Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অক্ষয় কুমার দত্ত: মুক্তবুদ্ধির অগ্রদূত

অশোক মুখোপাধ্যায়

 


লেখক প্রবন্ধকার, বিজ্ঞান-আন্দোলনের কর্মী

 

 

 

 

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর মৃত্যুর (১৮৩১) পর ডিরোজিয়ানদের আন্দোলন চলতে চলতে এবং তাঁদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এক-দেড় দশকে বিস্মৃতির অবপৃষ্ঠে চলে যেতে যেতে বাংলার চিন্তামঞ্চে ডিরোজিও-ভাবের আর এক শক্তিশালী ভাবুক হিসাবে অক্ষয় দত্তের প্রবেশ ও আত্মপ্রকাশ। সেদিন এ ছিল এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। ইতিহাসে ক্বচিৎ এমন সমাপতন ঘটে। কিন্তু আমাদের বিস্মিত করে তা যখন ঘটেছিল, একসঙ্গে দু জায়গায় ঘটেছিল। দুই দেশে। জার্মানিতে জন্মেছিলেন দুজন প্রায় কাছাকাছি সময়ে। আজীবন তাঁরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সমচিন্তক এবং সামাজিক সংগ্রামে সহকর্মী ছিলেন। কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-৮৩) এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (১৮২০-৯৫)। ভারতের মাটিতেও জন্মেছিলেন এমন দুজন মানুষ একেবারে সেই সময়েই (১৮২০) এবং তাঁরাও সারা জীবন পরস্পরের সহযোগী ছিলেন সমাজসংস্কার আন্দোলনে তথা নতুন ভাবনার ভাগীরথীতে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১) এবং অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-৮৬)। অথচ আক্ষেপের কথা এই, বিদ্যাসাগরকে নিয়ে আমরা বুঝি না বুঝি চর্চা করেছি। অক্ষয় কুমার দত্তকে আমাদের বুদ্ধিচর্চার চর্যাপদ থেকে প্রায় বাদ দিয়ে রেখেছি। বুঝিনি শুধু নয়, বুঝবার চেষ্টাই করিনি। তাঁকেও যে বুঝতে হবে, এরকম ভাবনাই আমাদের মনে উদয় হয়নি।

 

।। ।।

অথচ উনিশ শতকের নবজারণের সমাজবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষকরা জানেন, এই দুজনের জীবন-মননের বিচরণ ও ঘূর্ণনতল ছিল একই, এবং একই উচ্চতায়। মোটামুটি একই স্বরগ্রামে। বিদ্যাসাগর যে বস্তুবাদী বিজ্ঞান দর্শনভিত্তিক চিন্তাধারার আলোকে সামাজিক সংস্কার-শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন করে গিয়েছেন, অক্ষয় দত্ত তাকেই প্রয়োগ করেছেন জ্ঞান-রাজ্যের নানা অলিগলিতে। আত্মমর্যাদাবোধ দুজনেরই ছিল প্রখর এবং অনমনীয়। এই একটি জায়গা ছাড়া দুজনেরই আর কোনও ব্যক্তিস্বার্থপরতা ছিল না। ব্যক্তিজীবনে নীতি ও আদর্শ মেনে চলার প্রশ্নে দুজনেই ছিলেন কঠোরভাবে আপসহীন। সেই যুগে বিদ্যাসাগরকে যদি কেউ সঠিক চিনে থাকেন, তবে সেই একমাত্র ব্যক্তিটি হলেন অক্ষয় কুমার দত্ত। পাশাপাশি, অক্ষয় দত্তকে যদি সেই সময়ে কেউ সত্যিকারের অর্থে বুঝে থাকেন, তিনি অবশ্যই বিদ্যাসাগর। তাই আক্ষেপ বা আত্মসমালোচনা করে বলা যায়, আমরা যারা অক্ষয় দত্তকে নিয়ে ভাবিনি বা চর্চা করিনি, তারা আসলে বিদ্যাসাগর মশাইকেও চিনতে বা বুঝতে পারিনি। হ্যাঁ, আত্মসমালোচনাই এটা, কেন না আমিও বহুকাল পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি, নানা জায়গায় অনেক কথা বলেছি এবং লিখেছি, অক্ষয় কুমার দত্তকে না জেনে না বুঝেই।

