অক্ষয় কুমার দত্ত: মুক্তবুদ্ধির অগ্রদূত

অশোক মুখোপাধ্যায়

 


লেখক প্রবন্ধকার, বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী

 

 

 

 

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

।।।।

তত্ত্ববোধিনী-উত্তরকালে অক্ষয় দত্ত আর ছোটখাটো কিছু নয়, একটি বৃহৎ প্রকল্প হাতে তুলে নিলেন। তাঁর জীবনের বলা যায় মহত্তম কর্ম। একটি তিন খণ্ডে বিভক্ত মহাগ্রন্থ রচনায় হাত দেবেন তিনি। গ্রন্থটির নাম এখন সকলেই জানেন। ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাস’। অক্ষয় দত্তের এই একখানা মাত্র বই কালের অবলেপ এবং উত্তরসূরিদের অবহেলার কবল থেকে বেঁচে গেছে। আমাদের কাছে তাঁর প্রদত্ত ‘অক্ষয়’-সম্পদ হয়ে টিকে থেকেছে। কেন, বা কীভাবে— সে কথা যথাস্থানে বলব। তার আগে বইটির সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে নিতে চাই।

এই বইটির প্রথম খণ্ড বেরোয় ১৮৭০ সালে, এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৮৩ সালে। বোঝা যাচ্ছে, শেষ বইটি লেখার পর তিনি প্রায় এগারো বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন এই মহাপ্রকল্পের প্রথম অংশ সমাপ্ত করার জন্য। দ্বিতীয় অংশটি শেষ করতে লেগেছে আরও বেশি সময়— তেরো বছর। আর, দুঃখের কথা, তৃতীয় খণ্ডটি তিনি কার্যত ধরতেই পারেননি, শেষ করা তো দূরের কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? আগেকার কয়েক বছরের রচনার ইতিহাসের সঙ্গে শেষ পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের এইরকম পার্থক্য কেন? কলম তাঁর এত শ্লথ হয়ে গেল কেন?

কারণ একটা নয়, দুটো। একে একে দেখা যাক।

প্রথম এবং প্রধান কারণ হচ্ছে, গ্রন্থটির প্রতিসাধ্যের আকার বা বিশালতা। ভারতবর্ষের উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাস মানে তো ভারতের যাবতীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়েরই ইতিবৃত্ত বর্ণন। মনে হয়, দত্ত সচেতনভাবেই ধর্মীয় শব্দটি বাদ দিয়ে উপাসক শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আর কে না জানে, ভারতে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা খুব কম নয়। তাঁর অনেক কাল আগে (১৮২৮-৩২) ডিরোজিওর আমলের হিন্দু কলেজের প্রিন্সিপাল হোরেস হিম্যান উইলসন (১৭৮৬-১৮৬০) সাহেব এই কাজে প্রথম হাত দিয়ে মাত্র পঁয়তাল্লিশটি সম্প্রদায়ের কথা লিখেছিলেন। তাঁর সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধটি দুটি অংশে “A sketch of the religious sects of the Hindus” শিরোনামে এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্রে বেরিয়েছিল। [Asiatic Researches, vol. XVI, 1828 and vol. XVII, 1832] পরে এটি একত্রে ১৮৬২ সালে তাঁর রচনাবলির প্রথম খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়। তাঁর এই প্রবন্ধ থেকেই হয়ত দত্ত তাঁর আলোচ্য বইটি লেখার প্রাথমিক অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি হাত দিলেন একশো বিরাশিটি সম্প্রদায়ের কাহিনিতে। চার গুণেরও বেশি কাজ। পুরোটাই তিনি একা নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে করে সম্পন্ন করেছেন। বইপত্র পড়ার পাশাপাশি সরাসরি ক্ষেত্রসমীক্ষা করে অনেক রকম তথ্য পেয়েছেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে থেকেছেন, মিশেছেন, কথা বলেছেন, বুঝেছেন। তবে লিখেছেন। এই কারণেই ভারতীয় সমাজ তথা ধর্মীয় সমাজের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সাপেক্ষে বইটির আজও একটি আকর গ্রন্থমূল্য আছে, যা সেই যুগের খুব বেশি বইয়ের ক্ষেত্রে বলা যায় না। আর এতবড় একখানা কাজ, যার সমতুল্য কিছু তখন পর্যন্ত কোনও ভারতীয়র একক বা সমষ্টিগত উদ্যোগে সম্পন্ন হয়নি, একা করতে গিয়ে স্বভাবতই তাঁর সময় লেগেছে অনেক।

দ্বিতীয় কারণটি খুব বেদনাদায়ক। শারীরিক অসুস্থতা। কঠিন মাথার যন্ত্রণা, যার জন্য তিনি ক্রমাগতই কাবু হয়ে পড়ছিলেন, একটানা না পারতেন পড়তে, না লিখতে। গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি নিজেই নিজের এই অক্ষমতার কথা বেদনাবিধুর ভাষায় বলেছেন। অনেক সময় কারও সাহায্য নিতেন পড়া বা লেখার জন্য। তাও তার পাঠের শব্দ বেশিক্ষণ কানে শুনতে পারতেন না, অসহ্য বোধ হত; আবার লেখাতে গিয়ে যে শ্রুতিপাঠ দিতে হত তাও দিতে দিতে শ্রান্ত হয়ে পড়তেন। এর ফলে বইটি এগোয় খুব ধীর গতিতে। প্রথম খণ্ড বেরনোর পর তেরো বছর লেগে যায় পরের পর্ব বের করতে। যে মাথাটি এই জাতীয় গবেষণাধর্মী কাজের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার, যত তিনি পরিশ্রম করেছেন ততই সেই যন্ত্র অসুস্থ ও অকেজো হয়ে পড়েছে। আর যত তিনি অসুস্থ হয়েছেন ততই কাজটি শেষ করার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছেন। তাতে আরও বেশি করে অসুস্থতা বেড়ে গেছে। আজ যদি কেউ ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাস’ গ্রন্থটি খুলে পড়তে বসেন, তাঁকে স্মরণে রাখতে হবে, এর প্রতিটি পংক্তির গায়ে আছে একটি মহান মুক্তমন মানুষের জীবন-মৃত্যু সংগ্রামের পঁচিশ বছর ধরে একটানা পল পল শারীরিক যন্ত্রণার নিঃশব্দ-লাঞ্ছন। এ ছিল অন্তহীন ট্র্যাজেডির এক মেগাসিরিয়াল।

অথচ, অক্ষয় দত্তের এই বইটি ভারি অদ্ভুত। আমার জানায় এটি সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র বই যার গ্রন্থকার-কৃত ভূমিকা মূল গ্রন্থের আয়তনের চেয়ে অনেক বড়। এরকম সাধারণত হয় না। “উপক্রমণিকা” শীর্ষক এই ভূমিকা আবার দুই খণ্ডে পরিব্যাপ্ত। এও কোনও বইয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। কোনও পুস্তকে লেখকের নিজের ভূমিকা সচরাচর খুব একটা বড় হয় না, দু-চার পৃষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। পুরনো বই পুনর্মুদ্রণের সময় অনেক ক্ষেত্রে নতুন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক একটা বড় ভূমিকা (যদিও তা এত বড় হয় না) লিখে দেন তাঁর সমসময়ে বইটির প্রাসঙ্গিকতা স্থাপনের দায়ে। কিন্তু লেখক নিজেই এমন একটা কাণ্ড করছেন— এটা খুব একটা দেখা যায় না।

