Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সেপিয়েন্স-গাথা

সেপিয়েন্স-গাথা : কুশান গুপ্ত

কুশান গুপ্ত

 

দুটি সঙ্গীতপ্রিয় ডলফিন পুল থেকে মুখ তুলে মানবশিশুটির গালে এসে ঠোঁট রাখে। একটি ভয়ার্ত শ্লথ সীল রক্তাক্ত বরফে এসে উদ্যত বন্দুকের মুখে দুটি কালো লুপ্তপ্রায় হাত তুলে ধরে অনুনয় প্রার্থনায়, সে কি কোনও অপারগ ডানা? এখনও বুঝিনি। এসব করুণা চেনা মানবিক বলে ভুল করি, আমি সেপিয়েন্স। ত্যক্ত গুহায় আজও পড়ে আছে কিছু অনুগত সারমেয়-হাড়, সেসব ভ্রমণদিন অন্য কোনও অন্ধ অরণ্যের। তখন ভূখণ্ডগুলি আবিষ্কারে উল্লাসরত যারা যারা অর্ধনগ্ন হেঁটেছিল… শিখেছিল রোমাঞ্চের এক্সোডাস, ঐকিক কৌশলগুলি― আদিম কাতান, আর ডিঙা নির্মাণের। সেই কালে আমাদের নগ্নস্তন মানবীরা নির্দ্বিধায় মিষ্ট ঈষদুষ্ণ দুধ ভরে দিত লোভাতুর, দন্তহীন যৌথশিশুদের উদ্যত হাঁয়ে। তখন ধরিত্রীস্তন্যে‌ সুধা, মায়া, পরহিতব্রত।

 

একটি ক্ষিপ্র সিংহী, এখন শান্ত, ভেজা ভয়ভীত বাইসন-সন্তানের  ঘ্রাণ নেয়, গা-খানি চাটে। ধাত্রী-মমতা, নাকি এই দ্বিধা শুধু প্রবৃত্তির? এ-আমি প্রকৃতিচ্যূত, মনিটরে ভেসে ওঠে খরস্রোতে ধাবমান ভল্লুকশাবক, তার মৃত্যুভয়, কান্না, মাতৃডাক। এসময়ে ঘরে ঢোকে একটি কুমোরপোকা, নাছোড় ও কিয়ৎ-অস্থির। অনলস তার এই উচাটন আহরণ, আমাদের চেয়ে বেশি আন্তরিক তার ক্রিয়াশীল, ক্ষুদ্র লুক্কায়িত ঘর। আমাদের আকাশঅক্ষম অট্টালিকাগুলি জেগে থাকে উচ্চাশায়, রুদ্ধকক্ষ দিনলিপি লিখে যায়, লেখে নির্বিকার হত্যা, অবসাদ, অবরুদ্ধ ধর্ষণ-কাহিনী।

 

আমরা এই পাখিদের কেউ না, ওরাও তা জানে। একদিন অরণ্য থেকে আমরা এনেছি মনোনীত ফল, পুষ্প, শস্য ও গো-আদি, যে-যার কুটীরে। এছাড়া দুর্লভ ভেষজ বেছে পুরাকালে বানিয়েছি প্রিয় সুরা, নেচেছি পুলকিত জ্যোৎস্নায়। রক্ত ও মৃত্যুর ধারাবিবরণী দিতে বারম্বার ভিড় লেগে গেছে বেষ্টিত রোমক দেশে, নগ্ন কলোসিয়ামে। আমাদের আবিষ্কৃত শৈল্পিক খাঁচা ও আবশ্যক গারদগুলি অবশেষে আরও পরিব্যাপ্ত হল, কারুকার্যময়। শ্রমের ফসলে সেদিন ভরেছে মাঠ, যেহেতু লাঙলের ফলায় লৌহ ও করুণা ছিল অপরিমেয়, বৃষ্টি ও বজ্রদেবতার। আমরাই এনেছি এই চক্রের উড়ুক্কু গতি, দুরূহ সাইক্লিং শিখিয়েছি বাধ্য বন্যদের, কাকাতুয়াদের ভক্তিগীতি।

 

সেদিন খননকার্যে জেগেছিল কুয়া। ইতিউতি সে-কালীন জনপদ, কাঁচা পথ অরণ্যসঙ্কুল। ভাঙা সভ্যতার লুপ্ত আদিম গমের দেশে ছিল মহাস্নানাগার, মিনে করা মৃৎপাত্র… সেই অপরিচিতা, কৃষ্ণা, স্পর্ধিত, অলঙ্কারপ্রিয়। কোনকালে আগুনের সৎ ব্যবহার শিখে গেছে কারা, সৎকারের নীরবতা ঔচিত-স্তব। বাকি যারা জেন্দাবেস্তা-পারসিক, মৃতদেহ ফেলে গেছে বিজন টিলার পরিখায়। কিছু স্থির ব্যতিক্রমী, রাজকীয়, ঐশ্বরিক চিরঞ্জীব মরদেহ, এখন নিশ্চল পাথর, সমাসীন পিরামিড গৃহে। পুরাতন ক্রুশকাঠে বিদ্ধ পেরেক, পুনরুত্থানকামী, আজও সমস্ত কফিন ‘পরে বুকে আঙুল ছুঁয়ে লিখছে― আমেন। একদিন খননের পরে মৃত্তিকাগর্ভের তৃষ্ণাজল জেগেছিল প্রত্যাশায়, অন্যদিন নলকূপে উত্তপ্ত তেল।

 

সকল কায়েমি উট তোমাদের হস্তগত। হয়তো বা কতিপয় বুনো আজাদি ঘোড়া রয়ে গেছে আজও জঙ্গলে। এই অভয় অরণ্যের, অধুনা এ নৈশট্রিপ, কিছু কিছু দুর্গম বরফে আছে আশ্চর্য নীল হ্রদ, আমাদের ক্রয়যোগ্য প্রকৃতিতে প্রবেশাধিকার। যে দুরূহ পথে সশরীরে স্বর্গ দেখা পেত বিরল উত্তীর্ণ মর্ত্যমানব, আজ শুনি সেইখানে ভারীবুট সেনাদল মাতে মহড়ায়। প্রায় ভাবি হবে এক উল্কাপাত মহাজাগতিক। আমাদের লুপ্ত চিহ্ন, রক্তপুঁজ, যার নাম ইতিহাস― কেউ কি লিখবে, যারা আগামীর ভিন্ন গ্যালাক্সির?

