Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তিনটি অণুগল্প

অনির্বাণ চন্দ

 

নিরুদ্দেশ

মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে রোজকার মতোই ভদ্রস্থ দেখতে পাগলটা কী যেন লিফলেট বিলি করছে। রোজই দেখি। রোজই চোখে চোখ রেখে হাসে। আর হাতে গুঁজে দেয় একটা করে৷ খুলেও দেখিনি কখনও। কে দেখে এইসব। বেশিরভাগ দিনই ফেলে দিই। অপ্রয়োজনীয় দাদ-পাঁচড়ার বা অন্যান্য কোনও হ্যান্ডবিল তো রাস্তায় ফেলার জন্যই। কোনও-কোনও দিন অফিসের ব্যাগে রয়ে যায়। বাড়ি অবধি বয়ে নিয়ে গেলে তাতানকে দিয়ে দিই। ও রং-টং করে। তারপর ফেলে দেয় হয়তো। জানি না।

আজকেও দেখা হল। সেম হাসি। সেম হাতে গুঁজে দেওয়া আর আমার না দেখেই পকেটে ভরে ফেলা। আমি এগিয়ে যাচ্ছি, এমন সময়ে আচমকা সমবেত ‘গেল-গেল’ রব শুনে চমকে পিছনে তাকালাম।

বাসটা পিষে ফেলেছে লোকটাকে। রাস্তা জুড়ে তার শরীরের ভগ্নাবশেষ, আর রক্তলাল একগাদা লিফলেট।

জ্যাম হয়ে গেল। প্যাঁ-পোঁ শব্দে পুলিশের গাড়িটা চলে এল তড়িঘড়ি। হ্যাঁ, থানা কাছেই, মনে-মনে হিসেব কষে দেখলাম।

অফিসের দেরি হচ্ছে। জটলা ছেড়ে এগিয়ে গেলাম মেট্রো স্টেশনের দিকে।

মান্থলি কাটা আছে। ট্রেন আসতে উঠে পড়লাম। সিট নেই। খানিক গুঁতোগুঁতি করে ভেতরে সেঁধিয়ে দাঁড়ালাম। ট্রেন চলতে শুরু করল।

কী মনে হল, লিফলেটটা পকেট থেকে বের করে প্রথমবারের জন্য খুলে দেখলাম।

জেরক্স করা সাদা পাতায় একটা বাচ্চা ছেলের মুখ। হাতে আঁকা। তলায় লেখা, ‘আমার ছেলে তাতান। হারিয়ে গিয়েছে গত…’

হঠাৎই শীত করছে খুব। ট্রেন ছুটছে। পরের স্টেশন আর কত দূর? বাড়ি ফিরতে হবে। ছেলেটার কাছে।

এক্ষুণি!

 

ভয়

—তখন আর লিখতেই পারলাম না জানো! সারাক্ষণ ভয় লাগতে শুরু করল… সারাক্ষণই দেখতাম সারা ঘর জুড়ে ফরফর করে উড়ছে একগাদা সাদা পাতা… নাকেমুখে লেপটে যাচ্ছে… শ্বাস নিতে পারছি না…

—কিন্তু আগে তো লিখতেন। আপনি তো আবার খাতায়-কলমে ছাড়া নাকি…

—হ্যাঁ লিখতুম তো। খাতায়-কলমেই লিখতুম। কিন্তু কী জানো, সাদা পাতার দিকে তাকিয়ে থাকলেই আমি কেমন যেন হয়ে যেতুম… তাও লিখেছি। বুক ধড়ফড় করত, কাউকে বলতেও পারিনি… সে ইস্কুল লাইফ থেকেই… কীভাবে যে পার করেছি সে আমিই জানি…

—তো লিখতে এলেন কেন? এমনিতেই লিখতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যায়, তায় আপনার আবার এইরকম ঝামেলা…

—ওই যে, কিছু কথা বলার জন্য… না মানে আসলে পেট চলে তো…

—হুঁ, বুঝেছি। তা আজকাল মোবাইলে কম্পিউটারেও তো লেখা যায়। তাতে লিখতে পারতেন। এত কষ্ট পেতেন না তাহলে।