ব্যত্যয়টি বোঝার জন্য আরও কিছু কাঁচা তথ্য দেওয়া যাক।

উনিশ শতকে প্রকাশিত বইটির মূল কপি আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে সম্প্রতি এর ডিজিটাইজ করা পেলব কপি দেখেছি। আর আমার সংগ্রহে আছে কলকাতার করুণা প্রকাশনীর তরফে পুনর্মুদ্রিত বইটির দুটি খণ্ড— যার মধ্যে প্রথম খণ্ড ১৯৮৭ সালে এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রথম খণ্ডে মূল বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৩৮ এবং “উপক্রমণিকা”-র জন্য বরাদ্দ পৃষ্ঠা সংখ্যা হচ্ছে ১১৬। অর্থাৎ, গোটা বইটির ২৫৪ পৃষ্ঠার প্রায় ৪৬ শতাংশ হচ্ছে এই ভূমিকা। অন্যদিকে, দ্বিতীয় খণ্ডে মূল বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ২২৮ এবং “উপক্রমণিকা”-র জন্য বরাদ্দ পৃষ্ঠা সংখ্যা হচ্ছে ৩২০। অর্থাৎ, গোটা বইটির প্রায় ৬০ শতাংশ হচ্ছে এই ভূমিকা। আর দুই খণ্ড মিলিয়ে ধরলে দেখা যাচ্ছে, উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাসের জন্য যেখানে লেগেছে ৩৬৬ পৃষ্ঠা, সেখানে “উপক্রমণিকা”-র জন্য ব্যয় হয়েছে মোট ৪৩৬ পৃষ্ঠা। অর্থাৎ, অখণ্ডভাবে ধরে গোটা বইয়ের অর্ধেকেরও বেশি, প্রায় ৫৫ শতাংশ জুড়ে রয়েছে এই ভূমিকা

এরকম কেন?

অনেকেই এই গ্রন্থটির ক্ষেত্রে এই ব্যত্যয়ী ঘটনাটি লক্ষ করেছেন, এর ব্যাখ্যা খুঁজেছেন এবং বিভিন্ন দিক থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। “উপক্রমণিকা”-র দার্শনিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক গুরুত্ব তাঁরা অত্যন্ত ভালোভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁদের সেইসব উপস্থাপনার সঙ্গে একমত হয়েও সেই সূত্র ধরে এই ঘটনার ব্যাখ্যা পাচ্ছি না: প্রথম সংস্করণেই লেখকের ভূমিকা কীভাবে মূল বইয়ের থেকেও আকারে অনেক বড় হয়ে গেল? সত্যিই এর কতটা প্রয়োজন ছিল? বা আদৌ ছিল কি?

কেননা, আরও ভালো করে নজর করলে মনে হবে, আসলে এ লেখকের ভূমিকা নয়; এ যেন একই মলাটের ভেতরে সাজানো একই লেখকের দুটো বই। কারণ, মূল বইয়ের বক্তব্যের সঙ্গে বৃহদায়তন ভূমিকায় আলোচিত বিষয়ের খুব একটা তেমন সম্পর্ক নেই। একটা বইয়ের নাম শিরোনামে যা দেওয়া আছে সেইরকম হতে কোনও বাধা নেই। দ্বিতীয় বইটির নাম বোধ হয় বিষয়বস্তু অনুযায়ী হওয়া উচিত ছিল ‘ভারতে নিরীশ্বরবাদ ও বস্তুবাদের বিকাশ তথা অনুশীলন’। দুটো বই প্রথমেই আলাদা আলাদাভাবে ছাপানো যেত। বা, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড না করে এক একবারে একটা করে বই হতে পারত। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে লেখক অক্ষয় দত্ত দুটোকে মিলিয়ে একখানা বই তৈরি করে রেখেছেন।

আরও লক্ষণীয়, যুক্তিবাদী বিজ্ঞানলেখক অক্ষয়কুমার দত্ত যেন প্রথম বইটিতে ভারতবর্ষের বহু বিচিত্র ধর্মসংস্কৃতি বিশিষ্ট মানব গোষ্ঠী সম্পর্কে তাঁর বহুদিনের পরিশ্রমজাত ও বৈজ্ঞানিক বিধিসম্মত অনুপুঙ্খ ক্ষেত্রসমীক্ষার ফলাফল লিপিবদ্ধ করেছেন; আর দ্বিতীয় বইতে তিনি তাঁর নিজস্ব দার্শনিক বিচার, ভারতীয় চিন্তাশীলদের বিভিন্ন দার্শনিক মতের পরিচয়, পারস্পরিক তর্কবিতর্ক খণ্ডন-বিখণ্ডন, ভারতীয় প্রাচীন মনন-ঐতিহ্যে নিরীশ্বরবাদ এবং বস্তুবাদের নানা শাখার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, ভারত গ্রিস ও রোমের প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে ভাষা তথা অন্য নানা বিষয়ে সাদৃশ্য, ইত্যাদি বহু চিত্তাকর্ষক বৌদ্ধিক উপকরণ তুলে ধরেছেন। এখানে আছে শুধু যুক্তিবাদী বিচারধারা নয়, যুক্তিবাদের মননশীল ফসল। এতে পাওয়া যায় শুধু মাত্র বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আবাহনী নয়, আগমনী নয়, তার পাশাপাশি আমরা পাই সমাজ সংস্কৃতি ভাষা দর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অখণ্ড বিজ্ঞানমানস প্রয়োগের ফল স্বরূপ এক উৎকৃষ্ট বিচারপদ্ধতি ও অভাবিতপুর্ব সিদ্ধান্তরাশি। প্রথম পুস্তক শেখায়, কোনও একটি সমাজতাত্ত্বিক বিষয়ে কীভাবে তথ্যানুসন্ধান করতে হবে। দ্বিতীয় পুস্তক থেকে শেখা যায়, কোনও একটা দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে দীর্ঘপ্রচলিত বিভ্রান্তিগুলিকে কীভাবে কাটানো যায়। সেদিক থেকে বইদুটি সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন গ্রন্থন নয়, পরস্পর ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু তবুও আলাদা।

সেই দীর্ঘ উপক্রমণিকা থেকে দু-একটা উদ্ধৃতি দিয়ে মূল গ্রন্থের সঙ্গে এর বিচ্ছেদ ও সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করা যাক।

ধর্মসম্প্রদায়ীরা চিরকালই বুদ্ধিশক্তিকে ভয় করিয়া আসিয়াছেন ইহা প্রসিদ্ধই আছে। … জ্ঞানব্রত উপনিষদ বক্তারাও তাহাতে বর্জিত নহেন। … বুদ্ধি ও ধর্মনীতি বিষয়ে অধিকার থাকাতেই মনুষ্যের মনুষ্যত্ব জন্মিয়াছে। বিশুদ্ধবুদ্ধি তত্ত্বলাভের একমাত্র সোপান। বুদ্ধি বিচার ব্যতিরেকে তত্ত্ব নিরূপণ করা আর চক্ষু-কর্ণ ব্যতিরেকে দেখিতে ও শুনিতে পাওয়া উভয় তুল্য। … কুসংস্কারশূন্য বিশুদ্ধ বুদ্ধি জ্ঞানরূপ পুণ্যতীর্থের যে স্থানে বা যে অবস্থায় লইয়া যায় সেই স্থানে ও সেই অবস্থায় যাইব এই প্রতিজ্ঞা করিয়া যে সমস্ত তেজস্বীবুদ্ধি মনস্বী ব্যক্তি বুদ্ধিচালনা করেন তাঁহারাই প্রকৃত তত্ত্বানুরাগী। … যাঁহারা ঐরূপ বোধ না করেন, তাঁহারা কদাচ তত্ত্বানুরাগী নহেন; আপনাদের মনঃকল্পিত মতের ও চিরসঞ্চিত কুসংস্কারেরই অনুরাগী।

