২ মে এবং তার পর

সুজন ভট্টাচার্য

 

নির্বাচন কমিশনের বদান্যতায় ভারতের তো বটেই, সম্ভবত বিশ্বের দীর্ঘতম প্রত্যক্ষ নির্বাচনী প্রক্রিয়া গতকাল শেষ হয়েছে। খোঁয়ারি ভাঙার জন্য রাজনৈতিক বাহু ও নোটবলীরা দুদিনের সময় পাচ্ছেন। তারপরই ২ মে। সাড়া বছর না হলেও পরীক্ষার দিন কে কেমন খেলেছেন, তার ফল জানা যাবে। আমার যতদূর বিশ্লেষণ, পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ কোনো পরিবর্তন হবে না, আবার হবেও। স্পষ্ট ভাষায় বললে ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের ভোট এবার অনেকগুলো রেকর্ড ভঙে দিয়েছে। দফার দীর্ঘ তালিকা থেকে শুরু করে আধা সামরিক বাহিনীর সংখ্যা তো আছেই। আরো বেশকিছুও আছে সঙ্গে জড়িয়ে। কী সেগুলো?

পশ্চিমবঙ্গের ভোটে এত বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিয়োগ আমরা আগে কোনদিন দেখিনি। দেখিনি অতিথি-বক্তাদের আকাশে উড়োউড়ির এই বহর। কিছুদিন আগেও একটা সময় ছিল, প্রধানমন্ত্রী মাঝেমধ্যে বিমানে চেপে ভারতভূমে পা রাখতেন। করোনা আবহে সেই উড়োউড়ি বন্ধ। বোধহয় সেই খেদ মেটানোর জন্যই দিল্লী-কলকাতা বনগাঁ লোকাল চালু হয়ে গেল। সে হতেই পারে। পর্যটকদের কাজই তো দেশেবিদেশে ঘুরে বেড়ানো। তবে বিমান আর হেলিকপ্টারের চোটে আকাশের মুখ ঢেকে যাবার অভিজ্ঞতা আমাদের এই প্রথম হল। যেমন এই প্রথম অভিজ্ঞতা হল, সাধারণ ভোটারদের গুলি মেরে খুন করে আধা সামরিক বাহিনীর(!) একটা দলের পালিয়ে যাওয়া। খুনখারাপি পশ্চিমবঙ্গের ভোটে বাধাধরা। কিন্তু এমন ঘটনা এই প্রথম।

তবে সে হল খেলার কৌশল। ফুটবল মাঠে চোরাগোপ্তা ল্যাং কিংবা ক্রিকেটের মাঠে স্লেজিং তো খেলারই অঙ্গ। কিন্তু আদত খেলাটা তো উড়ানওয়ালারা প্রায় জিতেই গেছে। অন্তত নীতিগতভাবে। সেই খেলার বদলে যাওয়া নিয়মকানুন আর রীতি তারা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটে এত তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচার এর আগে কোনদিন শোনা যায়নি। শোনা যায়নি ধর্ম আর সম্প্রদায়ের নামে এমন রণহুঙ্কার। সবটাই যে মাঠে মারা গেছে, এমনটা বলার মত আস্থা রাখতে পারছি না। রাস্তাঘাটে যথেচ্ছ না হলেও খানিকখানিক তো ঘুরেছি, অজস্র চেনাঅচেনা মানুষের কথা বলেছি। তার ভিত্তিতেই বলছি, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার এমন ব্যাপক চাষ এর আগে হয়নি। ২ তারিখ তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। সবথেকে বড় কথা, সমস্ত প্রতিপক্ষকেই জেনেবুঝেই সেই ছক মাথায় রেখেই কথা বলতে হচ্ছে। আর বিপদটা লুকিয়ে আছে এখানেই।

