Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পুজো উৎসব অতিমারি ইত্যাদি

বিষাণ বসু

 


লেখক প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, পেশায় চিকিৎসক

 

 

 

শুরুতেই ডিসক্লেইমার দেওয়া যাক।

১. বর্তমান লেখক ভূত বা ভগবানে বিশ্বাস করেন কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর হলেও বলে রাখি, আমি বিশ্বাস করি কোভিড উনিশ বলে একটা অসুখ রয়েছে।

২. এও বিশ্বাস করি, যে, বিশ্বব্যাপী অতিমারি বলে যেকথা চাউর হচ্ছে, সেটা বাস্তব। অসুখটা হচ্ছে— মানুষজনও মারা যাচ্ছেন।

৩. ভ্যাক্সিন কবে আসবে জানা নেই। অসুখটার স্বীকৃত চিকিৎসাও তেমন নেই। সেক্ষেত্রে যদ্দূর সম্ভব আটকে রাখাই পথ। এবং ভিড়ভাট্টা বাড়লে অসুখটাকে আটকে রাখা যাবে না।

৪. কোন পথে এই অতিমারির মোকাবিলা আরো ভালোভাবে করা যেত, সে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, হওয়া জরুরি। যে পথে মোকাবিলা হয়েছে, বা মোকাবিলার জন্যে যে পথ বেছে নেওয়া হয়েছে, তাতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছোট ব্যবসায়ীরা। গরীব মানুষ দুঃস্থে পরিণত হয়েছেন, নিম্নমধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে, বেশ কিছু মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্তে। কিন্তু, খুব বেশি উচ্চ-মধ্যবিত্তের স্থানাঙ্ক বদলায়নি। আর বেশ কিছু উচ্চবিত্ত উঠে এসেছেন অতি-উচ্চবিত্তের পর্যায়ে। যে পথচয়নের ফসল এই, সেই পথ নিয়ে সুস্থ বিতর্ক অতিপ্রয়োজনীয় হিসেবেই গণ্য হওয়া উচিত।

৫. কিন্তু, বিতর্কের মুহূর্তে একথা মাথায় রাখা জরুরি, এদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল ভালো নয়। সংক্রমণ ঢালাও ছড়ালে যাঁদের চিকিৎসা আশু প্রয়োজনীয়, তাঁদের উন্নত চিকিৎসা তো দূর, নিয়মিত অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করে ওঠাই মুশকিল। আর, এর মধ্যেও, সম্পন্ন মানুষের পক্ষে চিকিৎসা জোটানো যতখানি সহজ, প্রান্তিক মানুষের পক্ষে তা বহুগুণে কঠিন। পাইকারি রেটে বিনাচিকিৎসায় পড়ে থাকতে হলে মৃত্যুহার দেড়-দুই শতাংশ বলে যে হিসেবটি জনপ্রিয়, তার ওলটপালট অবশ্যম্ভাবী।

প্লিজ, অন্যভাবে নেবেন না। ওপরের বক্তব্যটুকু মেনে নিতে পারলে, তবেই পরের অংশে আসুন।

হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। তাঁদের কাজ রায় দেওয়া— করেছেন। বলেছেন, মণ্ডপের মাপ অনুযায়ী, তার ভেতরে নির্দিষ্ট সংখ্যক পুজোকমিটির কর্তা বাদে কেউই থাকতে পারবেন না। এমনকি মণ্ডপের বাইরে পাঁচ-দশ মিটার অব্দি সংশ্লিষ্ট হর্তাকর্তা বাদে কেউই আসতে পারবেন না।

রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে পুজো কমিটিরা আবার আদালতে গিয়েছিলেন। প্রায় নজিরবিহীনভাবে চিকিৎসকদের একটি সংগঠন সেই পুনর্বিবেচনার দাবীর বিরোধিতা করে শুনানির অংশ হয়েছিলেন। শেষমেশ খুটিনাটিতে অল্পবিস্তর বদল ছাড়া রায় বদলায়নি।

