অন্তেবাসী — ১৬তম পর্ব

পীযূষ ভট্টাচার্য

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

বহুদিন পর সালভাদর দালির ক্রুশবিদ্ধকরণ পেইন্টিং-টা দেখার সুযোগ হয়েছিল। যদিও সেটি ছিল মূল থেকে ছাপাই। রঙের বর্ণচ্ছটা এমনই যে মৃত্যুর প্রতি অদ্ভুত এক একাত্মতাবোধে আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়েই ছিলাম। কেবলমাত্র এই পেইন্টিংটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি করে চলছে এই একাত্মতাবোধ। যেন বোঝাতে চাইছে জীবনের এক পরম সত্যকে।

আর ক্রুশটি এমনভাবে আঁকা, দুটি কাঠের সংযোগস্থলে একটি কাঠের টুকরো এমনভাবে স্থাপিত, যার দৈর্ঘ্য প্রস্থ সমান সমান। সেখানেই খ্রিস্টের হৃদপিণ্ড শলাকাবিদ্ধ। প্রসারিত ডান হাতের জন্য একটিমাত্র শলাকা আর বাম ঊরুর জন্য একটিমাত্র শলাকার ব্যবহার। কেবলমাত্র তিনটি শলাকা দিয়ে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল! নাকি এই তিন সংখ্যাই ইঙ্গিত করছে জন্ম-বিবাহ-মৃত্যুকে! কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু কাঠের খণ্ডটির ঘনত্ব বোঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে কালো রং। সেই ঘনত্বের ভিতর থেকে যেন উঠে আসছে জীবনের ভগ্নাংশের কথা।

কিন্তু প্রসারিত দুটি হাতের ছায়া মূল ক্রুশের ওপর স্থির। সেখানে ডান হাতের বিদ্ধ শলাকার ছায়াও বিদ্যমান। তবে কি হাতের ছায়ার ইশারা দেখিয়ে দিচ্ছে এক পূর্ণতার আশ্রয়স্থল? নাকি নিষ্প্রাণ হাত দুটির ছায়ার মধ্যেই খেলা করছে এমনই এক অনুভূতি— জীবনের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি একটু মায়া!

কিন্তু নানমাসির আনা যিশু খ্রিস্টে ছবিটা একটু অন্য ধরনের। সেখানে খ্রিস্টের বড় বড় চুলে মুখ ঢাকা, খুব ভালো করে দেখলে দেখা যায় অর্ধ-নিমীলিত চোখ, নিজে যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়েও অপরের যন্ত্রণার প্রতি সহমর্মী।

কিন্তু দালির ছবিটি যেন শ্রান্ত এক মানুষের। তখন এই দুঃখী মানুষটিই যেন ত্রাতা হয়ে ওঠেন।

 

সেদিন বারান্দার টেবিলে বসে চা খেতে খেতে নানমাসি বলে ওঠেন— আপনারাও আপনাদের দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করবেন।

মেজমাসি অনেকক্ষণ পর নিজের অবস্থান খুঁজে পেয়ে বলে ওঠে— “গুরুদেবের মন্ত্র জপ করা যাবে তো?”

“কেন যাবে না?”

শোনার পর মেজমাসি শূন্যে গুরুদেবের উদ্দেশে প্রণাম করে। মা নিশ্চিন্ত একটা ফয়সালা হয়ে গেল বলে। আবার আরও একবার ‘আদ্যাস্তোত্র’ বলতে পারবে বলে হেসে ওঠে। সাধারণত দিনে একবার স্নানের পর এই স্তবটা মুখস্থই বলে। কোনওদিনই একদম শুরুর লাইনটি উচ্চারণ করতে শুনিনি। ‘ওঁ নম আদ্যায়ে’ শব্দটি এমনই নিভৃতে রাখত যে প্রকাশ্যে উচ্চারণ পর্যন্ত করত না। শব্দের মধ্যে সে যেন দেবীমূর্তিকে দেখতে পেত। তারপর অবশ্য শৃণু বৎস প্রবক্ষ্যামি– অদ্যাস্তোত্রং মহাফলম’ স্পষ্ট উচ্চারণ। একবারের জন্যও না থেমে দীর্ঘ স্তবটি বলে যেত। সেই সময়ে মা যেন অন্য কোনও লোকে চলে যেত, এবং আমার ভয় করত।

–আমরা কী করব?
–কেন তোরা সরস্বতীর অঞ্জলির মন্ত্র বলবি!