জ্ঞানে-মননে যাঁদের এত মিল, অথচ কী বিপুল তাঁদের বৈপরীত্য! ঈশ্বরচন্দ্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ পেরিয়ে এসেছেন সসম্মানে। নানারকম উপাধি ও জলপানিতে ভূষিত হয়ে। করুন না করুন, ভালো ভালো চাকরি এবং পদমর্যাদা পেয়েছেন জীবনে অনেক। অক্ষয় দত্ত সাংসারিক দুর্বিপাকে স্কুলের গণ্ডিই পেরতে পারেননি। অসময়ে তাঁকে চাকরি নিতে হয়। বিদ্যাসাগর চাকরি ছাড়াও বইপত্র লিখে দানধ্যান করার মতো প্রচুর অর্থ আপন যোগ্যতায় উপার্জন করতে পেরেছেন, আর অক্ষয় দত্তকে সারা জীবন দারিদ্র্য ও অর্থকষ্টের সঙ্গে লড়াই করে যেতে হয়েছে। কেননা, যে পথে গেলে পয়সা আসতে পারত, যেভাবে লিখলে অনায়াসে আরামে আয়াসে দিন কাটাতে পারতেন তা তিনি সচেতনভাবে বর্জন করে গেছেন। বিদ্যাসাগর কীভাবে সমাজ সংস্কৃতি শিক্ষা নিয়ে ভাবতেন তা জানতে পারা যায় তাঁর বিভিন্ন কার্যক্রম দেখে, তাঁর নানা পরিকল্পনা থেকে। নিজের বক্তব্য তিনি কোনও বিশিষ্ট পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থে প্রকাশ করে যাননি। যা লিখেছেন তার সবই কেজো বই, এখনকার ভাষায় প্রচারের প্যাম্ফলেট। তাঁর সত্যকারের দার্শনিক মতামত আমরা সরাসরি জেনেছি সরকারি মহাফেজখানা থেকে তাঁর চিঠিপত্র উদ্ধার হওয়ার পর। তাঁর মৃত্যুর বেশ কয়েক দশক পরে। জানার চেষ্টা করা হয়েছে বলে। পক্ষান্তরে, অক্ষয় দত্ত তাঁর সমস্ত দার্শনিক মতামত নানা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে রেখে গিয়েছিলেন। সকলেরই তা পড়ার ও জানার সুযোগ ছিল। অথচ তা তাঁর উত্তর-প্রজন্মের প্রায় জানাই হয়নি। বইগুলি একে একে বইয়ের বাজার থেকে ফুরিয়ে গেছে। রাজ্যের কিছু কিছু পুরনো গ্রন্থাগারের আলমারিতে ঝুল-ধুলো-ময়লায় চাপা পড়ে গেছে। ধীরে ধীরে বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে কীটজগতের খাদ্য সরবরাহ করেছে। তারপর কোনও এক মাহেন্দ্রক্ষণে বাস্তববাদী ও সুকর্মা আধিকারিকের কৃপায় সেই সব বই স্ক্র্যাপ অভিধায় ভূষিত হয়ে ঊর্ধ্ব বা অধোগতি লাভ করেছে।

হয়ত এই সব কারণেই গত শতকে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা বিদ্যাসাগরের স্মৃতি তর্পণ করেছেন, বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির পক্ষে অনেক দামি কথা বলেছেন বা লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪), রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯), সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪), মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬), রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০), প্রমুখ— তাঁরা প্রায় কেউই অক্ষয় কুমার দত্তের নাম বা তাঁর কোনও রচনার উল্লেখযোগ্যভাবে উল্লেখ করেননি। অর্থাৎ, মৃত্যুর দশ বিশ বছরের মধ্যেই তাঁকে আমাদের দেশের বুদ্ধিমান মানুষরা পর্যন্ত কমবেশি ভুলে যেতে সক্ষম হয়েছেন। বিদ্যাসাগরের এই বন্ধুর নামটা হয়ত কোনওরকমে টিকে গেছে। কিন্তু তাঁর কাজ সবই প্রায় স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। আমাদের এই ক্ষমতা, যা আসলে অন্য একটা কিছুর অক্ষমতা, তার উৎস কারণ ও শক্তি আমাদের আজ ভালো করে জানতে বুঝতে হবে।

 