রায়ের ফলাফল কত দূর কাজে এসেছে, এখুনি বলা মুশকিল। অনেকে বলছেন, রাস্তা ফাঁকা। কেউ কেউ বলছেন, ভিড় অল্পবিস্তর হচ্ছে— মণ্ডপে নয়, ঠিক তার বাইরে। অনেকে বলছেন, কলকাতার বাইরে নিয়ম কেউই মানছেন না। টিভি দেখে বোঝা মুশকিল। প্রতিটি চ্যানেলই কোনও না কোনও পুরস্কার দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। পুজো ঘিরে হাইপ সৃষ্টি তাদের প্রাথমিক দায়ের মধ্যে পড়ে। আদালতের রায় মেনে মণ্ডপ ফাঁকা, কিন্তু পুজো খুব জমজমাট, এই স্ববিরোধী কিন্তু সদর্থক বার্তা না দেওয়া গেলে তাদের পুরস্কারের তাৎপর্য কমে যায়। সুতরাং, তাদের পুজো-সম্প্রচার দেখে পরিস্থিতির যথাযথ আন্দাজ পাওয়া মুশকিল।

যদি মেনেই নিই, যে আদালতের রায় মেনে রাস্তাঘাট ফাঁকা, পুজোমণ্ডপ দর্শকশূন্য— এবারের পুজো উৎসবের উচ্ছ্বাসহীন এই পরিস্থিতি দেখে ডাক্তারবাবুরা খুশি? কেননা, মহামারির দিনে বাজারদোকানে ঢালাও ভিড় দেখে আতঙ্কিত হয়েছিলেন চিকিৎসকরাই। তাঁদেরই সংগঠন বিচারক যাতে রায়ের পুনর্বিবেচনা না করেন, সেই দাবী নিয়ে আদালতে গিয়েছিলেন। দুর্গাপুজো হিন্দু বাঙালির বৃহত্তম উৎসব নাকি সার্বিকভাবেই বাঙালির বৃহত্তম উৎসব, সে বিতর্কে না ঢুকেই বলা যায়— পশ্চিমবঙ্গে এত বড় মাপে হইহুল্লোড় আর কিছুতেই হয় না; আর কোনও উৎসব ঘিরে এত বিপুলভাবে অর্থনীতি ক্রিয়াশীল থাকে না।

এত মাস জুড়ে দমবন্ধ পরিস্থিতিতে কাটিয়ে মানুষ যখন একটু প্রাণ খুলে বাঁচতে চাইছেন, এত মাস ধরে ধুঁকতে থাকা খুচরো ব্যবসা যখন একটু হলেও চাঙ্গা হওয়ার মুখে— সেই মুহূর্তে বাতি নিভিয়ে দিতে পেরে ডাক্তারবাবুরা, বিশ্বাস করুন, কোনও জয়ের আনন্দ পাচ্ছেন না। কিন্তু, এও বিশ্বাস করুন, তাঁদের সামনে এছাড়া পথও ছিল না।

কোথায় একটা পড়েছিলাম, আইনের পাশে বেড়া থাকা জরুরি— বেড়া অর্থে মূল্যবোধ, নীতিবোধ, সচেতনতার বেড়া। অর্থাৎ, আমাদের সেটুকু বিবেচনাবোধ, নিজস্ব দায়দায়িত্ববোধ থাকা প্রয়োজন। যাতে কথায় কথায় আইনের শরণাপন্ন হতে না হয়। যাতে কথায় কথায় আদালতের হস্তক্ষেপ জরুরি না হয়ে ওঠে। সেই দায়বোধ, সচেতনতা, কাণ্ডজ্ঞানের বেড়াটুকু রাখতে পারলাম কি?

