Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অন্তেবাসী — ১৭ তম পর্ব

পীযূষ ভট্টাচার্য

 

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ট্রেন ছাড়বার পূর্বমুহূর্তে মেসোমশাই মার হাতে টিকিট গুঁজে দিতেই বাবলু গম্ভীর। “আবার টিকিট” কথাটা খুব নিচু স্বরে বলেই ফেলে। কিন্তু কথাটা আমি ভিন্ন অন্য কেউ শোনেনি। শুনলে হয়তো মেসোমশাই হিড়হিড় করে টেনে হিঁচড়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে ছাড়ত। মেসোমশাই ব্যস্ত ছিল নানমাসির কাছ থেকে আশীর্বাদ নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে। এবং তা শেষ হতেই বলে উঠলেন “আবার আসবেন।”

“বেলুর জন্য আর আসতে হবে না। ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার আগের জন্মের কাঁঠালপাতার সইয়ের জন্য আসব।” কথা শেষ করে মার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মা-ও প্রতি-উত্তরে হেসে ওঠে।

কিন্তু মেসোমশাই বাবলুর দিকে এমনভাবে তাকালেন— কথাটা তিনি শুনেছেন। বাবলু শক্ত করে আমার হাতটা চেপে ধরতেই বলে উঠি— “যিশু কি কখনও উইদাউট টিকিটে যেতে পারেন?”

এ-কথার উত্তর না দিয়ে বাবলু ভাবলেশহীন, গম্ভীর। তা অবশ্য ক্ষণেকের জন্য।
–এরপর রংবুল হল্ট।
–তোর কি সব স্টেশনই মুখস্থ?
–এই লাইনে সতেরোটি স্টেশন, পনেরোটি হল্ট— সব জানা।

রংবুল হল্টে কিছু প্যাসেঞ্জার লাফিয়ে নামল, কিন্তু আবার উঠল, তাও আবার লাফিয়েই। কোনও টিকিট-ফিকিটের দরকার নেই। তা বোঝার পর বলেই ফেলি “কেউ যদি টিকিট কাটতে চায় তখন কী হবে?”

–কিছু একটা ব্যবস্থার বন্দোবস্ত আছে নিশ্চয়ই।

নানমাসির কথার উত্তরে বাবলু বুঝিয়ে দিল, না নেই। থাকলেও সে তা জানে না। এই কথা কটা বোঝাতে সে একটিও শব্দ ব্যবহার করল না। শারীরিক ভঙ্গির মধ্য দিয়ে বুঝে গেলাম সবকিছু। তখনই আমার মেজমাসির বিখ্যাত বয়াম ভর্তি খুচরো পয়সার কথা মনে পড়ে গেল। সে ওখান থেকে কিছু এনেছে কিনা জানতে চাইলে হেসে ওঠে– অর্থাৎ এনেছে। কিন্তু মুখে বলে “এরপর জোড়বাংলো হল্ট। তারপর ঘুম স্টেশন।” কিন্তু জোড়বাংলো হল্টে ট্রেন দাঁড়িয়েই ছেড়ে দিল কেননা এবার তাকে উঠতে হবে শুধু ভারত নয় পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ রেলস্টেশনে। এখানে পৌঁছালে মনে হয় আকাশ যেন ঘরের ছাদ। সেখানেই ধ্যানমগ্ন মানুষেরা কুয়াশার ভেতরে একাকী খুঁজে বেড়ায়, একাকী কথা বলে চলে, কথার প্রতিধ্বনি হয়… সবকিছুই যেন বেঁচে থাকার আনন্দের জন্যই।

যদিও ঘুম পাহাড়ের চড়াইয়ে উঠবার সময় ট্রেন বারকয়েক হুইসেল দেয়, কিন্তু সেসব তীব্র আওয়াজ নিমেষে শুষে নেয় চতুর্দিকের উন্মুক্ত দিগন্ত। নৈঃশব্দ্যের স্বাভাবিক চরিত্রে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে ট্রেন একটানা হুইসেল দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলে বাবলু চিৎকার করে ওঠে “ঘুম চলে এল।” একটু থেমে আবার বলে ওঠে “এরপর তোর বাতাসিয়া লুপ।”

–ঘুম স্টেশনের পাশেই ঘুম মনাস্ট্রি।

নানমাসিকেই প্রশ্ন করে উঠলাম— মনাস্ট্রি মানে কী?