এরপর তিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে যুক্তিবাদী বিশ্লেষকের চোখ দিয়ে একে একে ন্যায় বৈশেষিক মীমাংসা ইত্যাদি প্রাচীন দর্শনসমূহের মূল তত্ত্ব আলোচনা করে দেখান,

এই ষড়দর্শনের মধ্যেও প্রায় কোন দর্শনকারই জগতের স্বতঃ সৃষ্টিকর্তা স্বীকার করেন নাই। কপিলকৃত সাঙ্খ্য তো সুস্পষ্ট নাস্তিকতাবাদ, পতঞ্জলি ঈশ্বরের স্বীকার করেন বটে কিন্তু তাহাকে বিশ্বস্রষ্টা না বলিয়া বিশ্বনির্মাতা মাত্র বলিয়া গিয়াছেন। গৌতম ও কণাদের মতানুসারে জড় পরমাণু নিত্য; কাহার কর্তৃক সৃষ্ট হয় নাই। প্রাচীন মীমাংসা পণ্ডিতেরা তো ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্পষ্টই অস্বীকার করিয়াছেন। বেদান্তের মতে জগত সৃষ্টই হয় নাই, বিশ্বব্যাপার ভ্রম মাত্র, ইহাতে আর সৃষ্টিকর্তার সম্ভাবনা কি?

জগত স্রষ্টা ঈশ্বরে বিশ্বাস যদি আস্তিকতাবাদ স্বীকারের প্রধান অবলম্বন হয়, অক্ষয় দত্তের মতে,

প্রায় সমুদয় ষড়দর্শনকে নাস্তিকতা প্রতিপাদিক বলিয়া উল্লেখ করিতে হয়।

তারপরে তিনি দেখান,

উল্লিখিত ষড়দর্শনের প্রতি অনেকানেক আস্তিক্যবুদ্ধি ভক্তিমান লোকের বিশেষরূপে শ্রদ্ধা আছে। ঐ ছয়ের মধ্যে অধিকাংশ নাস্তিকতাবাদী ও কোন কোনটির মতে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় নাই, একথা শুনিলে তাঁহারা চমৎকৃত হইয়া উঠিবেন বোধ হয়।

বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর স্বাধীন ও মুক্তমন অধ্যয়নের দ্বারা অর্জিত উপলব্ধি তিনি পাঠকের কাছে তুলে ধরেন এইভাবে:

এখন বেদপ্রাণ হিন্দুমণ্ডলি! শ্রবণ কর! তোমাদের প্রাচীন মীমাংসকগণ অর্থাৎ বেদমন্ত্রের মীমাংসাকারী পূর্বকালীন আচার্যগণ না ঈশ্বরই মানিতেন না দেবতাই স্বীকার করিতেন। তাঁহারা নির্দেব ও নিরীশ্বর।

এই যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা, এর সঙ্গে যে উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাসের কোনও সিধা-সম্বন্ধ নেই তা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সব পড়তে পড়তে কেন জানি না আমার এক সময় মনে হয়েছিল, অক্ষয় দত্ত আসলে দ্বিতীয় বইটাই লিখতে চেয়েছিলেন, অন্তত দ্বিতীয় বইটিতেই তাঁর ছিল অধিকতর এবং অত্যান্তরিক আগ্রহ। এটি তাঁর উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাসের যথার্থ উপক্রমণিকা ছিল না, এ ছিল তাঁর আকৈশোর সঞ্চিত জ্ঞানভাণ্ডারের মণিরত্ন থেকে কিয়দংশ প্রকাশের আগ্রহের উপক্রম। আর, চল্লিশ বছর ধরে এই দেশে বুদ্ধিবৃত্তির চাষবাস করে, বিদ্যাসাগরের ঐহিক চিন্তাবাহিত সামাজিক কার্যক্রমের পরিণতি দেখে, এবং ততদিনে ব্রাহ্ম আন্দোলনের আপসজাত অবক্ষয় ও তার বিকল্প স্বরূপ বঙ্কিমী পরিশোধিত হিন্দুত্ব এবং রামকৃষ্ণ-ভক্তিবাদের ক্রম অভ্যুত্থান লক্ষ করে তিনি নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, তাঁর দার্শনিক বিচারের উপক্রমণিকাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তার গলায় ধর্মচর্চার কোনও একটা কিছু প্রসঙ্গ যে কোনও অছিলায় ঝুলিয়ে দিতে পারলে ভালো হবে। অনেকটা সেই খ্রিস্টীয় চার্চের কাছে গ্যালিলেওর ছদ্ম-আত্মসমর্পণের মতো। চার্চ যখন জানল গ্যালিলেও বিজ্ঞান পরিত্যাগ করেছেন, তারা বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে অসাবধান হয়ে গেল; আর প্রখর প্রতিভাধর গ্যালিলেও সেই ফাঁক দিয়ে নব্য বিজ্ঞানকে বাঁচিয়ে রেখে টুকরো টুকরো কাগজে লিখে তাঁর বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণাগুলি মথুরা (ইতালি) থেকে বৃন্দাবনে (হল্যান্ডে) পাঠিয়ে দিলেন।

অক্ষয়কুমার দত্তও গ্যালিলেওর মতোই জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি যদি এই দুখানা বই আলাদা করে লিখতেন, তাহলে— তিনি বোধ হয় ঠিকই বুঝেছিলেন— উপাসকদের ইতিহাস অবশ্যই বাংলার মনন ইতিহাসে টিকে যেত, এদেশের প্রধান ধারার মননচর্চায় যথেষ্ট প্রশ্রয় ও আশ্রয় পেত। কিন্তু তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দার্শনিক বিচারের উপক্রমণিকা আজ ইংলন্ডের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত একমাত্র কপি ছাড়া আর কোথাওই সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যেত না। আর তিনি এই রচনাটিকেই ভাবীকালের হাতে তাঁর প্রকৃত বৌদ্ধিক উত্তরাধিকার হিসাবে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। গ্রন্থটির পূর্বোক্ত বিচিত্র বিন্যাসের এটাই হয়ত যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা। তবে তিনি তাঁর উত্তরপ্রজন্ম সম্পর্কে যা ভেবেছিলেন, তার জবাবে আমাদের আত্মসম্মান পুনরুদ্ধার করার স্বার্থে এই দিকটাও এবার ভেবে দেখার সময় হয়েছে।