যে রাজ্যের প্রধান করোনাকে পাশবালিশ করে শোয়ার সুপরামর্শ দেন, বা বলেন পুজোয় করোনাকেই লকডাউন করে দেওয়া হবে; আর বিরোধী দলের নেতা যখন বলেন করোনা-টরোনা আগে হচ্ছিল, এখন আর নেই— সেখানে সচেতনতার বার্তা সর্বস্তরে পৌঁছানো মুশকিল। আবার পুজোর কেনাকাটার মুহূর্তে সবার মুখে মাস্ক রাখা হয়নি কেন, এ প্রশ্ন তোলার সময় এই বাস্তবটাও মাথায় রাখতে হবে, যে, অনেকক্ষণ মাস্ক পরে থাকা সহজ নয়, হাঁটাচলা করতে হলে কাজটা আরও কঠিন, ভিড়ভাট্টা গুঁতোগুঁতির মধ্যে হাঁটতে হলে, মাস্ক পরে থাকা প্রায় প্রাণান্তকর— ডাক্তারবাবুরা প্রায় দশ-বারো ঘণ্টা মাস্ক পরে থাকছেন, অনেকের ক্ষেত্রে বাড়তি যন্ত্রণা পিপিই-ও, কষ্টটা তাঁরা বোঝেন। আর সেইজন্যেই জানেন, ভিড় জমতে দেওয়া হলে, ভিড়ের মুখে মাস্ক থাকবে না সেও অনিবার্য। কাজেই ভিড়টাই বন্ধ করা দরকার। সমস্যাটা ডাক্তারবাবুদের পাশাপাশি অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও বুঝেছেন, ভালো ব্যাপার এটাই। অথচ খাতায়কলমে শিক্ষিত এমন বেশ কিছু মানুষ সরল সত্যটা বুঝে উঠতে পারছেন না।

এদিকে মন্ত্রীমশাই জানাচ্ছেন, আদালতের দ্বারস্থ হয়ে এই রায় নিয়ে এলেন যাঁরা, বাংলার মানুষ তাঁদের ক্ষমা করবেন না। স্বাভাবিক। তিনি তাঁর বিবেচনাবোধ বা শিক্ষাদীক্ষার অনুসারী বক্তব্যই রেখেছেন। করোনা মোকাবিলায় এমন আশ্চর্য কৃতিত্ব, লকডাউনের দিনগুলোতে কাজ হারানো সাধারণ মানুষকে সহায়তা জোগানোর এমন অপূর্ব বন্দোবস্ত, আমফান-পরবর্তী ত্রাণবণ্টনে এমন অনন্য সমদর্শিতা ও স্বচ্ছতা— এসবের পরে বাংলার মানুষ তাঁদের ধন্য ধন্য করার ফাঁকে অপরকে ক্ষমা না করার অবকাশ পেলে হয়!! কিন্তু, মন্ত্রীসান্ত্রীদের কথাবার্তা আজকাল ছোটদের খেলায় দুধভাতের মতো— ওসব নিয়ে ভাবতে নেই।

রায় নিয়ে, বা রায়ের বিরোধিতা করে, অবশ্য, মন্ত্রীদের পাশাপাশি বেশ কিছু মানুষজনও মতামত জানাচ্ছেন। তাঁদের কথাগুলোর মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুক্তি রয়েছে— কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপাতযুক্তি রয়েছে— এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ কিছু বড় বড় গেরামভারি শব্দও রয়েছে। সেইসব কথাগুলো শুনে দেখা যাক।

কয়েকজন বলছেন, পুজোমণ্ডপে ঢুকতে না দেওয়া সংবিধানস্বীকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, এই রায় অসাংবিধানিক ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁদের নিয়ে চিন্তা হয়। কবে না ধর্ষণকেও ব্যক্তিস্বাধীনতার চূড়ান্ত প্রকাশ হিসেবে মেনে নেওয়ার কথা বলে বসেন!! এনাদের যুক্তি শুনলে তো আইনকানুন থানা-পুলিশ সবই অসাংবিধানিক— স্রেফ ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ!! ছোঁয়াচে অসুখের ক্ষেত্রে অবাধ ঘোরাফেরা করতে দিলে ঝুঁকি শুধুই সংশ্লিষ্ট মানুষটির নয়, ঝুঁকি পাশের লোকজনেরও। যেমন, একান্তে ধূমপান করলে ঝুঁকি শুধুই ধূমপায়ীর, ভিড় বাসে-ট্রেনে ধূমপান করলে ক্ষতি আশেপাশের লোকজনেরও। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, আর যা-ই হোক, ব্যক্তিস্বাধীনতার যুক্তি চলে না।