।।।।

অথচ অখ্যাত অজ্ঞাত গাঁয়ের এই মানুষটা হঠাৎই একদিন কলকাতায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে চলে আসেন। উনিশ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুতে অকালে স্কুলের পড়া অসমাপ্ত রেখে জীবিকার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়ে নিতান্ত ঘটনাচক্রে তখনকার বিখ্যাত কবি ঈশ্বর গুপ্তের (১৮১২-৫৯) সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁর পত্রিকা ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সেখানে মাঝে মাঝে কিছু কিছু গদ্য রচনা লেখা, অনুবাদ করা— এইরকম কাজ করতে করতে তিনি একটু একটু করে সমকালীন বিশিষ্ট মান্যব্যক্তিদের নজর আকর্ষণ করে ফেলেন।

গুপ্ত কবির পরেই যিনি তাঁকে সঠিক মূল্যে চিনতে পারেন তিনি হলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫)। তিনিই তখন ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতৃপদে আসীন। হিন্দুয়ানির সঙ্গে নানা ব্যাপারে আপস করলেও রামমোহনের অধ্যাত্মচিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে নানারকম গঠনমূলক কাজের কথা ভাবতে হচ্ছে। তারই একটি হল স্কুল পরিচালনা, আর একটি হল মুখপত্র বের করা। উপযুক্ত লোকের খোঁজ করতে করতে সংবাদ প্রভাকর থেকে অক্ষয় দত্তকে তিনি আবিষ্কার করলেন। তাঁর তত্ত্ববোধিনী পাঠশালায় ভূগোল ও বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য তিনি দত্তকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করলেন।

১৮৪০ সালে সেটাই হল এক মহাবৃক্ষ রোপন। বুদ্ধিমুক্তির এক নতুন চারাগাছ। আগের এক চারাগাছ, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-৩১), অকালেই মুড়িয়ে গিয়েছিল। হয়ত উপযুক্ত এক বনমালীর অভাবে। এবারেরটা দ্রুত বেড়ে চলল। এক নতুন ইতিহাসের ভাবী স্রষ্টা বেছে নিলেন ভূগোল পঠনকে তাঁর “বহুবিদ্যা” নির্মাণ সংক্রান্ত পরীক্ষার প্রথম ধাপ হিসাবে। ছাত্রদের শিক্ষার উপযোগী বাংলায় লেখা কোনও ভূগোল বই তখন বইয়ের বাজারে ছিল না। বাংলা ভাষায় নতুন ভূগোল বই লেখা হল। ১৮৪১ সালে প্রকাশিত হল। উপযুক্ত পরিভাষা চাই; তাও একে একে তৈরি করা হল। আর, এযাবত তো এরকম গুরুপাঠ্য বিষয় বাংলায় লেখা হয়নি। তার জন্য বাংলা ভাষাকেও নতুন সাজে সাজানো শুরু হল। প্রতিটি নতুন এবং প্রথম কাজ। প্রতিটি কাজের পেছনে— এবং সামনেও— অক্ষয় কুমার দত্ত।

তারপরেই তিনি হাত দেন একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশে। ‘বিদ্যাদর্শন’। ১৮৪২ সালে এর ছয়টি সংখ্যা বেরনোর পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু লেখক সম্পাদক অক্ষয় দত্তের জন্ম এবং পরিচয় দিয়ে যায়। পরের বছর থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে শুরু হয় ‘তত্ত্ববোধিনী’ মাসিক পত্রিকা। বাংলার নবজাগরণের নির্মাণে ও বিকাশে সেকালে এই পত্রিকাটির ভূমিকা অনবদ্য ও সর্বাগ্রগণ্য। সেই যুগে এতে লেখেননি এমন লেখক পাওয়া দুষ্কর। বিদ্যাসাগরেরও অনেক লেখা এতে প্রকাশিত হয়েছে। সমকালীন অগ্রগণ্য চিন্তাবিদরা— যথা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, প্রমুখ, এর পেপার কমিটি বা সম্পাদনা সমিতির সদস্য ছিলেন। যে বারো বছর এর সম্পাদক ছিলেন অক্ষয় দত্ত (১৮৪৩-৫৫), সেই সময়েই এর সুবৃদ্ধি। তারপর থেকে এর মান জৌলুস এবং আকর্ষণ ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে।

