Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শাকম্ভরী

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


লেখক গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ দমদম রোডের হনুমানজির মন্দিরের লাগোয়া অঞ্চলে এক জঘন্য হত্যালীলা সংঘটিত হয়। এমন ঘটনা জনমানসে কখনওই সুতীব্র অভিঘাতের সৃষ্টি করে না। মুনাফাসর্বস্ব প্রচারমাধ্যমে এমন খবর নিয়ে হইচই খুব একটা হয় না। অথচ নানান বাহানায় এমন হত্যালীলা নিরন্তর ঘটে চলেছে আমাদের চেনা-অচেনা পরিসরে। এর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে রুখে দাঁড়াবার সময় এসেছে। নিজেদের সম্পদকে রক্ষা করতে আমাদের শাকম্ভরী হয়ে উঠতে হবে। এ কাহিনি একদল স্বপ্নমুখর সবুজ মানুষের জেহাদ।

***

 

গতকাল সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি অনুশা। বাবা খবর পেয়েছিল অনেক সকালে। তবে পাছে অনুশা কষ্ট পায়, সেজন্য খবরটা বিলকুল চেপে রেখেছিল। পচা ভাদুরে গরমের জন্য কপালে জমে ওঠা অসংখ্য স্বেদবিন্দুকে ছাপিয়ে দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে নেমে আসছিল বেদনার্ত হৃদয়ের নির্যাস। বেশ বুঝতে পারছিল অনুশা ঘটনাটা তাকে এক লহমায় অনেকটা ভেঙে দিয়ে গেল। মাথার পাশে রাখা মোবাইল ফোনটাকে আজ খানিকটা অনিচ্ছায় তুলে নেয় সে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা পরিচিত সহযোদ্ধাদের নম্বর মিলিয়ে হোয়াটস্যাপে মেসেজ পাঠিয়ে দেয়। সবাইকে খবরটা পৌঁছে দিতে হবে তো!

ঘুম আসবে না জেনেও চোখের পাতা দুটো এক করে গত বছরের ৪ আগস্ট ২০১৯ রবিবারের সেই আশ্চর্য সকালটার কথা মনে করার চেষ্টা করে অনুশা। মনে পড়ে ডাইরির পাতায় ওইদিনের ঘটনাটাকে বিশেষভাবে লিখে রাখার কথা। সেদিন খুব ভোরে বাবার সঙ্গে বিরাটির বাড়ি ছেড়ে দমদম নাগেরবাজার সংলগ্ন হনুমান মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল সে। ছোটবেলা থেকেই জ্যাঠা, বাবা, ঠাম্মির মুখ থেকে বারবার শুনেছে সেই সব আশ্চর্য যাপনের বর্ণিল উপাখ্যান। জ্যাঠা বাবা দুজনেই একই স্কুলের ছাত্র ছিল। ফলে দুজনের গল্পকথায় কোনও ফারাক ছিল না। সময়ের সামান্য ব্যবধানের কারণে যদি বা কোথাও গল্পের খেই হারিয়ে যেত তাহলে এক গাল হেসে ঠাম্মি সানন্দে সেই ফাঁক ভরিয়ে দিতেন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ উজাড় করা গল্পকথায়। অনেকবার ভেবেছে অনুশা এমন একটা সবুজের অভিযানে সামিল হতে। কিন্তু নানা কারণেই তা এতকাল হয়ে ওঠেনি। তাই গতবছর আশ মিটিয়ে উদযাপন করেছিল গাছ লাগানোর উৎসব। শুধু কি সে একা? গতবছরের অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া অন্যরা— চিত্রিতা, অদ্রিতা, অন্তরদীপা, অরিঞ্জয়, শরৎ, দীপ্তার্ক, প্রাচী, উত্তরণ— সকলেই এক নতুন ভালোবাসার রঙে নিজেদের রাঙিয়ে নিয়েছিল প্রাণভরে। হনুমান মন্দিরের লাগোয়া দমদম রোডের দুধারে বৃক্ষহীন ছায়াহীন নির্মম নিরেট কংক্রিটের চাট্টান অংশটাকে সবুজ পাতার আলপনায় ভরিয়ে তুলেছিল ওরা। নিজেরাই আত্মার আনন্দে বুনেছিল কত রকমারি গাছ— বকুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, সোনাঝুরি, জারুল, কাঞ্চন পারুল। সেদিন অনুষ্ঠানে হাজির না হলে অভিজ্ঞতার ভাণ্ড যে অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যেত ওদের। অনুশাদের স্কুলে বছরভর নানা অনুষ্ঠান উদযাপনের ব্যস্ততা থাকলেও গাছকে নিয়ে এমন মেতে ওঠার কোনও আয়োজন ছিল না। বিজ্ঞান বইয়ের পাতায় গাছেদের কথা, গাছেদের প্রয়োজনীয়তার কথা থাকলেও হাতেকলমে বইয়ের কথাগুলোকে যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ সেভাবে কখনওই হয়নি। অথচ দমদমের বুকে গাছকে নিয়ে গাছকে রক্ষা করার যে প্রচেষ্টা সূচনাই তো হয়েছিল বাবা-জ্যাঠার আদরের পাঠশালায়— দমদম কিশোরভারতী হাই স্কুলে। আজ এই মনখারাপি দিনে সেই পুরনো সময়ের গৌরবী আখ্যানে নতুন করে মন মজাতে ইচ্ছে হল অনুশার।