কেউ কেউ বলছেন, দুর্গাপুজোর বিরোধিতা আসলে বাঙালি সংস্কৃতির ওপরে আঘাত। ঠিকই। আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতির যাঁরা পুরোধা, সে রবীন্দ্রনাথই বলুন বা বিদ্যাসাগর, তাঁরা ধূমধাম করে সার্বজনীন দুর্গাপুজো করে তবেই না সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের ব্যাপারে এগোতে পেরেছিলেন!! আর এযুগে সংস্কৃতি রক্ষার গুরুভার বহন করছেন চেতলায় ববি হাকিম, নাকতলায় পার্থ চাটুজ্জে বা নিউ আলিপুরের পুণ্যভূমিতে শ্রীযুক্ত অরূপ বিশ্বাস— এনারা না থাকলে আমাদের সংস্কৃতি কোন রসাতলে হারিয়ে যেত, ভেবে দেখেছেন একবার!!! সত্যি বলছি, যাঁদের একান্ত সংস্কৃতিটি কেবলমাত্র হইহুল্লোড় বাদে হারিয়ে যাওয়ার ভয় হয়, সেই জাতির দুর্দিন আসন্ন।

আবার কেউ কেউ বলছেন, এত মানুষের রুজিরোজগার… একটুও ভাবব না!! হক কথা। মুখ্যমন্ত্রী পুজোর খয়রাতিতে সরাসরি দিয়েছেন প্রায় দুশো কোটি টাকা (পঞ্চাশ হাজার করে আটত্রিশ হাজারের কিছু বেশি পুজো, গুণ করে অঙ্কটা বললাম), বিদ্যুৎবিলে ছাড় এবং আরও বেশ কিছু ফিজ মকুব ধরলে পরিমাণটা দ্বিগুণ, সম্ভবত। টাকাটা অন্যভাবে খরচা করা গেলে কিছু সুরাহা হত না? ধরুন, দশ লক্ষ পরিবারকে মাসে চার হাজার টাকা ভাতা দেওয়া গেলে??

গরীবের দুঃখে যাঁরা কাতর, তাঁদের অনেকেই আবার গড়িয়াহাটে বা নিউ মার্কেটের ভিড়ে দুশো টাকার বারমুডা আশি টাকায় না পেলে বিরক্ত হচ্ছেন, বা হকারভাই চুলের ক্লিপের দাম পঞ্চাশ টাকা চাইলে কুড়ি টাকা দর হেঁকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ভারী কঠোর এই গরীবদরদ। কিন্তু আবার অনেকে বেশ আন্তরিকভাবেই ছোট ব্যবসায়ীদের নিয়ে চিন্তিত। বলছেন— ট্রেন বন্ধ, কাজেই অনেকেই আসতে পারবেন না, “করোনা জুজু”-র ভয়ে আরও অনেকেই বাড়ি থেকে বেরোবেন না— কাজেই, এবছর ভিড় সেরকম হত না এমনিতেই। খুব ভালো কথা বলেছেন। তাহলে তো ফুচকাওয়ালা, বেলুনওয়ালা, রঙিন সরবতওয়ালাদের বিক্রিবাটা এমনিতেই তেমন একটা হত না। হাইকোর্টের রায়ে তাঁদের ক্ষতির সম্ভাবনা কোথায়!!

কেউ কেউ আবার এমনও বলছেন, বাসে ভিড় হচ্ছে, অফিসে যেতে হচ্ছে— শুধু দুর্গাপুজোর ভিড় নিয়েই কথাবার্তা? সত্যিই তো!! কাজে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা আর উৎসব, একই নিশ্চয়ই!!! গরীব মানুষ যদি একটা পান-গুমটি বানানোর আশায়, বা নিজের একখানা রিকশা থাকবে, এই আশায় ধার করেন, তাঁর সেই দেনার সঙ্গে যিনি জুয়ায় টাকা উড়িয়ে দিয়ে আরো টাকা ধার করেন— ব্যাপারটা একই— দুক্ষেত্রেই দেনা। পুজো কিম্বা রুজিরোজগার— ভিড় দুজায়গাতেই। কোনটা জরুরি, হিসেব করব না?