এও ভেবে দেখতে হবে, কেন ভারতের বামপন্থী মার্ক্সবাদী যুক্তিবাদীরা এযাবত অক্ষয় কুমার দত্তকে বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব এবং শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে সামনে তুলে আনার প্রয়াস করলেন না। বিনয় ঘোষ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখর ভারতীয় দর্শন ও প্রাচীন সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে এত ভালো ভালো কাজ আছে, অথচ তাতে কোনও সূত্রে অক্ষয় কুমার দত্ত স্থান পেলেন না কেন, তাঁর এই বইটা খানিকটাও জায়গা আদায় করতে পারল না কেন— আমাকে বিস্মিত করেছে। আর তাঁরা উপযুক্ত গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে তাঁর রচনার ইংরেজি বা অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদও হল না। তার ফলে ভারতবর্ষের কোনও জায়গাতেই দত্ত সামান্যতম পরিচিতিও পেলেন না আজ অবধি।

 

।।।।

অক্ষয় কুমার দত্তকে বিস্মৃতির আড়ালে ঠেলে দেওয়ার পেছনে হয়ত একটা কারণ এই হতে পারে, তিনি তাঁর প্রায় সমস্ত রচনাতেই “পরমেশ্বর”-এর উল্লেখ করেছেন এবং জগৎ সংসারকে সেই তারই মহিমার প্রকাশ হিসাবে ব্যক্ত করেছেন। এমনকি আমরা সর্বশেষ যে ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় গ্রন্থের নাম উত্থাপন করে এত ভালো ভালো সব কথা বললাম, তাতেও আছে। আমাদের বিশ-একুশ শতকের যুক্তিবাদীদের হয়ত একে ভাববাদের দিকে ঝুল বলে মনে হয়েছে, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রশ্নে দুর্বলতা ও আপস বলে প্রতিভাত হয়েছে। আমরা বোধহয় তাই প্রাণ খুলে অক্ষয়কুমার দত্তকে ক্ষমা করতে পারিনি।

আসলে আমরা এই পরমেশ্বরকেও চিনতেই পারিনি। অক্ষয় দত্তের এই সব রচনার প্রায় সবই বেরিয়েছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়, যা ছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচালিত ব্রাহ্মসমাজের কর্তৃত্বাধীন। আবার তাঁর বেশিরভাগ বইপত্র প্রকাশ করেছিল সেই ব্রাহ্মসমাজ প্রেস। ফলে প্রতিটি রচনায় পরমেশ্বর মার্কা কিছু আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণার কথাবার্তা না থাকলে তা সেই ধর্মবিশ্বাসী প্রেস থেকে মুদ্রিত হওয়ার ছাড়পত্র যে পেত না, তা বলাই বাহুল্য। তাই এ ছিল অনেকটা কোপারনিকাসের সেই প্রাচীন তলেমীয় বিশ্বমডেলে কোপ মেরে নিকেশ করার পৃথিবীসহ গ্রহদলের সূর্যের চারদিকে আবর্তন সম্পর্কিত আলেখ্যটি ভ্যাটিকান পোপের উদ্দেশে উৎসর্গ করার মতো। জিওরদানো ব্রুনোর হাতে দত্তর এই সব লেখা পড়লে আমাদের ভ্রূকুঞ্চন দেখে তিনি চোখ পাকিয়ে বলতেন, ওরে ওরে, মূঢ়! ভদ্রলোকের এই পরমেশ্বরও বোগাস, আর যাদের জন্য ইনি এই নামোচ্চারণ করেছেন, তারাও এক একটা গর্দভ। বাকি লেখা জায়গাগুলো পড়ে দেখ। সবই বিজ্ঞানের কথা কিংবা বৈজ্ঞানিক মনোভাবনার প্রকাশ।

আমরা তো আর ব্রুনো নই। তাই অতশত বুঝিনি। বিদ্যাসাগরকে নিয়েও কত তর্ক করেছি, উনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, নাকি অবিশ্বাসী ছিলেন? যদি অবিশ্বাসীই হবেন, তাহলে চিঠিতে হরির নাম, গায়ে পৈতের সুতো— এসব ছিল কেন?

অত কষ্ট না করে উলটো দিক থেকেও ভাবা যেত। কার্ল পপারের অপ্রতিপাদনীয়তার যাচকাঠি প্রয়োগ করে দেখলেও হত। যারা ধর্মে বিশ্বাস করেন, আধ্যাত্মিক তত্ত্বের চর্চা করেন, তাঁদের কাউকে কখনও দেখেছেন, ঈশ্বরচন্দ্রের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিতে? কাউকে শুনেছেন বলতে, বিদ্যাসাগরের মতো ধার্মিক হও? অনুরূপ প্রশ্ন অক্ষয়কুমার দত্তকে নিয়েও করা যায়। তাঁর এত সব রচনায় পরমেশ্বর আছে, তাঁর কত মহিমার কীর্তন আছে, তবু কজন ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তি অক্ষয় দত্ত থেকে উদ্ধৃতি দেন? ধার্মিকদের আলোচনায় অক্ষয় দত্তকে নিয়ে পড়তে দেখেছেন নাকি কাউকে? কাউকে কখনও বলতে শুনেছেন, জগতে ঈশ্বরের মহিমা সম্পর্কে জানতে হলে অক্ষয় দত্তের রচনা পড়ুন? নরেন দত্তকে বলতে শুনেছেন কেউ, “এই সেই পুরুষসিংহ যাঁহার অপেক্ষায় আমরা দিবস গণনা করিতেছিলাম পরম ব্রহ্মের পূর্ণ বিকশিত জ্ঞানরূপ দেখিব বলিয়া!”?

না, এমনটা কেউ দেখেননি, বা শোনেননি। কেন না, তাঁরা তাঁদের ধর্মসাধনার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধক বলেই বোঝেন, বিদ্যাসাগরের “হরি-শরণম্‌” বা অক্ষয় দত্তের “পরমেশ্বর”কে দিয়ে তাঁদের কাজ হবে না। এই পরমেশ্বর জগত সংসারের স্রষ্টা ও সঞ্চালক হয়েও জগতের কার্যকারণ সম্পর্কের বাইরে থাকতে পারেন না, বাইরে কিছু ঘটাতে পারেন না। পদার্থের নিয়ম লঙ্ঘন করে অতিপ্রাকৃতিক কার্যকলাপ তিনি সংঘটিত করাতে পারেন না। ফলে অলৌকিকতা এক ধাক্কায় সেই “পরমেশ্বর”-এর হাতের বাইরে চলে যায়। আধ্যাত্মিকতাও। ওরকম এক পরমেশ্বরকে নিয়ে দর্শন করা যায়, বই লেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট থিসিস লেখা সম্ভব, কিন্তু আমজনতার প্রয়োজনমতো ধর্মের বারোয়ারি কাজ হয় না।

তার উপর কত স্ফুলিঙ্গ যে তাঁর লেখার মধ্য থেকে উঠে আসে! উপাসক সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় খণ্ডের উপক্রমণিকায় সাংখ্য দর্শন আলোচনাকালে তিনি বলেন,