সে অনেকদিন আগের কথা। ১৯৬৫ সাল। দমদমের নাগেরবাজার অঞ্চলে নবাঙ্কুরের মত মাথা উঁচিয়ে আত্মপ্রকাশ করল ছোট্ট একটা স্কুল— এক অন্যভাবনার ভাবুক, অন্যপথের পথিক। নিয়মমাফিক পঠন-পাঠনের পাশাপাশি পরিকল্পনা করা হল নানান রকমের সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমে এর এক নম্বর-পাওয়া কৃতি ছাত্র তৈরি নয়, কিশোরভারতীর লক্ষ্য ছিল সমাজসচেতন ভালো মানুষ তৈরি করা। আর তাই ১৯৬৭ সালে, আত্মপ্রকাশের মাত্র দু বছর পরেই স্কুলের উদ্যোগে বিদ্যালয়-সংলগ্ন দমদম রোডের ধারে শুরু হল বৃক্ষরোপণ উৎসব। তিলে তিলে দমদমকে সবুজ করে তোলার কাজে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে জ্যাঠা-বাবার স্কুল। অনুশা নিজেও যে এই গৌরবময় অভিযাত্রার এক উত্তরসূরি, সে কথা মনে করেই ভারি আনন্দ হয় তার। আজকের এই ধূসর মলিন বিবর্ণ হয়ে ওঠা পৃথিবীতে এমন কাজেরও যে অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে সে কথা বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যখন চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসে তখন একটুখানি আলোও যে পরম ভরসার আশ্রয় হয়ে ওঠে অনুশা সে কথা বেশ বুঝতে পারে। বাবা তাঁর ছেলেবেলায় এমনই আবহে বড় হয়েছে ভেবে একদিকে যেমন বাবাকে নিয়ে গর্ব করে অনুশা, অন্যদিকে বাবাকে মনে মনে একটু ঈর্ষাও যে করে না তা নয়। তবে একথা সে কোনওদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি। সে জানে এমন ভাবনায় তার অন্য সহযোগীরাও হয়ত মজে থাকে। কেননা, তাদের বাবারাও যে ওই ভাবনাপথের সহযাত্রী, এক অচ্ছেদ্য পারিবারিক সম্পর্কের গ্রন্থিতে বাঁধা।

বালিশের পাশে রাখা মুঠোফোন তার সুরেলা অস্তিত্বের জানান দিতেই সম্বিত ফিরে পেয়ে অনুশা। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ভেসে উঠতে দেখে অদৃতার নাম। ছয়ছোট্ট অদৃতার মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাটন অন করতেই অদৃতার সুরেলা কণ্ঠ কানে আসে।

–মর্নিং অনুশাদিদি। কেমন আছ? খবরটা পেয়েছ?