একটা বিষয় ইতিমধ্যেই বোঝা হয়ে গেছে। একজন চাকুরিওয়ালা যেমন কর্মস্থল বদলের সঙ্গে সঙ্গে তার যাবতীয় আনুগত্য বদলে ফেলেন, রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই যে সত্যি, সেই প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম পাওয়া গেল। ভোটের মুখে মুখে এমন গণহারে দলবদল উত্তর ভারতে সাধারণ চিত্র হলেও, পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম। এই প্রথম স্রেফ দলবদলুদের উপর ভরসা রেখেই একটা সর্বভারতীয় দল ক্ষমতালাভের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। জার্সি বদল করা নেতারা প্রথম দিন থেকেই পরিবর্তিত শ্লোগানগুলো চড়া সুরে উদ্দারণ করতে শুরু করলেন। কে বলবে, একদিন আগেও ঠিক এমন জোরেই তিনি উল্টো কথাগুলো বলতেন! এর ভিত্তিতে আমার বিশ্বাস, পশ্চিমবঙ্গের নেতারাও রাতে অন্যান্য দলের শ্লোগানগুলো নিয়ম করে প্র্যাকটিস করে থাকেন। যাতে পাল্টি খাবার পর নতুন শ্লোগান বলতে গিয়ে গলায় না আটকায়।

যেমনটা বলা হয়, সেই অর্থে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষ যে খাঁটি সেকুলার, এমনটা মোটেই নয়। সাম্প্রদায়িকতার চোরা স্রোত এখানে চিরকালই ছিল। বঙ্গবিভাজনের বাস্তবতায় সেটা হয়তো অনিবার্যও বটে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বৈশিষ্ট্য ছিল, মনে যাই থাক, প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক কথা বলতে লজ্জা পেতেন। ফলে রামরহিমের দোহাই এখানকার রাজনীতিতে খুব একটা পাত্তা পায়নি। কিন্তু গত পাঁচসাত বছরে সেই মুখোশটা আস্তে আস্তে খসে পড়তে শুরু করেছে। দোষ ও দায় উভয়পক্ষেই আছে। কিন্তু মুশকিলটা অন্যত্র। যারা এই রাখঢাকরাখা কিংবা খুল্লমখুল্লা সাম্প্রদায়িক প্রচারকে বিষ বলে মনে করেন, তাদের অকর্মণ্যতা। এই দলে আমি নিজেও একজন।

কথাটা খুবই সরল। ক্ষমতায় না এসেও পদ্মপক্ষের রণ-হুঙ্কার দেখে যারা বিচলিত, আজ থেকে তিরিশ বছর আগেও সেই পদ্মমণি সঙ্ঘীদের আচরণ মনে করুন। কি বিনয়ী, কি নম্র! তারা কিছু বোঝাতে আসতেন না। শুধু প্রশ্ন রেখে যেতেন। ক্রমাগত প্রশ্ন রাখতে রাখতে একদিন তিনি অনেক শক্ত পিলারকেও কাত করে ফেলতেন। আমরা কিন্তু এই বিষয়টায় উদাসীন। ঢাকার শাহবাগ আন্দোলনের সময় বেশকয়েকজন উদ্যোক্তাকে বলেছিলাম, আপনাদের নজর শহুরে শিক্ষিতদের দিকেই। গ্রামে কী হচ্ছে, আপনারা জানতেও চান না। আজ সেই আশঙ্কাটা সত্যি বলেই প্রমাণ হয়ে গেছে। আমাদের এখানেও তাই।

পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে আসল লড়াই শুরু হবে ২ তারিখ থেকে, যেই জিতুক না কেন। যদিও পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতার আহামরি কোনো পরিবর্তন হবে না বলেই আমার ধারণা। কিন্তু ফ্যাসিবাদী শক্তির সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনকে রোখার মনস্তাত্ত্বিক ক্ষমতা সংসদীয় বৃত্তে লম্ফঝম্প করা কোন দলের পক্ষেই সম্ভব হবে না। ইতিমধ্যেই সেটা প্রমাণিত। আর যদি পালা বদলায়, তাহলে তো আগ্রাসন আরো বাড়বেই। তখনও কোন প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে পাশে পাওয়া যাবে না। ফলে লড়াই-এর জোয়াল সাধারণ মানুষকেই ঘাড়ে তুলে নিতে হবে। সেই লড়াইটাই একমাত্র গ্যারান্টি। ধরুন, এই কোভিড সময়ে কেন্দ্রিয় সরকারের আশ্চর্য রকমের নিরুত্তাপ ভূমিকা দেখে আপনি কি হাল ছেড়ে দিয়েছেন? কিংবা আম ফানের সময়ে যাবতীয় দায়িত্ব রাজ্য সরকারের ঘাড়ে ফেলে ঘরে বসেছিলেন?