সেই পরের কথা পরে বলব।

অক্ষয় দত্তের সামনে তখন চারটি গুরু কর্তব্য। ১) বঙ্গভাষী জনসাধারণের মধ্যে ধীরে ধীরে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার ঘটিয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্ত কুসংস্কার দূরীকরণ করা; ২) তার জন্য ইউরোপীয় উৎস থেকে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উপলব্ধ জ্ঞান আহরণ করা ও সেগুলিকে জনসাধারণের পক্ষে সহজবোধ্য করে তুলে ধরা, অর্থাৎ, মাতৃভাষায় লোকপ্রিয় বিজ্ঞানের চর্চা করা; ৩) এতদুদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে বাংলা ভাষায় প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান সাহিত্য সম্ভার সৃষ্টি করা; ৪) এই কাজের উপযোগী করে বাংলা ভাষার এমনভাবে বিকাশ ঘটানো যাতে তার মাধ্যমে বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্বকেও ব্যাখ্যা করা বা বোঝানো যায়। এই সব কাজ করার মতো লোক যে তখন সহজলভ্য তো দূরের কথা, আদৌ লভ্যই ছিল না, একথা তো বলাই বাহুল্য। অতএব, এই কাজে তাঁকেই একে একে হাত লাগাতে হল। প্রায় একেবারে একাকী।

প্রথম কাজ দুটির জন্য তিনি নিজেকে কীভাবে তৈরি করেছিলেন তা আজ ভাবলেও আধুনিক পাঠকের মনে বিস্ময় এবং সম্ভ্রম জাগায়। চাকরি খুঁজতে কলকাতায় এসে তিনি পড়াশুনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে চাইছিলেন। বিদ্যার প্রতি তাঁর আগ্রহ লক্ষ করে তাঁর জ্যাঠতুতো দাদা তখন তাঁর জন্য দুজন গৃহশিক্ষক ঠিক করে দিলেন। সদ্য যুবকের সেই দুজন শিক্ষককে পছন্দ হল না। কারণ, তাঁরা তাঁর বেশিরভাগ কৌতূহল মেটাতে পারছিলেন না। তখন তাঁর সেই দাদা তাঁকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি করে দিলেন। সেখানকার প্রধান শিক্ষক ছিলেন হার্ডম্যান জেফ্রয় নামে একজন ইংরেজ বহুভাষাবিদ পণ্ডিত। তাঁর কাছে ১৮-১৯ বছর বয়সের অক্ষয় যা যা শিখলেন তার তালিকা দেখলে আজ বিশ্বাস করাও কঠিন। তিনি শিখলেন ইংরাজি গ্রিক লাতিন হিব্রু ফরাসি ও জার্মান ভাষা। জানলেন প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার কাহিনি। শিখলেন পদার্থবিদ্যা জ্যামিতি বীজগণিত ত্রিকোণমিতি উচ্চতর গণিত ইতিহাস ও ইউরোপের ধ্রুপদী সাহিত্য। পরে যখন সাংসারিক চাপে সেই বিদ্যালয় ছেড়ে দিতে হল, তখনও তাঁর পড়াশুনো বন্ধ হল না। স্বশিক্ষার মধ্য দিয়েই তিনি নিজেকে সুশিক্ষিত করে যেতে লাগলেন।

তারপর অচিরেই শুরু হল লেখা। প্রথমে তাঁর নিজের পত্রিকা ‘বিদ্যাদর্শন’-এ। তারপর ‘তত্ত্ববোধিনী’-তে। বাংলা ভাষায় প্রথম লোকপ্রিয় বিজ্ঞানের প্রবন্ধমালা। একটা দুটো নয়, পরের পর অনেক। বিষয় বৈচিত্র্যও বিপুল। ইতিহাস অর্থনীতি রাজনীতি কৃষি ও কৃষক বাণিজ্য পুরাতত্ত্ব ভূতত্ত্ব নক্ষত্রবিদ্যা প্রাণীবিদ্যা উদ্ভিদবিদ্যা শারীরতত্ত্ব মনস্তত্ত্ব— এক কথায় জ্ঞানজগতের প্রায় সমস্ত শাখা থেকেই এক হাতে নিয়ে অপর হাতে দেওয়া শুরু হল। তত্ত্ববোধিনীর তখন কি বিরাট চাহিদা! রমেশ চন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০১) লিখেছেন, “People all over Bengal awaited every issue of that paper with eagerness, and the silent and sick and indefatigable worker at his desk swayed for a number of years the thoughts and opinions of the thinking portion of the people of Bengal.” পত্রিকার জোরেই তত্ত্ববোধিনী সভা এবং ব্রাহ্মসমাজেরও দিকে দিকে প্রসার হতে লাগল।