খবর এখন একটাই। অনুশা তা বিলকুল জানে। তাই ঝটপট বলে,

–মর্নিং! তবে একদম গুড নয়। কী করে শুভ হবে সকালটা? একে এতদিন ধরে সকলে ঘরবন্দি, বাইরে যাওয়ার জো নেই, তার ওপর এমন একটা খবর! মন একদম ভালো নেই।
–সত্যিই গো! আমি তো ওদের সঙ্গেও কথা বললাম। সবারই মন খারাপ। অরিঞ্জয়দা তো শুনেছি বলেই ফোনটা কেটে দিল!
–কী আর করবে বল! এমন খবরে আমাদের মন খারাপ তো হবেই রে! কত যত্ন করে নিজেরা বসিয়েছিলাম গাছগুলোকে। ওরা সব ছারখার করে দিল।– অনুশার গলা ভারী হয়।

এই বছরে অতিমারির দ্রোহকালেও আবার নতুন করে ধরিত্রী মায়ের রুক্ষ হয়ে ওঠা শরীরে সবুজ গালিচা বিছানোর কথা ভাবছিল অনুশার বাবা আর তার সহযোগী বান্ধবেরা। বাবার ব্যস্ত কথোপকথন থেকে জেনেছে নতুন ঠাঁই খোঁজার কাজ চলছে। কাজের পরিধিকে আরও একটু বাড়ানোর চিন্তাভাবনা চলছে। ভাবা হচ্ছে একটা ছোট বুকলেট প্রকাশ করবার কথা। অনুশাকেই এ ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে হবে। একটু পড়াশোনা করতে হবে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই পাশের টেবিলে রাখা ‘গল্পগুচ্ছে’র অখণ্ড সংস্করণ টেনে নেয়। মা বলেছিলেন ‘অনুশা, বলাই গল্পটা পড়িস। এক আশ্চর্য গাছভাবুকের কথা আমাদের জন্য লিখে গিয়েছেন রবি ঠাকুর।’ মা শুধু মুখে বলেই থেমে যাননি। একটা সুন্দর পেজমার্কার নির্দিষ্ট পাতার ফাঁকে গুঁজে রেখে গেছেন। মায়ের এমন ছোটখাটো কাণ্ডকারখানাগুলোকে খুবই মজাদার বলে মনে হয়। এমন মনভারি সকালেও মুচকি হেসে উঠে বইটা চোখের সামনে মেলে ধরে অনুশা।

বেলা বেড়েছে। বেড়েছে ব্যস্ততা। রোববারের সকালগুলোয় গা এলিয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে ইচ্ছা করে। এখন অবশ্য অতিমারির কারণে সব দিনগুলি কেমন এক সুরে বাধা হয়ে গেছে। আজ সকালেই সূচনা হয়েছে দেবীপক্ষের। এমন দিনের প্রভাতী আমেজটাই একদম নষ্ট হয়ে গেছে। শরভ ওদের বিধ্বস্ত চেহারার ছবি তুলে পাঠিয়েছে। ছবিগুলো চোখ মেলে দেখতেই ইচ্ছে করেনি। ছোট ছোট বাতাসে দোল খাওয়া নরম শরীরগুলোকে ধারালো অস্ত্রের নির্বিচার আঘাতে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে ওরা! চিত্রিতার লাগানো সোনাঝুরির কী হাল করেছে দেখো! মাত্র কয়েকদিন আগেই গৌতমকাকু ছবি তুলে পাঠিয়েছিল। ওদের লাগানো কৃষ্ণচূড়ার লালে লাল হয়ে ওঠার ছবি। আবার মজা করে লিখেছিল, “কিরে, তোদের পাড়ার খবর কী? আমাদের পাড়ায় যে ওরা অকাল হোলির তোড়জোড় শুরু করেছে।” বাবা খানিকটা তরজা করার ভঙ্গি নিয়েই লিখেছিল “আমাদের ওরা যে এখন ‘অন্তহীন প্রাণের বিকাশতীর্থে যাত্রা করবে বলে রৌদ্রে-বাদলে-দিনে-রাত্রে’ তিলে তিলে নিজেদের প্রস্তুত করছে! এত অধৈর্য হলে চলে? জানিস না সবুরে মেওয়া ফলে। আমাদের বসন্ত সঠিক সময়েই হবে। অকালে অভিযানে আমাদের তেমন ভরসা নেই রে ভাই!” অনুশা জানে এসব কথা বাবা কপট অভিমানের বশেই বলেছে। ওটা বাবার মনের কথা নয় কখনওই। যে মানুষটা ‘পাশাপাশি ৮৮’-র দলবল নিয়ে এখনও ছেলেবেলার মত সবুজের অভিযানে মেতে ওঠে, তার এমন গোঁড়া নজর হতে পারে!

