Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচন ও রাজ্যবাসীর দাবিদাওয়া

সুমন সেনগুপ্ত

 


লেখক পেশায় বাস্তুকার

 

 

 

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন একমাত্র একটাই প্রশ্নে ঘূর্ণায়মান— কোন কোন দল থেকে কোন কোন বড়, ছোট নেতা বিজেপিতে যোগ দিলেন। তারা কত লোক সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কতটা লাভবান হল। এর মধ্যে দিয়ে কি বাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় চলে আসবে? কবে অমিত শাহ আসবে, কোন নেতা দিল্লি গিয়ে বিজেপিতে যোগ দেবেন? কোন নেতা অমিত শাহের বাংলার সভায় বিজেপির পতাকা হাতে নেবেন? অমিত শাহ বাংলায় এসে কোথায় কোথায় যাচ্ছেন? এবার কেন তিনি মতুয়াদের এড়িয়ে গেলেন? কোন দলিত মানুষের বাড়িতে গিয়ে অমিত শাহ কী খাদ্য গ্রহণ করছেন? সেই মানুষটি কীভাবে দেশের গৃহমন্ত্রীকে আপ্যায়ন করলেন? এই সমস্ত কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আপনি দেখতে পাবেন বাংলার প্রায় সমস্ত মিডিয়াতে। যদিও প্রিন্ট মিডিয়া এত খুঁটিনাটি তথ্য দিচ্ছে না, কিন্তু অডিও-ভিস্যুয়াল মিডিয়া আপনাকে একেবারে আপডেটেড রাখবে, আপনি না চাইলেও রাখবে। যদি কোনও তথ্য আপনি না দেখে থাকেন, সেগুলো আপনাকে দেখতে বাধ্য করানোর জন্য আছে ফেসবুক, হোয়াটসআপ এবং গুগল জাতীয় সামাজিক মাধ্যমগুলো। অথচ যেই সময়ে প্রবল ঠান্ডার মধ্যে দেশের রাজধানীর বুকে কৃষকেরা অবস্থানে বসেছেন, ৬ মাসের রসদ নিয়ে তাঁরা এই আন্দোলন চালাবেন বলে তাঁরা প্রস্তুত— এই খবর কি কোনও মিডিয়াতে আসতে পারার মতো নয়? নাকি সেটাও ইচ্ছাকৃত দেখানো হচ্ছে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে কীভাবে এই মুহূর্তে সবরকম নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে এই কর্পোরেট সংস্থাগুলো?

প্রত্যেকটি মিডিয়ার একটি ইন্টারনেট ভার্সন আছে। মানুষ যতটা মনোযোগ সহকারে যেকোনও লেখা পড়ে, তার থেকে অনেক কম মনোযোগ লাগে একটি যেকোনও হেডলাইন পড়তে। ফলে যেকোনও খবরের যদি হেডলাইনটি ঠিকমতো লেখা যায়, তাহলে অনেকেই সেখান থেকেই খবরটা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে নেন। খবরের ভেতরে হয়তো অন্য অনেক কিছু আছে কিন্তু যদি একটি চটকদার হেডলাইন লেখা যায় তাহলে অনেকেই হয়তো পুরো খবরটি পড়েও দেখবেন না। এটাও একটা মনস্তত্ত্ব আর যারা এই মুহূর্তে বকলমে দেশ চালাচ্ছেন, তারাও এটা খুব ভালো করে বুঝে গেছেন, তাই তারা কোন হেডলাইন লোকে পড়বে বা পড়বে না, সেইভাবেই খবর সাজান এবং পরিবেশন করেন। যাতে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা গণমাধ্যম থেকে সামাজিক মাধ্যম হয়ে ধীরে ধীরে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে প্রবেশ করতে পারে। যাতে যেকোনও সাধারণ ভোটারের মন থেকে দৈনন্দিন সমস্যাগুলোকে সরিয়ে দেওয়া যায়।

যদি খেয়াল করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে সময়টাতে করোনা অতিমারির জন্য সারা দেশ প্রায় স্তব্ধ, ঠিক সেই সময়েই এই দেশের সরকার একের পর এক আইন সংসদে কোনও আলোচনা ছাড়াই পাশ করিয়েছেন। পরে নামকাওয়াস্তে সংসদ খুলে, সমস্ত বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিয়ে তিনটি কৃষি আইন পাশ করিয়েছে। একটু নজর করলেই দেখা যাবে কী করে চোখের সামনে বুক ফুলিয়ে পিএমকেয়ারস-এর দুর্নীতি করা হয়েছে, কীভাবে একটি মধ্যপ্রদেশের নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই খবরগুলো দেখে কোনও মানুষই আলোড়িত হননি, মনে হয়নি যে বিজেপি সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়বে বলে ক্ষমতায় এসেছিল সেই বিজেপি কী করে এই আকাশছোঁয়া দুর্নীতি করতে পারে? একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে কখনও ইডি বা সিবিআই-এর ভয় দেখিয়ে বা কখনও টাকার প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের দলে টানা কি গণতন্ত্র? মনে হয়নি কারণ গণমাধ্যম থেকে সামাজিক মাধ্যম কোথাও এই নিয়ে আলোচনা হয়নি, বা বলা ভালো আলোচনা চলতে দেওয়া হয়নি। অথচ যখন ২০১৪ পূর্ববর্তী সময়ে আন্না হাজারে যখন অনশনে বসেছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং পরোক্ষে সেই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি, তখন কিন্তু প্রায় প্রত্যেকের নিউজফিড ভরে ছিল এই জাতীয় খবরে।