 

।।।।

ভাষা চিন্তার বাহন। উচ্চতর চিন্তাকে প্রকাশ করতে হলে ভাষারও উচ্চতর বহন ক্ষমতা অর্জন করা চাই। স্বতঃস্ফূর্ততার উপর ছেড়ে দিলে ভাষার এই বিকাশের প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও অতি ধীর গতিতে এগোতে থাকে। আর যদি সচেতন প্রয়াস যুক্ত হয় তবে তার গতিবেগ বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রেও তাই হল। অক্ষয় কুমার দত্তের হাত ধরে বাংলা ভাষায় এক নতুন বেগ সঞ্চারিত হল।

এবার সেই কথা।

রামমোহনের হাতেই আধুনিক নিয়মিত বাংলা গদ্যের আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটেছিল। সব শুরুরই শুরু থাকে, সেই মতো রামমোহনের আগেও বাংলা গদ্যের নজির দেখানো যাবে। কিন্তু রামমোহনই প্রথম নিয়মিতভাবে তাঁর ধর্ম ও সমাজ সংস্কার বিষয়ক প্রবন্ধ বাংলা ভাষায় লিখতে শুরু করেন। কিন্তু নিছক গদ্য এক কথা, আর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সমৃদ্ধ সন্দর্ভ রচনা আর এক জিনিস, সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। সেই গদ্যে শুধু বিবৃতি দিয়ে গেলেই তো হবে না। বাক্য গঠন এমন হওয়া চাই যাতে পাঠক বুঝতে পারে কোন শব্দে কতটা জোর পড়বে, যাতে সে বাক্যের নির্মিতির মধ্যে যুক্তি-তথ্যের বিন্যাস ও পরম্পরা খুঁজে নিতে পারে। তার জন্য নতুন নতুন শব্দ চাই, পরিভাষা চাই, অর্থাৎ, এমন শব্দ যার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানের বক্তব্যটা অবিকৃতভাবে লেখকের কলম থেকে পাঠকের মস্তিষ্কে চলে যাবে। বিজ্ঞানের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে আসবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং তার থেকে আসবে বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি। যুক্তিবাদী বিচারশীলতা।

এই ব্যাপারে অত্যন্ত সুন্দর কথা বলেছেন আশুতোষ ভট্টাচার্য: “রামমোহন রায় ধর্মীয় তত্ত্ব ও সামাজিক আচারমূলক প্রবন্ধ রচনার যে ধারার প্রবর্তন করেছিলেন, তাতে অক্ষয় কুমার দত্তের মধ্যস্থতায় এক সম্পূর্ণ নতুন ধারা এসে যুক্ত হল। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব এই যে, বাংলা প্রবন্ধের সাহিত্য ধর্ম রক্ষা করেও তিনি তার মধ্যে বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় আলোচনা করেছেন। সেই দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, তিনি বিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানসাধনার অগ্রদূত। সেই সূত্রেই সে যুগে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের তিনি ভবিষ্যত পথপ্রদর্শক। রামমোহন ধর্ম ও সমাজ বিষয়ে সেদিন যে প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, তা ঊনবিংশ শতাব্দীর সীমা উত্তীর্ণ হয়ে বিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক যুগের দ্বারদেশ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু অক্ষয় কুমার দত্তের তপস্যা কেবলমাত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর ধ্যানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, অনাগত যুগের মধ্যেও তার সম্ভাবনা রেখে গিয়েছিল। অক্ষয় কুমারের আবির্ভাবের সময় পর্যন্ত কেবলমাত্র ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় ছিল। কিন্তু প্রবন্ধের ক্ষেত্র যে কত বিস্তৃত, তার বিষয়ের মধ্যে যে অন্তহীন বৈচিত্র্য আছে, তা আমরা তাঁর মধ্যেই প্রথম দেখতে পেলাম। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের দুরূহ বিষয়ও যে সেই যুগের বাংলা গদ্য ভাষার ভিতর দিয়ে প্রকাশ পাবার যোগ্য ছিল, তা অক্ষয় কুমারই প্রথম প্রত্যক্ষ করালেন।”