[সত্ত্ব রজঃ তমঃ] এই তিনটি গুণের কার্য ও পরস্পর-সম্বন্ধাদি লইয়া সাংখ্য-শাস্ত্রে সবিশেষ আন্দোলন সহকারে অনেক তর্ক, বিতর্ক, বিচার ও সিদ্ধান্ত আছে। সেই সমস্ত কুটিল ও জটিল অবাস্তবিক বিষয়ের বৃত্তান্ত লিখিলে, পাঠকগণের অসুখ বই সুখের বিষয় হইবে না। ফলতঃ একবার মনে হয়, চিরকাল এই সমস্ত ভ্রান্তিভার বহন করিবারই বা প্রয়োজন কি? পুনর্বার ভাবি, ইতিহাস রচয়িতাদিগকে সত্যমিথ্যা সকলই কীর্তন করিতে হয়। সূর্য-জ্যোতিঃ বিশুদ্ধাশুদ্ধ সকল বস্তুই স্পর্শ করিয়া থাকে। মানবীয় মনের ইতিবৃত্ত পর্যালোচনা করিলে কখন বা সুখী ও কখন দুঃখিত হইতে হয়। এই পুস্তকের অধিকাংশই তো ভ্রান্তিভূধরের বর্ণনা বই আর কিছুই নয় মানুষে বুঝি ঐ অতি দুর্ভেদ্য ভূধরশ্রেণীর বহুতর শৃঙ্গ অতিক্রম না করিলে, তত্ত্বভুবন আরোহন করিতে সমর্থ হয় না।

কী সর্বনাশ! এ যেন বিদ্যাসাগরের সেই সাংখ্য ও… (বাকিটা এখন উহ্য থাক, একটু পরেই তাও দেখা যাবে) দর্শনকে ভ্রান্ত বলা মন্তব্যের ভাবসম্প্রসারণ!! যে ইতিবৃত্ত তিনি লিখছেন, তার অনেক কিছুই যে ভুলভ্রান্তির শিকার তা পাঠককে একেবারে গোড়াতেই জানিয়ে রাখছেন। দ্বিতীয়ত, মোটা হরফ সংযোজিত বাক্যটি আরও মারাত্মক। তিনি যে উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাস লিখছেন, তাকে এখানে বলেই দিচ্ছেন ভ্রান্তিভূধর! ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যগণ যার চর্চা করেন তা ভ্রান্ত মতাদর্শ বই আর কিছু নয়! আর সেই “অতি দুর্ভেদ্য ভূধরশ্রেণীর বহুতর শৃঙ্গ” এই বইতে তিনি অতিক্রম করছেন সত্য জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে। এর পর যদি তিনি পরমেশ্বরের নাম দু চারবার নিয়েও ফেলেন, তাতে কার কী এসে যায়? ঈশ্‌ বেচারিকে সেই ভ্রান্তিভূধরেই পড়ে থাকতে হয়।

বেদান্ত মতের বিশ্লেষণ শেষে বৈদান্তিকদের সংগে সাংখ্য ও অন্যান্য দর্শনের প্রবক্তাদের কিছু বিচিত্র বিতর্ক উল্লেখ করে তিনি লেখেন:

ফলত অতর্কনীয় বিষয়ে তর্ক উপস্থিত করিলেই বুদ্ধিবিপাক ঘটিয়া উঠে। যে বিষয় অজ্ঞেয় ও অনির্বচনীয়, তাহা জানিতে ও নির্বাচন করিতে গিয়া মানুষে বিপদাপন্ন হইয়া পড়ে।

যাঁরা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রহীন উপন্যাস পড়েছেন, তাঁদের হয়ত এই জায়গায় এসে পঁচিশতম অধ্যায়ে দিবাকরকে বলা কিরণময়ীর কিছু অসাধারণ প্রাসঙ্গিক সংলাপ মনে পড়ে যেতেও পারে। এইরকম ছিল সেই সংলাপ:

দিবাকর অনেকক্ষণ মৌন থাকিয়া বলিল, আচ্ছা বৌদি, যে বস্তু বুদ্ধির বাইরে, তার সম্বন্ধে সত্য-মিথ্যা বুদ্ধিপূর্বক কী করে স্থির করবেন?

কিরণময়ী তৎক্ষণাৎ প্রত্যুত্তর করিল, করব না তো। যা বুদ্ধির বাইরে তা বুদ্ধির বাইরে বলেই ত্যাগ করব মুখে বলব অব্যক্ত, অবোধ্য, অজ্ঞেয়, আর কাজে কথায় তাকেই ক্রমাগত বলবার চেষ্টা, জানবার চেষ্টা কিছুতেই করব না যিনি করবেন, তাকেও কোনমতে সহ্য করব না। তুমি এইসব বই পড়নি ঠাকুরপো, পড়লে দেখতে পাবে, সর্বত্র এই চেষ্টা আর এই জিদ। কেবল গায়ের জোর আর গায়ের জোর। যে মুখে বলচেন জানা যায় না, সেই মুখেই আবার এত কথা বলচেন যেন এইমাত্র সমস্ত স্বচক্ষে দেখে এলেন। যাকে কোনমতে উপলব্ধি করা যায় না, তাকেই উপলব্ধি করবার জন্য পাতার পর পাতা, বইয়ের পর বই লিখে যাচ্ছেন। কেন?… কেবল বড় বড় কথার মারপ্যাঁচ। নির্গুণ, নিরাকার, নির্লিপ্ত, নির্বিকার, এসব কেবল কথার কথা। এর কোনও মানে নেই। যদি কিছু থাকে তো সে এই যে, যাঁরা এ সকল কথা আবিষ্কার করেচেন, তাঁরাই প্রকারান্তরে বলচেন, এ সম্বন্ধে কেউ চিন্তামাত্র করবে না— সব নিষ্ফল, সব পণ্ডশ্রম।

দিবাকর অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে কহিল, বৌদি, আপনি আত্মা মানেন না?

না।

কেন?

মিথ্যে কথা বলে। তাছাড়া এমন দম্ভ আমার মনে নেই যে, সমস্তই নাশ হবে, শুধু আমার এই মহামূল্য আমিটির কোনদিন ধ্বংস হবে না। এমন কামনাও করিনে যে আমার মৃত্যুর পরেও আমার আমিটি বেঁচে থাকুক।

[মোটা হরফ সংযোজিত]

এই অবধিই এখানে থাক। আরও লম্বা উদ্ধৃতি দিতে গেলে অক্ষয় দত্তকে পাশ কাটিয়ে শরৎচন্দ্রে আমাদের মেতে ওঠার সম্ভাবনা আছে। সে বোধহয় ঠিক হবে না। যাঁরা আগ্রহ বোধ করবেন, উপন্যাসটি খুলে পড়ে নেবেন। আমি শুধু দেখিয়ে দিতে চাইছি, অক্ষয় দত্তের সেদিনের সেই যুক্তিতর্ককে সম্ভবত শরৎচন্দ্রই ঠিকমতো আত্মসাৎ করতে এবং সাহিত্যে স্পষ্ট ভাষায় রূপ দিতে পেরেছিলেন।

সে যাই হোক, ভারতীয় দর্শনের অনুশীলনকারীদের মধ্যে ব্যাপক শ্রদ্ধাভক্তি যে পরম ব্রহ্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা ও টিকাকে ঘিরে, তাকে ঊনবিংশ শতাব্দে যিনি অকুণ্ঠ ভাষায় “বুদ্ধিবিপাক” বলে বসতে পারেন, তিনি যে মননজগতের কী সাংঘাতিক ব্যক্তি কল্পনায় আনাও মুশকিল।

প্রাচীন ত্রিকালজ্ঞ মুনিঋষিদের সম্পর্কে তিনি যে মূল্যায়ন করেছিলেন, তাও একবার শুনে নেওয়া যাক:

[প্রাচীন ভারতীয়] দার্শনিক গ্রন্থকারেরা অনেকেই সতেজ বুদ্ধির সুপুষ্ট বীজ লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।… তাঁহারা বিশ্বের যথার্থ প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতিসিদ্ধ নিয়মাবলী নির্ধারণ পূর্বক কর্তব্যাকর্তব্য নিরূপণের নিশ্চিত উপায় চেষ্টা না করিয়া কেবল আপনাদের অনুধ্যান বলে দুই একটি প্রকৃত মতের সহিত অনেকগুলি মনঃকল্পিত মত উদ্ভাবন করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের একটি পথপ্রদর্শকের অভাব ছিল। একটি বেকন্‌— একটি বেকন্‌– একটি বেকন্‌ তাঁহাদের আবশ্যক হইয়াছিল। একটি তাদৃশী গুরুর আশ্রয় বিরহে তাঁহারা মেঘাচ্ছন্ন ও তিমিরাবৃত নিশীথ সময়ে দুর্গম বনস্থলে পথভ্রান্ত পথিকের ন্যায় চিরজীবন পরিভ্রমণ করিয়াছেন।

এই হচ্ছে অক্ষয় দত্তের চিন্তার জায়গা। তিনি তখন বেকনীয় অভিজ্ঞতাবাদ প্রসূত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেই ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রকে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। আজকের দিন হলে, তাঁর লেখায় কোনও ঈশ্বরভক্তি প্রদর্শনের দরকার হত না। এইসব তিনি লিখেছেন ১৮৭০-এর দশকে। তখন কেশব সেন হয়ে রামকৃষ্ণের উত্থান ঘটছে, বঙ্কিমচন্দ্র তখন মধ্যগগনে বিরাজ করছেন এবং “সাম্য” থেকে “ধর্মতত্ত্ব”-এর দিকে ঝুঁকছেন। ফলে পাঠকের কাছে পৌঁছনোর জন্য তাঁকেও একটু আধটু সেই বুড়ি ছুঁতে হয়েছে। অথচ সে এমন নিপুণ ছোঁয়া যে আপনি যখন তাঁর একটা যে কোনও প্রবন্ধ পড়বেন, টেরই পাবেন না, পরমেশ্বর কখন এল আর কখন বেরিয়ে গেল! একালে তাই প্রকৃত যুক্তিবাদীর কাজ এখন অক্ষয়কুমারের আসল বক্তব্যকে অনুধাবন এবং উদ্ধার করা। দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

 

।।।।

অক্ষয়কুমার দত্ত নামক ব্যক্তি মানুষটি কেমন ছিলেন?

এই প্রশ্নটাও জরুরি। কেন না, অনেকেরই ধারণা, ধর্মে মতিগতি না থাকলে, আধ্যাত্মিকতায় উৎপ্রেরিত না হতে পারলে, মানুষের নৈতিক চরিত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। নৈতিকতা আর ধর্ম নাকি অবিভাজ্য। রাজনারায়ণ বসু যে তত্ত্ববোধিনী সভায় অক্ষয় দত্তকে পাপী-তাপী চরিত্রদোষে পতিত ইত্যাদি বিশেষণ উপহার দিয়েছিলেন, তারও কারণ অক্ষয় দত্তের তৎকালীন সংশয়বাদী মানস। সেই মানুষটি তো পরে ধীরে ধীরে নিরীশ্বরবাদী বস্তুবাদী হয়ে ওঠেন। নৈতিক দিক থেকে তাঁর অবস্থানের কি কোনও পরিবর্তন হয়েছিল?

এর উত্তর পাওয়াটাও জরুরি। কেন না, যদি দেখা যায়, ধর্মীয় বিশ্বাস পরিবর্জন করা এই মানুষটি তাঁর সমকালে নবজাগরণ তথা সামাজিক-বৌদ্ধিক আন্দোলনের একজন অন্যতম বলিষ্ঠ প্রতিনিধি ও শ্রেষ্ঠ চরিত্র, নৈতিক ঋজুতা ও সিদ্ধান্তের দৃঢ়তায় বিদ্যাসাগরের সমগোত্রীয়, যে বিদ্যাসাগরও সেই যুগের মুষ্টিমেয় যুক্তিবাদী সংশয়বাদীদের অন্যতম, তাহলে অন্তত একটা বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারি— ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধের কোনওরকম একরৈখিক সম্পর্ক নেই।

মনে রাখা দরকার, সাধারণভাবে সততা, সদাচরণ, সত্যবাদিতা, সরল জীবনযাপন— এগুলো কোনও উন্নততর নৈতিকতার মাপকাঠি নয়। পরিচয়ও নয়। এগুলো একজন গড়পড়তা ভালো মানুষের বৈশিষ্ট্য। অথচ অধিকাংশ মানুষ এই সাদাসিধে গুণগুলিকেই সরল বিশ্বাসে নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা বলে মনে করেন। নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে আসলে চরিত্রের পরীক্ষা। সামাজিক বা সামূহিক স্বার্থের প্রয়োজনে ব্যক্তিগত স্বার্থকে ত্যাগ অস্বীকার বা উপেক্ষা করতে পারার মধ্যেই— বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সরল উপস্থাপনায় যা liberation from the self— রয়েছে নীতিনিষ্ঠার পরিচয়। যখন বাধা আসে, যখন একটা বড় কাজ করতে গিয়ে, অপরের হিতসাধন করতে গিয়ে বা একটা বড় সামাজিক দায়িত্ব বহন করতে গিয়ে, কাউকে ব্যক্তিগত ক্ষতি স্বীকার করতে হয় এবং যখন তিনি তা হাসিমুখে প্রচার বা পুরস্কারের প্রত্যাশা বিনাই করতে পারেন, সেখানেই পাওয়া যায় তাঁর চরিত্রের উচ্চতার পরিমাপ।

অক্ষয় দত্তর জীবনে এমন পরীক্ষা বারবার দিতে হয়েছে এবং সেইসব পরীক্ষায় প্রত্যেকবারই তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। দারিদ্র্য ছিল তাঁর জীবনের ছায়াসঙ্গী। অথচ অধিক পয়সা রোজগারের হাতছানি, সুযোগ বা প্রলোভন তাঁর কাছে বড় কম আসেনি। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে যখন তিনি মাত্র চল্লিশ টাকা বেতন পান, সেই সময় বাংলার সরকার শিক্ষাবিভাগের জন্য কিছু ডেপুটি ইন্সপেকটর পদ সৃষ্টি করে, যে পদের বেতন তখন একশো পঞ্চাশ টাকা। বিদ্যাসাগর তাঁকে এই পদে যোগ দিতে অনুরোধ করেন এবং সরকারকে বলে এই চাকরি যাতে তাঁর হয় তা দেখবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দেন। অক্ষয় দত্ত রাজি হলেন না। গেলেন না সেই চাকরি করতে। আর্থিক স্বচ্ছলতার চেয়েও তাঁর কাছে সেই মুহূর্তে অনেক বড় হয়ে উঠেছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাধ্যমে সমকালিক বুদ্ধিচর্চার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ। জ্ঞানের মশাল জ্বালানোর ব্রত।