–মঠ। বৌদ্ধ মঠ।

সে কিন্তু মঠের ভেতরে প্রবেশ করেনি কোনওদিন। বাইরে থেকে শুনেছে চরম নীরবতা থেকে উঠে আসছে ধ্বনি– যার উৎপত্তিতে নীরবতা যেমন আছে তেমনি প্রত্যাগমনেও নীরবতা। এক দিক থেকে দেখলে মনে হবে এই নীরবতা শব্দহীন, আবার শব্দ সবসময়ই শর্তাধীন এবং সীমিত।

মা কিন্তু নানমাসির কথাগুলো শুনছেই না, জানলা খুলে এদিক ওদিক দেখছে। কিন্তু এবারে নানমাসি হেসেই বলে ওঠে— ওই তো, সামতেন চোয়েলিং। তিব্বতি বুদ্ধিস্টদের মঠ। মৈত্রেয় রূপে বুদ্ধ এখানে স্থাপিত। বন্ধুর মতন…

–কাঁঠাল পাতার সইয়ের মতন?
–আরে আমার ছেলে রে! সই মানে জানিস?
–বন্ধু।

মা আমাকে বুঝিয়ে দেয় কাঁঠালপাতায় সইয়ের বিষয়টি। একটি কাঁঠালপাতাতে তেলে সলতে ভিজিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে জলে ভাসিয়ে দিতে হয়। জ্বলন্ত শিখা নিয়ে আমার কাঁঠালপাতা ওর পাতার সঙ্গে মিশে যায় বা ওর পাতা আমার পাতার সঙ্গে মিশে যায়। তবে নাকি জন্মজন্মান্তরের সই হয়ে যায়। যেমন এবারে দেখা হয়ে গেল। মা এবারে অনেকদিন পর সত্যি সত্যি হেসে ওঠে। আর তখনই বোন কেঁদে উঠতেই বুকের আঁচলের ভিতর।

–এখানেই কিন্তু অ্যান ড্যানিয়েল ঘমিয়ে আছে। কুয়াশায় সবসময় ঘিরে থাকে সমাধি।

কুয়াশা মায়াভরা সৌন্দর্য নিয়ে কেবলই ইঙ্গিত দেয় ঈষৎ বিষণ্ণ হলেও তুমি আবার এসো।

চরম উদাসীনতার মধ্যে নানমাসি বলে উঠলেন— গির্জায় ওর একটা পোর্ট্রেট আছে। সেখানেও কুয়াশা ভিড় করে থাকে।

আর সেই মুহূর্তেই বাবলু চিৎকার করে ওঠে— বাচ্চু তোর বাতাসিয়া লুপ চলে এসেছে। জানলার ধারে আয়।

আসলে কিছুই বুঝে ওঠা যাচ্ছিল না। রেলগাড়ি যে পাকদণ্ডী পথ ধরে পাহাড়ের মাথায় উঠে যাচ্ছে। বোঝা তখনই যায় পাহাড়ের মাথায় উঠে এক পাক দিয়ে চুলের কাঁটার মত বাঁক নিয়েছে যখন, তখন। তখনই ছোট্ট গুহা পথ পেরিয়ে চুলের কাঁটার মত বাঁক নিয়ে চলে গেছে দার্জিলিং-এর দিকে। তার মধ্যেই মা বেশ উঁচু গলায় বলে ওঠে— ওই দেখ কাঞ্চনজঙ্ঘা।

যে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখবার জন্য প্রায় নিয়মিত জানলার পাশে দাঁড়াত সকালের দিকে, যেদিন আকাশ মেঘলা থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার কোনও অবয়ব তৈরি হত না আর সেজন্য মন খারাপ হয়ে যেত সারাদিনের জন্য, সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা এতটাই স্পষ্ট যে হতবাক মা হাতজোড় করে প্রণাম করে উঠল। নিজেও কি প্রণাম করেছিলাম? সে কথা মনে না থাকা সত্বেও মাঝেমাঝে হিমশীতল এক অনুভূতির উপস্থিতি নিজের মধ্যে টের পাই। তা মধ্য দিন বা মধ্য রাতে চাগিয়ে ওঠে— তখন কয়েক মুহূর্তের জন্য হিমায়িত হয়ে যাই। একেই কি বলে মৃত্যুভয়? জানি না। হলফ করে বলছি এখনও এ ঘটনা ঘটে। আগে ব্যাখ্যা খুঁজতে যেতাম, এখন সেরকম নির্বুদ্ধিতা দেখাই না। কেবল অপেক্ষা করি ধীরে প্রবহমান তুষারস্রোত কখন শেষ হবে।

“সাতসকালে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যের সাত রঙের স্নানপর্ব দেখলে অবাক হয়ে যাবে তুমি। হিমালয়কে তোমরা দেবজ্ঞানে পুজো করো, আর আমরা দেখি ক্রুশবিদ্ধ করবার আগে প্রভুকে স্নান করানো হচ্ছে সূর্যের সাত রং দিয়ে। ক্রুশিফায়েড শেষ হয়ে গেলে কেবল হৈমপ্রভা।”

নানমাসির কথার উত্তরে মা শুধু বলতে পেরেছিল “দেহটা বিষে বিষে নীল বর্ণ। মাথায় কিন্তু নবচাঁদ দিনরাত্রি জ্বলছে।”