এইভাবেই সেদিন অক্ষয় দত্ত বাংলা ভাষার যেন পুনর্জন্ম দিলেন। আধুনিক বিচারশীল যুক্তিমূলক দার্শনিক ভাব বহন করার ক্ষমতা নিয়ে সেই নতুন গদ্য তাঁর হাত ধরে সংস্কৃতির মধ্যমঞ্চে এল এবং স্থায়ী আসন নিয়ে এগিয়ে চলল। সেকালে একথা অনেকেই মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করে গেছেন। এই আধুনিক রীতির গদ্য বাক-ধারা নির্মাণে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে ইংরাজি লিখিত ভাষা থেকে বিভিন্ন যতিচিহ্ন আত্মসাৎ করে তাদের বাংলাভাষার কোলে-কাঁখে গুঁজে দেওয়া। পূর্ণচ্ছেদ যতিচিহ্ন হিসাবে দাড়ির ব্যবহার আগে থেকেই ছিল। সংস্কৃত শ্লোকের দুই দাড়ি বর্জন ও এক দাড়ি গ্রহণ করে। বাকিগুলি, অর্থাৎ, কমা (,), সেমিকোলন (;), কোলন (:), হাইফেন (-), ড্যাশ (—), প্রশ্নবোধক-চিহ্ন (?), বিস্ময়চিহ্ন (!), উহ্যবাচক ঊর্ধ্ব কমা (’), দুরকম উদ্ধৃতি-চিহ্ন (‘’ এবং “”), তিন রকমের বন্ধনী(() {} []), অনুক্তিবাচক বহুডট (…), প্রতীক ব্যবহার সহযোগে পাদটীকা, ইত্যাদি এমনভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে দিলেন যে এগুলি যে লিখিত বাংলা ভাষার ভেতরে এক কালের আমন্ত্রিত বিদেশি অতিথি, মাত্র কিছু দিন আগেও এদের অস্তিত্ব বা ব্যবহার বাংলা রচনায় ছিল না, তা বলে না দিলে আজ আর বোঝার কোনও উপায় নেই।

দুঃখের বিষয়, অক্ষয় দত্তের এই অবদান বাঙালি বুদ্ধিজীবী মননে স্বনামে এবং সহজে প্রবেশাধিকার পায়নি। কৃতিত্বটি বিদ্যাসাগরের নামে হাত-বদল হয়ে গেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের, এই হাত-বদলের ঘটনাটি ঘটেছে স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৌজন্যে। তিনি বিভিন্ন সভায় বিদ্যাসাগরের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে বাংলাভাষায় ছেদচিহ্ন প্রবর্তনের কৃতিত্ব তাঁর নামে বলতে থাকেন। আর বাংলা ভাষার গদ্যশিল্পসৌষ্ঠব নির্মাণে বিদ্যাসাগরের অবদান এত সুবিদিত ও বহুচর্চিত যে সহজেই এই কথা সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি বিদ্বজ্জনদের মনের মধ্যেও স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়। সন্দেহের কোনও অবকাশই থাকে না। বাংলা ভাষার ইতিহাস ও সাহিত্যের ইতিহাস সংক্রান্ত বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকেও এই ধারণাকেই ধারণ লালন ও সঞ্চারণ করে যাওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে যে দুএকজন অক্ষয় কুমার দত্তের কথা তুলেও এনেছেন তাঁরাও কখনও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কখনও বিদ্যাসাগরকে এই কৃতিত্বের অন্তত ভাগীদার করে রাখতে চেয়েছেন। কেবলমাত্র অতি সম্প্রতি কিছু বিদ্বান ব্যক্তি পরিশ্রম সাধ্য গবেষণার মাধ্যমে সঠিক তথ্য উদ্ধার করে অক্ষয় কুমার দত্তকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন।

তাঁরা দেখিয়েছেন, বিদ্যাসাগর প্রথম এই ধরনের সুসংগঠিত বাংলায় লেখেন ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ যা প্রকাশিত হয় ১৮৪৭ সালে। পক্ষান্তরে, অক্ষয় দত্তের ১৮৪১ সালের ‘ভূগোল’ গ্রন্থেই আধুনিক যতি চিহ্নের প্রয়োগ দেখা যায়। সেইজন্যই সেকালের বেশিরভাগ চিন্তাশীল মানুষই তাঁর বিভিন্ন রচনার গুণ ও মানের প্রশংসা করার পাশাপাশি তাঁর অনবদ্য ভাষানৈপুণ্যেরও উল্লেখ করে গেছেন।

 

(ক্রমশ)