আবারও বেজে ওঠে ফোনটা। মায়ের তৈরি তুলতুলে পরোটা মুখে পুরেই অনুশা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। উত্তরণের ফোন— “অ্যাই অনুশাদিদি, হোয়াটস্যাপটা খুলে দেখ। একটা রিপোর্ট লিখেছি গতকালকের জঘন্য ঘটনাটা নিয়ে। সবকিছু এভাবে মুখ বুজে মেনে নেওয়ার কোনও মানেই হয় না। গ্রেটার কথাই ভাব। এইটুকু মেয়ে হয়েও কীভাবে পরিবেশ নিয়ে কথা বলছে বল! আমাদের বয়সিই হবে। ও পারলে আমরাও ঠিক পারব। অনুশাদিদি লেখাটা পড়ে আমাকে জানা। বাবার চাপাচাপিতে মাদার টাং-এ লিখতে হল। জানি না ঠিক হয়েছে কিনা। তুই পড়ে দেখ। ছাড়ছি।” এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামে উত্তরণ। অনুশা বেশ বুঝতে পারে গত রাতের ওই জঘন্য কাজ তার মত উত্তরণকেও ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছে। প্লেটে রাখা পরোটার টুকরোগুলো তাড়াতাড়ি মুখে পুরে ফেলে অনুশা। অন্যদিন হলে এই খাবার কাজটাই কত সময় নিয়ে সারতে হত। আর যে অন্য তাগিদের তাড়া আছে।

নিজের ঘরে এসে উত্তরণের পাঠানো লেখাটা পড়তে বসে অনুশা। সে পড়তে থাকে—

“গতকাল রাতে একদল অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী দমদমের পরিচিত হনুমানজির মন্দিরের লাগোয়া অঞ্চলে লাগানো কতগুলো নবীন গাছকে নির্বিচারে কেটে ফেলেছে। মাত্র গত বছরই একদল কিশোর-কিশোরী তাদের অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সবুজায়ন উৎসবে সামিল হয়ে এই গাছগুলো লাগিয়েছিল। সারা পৃথিবীর ক্ষয়ে যাওয়া পরিবেশকে রক্ষা করতে তারা যে উদ্যোগ নিয়েছিল তার এমন নির্মম পরিণতি হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি। এ বছর প্রবল ঝড়ে এই শহরের বিপুলসংখ্যক গাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের এই শহরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য যখন বিরাট প্রশ্নের মুখে, ঠিক তখনই দমদমের বুকে ঘটে যাওয়া এই ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা এর প্রতিকার চাই।”

প্রতিবাদপত্রটি পড়া শেষ করে অনুশা বেশ বুঝতে পারে নিজের মধ্যে একটা অন্যরকমের স্রোত বইছে। সেই স্রোতের মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে বেদনা অসহায়তা ক্ষোভ যন্ত্রণা ভালোবাসা প্রতিবাদ সব। এক নতুন অনুশা জন্ম নিতে থাকে ওর নিজের চেনা শরীরের কাঠামোর ভেতরে। ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির’– জেগে উঠছে অনুশা নতুনভাবে শাকম্ভরী হয়ে। মাঠে নামতে হবে এবার রণংদেহি মন্ত্রে নিজেকে পরিপূর্ণ করে। এমন অন্যায়কে মুখ বুজে মেনে নেওয়া নয়। অনুশা বুঝতে পারে সমস্ত নাগরিক অবজ্ঞাকে হেলায় তুচ্ছ করে আপন প্রাণের স্পন্দনে বেড়ে ওঠা ওই গাছগুলো ছিল তাদের প্রাণের দোসর, আত্মার পরমাত্মীয়। ওদের ছাড়া ধরিত্রী মায়ের আঁচল যে শূন্য।