একমাথা সাদা চুলে আঙুল ডুবিয়ে একবার হাসলেন শৌনক দে। বয়স্ক সে হাসির মধ্যে কোনও আওয়াজ নেই, কোনও খুশি নেই। কেমন যেন একটা গল্প লুকিয়ে ফেলা হাসি। একটু পরে বললেন, “মোবাইলে অসম্ভব। এত পাতা লেখা… কম্পিউটারও তো বেশি জানি না। চেষ্টা করেছিলাম তাও, জানো ডাক্তার…”

পুরনো প্রেসক্রিপশনটায় আর লেখার জায়গা নেই। একটা নতুন প্রেসক্রিপশন টেনে নতুন ওষুধের নাম লিখতে-লিখতে আমি বল্লুম, “হ্যাঁ তারপর কী হল?”

“দেখেছিলাম, সে স্ক্রিনটাও একটা সাদা পাতা…”

 

অক্টোপাস

বাংলা হরফে আট লিখতে পারলেও ইংরেজিতে এইট লিখতে পারত না জয়ন্ত। ‘এইট’ দেখলে বা শুনলেই, সেই ছোট থেকেই, কেমন যেন শ্বাস যেত আটকে। ‘8’ সংখ্যাটা, খালি দেখত জয়ন্ত, বনবন করে ঘুরছে। কিছুতেই সোজা হচ্ছে না। যেই ঘূর্ণি থামছে, অমনি কাত হয়ে এলিয়ে পড়ছে। আর যেন দুটো অদৃশ্য চোখ ওই এইটের দুটো খোঁদল থেকে তাকে দেখছে… দম আটকে আসত। কেন এমন হত তার, কে জানে। চড়-থাপ্পড় কম খায়নি ছোটবেলা থেকেই। সবাই বলল, মনের ভুল। ন্যাকামি। ফাঁকিবাজি করার কায়দা। মিথ্যে কথা মাইকে বাজলে যেমন সত্যি হয়ে যায়, একদিন জয়ন্তও প্রায় তেমনই মেনে নিতে শুরু করল। তাও, এইট লিখতে পারল না কিছুতেই। বারবার ভুল করেই গেছে। ভয় কাটেনি। অমল স্যার এক ক্লাস ছেলেদের মধ্যে বলতেন, “আর যাই কর, অঙ্ক নিয়ে কিছু করতে যাস না। এইট লিখতে পারিস না! জুতিয়ে তোকে সিধে করতে হয় জানোয়ার…” জয়ন্ত ভাবত, “পাগল!” মাধ্যমিক পরীক্ষায় অঙ্কে কেমন করে যে পাশ করেছিল, সে জানে না। বাংলা হরফে ছিল বলেই হয়তো।

যাই হোক, এইসব নিয়েই জয়ন্ত দিব্বি কাটিয়ে দিচ্ছিল জীবন। একা ছেলে। বাবা মারা যাওয়ার পর বাজারের হিসেব-টিসেব, মায়ের ওষুধ ইত্যাদি নিয়ে ব্যতিব্যস্ততা যেমন সব সংসারেই আসে, এল। ছেলেকে সামলানোর জন্য মা তার বিয়ে ঠিক করলেন। মালা শক্তসমর্থ স্বাস্থ্যবতী যুবতী। পাকা দেখার দিন জয়ন্তকে দেখে মালা ফিক করে একটু হাসল।

ফুলশয্যার রাতেই জয়ন্তর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হল। মরল না বটে, তবে প্রায়-পঙ্গু হয়ে গেল। কথা বন্ধ হয়ে গেল পুরোপুরি। মা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন।

মালা বুঝতে পারল না কী হল। কেন হল।

বলতে না পারলেও জয়ন্তর বাকি অস্তিত্বটুকু জুড়ে খালি ভয়। মালার উন্মুক্ত দুই স্তন তার গোটা বুকে এঁকে রেখেছে একটা ইংরেজি এইট…তার মধ্যে থেকে অন্ধকার দুটো চোখ তাকে যেন গিলতে আসছে…!

জয়ন্ত ছটফটিয়ে উঠতে চায়। ভয়ে শীতল শরীর নড়ে না।