তিনটে প্রশ্ন করা যেতে পারত। কিন্তু, সেগুলো এনারা পড়ে আসেননি। সম্ভবত, আগের বছর পরীক্ষায় এসে গেছিল বলে এবার আর ইম্পর্ট্যান্ট নয় বলে ধরে নিয়েছেন।

১. এই মুহূর্তে রাষ্ট্র কেন প্রান্তিক মানুষজনের খাওয়াপরার দায়িত্ব নেবেন না? কেন তাঁদের ঝুঁকিবহুল ভিড়ভাট্টায় বেলুন কি বাঁশি বিক্রি করে পয়সা জোটাতে হবে? এই পথে উপার্জন করতে গিয়ে কেউ যদি করোনায় প্রাণ হারান (এমন সব জ্ঞানীগুণীদের মতেই, করোনায় মরে দেড় শতাংশ— এক লাখে দেড় হাজার— হাজারে দেড়শ— এর মধ্যে একটাও গরীব থাকবে না!!! আর এই রাজ্যে মৃত্যুর হার কিন্তু তার চাইতে কিছু বেশিই), তাহলে তাঁদের পরিজনের কী হবে??

২. পুজো যদি মেনে নেওয়া হয়, বাস যদি চালু থাকে— তাহলে লোকাল ট্রেন কেন চালু হবে না? হ্যাঁ, ঝুঁকি থাকবে— করোনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি। কিন্তু, রিস্ক-বেনিফিটের হিসেব কষলে ট্রেন চালানোর বিরুদ্ধে যুক্তি থাকে কি? কোন রিস্ক-বেনিফিটের অঙ্কে পুজোর ভিড় অ্যালাউড, অথচ লোকাল ট্রেন নয়?? বলে রাখা যাক, ভিড়ের উপলক্ষ যদি উৎসবের হুল্লোড় না হয়ে মানুষের রুজিরোজগার হত, একান্ত প্রয়োজনের বিষয় হত, তাহলে চিকিৎসকরা এমন করে বিরোধিতা করতেন না, আদালতও, সম্ভবত, এমন নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন না। বাস চালু হওয়ার মুহূর্তে বা দোকানবাজার খোলা হলে এত বিতর্ক হয়েছে কি?

এমনকি পুজোর বাজার উপলক্ষেও যদি ভিড়ে সকলের মুখে মাস্ক থাকত, এত কথা উঠত কি? আগেই বলেছি, ভিড়ের মধ্যে মাস্ক রাখার কাজটা সহজ নয়। কিন্তু, যাঁরা রায়ের বিরোধিতা করছেন, তাঁদের অনেকের যুক্তি, গরীব মানুষ মাস্ক পাবে কোত্থেকে? কিডনি বিক্রি করে মাস্ক কিনবে নাকি!! একটু খোঁজ নিয়েই দেখুন না— মাস্কের দাম এখনও অত বেশি নয়, বা কিডনির বাজারদরও অত কমে যায়নি! মাস্ক থুতনির নীচে নামিয়ে যাঁরা ভিড় করছিলেন, মাস্ক তাঁদের সবারই সামর্থ্যের বাইরে!!

৩. একজায়গায় বেশি মানুষ জড়ো হওয়া নিয়ে আপত্তি যদি না-ই থাকে, তাহলে ইশকুল খুলবে না কেন? আপনার-আমার বাড়ির বাচ্চারা অনলাইন ক্লাস করছে। তাদের পড়াশোনা, এমনকি একবছর বন্ধ থাকলেও, কিচ্ছু আসবে যাবে না। কিন্তু, গ্রামেগঞ্জের গরীব মানুষের পরিবারের একটা আস্ত প্রজন্ম পাকাপাকি স্কুলছুট হয়ে যেতে চলেছে। তার আর্থসামাজিক অভিঘাত হিসেব করেছেন??