বাবলুই প্রথমে বিদ্রোহ করে— “বছরে একবার বললে মনে থাকে নাকি?”

এবারে আমার পালা। সরাসরি আমার দিকে তাকাতেই বলে উঠি “মাত্র এক লাইন মনে আছে।” বল তো বলবার আগেই বলে উঠি “জয় জয় দেবী চরাচরসারে কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।” মা অবশ্য পরবর্তী লাইনগুলো উচ্চারণ করে গেল, কিন্তু নিজে মুক্তাহারেই দাঁড়িয়ে আছি দেখে বলে “ওই এক লাইনেই চলবে। তবে বারবার বলতে হবে কিন্তু।”

বড় হয়ে যখন কুচযুগ শব্দটির অর্থ বোঝার বয়সে পৌঁছে যাই তখন মনে হয় এই শব্দটি অশ্লীল। তারপর থেকে এই মন্ত্রটি আর বলি না।

বাবলুকে কিছু একটা করতেই হবে। তারই একটা মরিয়া প্রচেষ্টা করে বসল— সে সবার শেষে একটা নাচ করবে। এবারে লক্ষ করলাম নানমাসি একটু নড়েচড়ে বসল— কী গানের সঙ্গে নাচ? –নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু, রবীন্দ্রসঙ্গীত। তা শুনে নানমাসি হেসে উঠে বলে “আমিও তোমার সঙ্গে গাইব।” তারপরই হঠাৎ তিনি উদাস হয়ে গেলেন। যেন তার কানে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগের দিন রাত্রে যিশু তার সহযোগীদের আহ্বান করছেন নাচবার জন্য— সবাই হাতে হাত ধরে বৃত্ত রচনা করে— আর তিনি ‘তোমারই মহিমা হে প্রিয় প্রিয় প্রভু’ গেয়ে ওঠেন। বৃত্তাকারে ঘিরে ঘিরে সহযোগীরা উত্তর দেয়— আমেন!

এতক্ষণ পর্যন্ত ডলিদিকে কোনও কথাই জিজ্ঞেস করা হয়নি সে কী করতে চায় সেই নিয়ে। তাই এক সময়ে নিজেই বলে ওঠে “আমি কিন্তু গানটা জানি।” নানমাসি হেসে উত্তর দেন “তুমিও গাইবে আমাদের সঙ্গে।” কী কারণে যেন রামছাগলের মালকিনের খোঁজ পড়ল— মেজমাসি গলা তুলে ‘কাঞ্ছি’ বলে হাঁক পাড়লেও কোনও সাড়াশব্দ নেই।

মা কিন্তু বলে “কী কারণে ওকে খুঁজছ মেজদি?” মেজমাসি আমাদের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল। মা এই নিশ্চুপতার মধ্যে কী সঙ্কেত খুঁজে পেল জানি না, তবে মুখে বলল “ব্যবস্থা একটা হবেই। ও নিশ্চয়ই বাড়ি গেছে। ফিরল বলে…”

কিন্তু এসবের মধ্যে কালুদা আর বাহাদুর দুটো হ্যাজাক আর একটা সোনালী কাগজের তৈরি স্টার নিয়ে এসে দাঁড়ালে সবাই বুঝে গেল এখন এই জায়গাটা ছাড়তে হবে। শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন করল কালুদা— যিশুর আসন কোথায় পাতা হবে?