 

এই মর্মরিত গাথা সত্যি বলে মনে হয়। হে প্রাচীন, তোমাদের ঈশ্বর আজও অর্ধনিমীলিত, অস্ফুট, পাথরপ্রবাহে। এই দ্বীপে তোমাদের সেই গড় ভেঙে দিয়ে চলে গেছে জলপথে নির্দয় পশ্চিমী কামান। এখানে বানরদল রয়ে গেছে বহুকাল; আজকে অরণ্য নেই, তারা তাই অভুক্ত, হিংস্র, কেড়ে খায় উচ্ছিষ্ট, মানবশিশুর। এইখানে শান্ত ঢেউ লোনাজল, ঠেসমূল… হাওয়ায়, রৌদ্রে, জলে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছে তোমাদের গড়া সৌধ, যুগপ্রস্তর। এখন ট্যুরিস্ট সব,  নিজেদের হাস্যময় ছবি তোলে, এই পরিপ্রেক্ষিত ছেনি আর বাটালির, শান্ত, বধির। একদিন এই জেগে থাকা স্থল কষ্টকর, দুর্গম ছিল, তোমরা গিয়েছ তবে কোন নৌকায়? আজও সেই স্থির অস্তাচল, ভুল হয় ভেবে কেবলই। ক্ষুধার্ত সীগালঝাঁক উড়ে উড়ে পিছু নেয় ফিরতি লঞ্চের, ডানার প্রখর শব্দ, ফিরে গেছে ওরা সন্ধ্যায়।

 

কিছু ফুল কেন তবে নিল না বাগান? তাই কাশগুলি বুঝি স্টেশনের থেকে দূরে গড়েছে কলোনি? অমলতাসের ডেরা কবরের পাশে, যেখানে মাটির নীচে বহু পুরাতন ঘর পাপীদের, পরিতাপস্থল। সেই কতকাল থেকে মানুষ ক্রন্দনরত স্ব-আকার, নিরাকার কল্পনার কাছে। কে বা কারা ক্ষমা চায়, যুদ্ধপরাজিত, অবলীলায় হাঁটু গাড়ে। যে কোনও স্পর্ধাই আজও কল্পনার আনুগত্যে বাস্তবিক আনতমস্তক। গীতিময়, হে জুড, কেন, বলো, হাত কাটো, নাম লেখো, অনাবশ্যক, ব্লেডে? দ্যাখো, ফ্লাইওভারের অনতিদূরে ফুটে আছে মনমরা পলাশ, বীরভূম ও পুরুলিয়া যার আত্মীয়।

 

শুধু ছদ্মবেশী হতে চাই, এই সাধ, এই তরে যেতে চাই অসম্ভব বিপরীত স্রোতে। রাত্রির মশাল জ্বেলে দেখে যেতে চাই গুহাগাত্র থেকে কীভাবে পাথরগুলি ভাঙে কারা, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বাঙ্ময় নিঃস্ব করুণার মথুরা, গান্ধার। সেই যারা অবিচল ভেঙে চলে, যাদের পেশিতে গ্রিস ও রোমক, হৃদয়ে জাগ্রত স্মৃতি, বিবিধ জাতকভঙ্গি, সেই যিনি প্রিয় তথাগত, ভারতীয়।  ওই মুখমণ্ডলে তাঁর কমনীয় প্রীতি ফুটে আছে, জন্মান্তরে প্রবাহিত সবিস্ময় বহু আখ্যানের। কতদিন ধরে তারা সেই পাথর ছেনেছিল, কতটা প্রজন্মকাল… সেই প্রপাপালিকার দেশে? যারা ছিল সহৃদয় পারদর্শী, সেই তাদের, কিছু নাম বলে দিও মহাকাল, কেননা লেখোনি।

 

সমস্ত রকম প্রজাতির স্বল্প সংরক্ষণ, ভেবে দ্যাখো, আশু প্রয়োজন। কেননা আরবার নোয়ার লগ্ন বোধ করি শুরু হয়ে গেছে; এই তরে, উপকূলে সমুদ্র-উচ্ছাস, দেখি, ক্রমবর্ধমান। কেবলই কু-ডেকে যায় রাত্রিপাহারার অক্লান্ত সারমেয়গুলি, ডাকে দুঃস্বপ্ন, আজ ঘুম দিতে পারে শুভার্থী অ্যান্টিসাইকোটিক। আকাশপ্রেরিত কন্যা, ওগো সুনয়না, অচেতন, এই কুষ্ঠ সভ্যতাকে ওষ্ঠের শিশির দিয়ে বলবে কি, ঘুম থেকে ওঠো? অলীক বিভ্রমে আছি, নিজ নিজ কুটিল অসুখে। বহু যত্নে নির্মিত গৃহগুলি আশ্বস্ত দূরত্বে রচা, মানুষের সুচিন্তিত জৈব কারাগার।