আবার যে পত্রিকা তাঁকে চিন্তা প্রকাশের মঞ্চ, জীবিকা নির্বাহের অর্থ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠার সিঁড়ি জোগান দিয়েছিল, যখন তিনি দেখলেন তাঁর স্বাধীন মতামত নিয়ে তাতে কাজ করার অসুবিধা হচ্ছে এবং অন্যান্যদের সঙ্গে তিক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই পত্রিকার সম্পাদকের পদও ছেড়ে দিতে তিনি দুবার ভাবেননি। বৈষয়িক বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হলে নিজের মুক্তচিন্তার মুখে সুগন্ধী রুমাল চাপা দিয়ে একটু মানিয়ে-গুনিয়ে নিতেই পারতেন। সামান্য দু-একটা প্রশ্নে দেবেন্দ্রনাথ সমর্থকদের এক-আধটুকু ভক্তিবাদী ছাড় দিলেই আদি ব্রাহ্মসমাজ তাঁকে মাথায় তুলে রাখত। তাঁর মতো গুণী মানুষকে ধরে রাখায় তাঁদেরও কম স্বার্থ ছিল না। অক্ষয় দত্ত সেই পথে হাঁটলেনই না। এমনকি, এইভাবে মতাদর্শিক বিরোধের কারণে তত্ত্ববোধিনীর সম্পাদকের পদ ছেড়ে দেওয়ার পর বিদ্যাসাগর যখন তাঁকে শিক্ষক শিক্ষণ নর্মাল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দিতে অনুরোধ করেন এবং বাংলার সরকারকে বলে সেই চাকরি তাঁকে জুটিয়ে দেন, তখনও তিনি অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর তা গ্রহণ করতে রাজি হন।

আরও কিছু ঘটনার কথা বলা দরকার। মাথার যন্ত্রণার কারণে নর্মাল স্কুলের চাকরিও তিনি বেশি দিন করতে পারেননি। ছেড়ে দিয়েছেন। কলকাতা ছেড়ে দিয়ে হাওড়া জেলার বালিতে বাড়ি কিনে তুলনামূলক নৈঃশব্দ্য উপভোগ করতে চেয়েছেন। এক সময়ে আবার অভাবে পড়েছেন। তখন বিদ্যাসাগর মশাই উদ্যোগ নিয়ে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পাতাতেই আবেদন বের করেন অক্ষয় দত্তকে কিছু আর্থিক সাহায্য করার জন্য। দেবেন্দ্রনাথের অনিচ্ছা ও আপত্তি সত্ত্বেও তত্ত্ববোধিনী সভা তাঁকে মাসিক পঁচিশ টাকা বৃত্তি দানের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৬৫ সাল নাগাদ আবার তাঁর বইপত্র বিক্রি থেকে অর্থাগম বৃদ্ধি পায়। তিনি তখন সভাকে এতকাল সাহায্য দানের কারণে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অনুরোধ করেন সেই সহায়তামূলক বৃত্তিপ্রদান প্রত্যাহার করে নেবার জন্য। ধীশক্তির প্রাখর্য ও আন্তরিক ঐশ্বর্য তাঁকে চিরদিনই মুদ্রাপ্রাচুর্যের বিপরীত অভিমুখে চালিত করেছে। তাঁর ‘স্বপ্নদর্শন’ রচনায় যেমন বাস্তবেও তেমনই সরস্বতীই তাঁর কাছাকাছি থাকার অনুমোদন পেয়েছেন, লক্ষ্মীকে তিনি কখনই ততটা আমল দেননি।

সারাজীবন সনিষ্ঠ বিদ্যাচর্চায় ব্যাপৃত থাকার ফলে সাংসারিক বুদ্ধি তাঁর কোনওদিনই পাকা হয়নি। স্ত্রী-পুত্রদের সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল না। শেষ জীবনের যন্ত্রণা বলতে গেলে নিঃসঙ্গভাবেই ভোগ করেছেন। অন্যদিকে, উনিশ শতকের প্রায় সমস্ত মনীষীই যখন ইংরেজ রাজত্বকে ভারতের ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন, ইংরেজ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, নীল চাষ, দেশি ও বিদেশিদের মধ্যে বেতন পার্থক্য ইত্যাদিকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে ভেবেছেন, কৃষকদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অবহেলা, জেলের কয়েদিদের সঙ্গে অমানুষিক আচরণ ও অত্যাচার, ইত্যাদির প্রতি প্রায় চোখ বুঁজে থেকেছেন, অক্ষয় কুমার দত্ত তখন তত্ত্ববোধিনীর পাতায় পাতায় এই সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে লিখেছেন, বিক্ষোভ ব্যক্ত ও সঞ্চারিত করেছেন, জ্বলন্ত ও সচেতন স্বদেশভাবনার পরিচয় দিয়ে গেছেন। সেই যুগে বসে তিনি সর্বজনীন শিক্ষা ও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলেছেন এবং সরকারকে তাদের আর্থিক ও প্রশাসনিক দায়দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

অন্যদিকে তিনিই সম্ভবত সেকালের একমাত্র রেনেশাঁস-পুরুষ, যিনি যুক্তি ও আবেগের রসায়নে দেশের মানুষকে বাল্যবিবাহ ভ্রূণহত্যা ও বহুবিবাহ রোধ করতে আবেদন জানিয়েছেন এবং বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ-বিবাহ, হিন্দু-মুসলিম বিবাহ, দেশি ও বিদেশি পাত্রপাত্রীর মধ্যে বিবাহ ইত্যাদির সপক্ষে জোর গলায় প্রচার করে গেছেন। তিনি একই সঙ্গে পাত্র-পাত্রীর ন্যূনতম বয়স আইনসম্মতভাবে নির্ধারণ, প্রাক-বিবাহ পরিচিতির সুযোগ প্রদান, পরস্পরের মানসিক ভাবের ঐক্য, ইত্যকার আধুনিক মুক্তমন ও উদারচিত্তভিত্তিক বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়গুলি সুনিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে গেছেন। এইসব দেখে একদিকে মনে হয়, তিনি বোধহয় কালের হিসাবে পঞ্চাশ কি একশো বছর আগে জন্মেছিলেন; আর অপর দিকে বুঝতে পারা যায় কেন তিনি সমাজের প্রবল শক্তিগুলির কাউকেই খুশি করতে পারলেন না। নানা উৎস থেকে তাঁর প্রতি অনেক প্রশংসার বাণী অনেক মর্যাদাজ্ঞাপক বাক্য ধেয়ে এলেও কোনও সরকারি খেতাব বা সম্মান তাঁর জোটেনি। বিপরীতভাবে বলা যায়, এসব কিছু জুটবে না জেনেও তিনি তাঁর স্বনির্ধারিত পথ থেকে তিলমাত্র বিচ্যুত হননি। ডিরোজিওর মতোই তাঁর ক্ষেত্রেও অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব নিয়েও শেষ অবধি তাঁর স্মৃতিরক্ষার কোনও ব্যবস্থাই হয়নি। কলকাতায় তাঁর কোনও মূর্তি নেই; তাঁর নামে স্মারক রাস্তাঘাটও কিছুই হয়নি। হয়ত আগামী দিনে হবে।

 