নানমাসিই উত্তর দিল— এখানে একটা ছোট টেবিল থাকলে পেতে দাও। পাশে একটা চেয়ার দিও, বেলু তো দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।

তারপরই সোনালী স্টার কোথায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে এই প্রশ্নটি মুখে না বলে ইঙ্গিতে জানতে চাইল কালুদা। “একেবারে প্রভুর চোখের সামনে।” সেখানে শিকলির ভেতর থেকে স্টারটি ঝুলিয়ে দেওয়ার ফলে মনে হল আকাশের মধ্যিখানে জ্বলজ্বল করে উঠল। মনে হয় রাত যতই বাড়বে জেল্লা ততই ছড়াবে।

বারান্দার সব আসবাবপত্র বাইরের চত্বরে রাখা হচ্ছে এক এক করে। কখন যে রামছাগলের মা এসে হাত লাগিয়েছে বুঝতেই পারিনি। কেননা আমার তখন বিশেষ নজর ছিল হ্যাজাক কীভাবে জ্বালানো হয় সেই দিকে। এর আগে অবশ্য জ্বলন্ত অবস্থাতে হ্যাজাক দেখেছি কিন্তু জ্বালাবার কৌশল সম্পর্কে কিছুই জানি না। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম ন্যাতানো মেন্টেলটা দৃঢ় হয়ে আলোর বিস্তারের খেলায় চলে গেল। পাহাড়ের সন্ধ্যা বলতে তেমন কিছু বিশেষ নেই। দিনের আলো শেষ হলেই ঝুপ করে রাত্রি। বাহাদুর পাম্প দিয়ে আলোর উজ্জ্বলতাকে শেষ সীমানায় নিয়ে গিয়ে হেসে ওঠে– এখন তিন-চার ঘণ্টা বিলকুল পার হয়ে যাবে। আর তখনই মা ঘর থেকে বলে ওঠে “জামাকাপড় পরে নে।”

প্যান্ট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েই আছি দেখে মা হেসে ওঠে (মাকে অবশ্য অনেকদিন পর হাসতে দেখলাম)। কিন্তু মুখে বলে— মাসির সামনে লজ্জা কিসের রে? যা, বাথরুমে যা…

বাথরুম থেকে বের হয়েই থ। বারান্দা জুড়ে ফরাশ পাতা, কিন্তু ফরাশের শরীরে ফুটে আছে এমনই এক জন্তু যা দেখতে অনেকটা সাপের মতন, কিন্তু চারটে পা, মুখের হাঁ-টা এত বড় যে মনে হয় যে কোনও সময় আমাকে গিলে ফেলবে! ওর চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েই আছি, এমন সময় মা ঘর থেকে বেরিয়ে এল আমার দেরি হচ্ছে কেন জানতে। মা কিছু বলবার আগেই বলে উঠি, এটা যদি কামড়ে দেয়…

–ধুর, ওটা তো চিনা ড্রাগনের ছবি! ছবি দেখে ভয় পায়… কী আমার বীরপুরুষ রে!

জামা পরাতে পরাতে বলে ‘চিনাদের কাছে এ ছবি ভীষণ পয়মন্ত। এদিকে খুব সস্তায় পাওয়া যায়।’ তারপর আমার চিবুক শক্ত হাতে ধরে চুল আঁচড়িয়ে দেয়। এটা অবশ্য এখানে আসার পর এই প্রথম।

মা-ই আমাকে বসিয়ে দেয় ড্রাগনের পিঠের উপরে। তারপর বোনকে কোলে শুইয়ে দেয়। ‘যদি হিসি করে দেয়?’ ‘তাই তো’ বলে এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে ওয়াল ক্লথ-কাঁথা নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। এদিকে বেলুদির ঘরের দরজা বন্ধ। বন্ধ মেজমাসির ঘরের দরজা। শুধু বাবলু নাচের ড্রেস পরে নুপুরের নিক্কন তুলে পাশে বসতেই হ্যাজাকের আলোর বৃত্তের বাইরে বসে থাকা কালুদা বলে ওঠে– নুপুরটা খুলে রাখ এখন। প্রেয়ারের সময় যেন কোনও শব্দ না হয়। নাচের সময় পরে নিবি।

ঠিক সেই সময় মেজমাসি দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই দেখি কপালে সাদা চন্দনের টিপ, যা তার গুরুদেবকে স্মরণ করে নেওয়া। ঠিক তার মাঝখানে সিঁদুরের টিপ, পরণে গরদের শাড়ি। মেজমাসি সবার আগে বেলুদিকে চন্দনের টিপ পরিয়ে আমাদেরকেও পরিয়ে দিল। “মাসি তোমার টিপটা সূর্যের মতন জ্বলজ্বল করছে” শুনেই আমাকে আদর করে দিল আঁচড়ানো চুল অবিন্যস্ত করে।