স্বাস্থ্য পরিষেবা যাতে আক্রান্ত প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছায়, তার জন্য ছোট ছোট বৃত্তে অসংখ্য মানুষ দিনরাত এক করে লড়ে যাচ্ছেন। এমন প্রতিটি লড়াই আসলে রাষ্ট্রীয় অকর্মণ্যতাকে শুধু হাতেকলমে প্রমাণ করছে না, তাকে খারিজও করে দিচ্ছে। অসংখ্য অসহায় মানুষ এঁদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এই লড়াই থেকেই আমরা শিক্ষা নিতে পারি। এই লড়াইয়ের ভিত্তিতেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের রুখে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ার কথা আমরা ভাবতে পারি। কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। হ্যাঁ, সবার আগে একটা কাজই করতে হবে। নিজেকে পণ্ডিত বা মসিহা বলে গায়ে স্ট্যাম্প মেরে নেওয়াটা বন্ধ করতে হবে। ভাবুন, আপনি একজন ভিলান্টিয়ার মাত্র; রেড, গ্রিন বা স্যাফ্রন নয়, সংবিধানের ভলান্টিয়ার, সাংবিধানিক নির্দেশকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ের ভলান্টিয়ার।

কী করবেন? কিচ্ছু না। আজ আপনি যেভাবেই ভাবুন না কেন একটু খেয়াল করে দেখুন, নাগপুরের বানিয়ে দেওয়া প্রকল্প মেনেই কথা বলতে আপনি বাধ্য হচ্ছেন। হ্যাঁ, আপনি বিরোধিতা করছেন, যুক্তি আর তথ্য সাজিয়ে খারিজ করে দিচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু আসলে আপনি সেই প্রকল্পকেই লাগাতার বিরোধিতা করতে করতে তাকে উল্টোদিকে মান্যতা দিয়ে বসছেন। আর পরোক্ষভাবে আপনার ভাবনাতেও ছোপ পড়ে যাচ্ছে তার। তাই উগ্র হিন্দুত্বের বিরোধিতা করতে গিয়ে আপনি নরম হিন্দুত্বের দোহাই পাড়ছেন। সাভারকরের বিরুদ্ধে রামকৃষ্ণের কথা বলছেন। আমিও তাই হয়ে যাচ্ছি। আর এভাবে জিতে যাচ্ছে ওরাই।

তাহলে? আসুন, আমরা এবার পাল্টা প্রশ্ন করা শুরু করি। কেমন প্রশ্ন? নোটবন্দীর কথা মাথায় আছে তো? আসুন, প্রশ্ন তুলি ২০০০ টাকার সেই ‘চিপ বসানো’ নোটগুলো আর দেখা যাচ্ছে না কেন? কোথায় গেল? আর ছাপানো হচ্ছে না কেন? তাহলে সেই নোটের কাগজ বিদেশ থেকে কিনে আনার খরচ তোলা হবে কিকরে? প্রশ্ন করুন, এই ফালতু খরচের কমিশন কার পকেটে ঢুকল? পদ্মমার্কা লোক দেখলেই জিজ্ঞাসা করুন, রামদেবের মতো আপনাকেও কয়েক কোটি টাকা লোনের ব্যবস্থা করে তারপর মাফ করে দেবার বন্দোবস্ত করে দিতে। সিধা জিজ্ঞাসা করুন, কত পার্সেন্ট দিতে হবে তার জন্য। হিন্দুমুসলিম বলতে এলেই পাল্টা বলুন, রামদেব তো গেরুয়াপরা হিন্দু। তাই তিনিই আমার আদর্শ। অতএব ব্যবস্থা না করে দিলে তুমি নিজেই শালা হিন্দুবিরোধী। পরের খেলার কথা পরে হবে।

(লেখাটি ৩০ শে এপ্রিল অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের পরের দিন লিখিত)

Be the first to comment

আপনার মতামত...