।।।।

অক্ষয় কুমার দত্তকে আজ যদি আমরা নতুন করে স্মরণ করি, আজকের বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলনের আদি পুরুষ হিসাবে তাঁকে বুঝতে চাই, তাহলেও মনে রাখতে হবে— তাঁর কথা নয়, শিক্ষণীয় চারিত্রগুণাবলিকেই আমাদের আয়ত্ত করতে হবে। তাঁর কথার অনেক কিছু আজ হয়ত ভ্রান্ত প্রমাণিত, অথবা, অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন। তাঁর নিরামিষ ভোজনের প্রতি আসক্তি বা প্রচার নিশ্চয়ই আমরা গ্রহণ করতে যাব না। কিংবা তাঁর প্রচারিত উনিশ শতকের ফ্রেনলজি নামক অপবিদ্যা, যার সারকথা (আসলে অসার কথা) ছিল মানুষের মাথার আকার ও আকৃতি দেখে তার বুদ্ধির পরিমাপ করা— সেও অবশ্যই আমরা পরিত্যাগ করব। কিন্তু এরকম দুএকটি ভুলভ্রান্তির জন্য বাকি অনেক ক্ষেত্রে তিনি যে সত্যের পতাকা উচু করে তুলে ধরেছিলেন, সেকথা আমরা ভুলে যেতে পারি না। জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতি তাঁর চর্চিত বা অধিগম্য বিষয়গুলিতে আমাদের জানার পরিসীমা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু এই জ্ঞান বিস্ফোরণের সময়ে বসেও ভুলে গেলে চলবে না, একদিন যখন চারদিক অন্ধকার ছিল, জানতে যে হবে— এটাই এদেশের মানুষ জানত না বা ভাবতে পারত না, সেই অবস্থায় কখনও ডিরোজিও, কখনও বিদ্যাসাগর, কখনও আবার অক্ষয় দত্ত জ্ঞানের নতুন ছোট ছোট প্রদীপ জ্বেলেছিলেন। আজকের ভেপার ল্যাম্পের তুলনায় তার আলোক শিখাকে যতই অনুজ্জ্বল মনে হোক না কেন, সেই নিবু নিবু আলোই পথ দেখিয়েছিল, পথ তৈরি করে দিয়েছিল। আমরা বর্তমানে তারই সুফল কিছুটা হলেও পাচ্ছি।

তবে সবটা যে পাচ্ছি না তার কারণ আমরা এই দেশের মানুষজন তাঁদের সেই জ্ঞানপ্রদীপকে বহুকাল চিনতেই পারিনি। আমরা আলেয়াকে আলো বলে ভেবেছি। সেই আলেয়া আমাদের বুঝিয়েছে, বাইরের অন্ধকারের মধ্যে বসে চক্ষু মুদে নিঃশব্দ ধ্যানে অন্তরের দৃষ্টি মেলে ধরতে পারলে তমসাকে ভ্রমজ্ঞানে অপনয়ন করে কোনও এক অসীম ঊর্ধ্বলোকের অদৃশ্য দ্যুতি দেখতে পাব। সেই দ্যুতিই আমাদের পথ দেখাবে। আর আসলে আমরা আরও গাঢ় অন্ধকারের দিকে এগিয়ে (কিংবা বলা ভালো, পিছিয়ে) গেছি। আমাদের দেশের মানবসম্পদ নির্মাণে যে নৈতিকতার বিরাট অভাব দেখা যায় তারও অন্যতম কারণ ডিরোজিও-ঈশ্বরচন্দ্র-অক্ষয় দত্তের মতো যুক্তিবাদী মুক্তবুদ্ধি উন্নত মূল্যবোধের অধিকারী মানুষগুলিকে ভুলে যাওয়া। তাঁদের থেকে নেওয়ার যা ছিল তা নিতে না পারা। তারপর নানা খানাখন্দে হোঁচট খেতে খেতে অনেক কষ্টে আজ হয়ত আমরা অনেকে ভুলটা বুঝেছি, আবার পথের সন্ধান করেছি। এইভাবেই আমরা এক শতাব্দের অবহেলা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে একবিংশ শতাব্দে প্রবেশ করে আবার ডিরোজিও বা অক্ষয় দত্তের মতো যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার পথিকৃতদের স্মরণ ও তাঁদের জীবন-চরিত্র অনুশীলনের কথা ভাবতে শুরু করেছি, অন্তত প্রয়োজনটা অনুভব করেছি। আজ শুরু হোক নতুন করে গবেষণা, নতুনভাবে অনুসন্ধান। ভুল করার, ভুলে যাওয়ার কারণগুলিকেও চিহ্নিত করা হোক। অক্ষয় দত্ত একদিন ডেভিড হেয়ারের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গিয়ে যা বলেছিলেন সেই ভাষার পুষ্পার্ঘ্য দিয়েই আমরাও আজ অক্ষয়কুমার দত্তকে স্মরণ করে, এই মুক্তবুদ্ধি তাপসের উদ্দেশে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও ঋণস্বীকার করি: “তিনি আমাদের হিরে দেননি, সোনা দেননি, রুপোও দেননি, কিন্তু তার থেকে লক্ষগুণ কোটিগুণ মূল্যবান বিদ্যারত্ন প্রদান করেছেন।”

 

গ্রন্থসূত্র

  • মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম (সম্পাদিত ২০০৬), বিজ্ঞান-বুদ্ধি চর্চার অগ্রপথিক অক্ষয়কুমার দত্ত ও বাঙালিসমাজ; রেনেশাঁস পাবলিশার্স, কলকাতা।
  • মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম (২০০৯), অক্ষয়কুমার দত্ত ও ঊনিশ শতকের বাঙলা;বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা।
  • মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম (২০১৮), মুক্তচিন্তার বিস্তার; কথাপ্রকাশ, ঢাকা।
  • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯১৭), চরিত্রহীন; কলকাতা।
  • অক্ষয়কুমার দত্ত (১৯১২) চারুপাঠ ৩য় খণ্ড; সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি, কলকাতা।
  • অক্ষয়কুমার দত্ত (১৯৮৭ ও ১৯৯০), ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্পদায়, ১ম ও ২য় খণ্ড; করুণা প্রকাশনী, কলকাতা।
  • অক্ষয়কুমার দত্ত (২০১৫), শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, সম্পাদনা, মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম, কথাপ্রকাশ, ঢাকা।
  • অন্নপূর্ণা বিশ্বাস (১৯৯৮), অক্ষয়কুমার দত্ত: সমাজ, বিজ্ঞান ও ধর্মচিন্তা; র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, কলকাতা।
  • অসিতকুমার ভট্টাচার্য (২০০৭), অক্ষয়কুমার দত্ত এবং উনিশ শতকের বাংলায় ধর্ম ও সমাজচিন্তা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা।
  • রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (২০০৩), কামারের এক ঘা; পাভলভ ইন্সটিটিউট, কলকাতা।
  • মহেন্দ্রনাথ রায় (বাং ১২৯২), বাবু অক্ষয়কুমার দত্তের জীবনবৃত্তান্ত, সংস্কৃত মুদ্রণ যন্ত্র, কলিকাতা।
  • আশীষ লাহিড়ী (২০০৭), আঁধার রাতে একলা পথিক; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
  • Muhammad Saiful Islam (ed. 2009), Akshaykumar Datta— The First Social Scientist in Bengal; Renaissance, Kolkata.
  • Ashoke Mukhopadhyay (2020), “Akkhay Kumar Datta: Rationality par excellence in Nineteenth Century Bengal”; The Other Mind; Visit: https://cestuss.blogspot.com/2020/06/the-other-mind-5th-issue-2020.html
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...