বাবলু চিৎকার করে ওঠে— দার্জিলিং! সেই চিৎকারে তিন তিনটে ঘটনা ঘটে যায় এক সঙ্গে। বোন ভয়ে কান্না জুড়ে দেয়। নানমাসি ও মা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে বাড়ি ফিরে আসবার জন্য গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আর অল্পবয়সি নান যিশুর ছবিটা নানমাসির কাছ থেকে নিয়ে বুকের হৃদপিণ্ডের মাঝখানে রেখে কামরা দিয়ে বেরিয়ে যায় এমনই সন্তর্পণে যে তার হৃদয়ের উৎসারিত ঢিপ ঢিপ প্রতিটি ধ্বনিই যেন যিশুর কাছে পৌঁছয়।

শেষ পর্যন্ত স্টেশন থেকে চার্চ অব্দি যাওয়ার পর্বটি অনেকটা মিছিলের মতো হয়ে গেল। প্রথমে যিশুর ছবি নিয়ে তরুণী নান, তার পিছনে কয়েকটি ছাতা সহ চার্চেরই একজন। “এত ছাতা কেন?” স্টেশনেই প্রশ্ন করেছিলাম। তখনই নানমাসি জানিয়েছিলেন “এখানে যখনতখন বৃষ্টি হয়। বছরে প্রায় তিনশো দিনই বৃষ্টি।” বাবলুকে দেখলাম এই প্রথম, এই বিষয়ে বিশেষ কিছু জানে না বলে চুপ করে থেকে বলেই ফেলল “তাই ম্যালে ছাতা ভাড়া পাওয়া যায়।” মিছিলে কিন্তু বোনকে কোলে করে মা। চড়াই-উৎরাইয়ের পথে যদি কোনও বিপদ ঘটে নানমাসি তাই মার পাশাপাশি হাঁটছেন। বিপদ হলেই জড়িয়ে ধরবেন এমনই সতর্ক ভঙ্গিমা। সবার পেছনে স্টেশন মাস্টারের ঠিক করে দেওয়া কুলি, একটি বড় ঝুড়িতে সকলের মালপত্র রেখে পিঠে ঝুলিয়ে কপালের চওড়া পট্টি দিয়ে বাঁধা। চড়াইয়ের পথে তার হাঁটা ধীরে, উৎরাইয়ের পথে সাবধানী।

মাইল খানেকের পথ কখন যে কীভাবে শেষ হয়ে গেল বোঝা গেল না। মিছিলটা সোজা রাস্তা ধরে বাঁদিকে ঘুরতেই বাবলু ডানদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে “ওদিকটা ম্যাল।” কিন্তু গির্জার মাথার উপর ক্রুশচিহ্ন দেখা দিতেই নানমাসি একটু থেমে নিজের বুকের উপর ক্রুশচিহ্ন আঁকলেন বাতাসের বুক চিরে। নিজেও প্রণাম করলাম নানমাসির দেখাদেখি, সে প্রণাম বাতাসের ভেতর যে শূন্যদেশ সৃষ্টি হয়েছিল ক্রুশচিহ্ন আঁকবার পর সেখানেও হতে পারে, অথবা মহাশূন্যের ভেতরে যে শূন্যদেশ আছে সেখানেও হতে পারে। ঠিক জানি না। তবে প্রণাম যে করেছিলাম তা কিন্তু মনে আছে এখনও।

গির্জার সিঁড়ির ধাপের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল মা— এত উঁচু উঁচু ধাপ উঠবে কেমন করে! তার উপর কোলে বোন। একসময় বলেই ওঠে ‘গির্জায় প্রবেশ করতে গেলে একটু তো কষ্ট করতেই হবে।’ একথা মুখে না বললেও মনে মনে বলেছিল। তা না হলে নানমাসি কেনইবা সাহায্য করবেন। ওঠা শেষ হতেই নানমাসি বলে ওঠেন “তুমি ঠিকই ধরেছ। কষ্ট করে উঠবার পর মনে হবে তুমি ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছ।”

অবশ্য আমাদের সেরকম কোনও অসুবিধা হয়নি। উঠে ঘন সবুজের মধ্যে হারিয়ে গেলাম।

এখন কোনও ফুল নেই। নির্দিষ্ট সময় বলতে বসন্তকাল। তখনই ফোটে— আবার তারই বীজে আরও একটি গাছের জন্ম— সেই গাছ আবার বসন্তের অপেক্ষায় থাকে। পাহাড়ের বসন্ত সেভাবে বোঝা সম্ভব নয়। ফুল ফোটা দেখে বুঝে নিতে হয় ঋতুকে। এই তথ্যটি নানমাসি জানিয়ে দেয় মাকে। কেননা মা আমাকে ধমকে উঠেছিল— আগাছার মধ্যে কী করছি?

 

এরপর আগামী সংখ্যায়