এরপর দরজা খুলে গেল, মা আর নানমাসি যিশুর ছবি, পবিত্র জলের পাত্র, ফুলের তোড়া যিশুর আসনে এমনভাবে রাখলেন, সমস্ত কিছুই এমনভাবে বদলে গেল যে ক্রুশ ছাড়া অন্য কিছুই দৃশ্যমান নয়।

অনেকদিন পর যখন বুঝতে শিখলাম এক দৃষ্টিতে ক্রুশের দিকে তাকিয়ে থাকার মধ্য দিয়ে বোঝা শুরু হয়ে গেছিল একটু একটু করে মরণের স্বাদ পাওয়ার ক্ষমতা। অবশ্য তখন যা বয়স তাতে এই বোধে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তবুও মনে হয় তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল এই বোধ।

দু পাশে দুটো ফুলদানিতে ফুলের স্তবকের ছায়া ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছবিকে ঢেকে দিল এমনভাবে যে মনে হতেই পারে আমাকে দেখতে হলে ছায়া সরিয়ে তোমাকে আসতে হবে। এ যেন আশ্চর্য গোলকধাঁধা। পথকে যেন ইচ্ছে করেই বিভ্রান্তিকর করা হয়েছে। যদি গুপ্ত মন্ত্র জানা থাকে তবেই এই ক্রুশ কতখানি সহমর্মিতা বহন করছে বোঝা যাবে। কিন্তু নানমাসি যখন দুদিকে দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছে কতক্ষণে মোমবাতির শিখা স্থির হয় এবং তা হতেই মার দিকে তাকাতেই বেলুদিকে ঘর থেকে বারান্দায় নিয়ে আসা হল। বেলুদি এসেই জ্বলন্ত মোমবাতির মধ্য দিয়ে হাত বাড়িয়ে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

নানমাসি ধ্যানস্থ। কেবলমাত্র নিজের গলায় ঝোলানো ক্রুশটাকে চুম্বন করে নিজের হৃদপিণ্ড থেকে শুরু করে ক্রুশ আঁকলেন। দেখলে মনে হবে নিজের শরীরের ভেতর ক্রুশটাকে স্থাপিত করলেন। আবার এও মনে হতে পারে, মহাকালের বুকে এমন ক্রুশ চিহ্ন এঁকে দিলেন যেন এক দুঃখী মানুষই হতে পারে অপর এক দুঃখী মানুষের ত্রাতা।

বেলুদির মাথায় পবিত্র জল ছিটিয়ে দেওয়া পর্যন্ত মা বেলুদিকে সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেই চলেছে। পরিষ্কার দেখতে পেলাম পবিত্র জলকণা মার চোখেমুখেও আছড়ে পড়ল। কেউ অবশ্য নানমাসি কী মন্ত্র উচ্চারণ করছেন শুনতে পারছে না। কেবলমাত্র ঠোঁট নাড়াতেই বুঝে নিতে হচ্ছে তিনি কিছু একটা বলছেন এবং তা এতটাই নীরবে বলা যে নৈঃশব্দ ভিন্ন অন্য কিছুই উঠে আসছে না। হঠাৎই মনে হল যিশুর ছবির সামনে রাখা জলন্ত মোমবাতি ছবির কাচের ভিতরেও জ্বলন্ত প্রতিবিম্ব। তা দূরে কোথাও জ্বলছে, নিশ্চয়ই তারও কিছু অলৌকিক আভা আছে, তা আমার বোধগম্যের বাইরে হওয়া সত্ত্বেও স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করল। মা অবশ্য বেলুদিকে চেয়ারে বসিয়ে আমার কোল থেকে বোনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এমনভাবে যেন নানমাসি আসল পুজোটা শুরু করবে— আর সেও শুরু করবে তার স্তব— আদ্যা স্তব— শৃণু বৎস প্রবক্ষ্যামি, অদ্যাস্তোত্রং মহাফলম।