এই মুহূর্তে বাংলায় ফেসবুকে বিজেপির বেশ কিছু অফিসিয়াল পেজ চলে, একটার নাম ‘আর নয় অন্যায়’, অন্যটি বিজেপির নিজস্ব পেজ আর এছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু পেজ চলে যা সরাসরি বিজেপির কথা না বললেও ঘুরিয়ে বিজেপির হয়েই প্রচার করে। যা খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে এখনও অবধি প্রায় ৫৫ লক্ষ টাকা ফেসবুককে দেওয়া হয়েছে বিজেপির তরফ থেকে। এবার ফেসবুককে কেন এত টাকা দিচ্ছে বিজেপি? টাকা দিয়ে যেকোনও পোষ্টকে বুস্ট করা অর্থাৎ সামনে আনা যায়। সামনে অর্থাৎ চোখের সামনে, ফলে আমি-আপনি না চাইলেও ওদের করা পোস্ট বা ভিডিও দেখতে বাধ্য। প্রত্যক্ষভাবে কেউ যদি ওই পেজে নাও ঢোকে তাও ফেসবুক প্রত্যেক মানুষকে প্রায় ঘাড় ধরে দেখাবে ওই ভিডিও এবং পোস্টগুলো। বিজেপিও খুব ভালো করে জানে সমস্ত মানুষ সরাসরি রাজনীতি করেন না। বেশ কিছু মানুষ আছেন তাদের রাজনৈতিক পরিভাষায় ফ্লোটিং ভোটার বলে। তারা সমস্ত বিষয়ে মত না দিলেও তাদেরও কিছু মতামত থাকে, এবং সেই মতামতকে প্রভাবিত করার জন্য এই সামাজিক মাধ্যম এবং গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনকে কী করে ব্যবহার করতে হয় তা বিজেপির কাছে মোটেও অজানা নয়। তাই কখনই রান্নার গ্যাসের মুল্যবৃদ্ধি সেটা গণমাধ্যমেও খুব অকিঞ্চিৎকরভাবে খবর হয় এবং সামাজিক মাধ্যমে এই নিয়ে আলোচনা হয় না।

আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন হওয়া উচিত কিছু নির্দিষ্ট দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে, যখন আলোচনা হওয়া উচিত কৃষকদের আন্দোলন বা নাগরিকত্ব নিয়ে এক বিপুল সংখ্যক মানুষের অনিশ্চয়তা নিয়ে, যখন কথা হওয়া উচিৎ রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি নিয়ে, যখন কথা হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক পরিসর নিয়ে, তখন কোন নেতা কত দুর্নীতি করে কীভাবে দলবদল করছেন, কোন দাঙ্গাকারী ক্ষুদিরামের উত্তরসূরি হতে চাইছেন, বা দেশের প্রধানমন্ত্রী কিভাবে রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন তা নিয়ে আলোচনা চলে। যখন অলোচনার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত বেকারের চাকরি বা রেলের মতো পরিষেবা বেসরকারিকরণ হলে কত মানুষের চাকরি যাবে, তখন আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠছে অমিত শাহ বাংলায় এসে কী খেলেন, কোন থালায় খেলেন ইত্যাদি ও প্রভৃতি। যখন আলোচনা হওয়া উচিত কীভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা বেসরকারি হলে, সাধারণ মানুষের হাত থেকে বেরিয়ে যাবে, যখন আলোচনা হওয়া উচিত অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তখন আমাকে আপনাকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে এমন কিছু বিষয় নিয়ে যা কিছুতেই আপনাকে আমাকে বুঝতে দেবে না আসল শত্রু কে? যখন আলোচনা হওয়া উচিত করোনার চিকিৎসা এবং পরীক্ষা কিংবা ভ্যাকসিন কেন সমস্ত নাগরিককে বিনামূল্যে দেওয়া হবে না, তখন এই সামাজিক মাধ্যমে আলোচনাতে আমাকে আপনাকে নিবিষ্ট করে রাখা হবে হিন্দু- মুসলমান বিতর্কে, রামমন্দির হলে বা কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে কী কী ভালো কাজ হয়েছে এইসব  আলোচনাতে।

আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা যত এই গণমাধ্যমের বা সামাজিক মাধ্যমের তৈরি করা বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, ততবার তারাই জিতে যাবে যারা এইসব বুনিয়াদি সমস্যা থেকে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে দিতে চায়। আর ওদের তৈরি করা বিষয়ের বদলে যদি মানুষের তৈরি করা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে ওদেরকে প্রশ্নের মুখে এনে ফেলা সম্ভব। সেটাই আসল কাজ, এবং এই কাজটা যত দ্রুত সম্ভব যদি মানুষ করতে পারে, তবেই সুবিধেবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে হারানো সম্ভব।