আর হ্যাঁ, দুর্গাপুজোর পরে ডাক্তারবাবুদের আশঙ্কা অনুসারে করোনার বাড়বাড়ন্ত হলে কিন্তু এই দুই ও তিন নম্বর পয়েন্ট বিশ বাঁও জলে চলে যাবে। মানে, সেরকম সংক্রমণের বাড়াবাড়ির মুহূর্তে নতুন করে ইশকুল বা ট্রেন চালু করার দুঃসাহস কোনও অকুতোভয় নেতা/নেত্রীই নেবেন না। একুশের ভোটবৈতরণীর জন্যে ধর্মানুষ্ঠান জারি রাখা বা ক্লাবদের খুশি রাখা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ইশকুল বা ট্রেন ততখানি নয়।

দেশজুড়ে করোনার গ্রাফ নিম্নমুখী— একা পশ্চিমবঙ্গ মাথা তুলছে। পুজোর পর সংক্রমণের গ্রাফ সবেগে মুখ তুলে চাইলে দেশের মধ্যে বিচ্ছিন্ন রাজ্য হিসেবে গণ্য হয়ে একঘরে হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। অন্য প্রদেশে কাজ করার সুযোগ হারানোর বিপদ। সেই মুহূর্তে, শুধু ভাজপা-কে গালি পেড়ে ধান সেদ্ধ হওয়ার আশা কম।

আবারও বলি, এই মুহূর্তে দেশ জুড়ে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কমছে। এই রাজ্যে চিত্রটা বিপরীত। নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা বা মৃত্যুর সংখ্যা— দুই ক্ষেত্রেই এই রাজ্যে রোজ নতুন নতুন রেকর্ড ভাঙাগড়া চলছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে, রাজ্য সরকার চান বা না চান, নতুন করে লকডাউনের নির্দেশিকা এলে এই নড়বড়ে অর্থনীতি, এই অসহায় গরীবগুর্বোদের হাল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, ভেবে দেখেছেন কি?

স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল যে খুব খারাপ, সেকথা আর নতুন করে না বললেও চলবে। সংক্রামিত বা আক্রান্তের পাঁচ শতাংশেরও যদি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করতে হয়, সেই ব্যবস্থা রয়েছে তো? না না, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি হাইফাই বন্দোবস্তের কথা বলছি না— স্রেফ একখানা পরিষ্কার বিছানা আর পাশে অক্সিজেন, এটুকু??

সুস্থ এবং জীবিত চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা ক্লান্ত। প্রায় বিরতিহীন ছুটিহীন অবসরহীন চাপ তাঁরা সামলাচ্ছেন। টানা সাত মাস। আরও কতদিন, কেউই জানেন না। কাজের চাপের চাইতেও বেশি স্নায়ুচাপ— সঙ্গী-সহযোদ্ধারা আক্রান্ত হচ্ছেন, চিরতরে হারাতে হচ্ছে অনেককে। দ্বিতীয় দফার ঢেউয়ের বাড়তি চাপ ঠান্ডা মাথায় সামলানোর জন্যে প্রস্তুত কজন!!

সদ্য জানা গেল, একটি বিশেষ হাসপাতালে প্রায় দশ শতাংশ চিকিৎসক, তিরিশ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রামিত— উপসর্গহীন সংক্রামিত। নিম্নবিত্তের সংসারে একপয়সা দুপয়সার হিসেবনিকেশ আরও বেশি জরুরি। নড়বড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় একলপ্তে বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হলে সবার চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে তো?