যখন শুরু করতে যাব ‘জয় জয় দেবী চরাচরসারে, কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে’ আশ্চর্যভাবে দ্বিতীয় পংক্তিটি মনে পড়ে গেল। বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে ভারতী দেবী নমস্তুতে। সরস্বতী মহাভাগে পর্যন্ত পৌঁছাতেই নানমাসির কণ্ঠ থেকে সুরের নির্ঝর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

যার ভাষা ক্রমেই যেন অর্থহীন সুরের কাছে। সুর যেন চাবুক মেরে নির্বল করে দিচ্ছে যিশুকে— নিয়ে যাচ্ছে ক্রুশের দিকে— ডান হাতের ধমনীতে পেরেক পোঁতা— তারপর হৃদপিণ্ডে— এভাবেই দড়িতে টান দিয়ে ক্রুশটিকে সোজা করে দাঁড় করানো— তবুও তিনি দৃষ্টি মেলে ধরলেন আকাশের দিকে— তারপরই মাথা ঝুঁকিয়ে দেখে নিলেন পৃথিবীকে— তারপরই নিথর। যেন চোখ বন্ধ করে এসব দেখে ফেলেছি। মা তখন মন্ত্রোচ্চারণের শর্ত ভঙ্গ করে স্পষ্ট উচ্চারণে বলে উঠল— ভয়ঙ্করী মহারৌদ্রী মহাভয়বিনাশিনী।

চোখ খুলতেই দেখি বেলুদির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে আর নানমাসি নিজের পোশাকের প্রান্ত দিয়ে জল মুছে দিচ্ছেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন— সব ঠিক হয়ে যাবে। এতদিন ধরে বয়ে চলা যন্ত্রণাকে বেলুদি যে আর বইতে পারছে না, সে-কথাই বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। একসময় নিজেকে শক্ত করে হাসি ফুটিয়ে আমাকে দেখেই বলে ওঠে— এই বাচ্চু, কাঁদছিস কেন?

নানমাসি এক ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে— মন্ত্র ভুলে গিয়েছিলে?
–না, সবটাই মনে পড়ে গিয়েছিল।
–তবে কাঁদছ কেন?

আমাকে বলতেই হল— তুমি যে গানটা গাইছিলে, কান্নার মতন সুর। সুরই নিয়ে গিয়েছিল যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ কেমনভাবে করা হচ্ছে। গানের মানে তো বুঝতেই পারিনি! ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল…

এরপর নানমাসি হাঁটু গেড়ে বসে আমার সমান হয়ে হু হু করে কেঁদে উঠল।

আর বাবলু ঘুঙুরে শব্দ না তুলে নির্বাক হয়ে দেখছে তা। সেই মুহূর্তেই ডলিদি গানটা ধরল—

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারই সঙ্গে, কী মৃদঙ্গে, সদা বাজে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।

‘তাতা থৈথৈ’ শেষ হলেই নানমাসি যে নিঃশব্দে বলছেন “আমেন” তা বুঝতে অসুবিধা হল না। সেই থেকে তিনি আমাকে জাপটে ধরে আছেন। শব্দটা যে তিনি নাভিমূল থেকে উচ্চারণ করছেন, তার ফলে শরীরে যে কম্পন হচ্ছিল তাতে কিছু একটা তিনি সংযোজন করছেন তা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু তখন— নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু, পাছে পাছে/তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ গানটি না জানা সত্ত্বেও গেয়ে উঠেছিলাম।

ড্রাগনের উপর এই নৃত্য থেমে যাওয়ার পর দেখি বারান্দার বাইরের চত্বরে রামছাগল কুয়াশার ভেতর তিড়-তিড় করে কাঁপছে। যেন তার পায়ে ঘুঙুর বাঁধা থাকলে সে নিজেও নেচে উঠত।

 

অনেকক্ষণ পর আবিষ্কার করলাম মোমবাতির শিখা তার প্রতিবিম্ব নিয়ে যিশুর ছবির সামনে এবং ভেতরে আলোর দ্বৈত-সমাহার ঘটিয়েই চলেছে।

এর মধ্যে কে যেন কানের সামনে এসে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল “তা থৈ”! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি কেউ নেই, সব ঘরের দরজা বন্ধ, যে যার পোশাক পরিবর্তনে ব্যস্ত।

 

এরপরে আগামী সংখ্যায়

 

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4245 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...