হয়। সকলেই জানি, সৎ কবিতার বৈশিষ্ট্য হল চিন্তা ও অনুভবের নতুন পথ সৃষ্টি করা।

এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আমাদের সম্পূর্ণ মর্মর
লেখো আয়ু, লেখো আয়ু
ভেড়ে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখে নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে
স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও

(চুপ করো, শব্দহীন হও)

নিভন্ত, এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে।

যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে
বিষের টোপর নিয়ে।
যমুনাবর্তী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে
দিয়েছে পথ, গিয়ে

নিভন্ত এই চুল্লিতে কোন আগুন ফলেছে

যমুনাবতীর মত অতিজনপ্রিয় কবিতা লেখার পেছনের ঘটনা কাহিনি, একটা অগ্নিস্ফূলিঙ্গ সংযোগ করে চিন্তার বারুদে আগুন ধরিয়ে কবিতার আতসবাজিতে আলোকিত হয়ে আলোড়িত হয় দশদিক। ‘বাবরের প্রার্থনা’ আমাদের কবিতার আকাশকে বিনির্মাণ করে ইতিহাসকে পরিণত করেছেন স্বপ্ন ও বাস্তবের যুগের যৌথ গৌরব। জীবনের হাসি, জীবনের কলরবকে গ্রহণ করতে হলে বলিষ্ঠতার প্রয়োজন। সত্যই আমাদের সে বলিষ্ঠতা দিতে পারে। জীবনবিরোধী দর্শনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন কবি। কলমের ডগায় আপস আসেনি কখনও। জড়তার বিরুদ্ধে কবিমন সোচ্চার ছিল সব সময়। মানুষের জন্য মঙ্গলের জন্য, কবি চিরটাকাল কাজ করে গেছেন। অতীন্দ্রিয়ের সাধনা করেননি কখনও। তাঁর কবিতা, প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তুর ঐশ্বর্য ও বিরাটত্ব তাঁর শিল্পকে গভীর করেছে। আমরা সেই শিল্পের কাছে শিখি। স্থির করি আমাদের পথ। জগতের শিল্পের সৌন্দর্য, মাধুর্য ও কল্যাণ আমরা আবিষ্কার করি তাঁর রচনা ভাণ্ডারে। কারণ তিনি শিরদাঁড়া উচু করে কথা বলার মন্ত্র শিখিয়েছেন তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে। বর্ণাঢ্য জীবনে বাংলাদেশ থেকে ভারত, এই দীর্ঘ যাত্রায় তাঁর জীবনদর্শন সকলের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে বহুবার কলকাতা গিয়েও এই মহীরুহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পারার মনোকষ্ট বাকি জীবন থেকেই যাবে। এখন শুধু হাতের কাছে রয়েছে তাঁর বিশাল সৃষ্টির আকাশ। সেখানেই রইলাম।

তথ্যসংগ্রহ

  • বিভিন্ন জার্নাল
  • সন্ধ্যানদীর জলে: শিকড় অনুসন্ধানের দীর্ঘ যাত্রা: রাসেল রায়হান
  • গুগল
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...