আপনি স্বীকার না করলেও একটু মনে করিয়ে দিই, সরকারবাহাদুরও কিন্তু জানেন, পুজোর বাজার এবং পুজোর হুল্লোড়ের সুবাদে সংক্রমণের ঝুঁকির কথা। তা না হলে, পুজোর উদ্দেশে প্রাণপণ সদর্থক বার্তার সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালের সর্বশ্রেণির কর্মীর ছুটি বাতিলের নির্দেশিকা আসত না। বেসরকারি চিকিৎসকদের শহর না ছাড়ার অনুরোধও এমন করে আসত না। শহরের আরও একটি হাসপাতালকে নতুন করে কোভিড হাসপাতালে রূপান্তরিত করার প্রয়াস পুরোদমে শুরু হত না। একখানা চালু হাসপাতাল কেবলমাত্র কোভিড চিকিৎসার জন্যে ব্যবহৃত হতে থাকলে কত মানুষের হয়রানি, কত অসুস্থ একলপ্তে বিপদে পড়েন, সেকথা নতুন করে না বললেও চলবে। অতএব, আপনি ঝুঁকির কথা উড়িয়ে দিতে চাইলেও সরকার সংক্রমণের ঝুঁকির কথা মেনে নিয়েই এগোচ্ছেন।

অর্থনীতির কথা ভাবা জরুরি, অবশ্যই। অনলাইন ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে, ছোট ব্যবসায়ী ঘোর বিপদে, নতুন অসাম্য সামনে আসছে। প্রাণে বাঁচলে তবেই না সংক্রামিত হয়ে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা। প্রত্যেকটি যুক্তিই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, অতিমারি আক্রান্ত এই নতুন বিশ্বে নতুন মডেল খোঁজা সমান জরুরি। কর্পোরেট রাষ্ট্রকে সনাতন কল্যাণকামী রাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা, নাগরিকের ন্যূনতম বা সাধারণ চাহিদাটুকু পূরণের দায় রাষ্ট্রের— এই কথা মনে করিয়ে দেওয়া, অধিক ক্রয়, এমনকি প্রয়োজনহীন ক্রয়ই অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র পথ— সেই তত্ত্বের  বিপরীতে গিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা, কিছু মানুষ কোটিপতি হলে তাঁদের গাড়ি ধোয়ার ছেলের দরকার হবে বলে গরীবের হাতেও কাজ জুটবে— এমন আশ্চর্য প্রত্যাশার পরিবর্তে উন্নয়নের এমন মডেল যা কিনা দীর্ঘমেয়াদে সকলের জন্যে উপযুক্ত, অন্তত এমন একটা ব্যবস্থা যাতে আর্থিক অসাম্য উত্তরোত্তর এমন কদর্য না হয়ে কিছুটা ভদ্রস্থ হতে পারে, ওই যেমন বললাম— ন্যূনতম চাহিদাটুকু নিয়ে যাতে ভাবতে না হয়, সেই পথ খোঁজার পরিশ্রমটুকু শুরু হোক। ঢালাও ভিড়, ফুটপাথে ধাক্কাধাক্কির পক্ষে বলতে গিয়ে আপনি কিন্তু পুরনো পথটাকেই একমাত্র সমাধান বলে ভাবছেন। নতুন বা বিকল্প পথ খোঁজা, রাষ্ট্রের কাছে আরও দায়বদ্ধতার দাবী তোলা— সেসবের থেকে দূরে সরে আসছেন।

মনে করিয়ে দেওয়া যাক, অতিমারি সংক্রমণ ইত্যাদির তোয়াক্কা না করে ঢালাও বাণিজ্য চালু করা যুক্তি সব দক্ষিণপন্থী অর্থনীতিবিদই দিচ্ছেন— তাঁদের নীতিভাবনার সঙ্গে জনদরদী, তথাকথিত বামপন্থী মানুষজনও শেষ কবে এমন সহমত হয়েছেন, খেয়াল পড়ছে না। কিন্তু, এই নীতির ফলে অনিবার্যভাবেই মারা যাবেন যাঁরা, সেই মৃতরা প্রথমোক্তদের কাছে কোল্যাটারাল ড্যামেজ। আর উলুখাগড়াদের নিয়ে কে-ই বা ভাবে! অথচ সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী মারা গেলে উলুখাগড়াদের পরিবার যে স্রেফ ভেসে যায়, সেকথা ভুলে যাবেন? খুব সরল অঙ্কে গরীব মানুষের স্বার্থ নিয়ে ভাবতে গিয়ে, শেষমেশ, আপনিও কি তেমন করেই, বড়লোকদের মডেলেই ভাবতে অভ্যস্ত হচ্ছেন??